রাজা সাহেব/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

মুক্তা খরিদ।

 ভগবান দাস একজন প্রকৃত দালাল। দালালী করিতে করিতে চল্লিশ বৎসর উত্তীর্ণ হইয়া এখন প্রায় পঁয়তাল্লিশে উপস্থিত। ইনি দালালীর রীতি-নীতি, ভাব-ভঙ্গী, বোল-চাল যেমন জানেন, মিষ্ট মিষ্ট কথায় ক্রেতা ও বিক্রয়কারীকে সন্তুষ্ট করিতে যেমন শিখিয়াছেন, সেরূপ আর কোন দালালেই শিখে নাই। তবে ইহার দোষের মধ্যে ইনি মিথ্যা কথা বলিতে এবং অপরকে প্রতারণা করিতে কিছুমাত্র সঙ্কুচিত হয়েন না। এ সকল দোষকে তিনি দোষ বলিয়াই গ্রাহ্য করেন না, কোনরূপে অর্থ উপার্জন করিতে পারিলেই তিনি সন্তুষ্ট থাকেন। লোকে বলে যে, ইনি দুই একবার পুলিশের হস্তেও পড়িয়াছিলেন। কিন্তু ভাগ্যবলে মন্দিরে গমন করেন নাই। ভগবান দাস দেবীলালের কথামত একজন জহুরির নিকট এই সকল প্রস্তাব করিয়া তাহাকে সম্মত করাইলেন, এবং মুক্তা লইয়া পরদিবস প্রাতে তিনজনে এক মিলিত হইয়া সেই সেক্রেটারী বাবুর বাসায় উদ্দেশে চলিলেন। ক্রমে তাঁহার মেছুয়াবাজারের বাধা অনুসন্ধান করিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইলেন।

 সেক্রেটারী বাবু, দেবীলালকে দেখিয়াই চিনিলেন এবং তাহার কথার কিছুমাত্র ব্যক্তি না দেখিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন।  দেবীলাল, ভগবান দাসের পরিচয় দিয়া সেক্রেটারী বাবুর নিকট কহিলেন, “আমাদিগের মধ্যে ইনিই সর্ব্ব প্রধান ও অতিশয় বিশ্বাসী ও উপযুক্ত লোক। এই নিমিত্ত আমি ইহাঁকেও সঙ্গে করিয়া আপনার নিকট আনয়ন করিয়াছি। আর অপর এই ব্যক্তি বড়বাজারের একজন প্রধান জহরত-বিক্রেতা। আপনার কথামত ইনি কতকগুলি মুক্তাও সঙ্গে করিয়া আনিয়াছেন। ইহার ভিতর যদি আপনার কোন মুক্তা মনোনীত হয়, তাহা হইলে উহা আপনি লইতে পারেন।”

 সেক্রেটারী বাবু ভগবান দাসের সহিত আলাপ করিয়া, সেই জহুরিকে মুক্তা দেখাইতে বলিলেন। জহুরি তাহার পকেট হইতে কয়েকটা মুক্তা বাহির করিয়া একটা একটা করিয়া সেক্রেটারী বাবুর হস্তে দিতে লাগিলেন, এবং সেই সঙ্গে সেই সেই মুক্তার উৎকর্ষ প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত যে কত কথা বলিলেন, তাহার স্থিরতা নাই। তিনি যে কত বড় লোকের নিকট, কত রাজা-মহারাজার নিকট, কত সাহেব সুর নিকট মুক্তা, হীরা প্রভৃতি বিক্রয় করিয়া থাকেন, তাহা প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত যে কত লোকের নাম করিলেন, তাহার সংখ্যা নাই।

 এই সকল কথা শুনিতে শুনিতে সেক্রেটারী বাবু মুক্তা দেখিতে লাগিলেন। দেখিয়া দেখিয়া কয়েকটী মুক্তা মনোনীতও করিলেন। তাহার দাম জিজ্ঞাসা করতে মুক্তা-বিক্রেতা উহার এক প্রকার দামও বলিয়া দিলেন। সেক্রেটারী বাবু দাম শুনিয়া দেবীলালের ও ভগবান দাসের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। কিন্তু তাহাতে ভগবান দাস কহিলেন, "মহারাজ! আপনার যে যে মুক্তা মনোনীত হয়, আপনি গ্রহণ করুন। উহার এক প্রকার দামও শুনিলেন, পরে দেখিয়া শুনিয়া উহার দাম স্থির করা যাইবে। এখন আপনি উহা আপনার নিকট রাখিয়া দিন। ইনি দুই দিবস পরে আসিয়া হয় ইহার দাম—না হয় মুক্তা ফেরৎ লইয়া যাইবেন। আমরা কল্য প্রাতঃকালে আসিয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব।” ভগবান দাসের এই কথায় মুক্তা-বিক্রেতাও সম্মত হইলেন। তখন মুক্ত কয়েকটা সেক্রেটারী বাবুর নিকট রাখিয়া তাহারা সকলেই প্রস্থান করিলেন।

 তাঁহারা যখন সেক্রেটারী বাবুর বাসা হইতে প্রত্যাগমন করেন, সেই সময়ে পথিমধ্যে ভগবান দাস দেবীলালকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “ভাই! বোধ হইতেছে, এই বাবুটা অতি সরল; সুতরাং ইহার নিকট হইতে কিছু অর্থ বাহির করিয়া লইতে হইবে। যাহাতে আমাদের দশ টাকা উপার্জন হয়, এবং এই জহুরিও কিছু পায় তাহার এক সদুপায় করিতে হইতেছে।” এই বলিয়া সেই মুক্তাবিক্রেতাকে কানে কানে কি বলিয়া দিল। তিনি অতঃপর এই দালালদ্বয়কে পরিত্যাগ করিয়া প্রস্থান করিলেন।

 দেবীলাল ও ভগবান দাস পরদিবস প্রত্যুষে সেক্রেটারী বাবুর বাসায় গিয়া পুনরায় উপস্থিত হইল, এবং বাবুকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “মহাশয়। কল্য সেই জহরতবিক্রয়কারীর সম্মুখে আপনাকে আমরা কিছু বলিতে পারি নাই। যে সকল মুক্তা আপনি মনোনীত করিয়া রাখিয়া দিয়াছেন, তাহা অতি উৎকৃষ্ট দ্রব্য। তথাপি সেই জহুরি যে দাম বলিয়াছিলেন, তাহা কিন্তু আমাদিগের মনোনীত হয় নাই। এই নিমিত্ত আমি সেই মুক্তা আপাততঃ রাখিয়া দিবার নিমিত্ত বলিয়াছিলাম। অদ্য আমাদিগের সহিত বাজারে চলুন,—সেইস্থানে জহরতের বিস্তর দোকান আছে, তাহাদিগের নিকট যাচাই করিয়া দেখিলেই ইহার প্রকৃত দাম বুঝিতে পারিব। আপনাকে একটা কথা পূর্বেই বলিয়া রাখি যে, জহরত বিক্রেতামাত্রই প্রায় একই প্রকৃতির লোক। যদি উহারা বুঝিতে পারে যে, আপনি সেই সকল মুক্তা ক্রয় করিবেন, তাহা হইলে তাহারা উহার দাম প্রকৃত দাম অপেক্ষা অনেক অধিক করিয়া বলিয়া দিবে। আপনি যাহাতে কোন প্রকারে প্রতারিত না হন, ইহাই আমাদিগের নিতান্ত ইচ্ছা বলিয়াই পূর্ব্ব হইতেই আপনাকে সতর্ক করিয়া দিতেছি। যে মুক্তা আপনি ক্রয় করিবেন, বাজারে গিয়া সেই সকল দ্রব্য বিক্রয়ের ভান করিবেন, তাহা হইলে আপনি ইহার প্রকৃত মুল্য অবগত হইতে পারিবেন। কারণ, সেই ব্যক্তি উহা যে মূল্যে প্রকৃতই ক্রয় করিতে পারিবে, সেই মূল্যই বলিবে; কেহ বা কিছু কম করিয়াও বলিতে পারে। এরূপ অবস্থায় উহার প্রকৃত মূল্য জানিতে আর বাকি থাকিবে না। সুতরাং কোনরূপে আমাদিগের ঠকিবার সম্ভাবনা থাকিবে না। প্রকৃত মুল্য অবগত হইতে পারিলে, জহরত-বিক্রেতা যদি সেই মূল্যে সেই মুক্তা বিক্রয় করে, তাহা হইলে আপনি উহা গ্রহণ, করিবেন। নচেৎ সেই মুক্তা ফেরৎ দিয়া পুনরায় অন্য কোন জহুরিকে মুক্তা সহিত আপনার নিকট আনয়ন করিব।”  উহাদিগের কথা শ্রবণ করিয়া সেক্রেটারী বাবু অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন, এবং মনে মনে ভাবিলেন যে, ইহারা যাহা বলিতেছে, তাহা অপেক্ষা অন্য কোন সদুপায় আর নাই। ইহাদিগের প্রস্তাবিত উপায় অবলম্বন করিলে কিছুতেই আমাদিগের ঠকিবার সম্ভাবনা নাই। এই ভাবিয়া সেক্রেটারী বাবু মুক্তা কয়েকটী হস্তে লইয়া, দালালদ্বয়ের সহিত বড়বাজার-অভিমুখে গমন করিলেন।

 ভগবান দাস সেক্রেটারী বাবুকে একটা জহরতের দোকানে সর্ব প্রথম লইয়া গেলেন। সেইস্থানে সেক্রেটারী বাবুকে একজন সাবেক বড়লোক বলিয়া পরিচয় দিলেন, এবং মুক্তা কয়েকটা বাহির করিয়া সেই দোকানদারের হন্তে প্রদান করিয়া কহিলেন, “বিশেষ কোন কারণবশতঃ ইহাকে এই মুক্তা কয়েকটী বিক্রয় করিতে হইবে। আর আপনারা প্রকৃত যে দরে সইতে পারেন, তাহা বলিয়া দিন। নিতান্ত লোকসান না হইলে এখনই ইহা আপনার নিকট বিক্রয় করিবেন।”

 দোকানদার এই কথা শুনিয়া মুক্তা কয়েকটী উত্তমরূপে দেখিয়া কহিলেন, “এ অতি উৎকৃষ্ট মুক্তা, এরূপ মুক্তা সচরাচর বাজারে পাওয়া যায় না। আপনি যখন ইহা ক্রয় করিয়াছেন, তখন আপনাকে অধিক মূল্য প্রদান করিতে হইয়াছে; কিন্তু আজকাল মুক্তার বাজার অত্যন্ত নরম যাইতেছে। তথাপি যদি আপনি প্রকৃতই ইহা বিক্রয় করেন, তাহা হইলে আমি এই মূল্য প্রদান করিতে পারি।” এই বলিয়া সেই মুক্তা কয়েকটীর একটা দাম বলিয়া দিলেন। সেক্রেটারী বাবু দেখিলেন, তিনি যে দর প্রাপ্ত হইয়াছেন, তাহা জহরত-বিক্রয়কারীর কথিত মূল্য অপেক্ষা অধিক নন নাহ, প্রায় সমান।

 দোকানদারের কথা শুনিয়া দেবীলাল কহিলেন, “আরও দুই একজন দোকানদারকে দেখাই। দেখি, উহারাই বা কি প্রকার দরে ক্রয় করিতে চাহে। আপনার প্রদত্ত দর অপেক্ষা অধিক দর অপর দোকানদার যদি প্রদান না করে, তাহা হইলে আপনার নিকটই উহা বিক্রয় করিব।” এই বুলিয়া বাবুকে সঙ্গে লইয়া নিকটবর্তী আর একখানি দোকানে গমন করিলেন। সেই দোকানদার এই মুক্তা কয়েকটা দেখিয়া পূর্ব্ব দোকানদার অপেক্ষা আরও কিছু কম মূল্য বলিয়া দিলেন। এবারও পূর্বরূপ বলিয়া দেবীলাল, বাবুকে লইয়া সেই দোকানের বাহিরে আসিলেন। সেই সময় সেক্রেটারী বাবুকে কহিলেন, “আমরা যেরূপ অনুমান করিয়াছিলাম, এখন দেখিতেছি, আমাদিগের সে অনুমান ঠিক নহে। এখন বুঝিতে পারিতেছি যে, মুক্ত কয়েকটা প্রকৃতই উত্তম দ্রব্য, এবং বিক্রেতাও যে নিতান্ত অধিক দর বলিয়াছে, তাহা নহে। আরও দুই এক দোকানে যদি উহা দেখাইতে চাহেন, তাহাও দেখাইতে পারেন।”

 দেবীলালের এই কথা শ্রবণ করিয়া সেক্রেটারী বাবু কহিলেন, “ইহার প্রকৃত দর এক প্রকার বুঝিতে পারিয়াছি, আর কোন দোকানে দেখাইবার প্রয়োজন নাই। কিন্তু বিক্রেতা যখন ইহার মুল্যের জন্য আগমন করিবে, সেই সময় তুমিও তাহার সহিত আসিও। তাহাকে বলিয়া কহিয়া ইহার মুল্য আরও কিছু কম করিয়া লইতে হইবে।” দালালদ্বয় বাবুর কথায় সম্মত হইয়া আর কোন দোকানে গমন করিল না। বাবুর সহিত বাজার পরিত্যাগ করি মেছুয়াবাজারের বাসা-অভিমুখে প্রস্থান করিল।

 গমনকালীন কথায় কথায় সেক্রেটারী বাবু দালালদ্বয়কে কহিলেন, “তোমাদিগের দালালীতে আমি বিশেষ রূপ সন্তুষ্ট হইয়াছি। কোনরূপ দ্রব্যাদি ক্রয় করিবার নিমিত্ত যখন আমি কলিকাতায় আসিব, সেই সময় তোমাদিগের সন্ধান করিব, এবং তোমাদিগের সহায়তা গ্রহণ করিয়া দ্রব্যাদি ক্রয় করিব। তোমাদিগের দালালী দেখিয়া বোধ হইতেছে যে, তোমরা উভয়েই অতিশয় পুরাতন দালাল।”

 ভগবান দাস। হাঁ মহাশয়! অনেক দিবস হইতে এই কার্য্য করিতেছি।

 সেক্রেটারী বাবু। অনেক টাকা কর্জ দিতে পারে, এরূপ কোন বড়লোকের সহিত তোমাদিগের জানা শুনা আছে কি?

 ভগবান। কেন মহাশয়! কোন ব্যক্তি টাকা কর্জ্জ করিতে চাহেন কি?

 বাবু। একজন বড়লোকের কিছু টাকার প্রয়োজন আছে বলিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছি।

 ভগবান। দালালীই যখন আমাদিগের ব্যবসা, তখন আমরা সকল কর্মেরই দালালী করিয়া থাকি। টাকা ধার দেওয়া ত আমাদিগের প্রধান কর্ম্ম। কি দ্রব্য বন্ধক রাখিয়া কত টাকা ধার দেওয়াইতে হইবে, তাহা আমাকে বলিয়া দিবেন, আমি অনায়াসেই টাকার সংগ্রহ করিয়া দিব।  বাবু। সময়মত আমি এ বিষয়ে তোমার সহিত পরামর্শ করিব।

 এইরূপ কথাবার্তা শেষ হতে না হইতেই সকলেই মেছুয়াবাজারের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইল। কিয়ৎক্ষণ পরেই সেই জহরত-বিক্রেতা আগমন করিল। সে পূর্বে যে মুল্য স্থির করিয়া জহরত রাখিয়া গিয়াছিল, দালালদ্বয় বাবুর সাক্ষাতে অনেক করিয়া বলায়, তাহা অপেক্ষা মূল্য কিছু কম করিয়া দিল। বাবুও তাহার সমস্ত টাকা মিটাইয়া দিলো সকলে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। প্রকৃত দ্রে মুক্তা ক্রয় করা হইয়াছে বিবেচনা করিয়া, বাবু সবিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন। এদিকে দালালগণ বাবুকে উত্তমরূপে ঠকাইয়া হাস্যমুখে আপন আপন স্থানে প্রস্থান করিল।

 পাঠকগণকে বোধ হয় বলিয়া দিতে হইবে না, জহরতবিক্রয়কারী ও দুইজন দালাল চক্রান্ত করিয়া সেক্রেটারী বাবুকে বিশেষরূপে, প্রতারিত করিল। যে যে দোকানে মুক্তা যাচাইয়া দেখিবার নিমিত্ত সেক্রেটারী বাবুকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিল, সেই সকল দোকান পূর্ব হইতেই ঠিক করিয়া রাখা হইয়াছিল। সুতরাং এরূপ চক্রান্তে পড়িয়া একজন সহর হইতে বহুদূরদেশবাসী ব্যক্তি যে প্রতারিত হইবেন, তাহার আর ভূল কি?