রাজা সাহেব/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।


দালালের দালালী।

 সেক্রেটারী বাবু কলিকাতায় আসিয়া মেছুয়াবাজার ষ্ট্রীটে অশ্বিনীকুমার বসুর বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলেন। অশ্বিনীকুমার বসু সেক্রেটারী বাবুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা, এখানে থাকিয়া বিদ্যাভ্যাস করিতেছেন। এবার তাঁহার বি-এ, পরীক্ষা দেওয়ার বৎসর; সুতরাং তিনি রাত্রিদিন পাঠেই নিযুক্ত আছেন। তাঁহার গৃহে সেক্রেটারী বাবু থাকিলে পাছে তাঁহার পড়া শুনার ব্যাঘাত জন্মে, বিশেষতঃ এবার তিনি যে কর্মের নিমিত্ত আগমন করিয়াছেন, তাহা যে দুই চারি দিবসের মধ্যে সম্পন্ন হইবেক, তাহাও নহে; বোধ হয়, দুই চারি মাস লাগিলেও লাগতে পারে; এই ভাবিয়া তিনি অশ্বিনীকুমারের গৃহের সংলগ্ন আর একটা ঘর ভাড়া বাইয়া সেইস্থানেই অবস্থিতি করিতে লাগিলেন।

 সেক্রেটারী বাবু নানাস্থানে গমন করিতে লাগিলেন। অনেক ব্যক্তির নিকট টাকার প্রসঙ্গ উত্থাপন করিতে লাগিলেন। কিন্তু কোনস্থানেই কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। কেহই এত টাকা দিতে স্বীকার করিলেন না; যদি বা কে স্বীকার করিলেন, তিনি স্বাধীনরাজ্য বন্ধক রাখিতে অস্বীকৃত হইলেন। কেহ বা সুদ অনেক অধিক চাহিলেন। এইরূপ নানা গোলযোগে প্রায় এক মাস অতীত হইয়া গেল। তখন একদিবস সেক্রেটারী বাবু, কিছু কাপড় ও মুক্তা খরিদ করিবার মানসে বড়বাজারে গমন করিলেন।

 দিবা প্রায় দুইটা বাজিয়াছে। বড়বাজারে গাড়ী ঘোড়ার এবং লোকজনের এত ভিড় যে, তাহার ভিতর সহজে প্রবেশ করে কাহার সাধ্য। এই ভিড়ের ভিতর একখানি দ্বিতীয় শ্রেণীর গাড়ীতে কেবল একজন চাকর মাত্র সঙ্গে লইয়া, সেক্রেটারী বাবু প্রবেশ করিলেন; কিন্তু বহুস্থানে নানাপ্রকার প্রতিবন্ধক পাইয়া, বহুস্থানের পথ একবারে বন্ধ থাকা প্রযুক্ত গাড়ী থামাইয়া থামাইয়া তাঁহার গাড়ীর কোচমান ও গরুর গাড়ীর গাড়োয়ানদিগের মুখনির্গত অশ্রাব্য ভাষায় উভয়ের উত্তর প্রত্যুত্তর শুনিতে শুনিতে দিবা চারিটার সময় বড়বাজার মনোহর দাসের চকের সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেইস্থানে তাঁহার গাড়ী থামিতে না থামিতে তিন চার জন লোক আসিয়া তাঁহার গাড়ীদ্বারে উপস্থিত হইল। সেক্রেটারী বাবু ইহাদিগকে দালাল বলিয়া. চিনিতে পারিলেন। ইহাদিগের কাহারও সাহায্য না চাইলে, বড়বাজারের কোন স্থানে কি দ্রব্য বিক্রীত হয়, তাহা সকলের—বিশেষতঃ বিদেশবাসী আগন্তুক লোকের পক্ষে জানা অসম্ভব বলিয়া, তিনি উহাদিগের মধ্যে একজনকে সঙ্গে করিয়া কিছু “কিংখাপ" খরিদ করিবার মানসে চকের উপর উঠিলেন।

 সেক্রেটারী বাবু যে দালালের সহিত উপরে উঠিলেন, তাঁহার নাম দেবীলাল। দেবীলালের বাসস্থান মথুরার সন্নিকটস্থ একটী পল্লীগ্রামে। দেবলীলালের বয়ঃক্রম যখন ষোল বৎসর, সেই সময়ে কোন একজন দালালের সঙ্গে সে কলিকাতায় আইলে, এবং তাহার সহিত সে সামান্য দালালী কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়; সেই কার্য্যে এতদিবস পর্যন্ত নিযুক্ত থাকিয়াও আজ পর্য্যন্ত তাহার সেই সামান্য দালালী ঘুচে নাই। এখন উহার বয়ঃক্রম প্রায় ষাট বৎসর হইয়াছে, বয়ঃক্রমে দেবীলাল যেরূপ পরিপক্ক হইয়াছে, কার্যে কিন্তু এখনও সেরূপ পরিপক্ক হইতে পারে নাই।

 দেবীলাল সেক্রেটারী বাবুকে সঙ্গে করিয়া একজন মাড়ওয়াড়ির দোকানে লইয়া গেল, এবং তাঁহার দোকান হইতে বাবুর মনোনীত প্রায় সত্তর আশী টাকার বস্ত্রাদি ক্রয় করিয়া দিল। সেক্রেটারী বাবু দেবীলালের দালালীর গতিক দেখিয়া সবিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন, এবং পূর্বে তিনি অন্য স্থান হইতে যেরূপ মূল্যে সেইপ্রকায় বস্ত্র ক্রয় করিয়াছিলেন, অদ্য তাহা অপেক্ষা অনেক নূয়ন মুল্যে সেই প্রকার বস্ত্র পাইয়া দেবীলালের অনেক প্রশংসা করিলেন, এবং আপন পকেট হইতে একটা টাকা বাহির করিয়া দেবীলালকে প্রদান করিলেন ও কহিলেন, “দেবীলাল। তোমার কার্য্য দেখিয়া আমি তোমার উপর একান্ত সন্তুষ্ট হইয়াছি। এখন হইতে বড়বাজারে আমার যে কোন দ্রব্য ক্রয় করিবার প্রয়োজন হইবে, তাহা তোমার সাহায্য ভিন্ন কথন ক্রয় করি না। “

 দেবীলাল। মহারাজ! আমি আপনার তাবেদার! হুকুম করিবামাত্র তাহা সম্পন্ন করিতে কিছুমাত্র ক্রটী করিব না।  সেক্রেটারী। দেবীলাল! তোমাকে আমার যখন প্রয়োজন হইবে, তখন কোথায় তোমার সাক্ষাৎ পাইব?

 দেবীলাল। আমাকে যখন অনুসন্ধান করিবেন, তখনই এই স্থানে পাইবেন। আর যদি দৈবাৎ কখন দেখা না পান, তবে অন্য দালালদিগের মধ্যে যাহাকে বলিবেন, সেই আমার সন্ধান বলিয়া দিতে পারিবে।

 সেক্রে। তোমার সহিত কোন ভাল জহুরির আলাপ আছে?

 দেবীলাল। অনেক ভাল ভাল ও বিশ্বাসী জহুরির সহিত আমার জানা শুনা এবং লেনা দেনা আছে। আপনার যে কোন দ্রব্যের প্রয়োজন হইবেক, আমাকে বলিবেন, তাহা আমি আনিয়া দিব।

 সেক্রে। মহারাজের নিমিত্ত কয়েকটা ভাল মুক্তা খরিদ করিবার প্রয়োজন আছে। বাজারে কি প্রকার মুক্তা পাওয়া। যায়, একবার দেখিয়া গেলে হয় না?

 দেবীলাল। মুক্তা যদি কেবলমাত্র দেখিতে চাহেন, তবে চলুন; যে প্রকারের মুক্তা চাহিবেন, দেখাইতে পারি। কিন্তু আমার কথার উপর আপনি যদি বিশ্বাস করেন, তাহা হইলে বাজারে গিয়া মুক্তা প্রভৃতি কোন জহরত ক্রয় করিবেন না। বাজারে এ সকল, দ্রব্য ক্রয় করিলে প্রায় ঠকিতে হয়। বিশেষতঃ ঠকিয়া ক্রয় করিয়া একবার লইয়া গেলে, এখানকার দোকানদারেরা আর কোনক্রমেই তাহা ফেরৎ লয় না। যদি আপনি অনুমতি করেন, এবং আমার কথায় যদি বিশ্বাস করেন, তাহা হইলে আমাকে আপনার ঠিকানা লিখিয়া লিউন, কল্য প্রাতঃকালে একজন জহুরিকে মুক্তা সমেত আপনার বাসায় লইয়া যাইব। মুক্তা দেখিয়া যদি আপনার মনোনীত হয়, তাহা হইলে দর দস্তর ঠিক করিয়া আপনার নিকট উহা রাখিয়া দিবেন। পরে আপনার পরিচিত লোক দ্বারা উহার বাজার দর যাচাইয়া যদি সুবিধা বিবেচনা করেন, রাখিবেন, নচেৎ ফেরৎ দিবেন। পুনরায় অন্য জহুরিকে আমি ডাকিয়া আনিব; ইহাতে কোন প্রকারেই আপনার ঠকিবার সম্ভাবনা থাকবে না। আর আমরা মহাশয়দিগের ন্যায় সদাশয় ব্যক্তিগণের নিকটই প্রতিপালিত; সুতরাং যাহাতে আপনারা কোন প্রকার প্রতারিত বা ক্ষতিগ্রস্ত না হন, ইহাই আমাদের একমাত্র বাসনা ও কর্ত্তব্য কর্ম্ম।

 সেক্রেটারী বাবু মনে মনে ভাবিলেন যে, এ অতি উত্তম প্রস্তাব। ইহাতে কোন প্রকারেই ঠকিবার সম্ভাবনা নাই। মাল দেখিয়া, পছন্দ করিয়া, বাচাই করিয়া তাহার পর টাকা দিব, ইহাতে আর ঠকিব কি প্রকারে? দেবীলালের এ প্রস্তাব উত্তম। আমি জানিতাম না যে, বড় বাজারে এরূপ সৎ ও পরোপকারী দালালও আছে। প্রকাশ্যে বলিলেন, “আচ্ছা দেবীলাল! আমি তোমার প্রস্তাবেই সন্মত হইলাম। কল্য প্রত্যুষে তুমি একজন সদ্ব্যবসায়ী জহুরিকে ভাল মুক্তার সহিত আমার নিকট লইয়া যাইও। যদি মনোমত হয়, এবং সুবিধা বিবেচনা করি, তাহা হইলে আমি ক্রমে তোমাদ্বারা অনেক জহরৎ প্রভৃতি ক্রয় করিব।” এই বলিয়া সেক্রেটারী বাবু তাঁহার মেছুয়াবাজারের ঠিকানা একখানি কাগজে লিখিয়া দেবীলালের হতে প্রদান করিয়া আপন গাড়ীতে আরোহণ করিলেন। তাঁহার চাকর সেই কাপড়গুলি গাড়ীর ভিত্তর রাখিয়া কোচবাক্সের উপর গিয়া বলিল। কোচমান গাড়ী চালাইয়া দিল। দেরীলাল তাঁহার মস্তক নিম্ন ও দক্ষিণহ উত্তোলন করিয়া উপর্যুপরি তিন চারিবার সেলাম করিলে, গাড়ী ক্রমে ক্রমে ভিড়ের ভিতর বাইয়া মিশিল।

 এই গাড়ী চলিয়া গেলে দেবীলাল মনে মনে ভাবিতে লাগিল যে, অদ্য কোন গতিকে সেক্রেটারী বাবুর মত পরিবর্তিত করিয়া তাঁহাকে ত ফিরাইয়া দিলাম। কিন্তু কল্য কি করিব? আমার কথায়, ত কোন জহরি মুক্তা লইয়া মেছুয়াবাজারে যাইবে না। আর আমি যে মুক্তা প্রভৃতি বহুমূল্য দ্রব্যের দালালী করিতেছি, ইহাও ত কেহ বিশ্বাস করিবে না। এখন কোন উপায় অবলম্বন করিলে, বাবুও সন্তুষ্ট হইবেন আমিও কিছু উপার্জ্জন করিতে সমর্থ হইব? পথের ধারে একখানি দোকানে বসিয়া দেবীলাল এইরূপ ভাবিতেছে, এমন সময় অন্য আর একজন দালাল আসি। সেইস্থানে উপস্থিত হইল, এবং দেবীলালকে চিন্তিত দেখিয়া বলিল, “কি হে দেবীলাল! বসিয়া বসিয়া কি ভাবিতেছ?”,

 দেবীলাল। তুমি আসিয়াছ, ভালই হইয়াছে। তোমার আসায় গিয়া তোমার সহিত দেখা করিব ভাবিতেছিলাম। একটি কার্য্য উপস্থিত আছে, জোগাড় করিতে পারিলে উভয়েই কিছু কিছু পাইতে পারি।

 দালাল। এমন কি কার্য্য উপস্থিত করিয়াছ যে, তাহাতে উভয়েই কিছু কিছু উপার্জ্জন করিতে পারিব?  দেবীলাল। একজন বাবু অদ্য এখানে আসিয়াছিলেন, তাঁহার কিছু কাপড় ও কয়েকটা ভাল মুক্তা ক্রয় করিবার প্রয়োজন ছিল। আমি তাঁহার কাপড় ক্রয় করিয়া দিয়াছি, ইহাতে দোকানদারের নিকট হইতে আমি দুই টাকা দালালী পাইয়াছি। কিন্তু বাবু তাহা জানিতে না পারিয়া, আমাকে এক টাকা পারিতোষিক প্রদান করেন, এবং আমাকে মুক্তা ক্রয় করিয়া দিতে বলেন। আমার সহিত, মুক্তা বিক্রেতার ভাল: আলাপ পরিচয় না থাকায়, কোন চুল অবলম্বন করিয়া অদ্য আমি তাঁহাকে বিদায় করিয়া দিয়াছি, এবং কল্য প্রাতঃকালে তাঁহার বাসায় মুক্তা লইয়া যাইব, ইহা তাহাকে বলিয়া দিয়াছি। বাবুটীর চাল-চলন কিছু উচ্চদরের। তাঁহার নিকট মুক্তা বেচিতে পারিলেই বিলক্ষণ কিছু লাভ করিতে পারিব। যদি কোন জহুরির সহিত তোমার সবিশেষ জানা শুনা থাকে, তাহা হইলে তাহাকে ঠিক কর; কল্য প্রাতঃকালেই মুক্তাসহ তাহাকে লইয়া আমরা সেইস্থানে গমন করিব। তাঁহার বাসার ঠিকানা আমাকে তিনি লিখিয়া দিয়া গিয়াছেন।

 দালাল। কাহার জন্য আর ভাবনা কি? একজন যে, বল না, শতজন জহুরিকে মুক্তা সহিত তাহার বাসায় লইয়া যাইব; ইহার জন্য তুমি চিন্তিত হইও না। কল্য প্রত্যুষে আমার বাসায় যাইও; সে হইতে সকলে একত্র বাবুর বাসায় গমন করিয়া

 এই বলিয়াই উভয়ে সে স্থান পরিত্যাগ পূর্বক আপন আপন কার্য্যে গমন করিল।