রাজা সাহেব (৩য় অংশ)/একাদশ পরিচ্ছেদ
একাদশ পরিচ্ছেদ।
“ভায়ারও ফলার?”
পুলিসের হস্তে কোনরূপে এই মােকদ্দমার ভার যাহাতে অর্পিত হইতে পারে, এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবু প্রাণপণে তাহার চেষ্টা দেখিতে লাগিলেন। কারণ, যেরূপ ভাবে তাহাকে লােভ দেখাইয়া জুয়াচোরগণ তাহার নিকট হইতে পাঁচ হাজার টাকা বাহির করিয়া লইয়াছে, তাহা নিতান্ত সহজ অপরাধ না হইলেও আইন অনুসারে একায়েক অনুসন্ধান করিবার ক্ষমতা। সেই সময় কোন পুলিস-কর্মচারীর ছিল না। এখন যে আইনমতে কার্য্য হইতেছে, সেই আইনের পরিবর্তন সেই সময় ঘটে নাই, সুতরাং ম্যাজিষ্ট্রেট বা ম্যাজিষ্ট্রেটের ভারপ্রাপ্ত কোন পুলিস-কর্মচারীর আদেশ ব্যতীত অপর কোন পুলিস-কর্মচারী এই অনুসন্ধানে সেই সময় লিপ্ত হইতে পারিতেন না, একথা বােধ হয়, অনেক পাঠকই অবগত আছেন।
যে সকল লােকের সহানুভূতি প্রাপ্ত হইলে পুলিসের হন্তে এই অনুসন্ধানের ভার অর্পিত হইতে পারিবে, এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবুর বন্ধু-বান্ধবগণ তাহার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন। সেক্রেটারী বাবু সেই দিবসই আহারাদির পর বড়বাজারে সেই দোকানদারের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন।
দোকানে গিয়া দেখিলেন যে, সেক্রেটারী বাবুর মত যিনি হাজার টাকা জলাঞ্জলি দিয়াছেন, তিনও একজন নিতান্ত সামান্য দোকানদার নহেন। ইনি শাল, চেলি, প্রভৃতি মূল্যবান্ কাপড় সকল বিক্রয় করিয়া থাকেন। সেক্রেটারী বাবুকে দেখিবামাত্র তিনি চিনিতে পারিলেন, তাহাকে আপন দোকানে বসাইয়া কিরূপে তাহার নিকট হইতে জুয়াচোরগণ একবায়ে পাঁচ হাজার টাকা গ্রহণ করিতে সমর্থ হইল, তাহা জিজ্ঞাসা করিলেন। উত্তরে সেক্রেটারী বাবু যেরূপ অবস্থায় পড়িয়া পাঁচ হাজার টাকা তাহাদিগের হন্তে অর্পণ করিয়াছিলেন, তাহা আনুপূর্বিক বিবৃত করিলেন। এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী মহাশয়ের এই কথা শ্রবণ করিয়া দোকানদার মহাশয় আরও বিস্মিত হইলেন ও কহিলেন, “জুয়াচোরগণ না করিতে পারে, এরূপ কার্যই প্রায় দেখিতে পাওয়া যায় না!”
সেক্রেটারী। আমার বাড়ী বঙ্গদেশে, কলিকাতায় আমি প্রায়ই থাকি না। সুতরাং জুয়াচোরগণের হস্তে পতিত হওয়া আপনার পক্ষে একেবারে অসম্ভব নহে; কিন্তু আপনি কলিকাতায় থাকিয়া, বিশেষতঃ বড় বাজারের দোকানদার হইয়া কিরূপে উহাদিগের হস্তে পতিত হইলেন?
দোকানদার। বিশ্বাস। বিশ্বাসের উপর নির্ভর না করিলে কোন প্রকারেই আমাদিগের এই কার্য্য চলিতে পারে না। সুতরাং সেই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া সময় সময় আমাদিগকে এইরূপ লোকসানও দিতে হয়।
সেক্রেটারী। কি ছল অবলম্বন করিয়া আপনার নিকট হইতে উহারা বস্ত্রাদি আত্মসাৎ করিতে অসমর্থ হইল, যদি কোন বাধা না থাকে, অনুগ্রহ পূর্ব্বক বলিতে পারেন কি? দোকানদার। সর্বপ্রথমে যে ব্যক্তি আপনাকে এই কার্য্যে লওয়াইয়াছিল, সেই ব্যক্তি কর্তৃক আমরাও এইরূপে প্রতারিত হইয়াছি। ভগবান দাস এই বাজারের একজন পুরাতন দালাল, সে আমাদিগের দোকান হইতে সময় সময় অনেক বস্ত্রাদি তাহার আনীত গ্রাহকগণের নিকট বিক্রয় করাইয়া দিয়াছে। তাহাতে সেও কিছু পাইয়াছে, আমরাও দু পয়সা লাভ করিয়াছি; সুতরাং তাহার কথায় আমরা হঠাৎ অবিশ্বাস করিতে না পারিয়া এইরূপে প্রতারিত হইয়াছি।
সেক্রেটারী। সে কিরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া আপনাদিগকে প্রতারিত করিল?
দোকানদার। একদিবস সে আসিয়া আমাকে কহিল, “মফস্বল হইতে একজন রাজা আসিয়া কিছুদিবস হইতে এই কলিকাতা সহরে বাস করিতেছেন, কোন কার্য্য গতিতে আমাকে সেইস্থানে গমন করিতে হয়। সেই সুযোগে রাজা মহাশয় ও মন্ত্রী মহাশয় প্রভৃতির সহিত আমার আলাপ পরিচয় হইয়াছে। রাজা মহাশয়ের সহিত রাণীও এইস্থানে আগমন করিয়াছেন, তাহার দুই একখানি বেনারসী শাটীর আবশ্যক। রাজা মহাশয় আমাকে বলিয়া দিয়াছেন যে, যদি কোন দোকানদারের সহিত আমার আলাপ পরিচয় থাকে, তাহা হইলে ভাল ভাল কয়েকখানি বেনারসী শাটীর সহিত সেই দোকানদারকে তাঁহার বাড়ীতে লইয়া যাইতে পারিলে ভাল হয়; কারণ, সেই বস্ত্র রাণী স্বচক্ষে দেখিয়া পরে ক্রয় করিবেন। যদি তাহার মনোনীত হয়, তাহা হইলে নগদ মূল্য প্রদান করিবেন। নচেৎ বস্ত্র লইয়া দোকানদার আপন দোকানে চলিয়া আসিবেন।” দোকানদার হইয়া একথা শুনিবার পর আর কোন ব্যক্তি স্থির থাকিতে পারে? প্রায় এক হাজার টাকা মূল্যের চারি পাঁচখানি ভাল ভাল শাঢী লইয়া তৎক্ষণাৎ ভগবান দাসের সহিত সেই রাজবাটীতে গমন করিলাম। বাড়ীর অবস্থা দেখিয়া এবং লোকজন প্রভৃতির অবস্থা দেখিয়া আমার মনে প্রত্যয় হইল যে, প্রকৃত রাজা না হইলেও কোন একজন বড়লোক আসিয়া এই বাড়ীতে যে বাস করিতেছেন, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। ভগবান দাস ক্রমে আমাকে মন্ত্রী মহাশয়ের নিকট লইয়া গেল। মন্ত্রী মহাশয় রাজা মহাশয়কে সংবাদ প্রদান করিলে তিনি অন্তঃপুর হইতে বাহিরে আগমন করিয়া আমার সহিত নানাপ্রকার কথা বার্তা কহিলেন, এবং পরিশেষে আমার নিকট হইতে শাটী কয়েকখানি লইয়া প্রথমে তিনি উহার মূল্য জিজ্ঞাসা করিলেন। বলা বাহুল্য, সুযোগ বুঝিয়া সেই হাজার টাকা মূল্যের শাটী কয়েকখানির মূল্য দেড় হাজার টাকা বলিয়া দিলাম। তাহাতেও রাজা মহাশয়ের ভাব দেখিয়া বোধ হইল যে, শাটী কয়খানিই রাজা মহাশয়ের মনোনীত হইয়াছে। মনুষ্যের আশার কিছুতেই নিবৃত্ত হয় না। রাজা মহাশয়ের ভাবগতি দেখিয়া মনে করিলাম, সেই কয়খানিমাত্র শাটী ভিন্ন আরও অনেক দ্রব্য ইহার নিকট বিক্রয় করিতে পারি, এবং এই সুযোগে বেশ দশ টাকা লাভও করিয়া লইব। মনে মনে এইরূপ ভাবিতেছি, এরূপ সময়ে রাজা মহাশয় আমাকে কহিলেন, “আপনার আনীত শাঢী কয়েকখানি মন্দ নয়, ইহা আমার বেশ মনোনীত হইয়াছে। কিন্তু যিনি ইহা পরিধান করিবেন, তাহাকে একবার দেখাইয়া ইহা ক্রয় করাই কর্তব্য। যদি আপনার কোনরূপ আপত্তি থাকে, তাহা হইলে ইহা একবার অন্তঃপুরের ভিতর পাঠাইয়া দি!” রাজা মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া আমি কহিলাম, “আমার কোন আপত্তি নাই, আপনি স্বচ্ছন্দে ইহা অন্তঃপুরের ভিতর প্রেরণ করিতে পারেন।
আমার কথা শ্রবণ করিয়া রাজা মহাশয় একজন পরিচাকরের দ্বারা উহা অন্তঃপুরের ভিতর প্রেরণ করিলেন, এবং পরিচারককে বলিয়া দিলেন, রাণীকে ইহা দেখাইয়া আন। আর জিজ্ঞাসা করিয়া আইস, ইহার মধ্যে কোন্ কোনখানি তাহার পছন্দ হয়।
রাজা মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া বস্ত্র কয়েকখানি হস্তে গ্রহণ করিয়া পরিচারক অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিল, এবং কিয়ৎক্ষণ পরে প্রত্যাগমন করিয়া কহিল, “রাণীমা পত্রাদি লিখিতে এখন অতিশয় ব্যস্ত আছেন। তিনি উক্ত বস্ত্র কয়েকখানি আপনার হন্তে গ্রহণ করিয়া একবার দেখিলেন, এবং আপনার নিকট রাখিয়া দিয়া কহিলেন, আমি এখন অতিশয় ব্যস্ত। সময়মত আমি ইহা ভালরূপে দেখিব, এবং ইহার মধ্যে কোন্ কোন্খানি লইব, তাহা বলিয়া দিব। ইহা ব্যতীত আমার আরও যে সকল বস্ত্রের প্রয়োজন আছে, তাহাও আনিতে বলিব।”
পরিচালকের কথা শ্রবণ করিয়া রাজা মহাশয় আমাকে কহিলেন, “যখন রাণী বস্ত্র কয়েকখানি রাখিয়া দিয়াছেন, তখন বোধ হয়, সমস্তগুলিই তাহার মনোনীত হইয়া থাকিবে। যাহা হউক, আপনি কতক্ষণ বসিয়া থাকিবেন। আপনি অদ্য গমন করুন, কল্য এই সময় পুনরায় আগমন করিবেন। ইহার মধ্যে যে যে বস্তু তাঁহার মনোনীত হয়, কল্য তাহার মূল্য লইয়া যাইবেন, এবং তাহার অপরাপর কি কি বস্ত্রের প্রয়োজন আছে, তাহাও শুনিয়া যাইবেন।
রাজা মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া সেইদিবস সেই বস্ত্র কয়েকখানি সেইস্থানে রাখিয়া আপনার দোকানে প্রত্যাগমন করিলাম। পুনর্বার পরদিবস নিয়মিত সময়ে সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। রাজা মহাশয় সেই সময় দরবার গৃহেই বসিয়াছিলেন, “আমাকে দেখিবামাত্র তিনি কহিলেন, “আপনার সমস্ত বস্তুই রাণীর মনোনীত হইয়াছে। তিনি উহা নিজের বাক্সের ভিতর বন্ধ করিয়া রাখিয়াছেন, আরও কিছু বস্ত্রের ফরমাইসও দিয়াছেন।” এই বলিয়া একটী ফর্দ আমার হস্তে প্রদান করিলেন ও কহিলেন, “এই সকল বস্ত্র লইয়া আপনি পরশ্ব দিবস আগমন করিবেন, এবং আপনার সমস্ত টাকা লইয়া যাইবেন। কল্য আমার একটু সবিশেষ কার্য্য আছে, সুতরাং কল্য আসিলে আমার সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইবে না।”
রাজা মহাশয়ের এই কথা শ্রবণ করিয়া, এবং লাভের আরও কিছু প্রত্যাশা করিয়া আমি রাজা মহাশয়ের প্রস্তাবে সম্মত হইলাম, এবং সেইদিবস আপন দোকানে প্রত্যাগমন করিলাম। তাহার পরদিবস রাজা মহাশয়ের প্রদত্ত ফর্দ অনুযায়ী সমস্ত দ্রব্যাদি সংগ্রহ করিয়া পুনর্ব্বার নিয়মিত সময়ে রাজবাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানে গিয়া যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার মস্তক ঘুরিয়া গেল, বুদ্ধিলোপ হইল, আমি সেইস্থানে বসিয়া পড়িলাম। দেখিলাম যে, সেই বাড়ী তখন শূন্য; লোকজন প্রভৃতি কেহই নাই। তথাপি এক পা দুই পা করিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। দরবার গৃহে গমন করিলাম; সেইস্থানে না আছেন রাজা, আছেন মন্ত্রী, না আছেন অপর কোন ব্যক্তি। তাহার পর অন্তঃপুরের ভিতর গমন করিলাম, সে স্থানেও কাহাকে দেখিতে পাইলাম না। অধিকন্তু অন্তঃপুরের অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল যে, সেইস্থানে কোন লোক কখন বাস করে নাই। এই অবস্থা দেখিয়া বিষন্নবদনে আপন দোকানে চলিয়া আসিয়া ভগবান দাসের অনুসন্ধান করিলাম। কিন্তু তাহাকেও আর কোনস্থানে দেখিতে না পাইয়া, আজ কয়েক দিবস পর্যন্ত তাহাদিগের সন্ধান করিয়া বেড়াইতেছি; কিন্তু কোনরূপ সন্ধানই করিয়া উঠিতে পারি নাই। এই ত মহাশয় আমার অবস্থা। এই অবস্থায় পড়িয়া আমি হাজার টাকা জলাঞ্জলি দিয়াছি।
দোকানদারের কথা শ্রবণ করিয়া এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী মহাশয় আরও বিস্মিত ও ক্রোধান্বিত হইলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে কহিলেন, “ইহার প্রতিবিধানের নিমিত্ত পুলিসের সাহায্য লইলে হয় না?” উত্তরে দোকানদার মহাশয় কহিলেন, “আমার অদৃষ্ট্রে যে লোকসান ছিল, তাহা হইয়াছে। ইহার নিমিত্ত আর থানা পুলিসের হাঙ্গাম করিতে চাহি না।” দোকানদারের নিকট এই সকল অবস্থা অবগত হইয়া এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবু সন্ধ্যার পর আপন বাসায় প্রত্যাগমন করিলেন।
এদিকে এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী যে ভদ্রলোকের সহানুভূতিতে পুলিসের সাহায্য পাইবার চেষ্টা করিতেছিলেন, তাহারই চেষ্টায় পুলিসের সর্বপ্রধান কর্মচারী এই জুয়াচুরি কাণ্ডের অনুসন্ধানের ভার গ্রহণ করিয়া জনৈক স্থানীয় ইনস্পেক্টারকে ইহার যথাযথ রিপোর্ট করিতে আদেশ দিলেন। ইনস্পেক্টার বাবুও সেই আদেশ প্রতিপালনের নিমিত্ত অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন।