রাণী না খুনি? (শেষ অংশ)/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

 “আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলে পর, ত্রৈলোক্য ওরফে রাণীজি, রামজীলালের নাম জিজ্ঞাসা করিল। উত্তরে রামজীলাল কহিল, “রাণীজি! আমার নাম রামজীলাল।”

 ত্রৈলোক্য। আমি যে সকল জহরত পসন্দ করিয়া দিয়াছিলাম, তুমি সেই সকল জহরতই আনিয়াছ ত?

 রামজীলাল। আমি তাহাই আনিয়াছি।

 ত্রৈলোক্য। উহার দাম কত হইয়াছে?

 রামজীলাল। প্রায় দশ হাজার টাকা।

 ত্রৈলোক্য। তুমি কি কি দ্রব্য আনয়ন করিয়াছ দেখি?

 রামজীলাল। রাণীজি! আমাকে ক্ষমা করিবেন। আমার মনিবের আদেশ আছে যে, অগ্রে দাম না পাইলে এই সকল দ্রব্য কাহারও হস্তে প্রদান করিতে পারিব না।

 ত্রৈলোক্য। এত সামান্য় টাকার নিমিত্ত তোমার মনিবের এত অবিশ্বাস!

 রামজীলাল। আপনাকে আমার কিছুমাত্র অবিশ্বাস নাই। আমার অপরাধ লইবেন না, আমাকে ক্ষমা করিবেন। আমি সামান্য় চাকর হইয়া কিরূপে মনিবের আদেশ লঙ্ঘন করিব?

 ত্রৈলোক্য। তোমার মনিবের এত অবিশ্বাস করিবার কারণ?

 রামজীলাল। কয়েকবার জুয়াচোরের হস্তে পড়িয়া তিনি ঠকিয়াছেন, তাহাতেই আমাকে এইরূপ আদেশ প্রদান করিয়াছেন। আপনি ত সবিশেষ জানেন যে, কলিকাতা সহর জুয়াচোরগণের দ্বারা পরিপূর্ণ।

 “আমি এতক্ষণ পর্য্যন্ত স্থির ভাবে সেই স্থানে বসিয়াছিলাম, রামজীলালের এই সকল কথা শুনিয়া আমি আর স্থির থাকিতে পারিলাম না। রাগের ভাব প্রকাশ করিয়া রামজীলালকে কহিলাম, ‘তুমি জান না, কাহার সহিত কিরূপ ভাবে তুমি কথা কহিতেছ। তুমি জান, রাণীজি একটু রাগ করিলে তোমার মস্তক সহ এই বাটী হইতে প্রস্থান করা কঠিন হইবে?’

 “আমার এই কথা শুনিয়া রামজীলাল যেন একটু ভীত হইল; কিন্ত মনের ভাব গোপন করিয়া মুখে একটু সাহস দেখাইয়া কহিল, ‘কেন, আমি কি অন্যায় কথা বলিয়াছি যে, আমার এই বাটী হইতে মস্তক সহ বাহির হওয়া কঠিন হইয়া উঠিবে? আমি কি চোর? ইহা কি ইংরাজের রাজত্ব নহে? অরাজকের মুল্লুক যে, যাহার যাহা ইচ্ছা হইবে, অনায়াসেই তিনি তাহা করিবেন? দশ হাজার টাকার জহরত বিক্রয় না হইলে আমার মনিব একবারে গরিব হইয়া যাইবেন না! আমি জহরত বিক্রয় করিব না চলিলাম।’ এই বলিয়া রামজীলাল উঠিয়া দাঁড়াইল।

 রামজীলালের কথা শুনিয়া এবং তাহার অবস্থা দর্শন করিয়া আমি নিতান্ত রাগের ভাব দেখাইয়া বলিলাম, ‘কি! ছোট মুখে বড় কথা! রাণীজিকে এইরূপ ভাবে অবমাননা! এ অবমাননা স্বচক্ষে দেখিয়া কোনরূপেই সহ্য করিতে পারি না।’ এই বলিয়া আমার জুতা সহিত রামজীলালের বক্ষে সবলে এক পদাঘাত করিলাম। আমার লাথি খাইয়া হতভাগ্য রামজীলাল চতুর্দ্দিক অন্ধকার দেখিল, এবং সেই স্থানেই পড়িয়া গেল। পড়িবামাত্রই আমি দ্রুতগতি তাহার বুকের উপর উঠিয়া বল-পূর্ব্বক তাহাকে ধরিলাম।

 “আমি তখন কি করিলাম? আপনারা যাহা কখনও স্বপ্নেও ভাবেন নাই, আজ আমি তাহাই করিলাম। কেবলমাত্র একজন স্ত্রীলোকের সাহায্যে যে কার্য্য কখনও হইতে পারে বলিয়া আপনারা একবারও মনে স্থান দেন নাই, আজ আমি তাহাই করিলাম। দস্যু বা তস্করেরাও যে কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে মনে মনে ঘৃণা বোধ করে, আজ আমি তাহাই করিলাম। রাক্ষস বা পিশাচগণও যে কার্য্যের কথা শুনিলে আপনাপন কর্ণে অঙ্গুলি প্রদান করে, আমি আজ তাহাই করিলাম। উঃ! যে কথা বলিতে এখন আমার কণ্ঠরোধ হইয়া আসিতেছে, যে কথা বলিতে এখন আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইতেছে, যে কথা বলিতে কোনরূপেই এখন আমি আমার চক্ষুজল সম্বরণ করিতে পারিতেছি না, সেই সময় আমি তাহাই কার্য্যে পরিণত করিয়াছিলাম। যে মহাপাপের আদি নাই, অন্ত নাই, যে মহাপাপের কথা শুনিলেও মহাপাপ জন্মে আমি সেই সময় সেই মহাপাপে লিপ্ত হইতে কোনরূপেই পরাঙ্মুখ হইলাম না। বিনা-কারণে ও বিনা-দোষে সেই নিরীহ, নিঃসহায় ব্যক্তির উপর সবলে পা দিয়া দাঁড়াইলাম, যে পর্য্যন্ত তাহার প্রাণবায়ু একবারে শেষ না হইয়া গেল, সেই পর্য্যন্ত আর পা উঠাইলাম না। ত্রৈলোক্যও বল-পূর্ব্বক তাঁহার পা দুইখানি চাপিয়া ধরিয়া আমার এই মহাপাপের সম্পূর্ণরূপে সহায়তা করিল। সামান্য় টাকার লোভে দেখিতে দেখিতে এই ভয়ানক নৃশংস হত্যাকাণ্ড সমাধা করিলাম!

 “এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ড সমাধা হইবার পর, রামজীলালের মৃতদেহের উপর আমার দৃষ্টি একবার পতিত হইল। সেই দৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ক্ষণকালের নিমিত্ত আমার মনের ভাবও সবিশেষরূপে পরিবর্ত্তিত হইয়া গেল। চক্ষু দিয়া বিন্দুপাত হইল, সামান্য় টাকার উপর ঘৃণা জন্মিল; পরকালের ভীষণ ভাবনা আসিয়া হৃদয় অধিকার করিল। কিন্তু অধিকক্ষণ পর্য্যন্ত এভাব আমার হৃদয়ে স্থান পাইতে দিলাম না। পরক্ষণেই আবার সে ভাব দূরে পলায়ন করিল। রামজীলালের সমভিব্যাহারে যে সকল জহরত ছিল, তাহার সমস্তগুলি তখন আমরা অপহরণ করিলাম।

 “রামজীলালের মৃতদেহ লইয়া তখন আমরা কি করিব, মনে সেই ভাবনা আসিয়া উপস্থিত হইল। একবার ভাবিলাম, রাত্রিকালে উহার মৃতদেহ টানিয়া রাস্তায় ফেলিয়া দিব; কিন্তু তাহা বিপদ-জনক বলিয়া মনে হইল। পুনরায় ভাবিলাম, একমাস পর্য্যন্ত খালি-বাড়ীর ভিতর এই মৃতদেহ আবদ্ধ থাকিলেই সকল গোল মিটিয়া যাইবে; একমাস পরে উহা দেখিয়া কেহই বুঝিতে পারিবে না যে, উহা কাহার মৃতদেহ। সুতরাং আমাদিগের বিপদের সম্ভাবনা অতি অল্পই থাকিবে। কিন্তু পরিশেষে মনে হইল, দুই চারিদিবসের মধ্যেই এই মৃতদেহ পচিয়া যখন ভয়ানক দুর্গন্ধ চতুর্দ্দিকে বহির্গত হইতে আরম্ভ হইবে, তখন পুলিস আসিয়া নিশ্চয়ই এই বাড়ী খুলিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবে, এবং সম্মুখেই মৃতদেহ দেখিতে পাইয়া অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবে। এরূপ অবস্থায় সকল কথা প্রকাশ হইয়া পড়িবারই সম্পূর্ণরূপ সম্ভাবনা। মনে মনে এইরূপ নানা বিষয়ের কল্পনা করিয়া পরিশেষে একটা উপায় বাহির করিলাম। আমি ও ত্রৈলোক্য উভয়ে মিলিয়া রামজীলালের মৃতদেহ উপর হইতে নীচে নামাইলাম, এবং নীচের একখানি গৃহের মেঝের উপর যে সকল পাথর বসান ছিল, অনেক কষ্টে তাহার তিন চারিখানি উঠাইয়া ফেলিলাম। পরে সেই স্থান হইতে মৃত্তিকা উঠাইয়া ক্রমে একটী প্রশস্ত গহ্বর খনন করিলাম। তখন রামজীলালের মৃতদেহ সেই গর্ত্তের ভিতর উত্তমরূপে পুতিয়া ফেলিলাম। তাহার উপর যতদূর মৃত্তিকা ধরিতে পারে, তাহা উত্তমরূপে দুরমুস করিয়া বসাইয়া দিয়া, যে প্রস্তর চারিখানি উঠাইয়া ফেলিয়াছিলাম, তাহাও উত্তমরূপে তাহার উপর বসাইয়া দিলাম। এই সকল কার্য্য সম্পন্ন করিতে আমাদিগের অতিশয় পরিশ্রম হইল সত্য; কিন্ত এই কার্য্য সম্পন্ন করিবার উপযোগী দ্রব্যাদির নিমিত্ত আমাদিগের কোনরূপ কষ্ট পাইতে হইল না। চুন, সুরকি, সাবল, কোদালী, দুরমু্স প্রভৃতি আমাদিগের যে কোন দ্রব্যের প্রয়োজন হইল, তাহার সমস্তই আমরা সেই বাড়ীর একখানি গৃহের ভিতর প্রাপ্ত হইলাম। সেই বাড়ী প্রস্তত করিবার সময় যে সকল যন্ত্রাদি ব্যবহৃত হইয়াছিল, এবং চুন, সুরকি, বালী প্রভৃতি যে সকল দ্রব্য উদ্বৃত্ত হইয়াছিল, তাহার সমস্তই সেই গৃহের ভিতর রক্ষিত ছিল। কলেও সমস্ত দিবস জল ছিল। সুতরাং কোন দ্রব্যই আমাদিগের অপর কোন স্থান হইতে সংগ্রহ করিতে হইল না। কিন্তু সেই কার্য্য সমাধা করিতে করিতে আমাদিগের সমস্ত দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। মৃতদেহ প্রোথিত হইবার পর, বে সকল মৃত্তিকা প্রভৃতি উদ্বৃত্ত হইয়াছিল, তাহা সেই গৃহ হইতে বাহির করিয়া স্থানান্তরে রাখিয়া দিলাম। সেই গৃহখানি এরূপ ভাবে পরিষ্কার করিয়া রাখিলাম যে, উহার অবস্থা দেখিয়া কাহারও মনে কোনরূপ সন্দেহ না হয়।

 “রামজীলালের মৃতদেহ এইরূপে মৃত্তিকার ভিতর প্রোথিত করিয়া, ঘর সাজাইবার যে সকল দ্রব্য যে স্থান হইতে ভাড়া করিয়া আনা হইয়াছিল, সেই সকল দ্রব্য ভাড়া সমেত সেই স্থানে পাঠাইয়া দিলাম, এবং সেই বাড়ীর সদর দরজায় তালাবদ্ধ করিয়া একখানি ঠিকা গাড়ি আনিয়া আমরা সে দিবস সেই স্থান হইতে আপন বাসায় ফিরিয়া আসিলাম। বলা বাহুল্য, যে সকল জহরত আমরা রামজীলালের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছিলাম, তাহা আমাদিগের সঙ্গে আনিতে ভুলিলাম না।

 “পরদিবস অতি প্রত্যূষে আমি সেই জহরতগুলি এবং সেই বাড়ীর চাবি লইয়া বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেলাম। যাঁহার বাড়ী ভাড়া লইয়াছিলাম, তাঁহাকে যাহা বলিয়া চাবি ফিরাইয়া দিয়া আসিয়াছিলাম, তাহা আপনি পূর্ব্বেই সেই বাড়ীওয়ালার নিকট হইতে অবগত হইয়াছেন। বাড়ীর চাবি ফিরাইয়া দিয়া সেই জহরতগুলি সেই পশ্চিমদেশীয় জমিদার মহাশয়ের নিকট লইয়া গেলাম। তিনি যেরূপ ভাবের জহরত আনিবার নিমিত্ত আমাকে ফরমাইস করিয়াছিলেন, ঠিক সেই মত জহরত দেখিয়া অতিশয় সন্তষ্ট হইলেন। সমস্ত দ্রব্যই তাঁহার পসন্দ হইল। তিনি সেই সকল দ্রব্য গ্রহণ করিয়া তাহার দাম আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন। তাঁহার কথার উত্তরে আমি কহিলাম, “এই সকল দ্রব্য দশ বার হাজার টাকার কম আমরা কাহারও নিকট বিক্রয় করি না; কিন্ত আপনার নিকট আমাদিগের অনেক দ্রব্য বিক্রয় হইবার আশা আছে, অথচ কোন্‌ দ্রব্যের কি মূল্য, তাহাও আপনি উত্তমরূপে বুঝিতে পারেন। এরূপ অবস্থায় এ সামান্য় বিষয় লইয়া আমার আর কিছুই বলিবার আবশ্যক নাই। বিবেচনা করিয়া আপনি আমাকে যে মূল্য বলিয়া দিবেন, আমি সেই মূল্যেই উহা আপনাকে প্রদান করিব।’

 “আমার কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় সেই জহরতগুলি আর একবার উত্তমরূপে দেখিলেন ও কহিলেন, “আমার বিবেচনায় এই সকল দ্রব্যের মূল্য নয় হাজার টাকার অধিক বলিয়া অনুমান হয় না।”

 “তাঁহার কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “আপনি যে দাম বলিয়াছেন, তাহা প্রায় ঠিকই হইয়াছে। এই সকল দ্রব্য আমার নয় হাজার টাকায় খরিদ। সেই মূল্যেও আমি উহা আপনাকে বিক্রয় করিতে পারি। ইহাতে আমার আর এক পয়সাও লাভ হয় না।

 “আমার কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় আর কোন কথা কহিলেন না। আমাকে এক হাজার টাকা পূর্ব্বেই প্রদান করিয়াছিলেন, এখন বক্রী আট হাজার টাকার নোট আনিয়া আমার হস্তে সেই দ্রব্যের মূল্য বলিয়া প্রদান করিলেন। তদ্ব্যতীত আমার লাভ ও পারিশ্রমিক বলিয়া আরও দুইশত টাকা আমাকে দিলেন।

 “তিনি আমাকে যাহা প্রদান করিলেন, তাহা নগদ টাকা নহে; নম্বরী-নোট। কতকগুলি হাজার টাকা করিয়া, ও কতকগুলি একশত টাকার হিসাবে। আমি সেই নোটগুলি গ্রহণ করিয়া সেই স্থান হইতে চলিয়া আসিলাম, এবং সমস্তই ত্রৈলোক্যের হস্তে প্রদান করিলাম। সে দিবস আর কোন স্থানে গমন করিতে বা অপর কোন কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে ইচ্ছা হইল না। মনে কেমন একরূপ দুর্ভাবনা আসিয়া উপস্থিত হইল। এই সকল কথা যদি কোনরূপে প্রকাশ হইয়া পড়ে, তাহা হইলে আমাকে কি বলিতে হইবে, বা কোন্‌ উপায়ই বা অবলম্বন করিতে হইবে! এইরূপে নানা প্রকার পরামর্শ করিতে করিতে সেই রাত্রি অতিবাহিত করিলাম।

 “পরদিবস দিবা দশটার সময় সেই নোটগুলি সঙ্গে লইয়া, পুনরায় আমি আমার বাসা হইতে বহির্গত হইলাম, এবং করেন্‌সি আফিসে গমন করিয়া সেই স্থানে সেই নোটগুলি প্রদান করিয়া, তাহার পরিবর্ত্তে কতকগুলি দশ টাকার নোট ও কতকগুলি নগদ টাকা গ্রহণ করিলাম। নোটের পৃষ্ঠে নাম লিখিয়া দিতে বলায়, আমি রামজীলালের নাম ও বড়বাজারের ঠিকানা লিখিয়া দিলাম। বলা বাহুল্য, আমি আমার নাম ও ঠিকানা না দিয়া রামজীলালের নামেই সেই নোট ভাঙ্গাইয়া আনিয়াছিলাম। যাহা হউক, উক্ত সমস্ত টাকাই ত্রৈলোক্যের হস্তে প্রদান করিলাম।”

 আমি। ত্রৈলোক্য সেই সকল টাকা কোথায় রাখিয়াছে?

 কালী। তাহা আমি বলিতে পারি না। সেই সকল টাকা একটা পিত্তলের কলসীর মধ্যে পুরিতে আমি দেখিয়াছি; কিন্তু পরিশেষে উহা যে কোথায় রাখিয়াছে, তাহা আমি বলিতে পারি না। কিন্তু আমি শুনিয়াছিলাম যে, ত্রৈলোক্য উহা কোন স্থানে মৃত্তিকার মধ্যে পুতিয়া রাখিয়াছে।

 আমি। তাহার পর?

 কালী। ইহার পর কয়েকদিবস পর্য্যন্ত আর কোনরূপ গোলযোগ শুনিতে পাইলাম না। তাহার পর পুলিসের লোক আসিয়া অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। তাঁহাদিগকে আমি যাহা বলিয়াছিলাম, তাহা আপনি পূর্ব্বেই জানিতে পারিয়াছেন। যে সকল নোট আমি জমিদার মহাশয়ের নিকট হইতে পাইয়া, করেন্‌সি আফিস হইতে ভাঙ্গাইয়া আনিয়াছিলাম, সেই সকল নোট রামজীলাল লইয়া প্রস্থান করিয়াছে, এই কথাই কর্ম্মচারীগণকে বলিয়াছিলাম। তাহাও করেন্‌সি আফিসে অনুসন্ধান করিয়া আপনারা অবগত হইতে পারিয়াছিলেন যে, রামজীলালই সেই নোট ভাঙ্গাইয়া লইয়া গিয়াছে। ইহার পরই রামজীলালের নামে ওয়ারেণ্ট বাহির হয়।

 “যে মাজিষ্ট্রেট সাহেব রামজীলালের বিরুদ্ধে ওয়ারেণ্ট বাহির করিবার আদেশ প্রদান করেন, তিনি কেবলমাত্র আমার সাক্ষ্য ও করেন্‌সি আফিসের একটী বাবুর সাক্ষ্য গ্রহণ করিয়াই সন্তুষ্ট হন, অপর কোন বিষয় অনুসন্ধান না করিয়াই ওয়ারেণ্ট প্রদান করেন। তাহার পর আর যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা আপনি স্বহস্তেই করিয়াছেন।”

 কালীবাবুর কথা শুনিয়া এই মোকদ্দমার অবস্থা আমরা অতি পরিষ্কাররূপে বুঝিতে পারিলাম। তখন আমরা কালীবাবু ও ত্রৈলোক্য উভয়কেই এই মোকদ্দমার আসামী করিলাম। পূর্ব্বোক্ত সেই সকল টাকা ত্রৈলোক্য কালীবাবুর নিকট হইতে গ্রহণ করিয়া যে কোথায় রাখিয়াছে, তাহা জানিবার নিমিত্ত ত্রৈলোক্যকে লইয়া সবিশেষরূপে পীড়ীপীড়ি করিলাম, তাহার ঘর বাড়ী খুঁড়িয়া উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কোনরূপেই সেই টাকা বাহির করিতে পারিলাম না। কালীবাবুও সেই সম্বন্ধে আর কোন কথা বলিতে পারিল না, বা বলিল না।

 মোকদ্দমা প্রথমতঃ মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরিত হইল। কেবলমাত্র কালীবাবুর কথা ব্যতীত ত্রৈলোক্যের বিপক্ষে আর কোনরূপ প্রমাণ সংগ্রহ করিতে পারিলাম না। কালীবাবু যে বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, তাহার অধিকারীকে যখন বলিলাম, “আপনি আপনার এই ভাড়াটিয়া বাটীতে এই ত্রৈলোক্যকে কখনও আসিতে দেখিয়াছিলেন?” তখন তিনি তাহার কিছুই বলিতে পারিলেন না। কেবলমাত্র ইহাই বলিলেন, “আমার নিকট হইতে কালীবাবু আমার বাটীর চাবি লইয়া আসিলে, আমার বাটীতে কেহ আসিয়া বাস করিয়াছিল কি না, তাহা জানি না, বা দেখি নাই।” জহরতের দোকানেরও কোন ব্যক্তিই রাণীজিকে দেখে নাই; সুতরাং কেহই ত্রৈলোক্যকে সনাক্ত করিতে পারিল না। সহিস-কোচবান্‌ দোকানদার প্রভৃতিও কেহই ত্রৈলোক্যকে রাণীজি বলিয়া চিনিতে পারিল না। সুতরাং মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট হইতে সে যাত্রা ত্রৈলোক্য নিষ্কৃতি লাভ করিল।

 কালীবাবুর নিষ্কৃতির উপায় রহিল না। প্রথমতঃ কালী বাবু বাড়ীওযালার নিকট একমাসের বন্দোবস্তে বাটী ভাড়া লইয়া চাবিটী লইয়া আসিয়াছিল বটে; কিন্তু দুই তিনদিবসের মধোই বাটীর প্রয়োজন হইল না বলিয়া, সেই চাবি প্রত্যর্পণ করিয়াছিল। সেই দুই তিনদিবসের মধ্যেই সেই বীভৎস-কাণ্ড সকলের অজ্ঞাতসারে কালীবাবু কর্ত্তৃক সম্পাদিত হইয়াছিল, একথা ত দোষী নিজ মুখেই ব্যক্ত করিয়াছিল। অধিকন্তু বাড়ীওয়ালা, সহিস-কোচবান্‌ প্রভৃতির সাক্ষ্যে ও সেনাক্তে তাহা একরূপ প্রমাণীকৃত হইল; চাক্ষুষ প্রমাণ না থাকিলেও, ঘটনা-পরম্পরায় অবিরোধী সমবায়ত্ব প্রমাণে কালীবাবু দোষ-মুক্ত হইতে সমর্থ হইল না। আড়গোড়ায় গিয়া যাঁহার নিকট গাড়ি ভাড়া করিয়া ভাড়ার টাকা জমা দিয়াছিল, কালীবাবু তাঁহা কর্ত্তৃকও পরিচিত হইল; সহিস-কোচবান্‌ ত চিনিয়াই ছিল। জহরতের দোকানের মালিক ও আমলাগণ কালীবাবুকে সবিশেষরূপেই চিনিয়াছিলেন; করেন্‌সি আফিসে যাঁহার নিকট হইতে নম্বরী-নোট বদ্‌লাইয়া কালীবাবু খুচরা নোট ও নগদ টাকা লইয়া রামজীলালের নাম ও ঠিকানা লিখিয়া দিয়াছিল, তিনিও কালীবাবুকে ভাল করিয়া দেখিয়া বলিলেন যে, এই ব্যক্তিই রামজীলালের নাম ও ঠিকানা লিখিয়া আট হাজার টাকার নম্বরী-নোট ভাঙ্গাইয়া লইয়াছিল। এইরূপে বিধাতার চক্রে পড়িয়া আজ কালীবাবু আর উদ্ধার পাইল না।

 যথাক্রমে কালীবাবুর মোকদ্দমা মাজিষ্ট্রেট সাহেব দায়রায় পাঠাইয়া দিলেন। সেই স্থানে জুরির বিচারে কালীবাবু হত্যাপরাধে দোষী সাবাস্ত হইল, এবং তাহার কার্য্যের উপযুক্ত দণ্ড প্রাপ্ত হইল। বিচারে তাহার ফাঁসির হুকুম হইল। *

সম্পূর্ণ।


*মাঘ মাসের সংখ্যা,

“রকম রকম।”

অর্থাৎ জুয়াচুরির অদ্ভুত অদ্ভুত বৃত্তান্ত!)

যন্ত্রস্থ।