রাণী না খুনি? (শেষ অংশ)/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
“পরদিবস অতি প্রত্যূষে আমি আমার বাসা হইতে বহির্গত হইয়া গেলাম। সহরের ভিতর নানাস্থানে অনুসন্ধান করিয়া সুবিধা মত একটী বাড়ী দেখিতে পাইলাম। কোন গতিতে সেই বাড়ী ভাড়া করিতে পারিলে, আমার মনোবাঞ্ছা পুর্ণ করিতে পারিব, এই ভাবিয়া খুঁজিয়া খুঁজিয়া সেই বাড়ীর মালিককে বাহির করিলাম। তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া কেবলমাত্র সাতদিবসের নিমিত্ত সেই বাড়ী ভাড়া লইতে চাহিলাম। কিন্ত সামান্য় দিবসের নিমিত্ত সেই বাড়ী ভাড়া দিতে তিনি অসম্মত হওয়ায়, পরিশেষে একমাসের নিমিত্তই আমাকে সেই বাড়ী ভাড়া লইতে হইল। কিন্তু যাঁহার বাড়ী, তিনি যে ইহাতেও ন্যায্য ভাড়া গ্রহণ করিলেন, তাহা নহে; নিয়মিত ভাড়া অপেক্ষা প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া আমার নিকট হইতে অগ্রিম গ্রহণ করিয়া, তাহার পর তিনি আমার হস্তে সেই বাড়ীর চাবি অর্পণ করিলেন। চাবি আনিয়া আমি সেই বাড়ী খুলিলাম, এবং কতকগুলি আসবাব ভাড়া করিয়া সেই দিবসেই উহার বৈঠকখানা সাজাইয়া ফেলিলাম। গৃহ সাজান হইয়া গেলে, আমি আড়গোড়ায় গমন করিলাম। সেই স্থানে একখানি জুড়িগাড়ি ও একখানি কম্পাস গাড়ি একদিবসের নিমিত্ত ভাড়া করিয়া তাহার অগ্রিম ভাড়া তাহাদিগকে প্রদান করিলাম। তাহাদিগের সহিত আমার এইরূপ বন্দোবস্ত রহিল যে, পরদিবস আমি আড়গোড়ায় গমন করিয়া গাড়ি দুইখানি সঙ্গে করিয়া আনিব।
“এই সকল কার্য্য সম্পন্ন করিতে আমার সমস্ত দিবস অতীত হইয়া গেল। সমস্ত দিবসের মধ্যে আমি আমার বাসায় আর ফিরিতে পারিলাম না। ক্রমে সন্ধ্যা হইল, দেখিতে দেখিতে ক্রমে রাত্রি নয়টাও বাজিয়া গেল। রাত্রি নয়টার পর আমি আমার বাসায় ফিরিয়া গেলাম, এবং ত্রৈলোক্যকে সম্বোধন করিয়া কহিলাম, ‘আমি যে কার্য্যের নিমিত্ত অদ্য প্রাতঃকালে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছিলাম, তাহার সমস্তই ঠিক করিয়া আসিয়াছি। ঘর ভাড়া হইয়া গিয়াছে, এই দেখ তাহার চাবি। ঘর দ্রব্যাদিতে সুসজ্জিত করিয়াও রাখিয়াছি।’ এই বলিয়া আমার পকেট হইতে সেই বাড়ীর চাবি বাহির করিয়া ত্রৈলোক্যের হস্তে প্রদান করিলাম।
“আমার কথার উত্তরে ত্রৈলোক্য কহিল, ‘চাবি ত দেখিলাম; কিন্ত কিরূপ স্থান ঠিক করিয়াছেন, চলুন একবার যাইয়া দেখিয়া আসি।’
“ত্রৈলোক্যের সেই কথায় আমি তখন সম্মত হইলাম না, তাহাকে সেই রাত্রিতে আমি সেই স্থানে লইয়া গেলাম না। কহিলাম, ‘আজ রাত্রি অধিক হইয়াছে। বিশেষতঃ সেই স্থান নিকটেও নহে, অনেক দূরে। সে স্থানে গিয়া ফিরিয়া আসিতে আজ রাত্রি কাটিয়া যাইবে, অতএব এখন আর সে স্থানে যাইবার প্রয়োজন নাই। কল্য প্রাতঃকালে একবারে সুসজ্জিত হইয়া আমার সহিত গমন করিও, সেই স্থানে তোমাকে রাখিয়া আমি গাড়ি প্রভৃতি আনিবার নিমিত্ত গমন করিব।’
“আমার কথায় ত্রৈলোক্য সম্মত হইল, এবং আমার পুর্ব্ব-পরামর্শ অনুসারে সে যাহাতে উত্তমরূপে সজ্জিত হইতে পারে, তাহার নিমিত্ত উত্তম উত্তম অলঙ্কার ও বস্ত্রাদি সংগ্রহ করিতে তখন প্রবৃত্ত হইল।
“পরদিবস অতি প্রত্যূষে উঠিয়া স্নান আহারের কার্য্য শীঘ্র শীঘ্র সমাধা করিয়া লইলাম। অন্য় স্থান হইতে বস্ত্র-অলঙ্কার প্রভৃতি যে সকল উত্তম উত্তম দ্রব্য ত্রৈলোক্য চাহিয়া আনিয়াছিল, তাহার দ্বারা সেও উত্তমরূপে সজ্জিত হইল। তাহার পর আমি একখানি ঠিকা গাড়ি ডাকাইয়া আনিলাম, এবং আমরা উভয়েই উহাতে আরোহণ করিয়া আমাদিগের বাসা হইতে বহির্গত হইলাম। নানাপথ ও গলির ভিতর দিয়া অনেক দূর গমন করিবার পর, একটী গলির ভিতর আমি যে নূতন বাড়ী ভাড়া করিয়াছিলাম, সেই বাড়ীর দরজায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। দরজার সম্মুখে গাড়ি লাগিলে, আমরা সেই গাড়ি হইতে অবতরণ করিলাম। উহার ভাড়া মিটাইয়া দিলে, গাড়িবান্ তাহার গাড়ি লইয়া প্রস্থান করিল। আমার নিকট সেই বাড়ীর যে চাবি ছিল, তাহার দ্বারা সেই বাড়ীর দরজা খুলিয়া আমরা উভয়েই তাহার ভিতর প্রবেশ করিলাম। বাড়ীর অবস্থা এবং সুসজ্জিত গৃহের অবস্থা দেখিয়া, ত্রৈলোক্য অতিশয় সন্তষ্ট হইল। পরিশেষে ত্রৈলোক্য সেই বাড়ীর সদর দরজা ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দিয়া সেই সুসজ্জিত গৃহের একখানি চেয়ারের উপর বসিয়া রহিল। আমি গাড়ি আনিবার মানসে সেই আড়গোড়ায় গমন করিলাম।
“আড়গোড়ায় গমন করিবামাত্রই একখানি প্রকাণ্ড জুড়ি ও একখানি অতিশয় দ্রুতগামী কম্পাস গাড়ি আমি প্রাপ্ত হইলাম। সেই কম্পাস গাড়িতে উপবেশন করিয়াই জুড়ির সহিত আমি পূর্ব্বোক্ত বাড়ীর দরজায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। আমরা সেই স্থানে আগমন করিবামাত্রই ত্রৈলোক্য ভিতর হইতে সেই বাড়ীর দরজা খুলিরা দিলে আমি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। গাড়ি দুইখানি বাড়ীর সম্মুখেই দাঁড়াইয়া রহিল।
“আমি বাড়ীর ভিতর গিয়া প্রথমতঃ ত্রৈলোক্যের সহিত উত্তমরূপে পরামর্শ আঁটিয়া লইলাম। কিরূপ ভাবে আমাদিগকে কি কি করিতে হইবে, তাহার সমস্ত ঠিক হইয়া গেলে, আমি জুড়িগাড়ির সহিসদ্বয়কে সেই গাড়ির পরদা উত্তমরূপে ঢাকিয়া দিতে কহিলাম। সহিসদ্বয় আমার কথা শুনিয়া উহার পরদা সকল এরূপ ভাবে ফেলিয়া দিল যে, উহার ভিতর বসিলে বাহিরের কোন লোক যে আরোহীকে কোনরূপে দেখিতে পাইবে তাহার আর কোনরূপ সম্ভাবনা রহিল না। ইহার পরই ত্রৈলোক্য বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া সেই জুড়িগাড়ির ভিতর গিয়া উপবেশন করিল। আমি বাড়ীর চাবি বন্ধ করিয়া দিয়া সেই চাবি ত্রৈলোক্যের হস্তে প্রদান করিলাম। আমিও সেই কম্পাস গাড়িতে উঠিয়া বড়বাজার অভিমুখে উহাদিগকে গমন করিতে বলিলাম। আমার নির্দ্দেশ মত উভয় গাড়িই একত্র বড়বাজার অভিমুখে গমন করিল।
ক্রমে গাড়ি গিয়া বড়বাজারে উপস্থিত হইল, এবং রামজীলাল যে দোকানের কর্ম্মচারী ছিল, সেই দোকানের সম্মুখে গিয়া উভয় গাড়িই থামিল। আমি গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া দোকানের ভিতর প্রবেশ করিলাম, ত্রৈলোক্য গাড়ির ভিতরেই বসিয়া রহিল।
“আমি দোকানের ভিতর প্রবেশ করিয়া দোকানদারকে কহিলাম, ‘একজন রাণী কতকগুলি জহরত ক্রয় করিবেন, আমি তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি, তিনি দোকানের সম্মুখে গাড়ির ভিতর বসিয়া আছেন। তাঁহাকে ভাল ভাল কতকগুলি জহরত দেখাও, যদি কোন জহরত তাঁহার পসন্দ হয়, তাহা হইলে উনি তাহা নিশ্চয়ই গ্রহণ করিবেন। ইঁহার নিকট কিছু বেচিতে পারিলে, আপনাদিগের বেশ দুই পয়সা লাভ হইবে, আমারও কিছু উপার্জ্জন হইবে। আমার বোধ হয়, উনি নিজে কোন দ্রব্যের মূল্য আপনাদিগকে জিজ্ঞাসা করিবেন না, কেবল দ্রব্য পসন্দ করিয়া দিবেন। দ্রব্য পসন্দ হইলে আমরা তাহার মূল্য যাহা বলিব, তাহাতেই উনি তাহা গ্রহণ করিবেন। কিন্তু আপনাকে আমি পূর্ব্ব হইতেই সতর্ক করিয়া দিতেছি যে, যদি কোন দ্রব্যের মূল্য উনি জিজ্ঞাসা করেন, তাহা হইলে উহার মূল্য সেই সময় যেন খুব অধিক করিয়া বলা হয়।’
“দোকানদারকে এইরূপ শিখাইয়া দিয়া তাহাকে সঙ্গে লইয়া আমি দোকানের বাহিরে আসিলাম, এবং সেই জুড়িগাড়ির নিকট দাঁড়াইয়া কহিলাম, ‘এই গাড়িতে রাণীজি আছেন, তিনি অনেকগুলি জহরত ক্রয় করিবেন। আপনি এক একটী করিয়া জহরতের বাক্স তাঁহার হস্তে প্রদান করুন, ইহার মধ্যে যদি কোন দ্রব্য রাণীজির পসন্দ হয়, তাহা হইলে তাহার দর স্থির করিয়া দিয়া উহার মূল্য গ্রহণ করিবেন।’ আমার প্রস্তাবে দোকানদার সম্মত হইলেন, এবং এক একটী করিয়া নানা প্রকার জহরতের বাক্স রাণীজির হস্তে প্রদান করিতে লাগিলেন। সেই সকল জহরতের মধ্যে যে সকল জহরত রাণীজি পসন্দ করিলেন, বা যে সকল জহরত আমাদিগের লইয়া যাইবার পরামর্শ ছিল, সেই সকল জহরত ত্রৈলোক্য একটা একটা করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিতে লাগিল। এইরূপে কতকগুলি জহরত আমার হস্তে প্রদান করিবার পর আমাদিগের পূর্ব্ব পরামর্শ অনুযারী ত্রৈলোক্য আমাকে কহিল, ‘আমি এখন বাসায় যাইতেছি। আপনি এই সকল জহরতের উপযুক্ত দাম দোকানদারের সহিত স্থির করিয়া আমার বাসায় লইয়া আসিবেন। আর হয় দোকানদারকে, না হয় তাঁহার দোকানের অপর কোন একজন লোককে সেই সঙ্গে লইয়া যাইবেন। আমার বাসায় গেলেই, আমি হয় ইহার নগদ মূল্য প্রদান করিব, না হয় কোন ব্যাঙ্কের উপর একখানি চেক প্রদান করিব। আমার বোধ হয়, এই সকল জহরতের মূল্য আট দশ হাজার টাকার অধিক হইবে না। সুতরাং এই সকল সামান্য় দ্রব্যের মূল্য বাকী রাখিবার কোনরূপ প্রয়োজন দেখি না।’ আমাদিগকে কেবল এই মাত্র বলিবার পরই রাণীজি তাহার গাড়ি চালাইতে কহিলেন। দেখিতে দেখিতে সেই প্রকাণ্ড জুড়ি বড়বাজার অতিক্রম করিরা চলিয়া গেল।
“ত্রৈলোক্য গমন করিবার পর আমি সেই দোকানদারের সহিত একত্র বসিয়া যে সকল দ্রব্য ত্রৈলোক্য পসন্দ করিয়া গিয়াছিল, তাহার মূল্যের একটা তালিকা প্রস্তুত করিলাম। তালিকা প্রস্তুত হইলে, সেই জহরতগুলি লইয়া দোকানদারকে রাণীজির বাসায় গমন করিবার নিমিত্ত অনুরোধ করিলাম; কিন্তু তিনি নিজে না আসিয়া তাঁহার একজন অতিশয় বিশ্বাসী কর্ম্মচারী রামজীলালকে আমার সহিত পাঠাইয়া দিলেন। তিনি সেই সকল গহনার সহিত আমার গাড়িতে আসিয়া উপবেশন করিলেন।
“ত্রৈলোক্য বড়বাজার হইতে প্রত্যাগমন করিলে প্রায় একঘণ্টা পরে আমি জহরতগুলির সহিত রামজীলালকে সঙ্গে করিয়া আমাদিগের সেই নূতন বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। সেই স্থানে উপস্থিত হইয়াই আমি আমার সেই গাড়ি বিদায় করিয়া দিলাম। ইতিপূর্ব্বে ত্রৈলোক্যও প্রত্যাবর্ত্তন করিবার পর তাহার জুড়ি বিদায় করিয়া দিয়াছিল।
“রামজীলালকে সঙ্গে করিয়া আমি একবারে উপরে উঠিলাম। যে ঘরটী উত্তমরূপে সাজান ছিল, সেই গৃহে তাহাকে বসাইয়া তাহার সহিত দুই চারিটী কথা কহিতেছি, এরূপ সময় রাণীজি বা ত্রৈলোক্য অন্য ঘর হইতে আসিয়া সেই গৃহে প্রবেশ করিল। আমি রামজীলালের সম্মুখে ত্রৈলোক্যকে কহিলাম, ‘সমস্ত জহরতের দাম প্রায় দশ হাজার টাকা হইয়াছে। দোকানদার মহাশয় নিজে আসিতে পারেন নাই, তিনি তাঁহার এই বিশ্বাসী লোককে জহরতের সহিত আপনার নিকট পাঠাইয়া দিয়াছেন; কিন্ত ইঁহার মনিব ইঁহাকে বলিয়া দিয়াছেন যে, অগ্রে টাকা না পাইলে এই সকল জহরত যেন কাহারও হস্তে প্রদান করা না হয়। কারণ, কলিকাতা জুয়াচোরে পরিপূর্ণ।’
“আমার এই কথা শুনিয়া রাণীজি সেই স্থানে উপবেশন করিয়া রামজীলালের সহিত কথাবার্ত্তা কহিতে লাগিল। সেই অবকাশে আমি একবার নিম্নে গমন করিয়া বাড়ীর ভিতর দিক হইতে সদর দরজা তালাবদ্ধ করিয়া দিয়া পুনরায় উপরে উঠিলাম। পরে যে স্থানে রামজীলাল বসিয়াছিলেন, তাহার এক পার্শ্বে গিয়া উপবেশন করিলাম।