রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ/প্রথম পরিচ্ছেদ


স্বর্গীয় রামতনু লাহিড়ী
প্রথম পরিচ্ছেদ।
কৃষ্ণনগর, কৃষ্ণনগরের রাজবংশ, ও কৃষ্ণনগরে
লাহিড়ীদিগের বাস।

 যে লাহিড়ী পরিবার কৃষ্ণনগরের মুখ উজ্জ্বল করিয়াছেন, তাঁহাদের বিষয়ে কিছু বলিতে গেলে অগ্রে কৃষ্ণনগরের বিষয়ে কিছু বলিতে হয়; আবার কৃষ্ণনগরের বিষয়ে কিছু বলিতে গেলেই নদীয়ার রাজাদিগের বংশাবলী সম্বন্ধে কিছু বলিতে হয়; কারণ তাঁহাদিগকে লইয়াই কৃষ্ণনগর; তাঁহারা ইহার প্রতিষ্ঠাকর্ত্তা; তাঁহারা ইহার গৌরব; তাঁহারাই ইহার শ্রীসমৃদ্ধির মূল। কৃষ্ণনগরের রাজবংশের সহিত লাহিড়ী বংশীয়গণের বহুকালের যোগ। লাহিড়ীবংশের পূর্ব্বপুরুষগণ এই বংশের রাজগণের সাহায্যে ও তাঁহাদের আশ্রিত দেওয়ানদিগের সংশ্রবেই কৃষ্ণনগরে আসিয়াছিলেন। এতদ্ভিন্ন ঐ বংশের অনেকে মধ্যে মধ্যে এই রাজপরিবারে উচ্চ উচ্চ পদে প্রতিষ্ঠিত থাকিয়া কার্য্য করিয়াছেন। বিশেষতঃ ভক্তিভাজন রামতনু লাহিড়ী মহাশয়ের সহিত শেষ তিন রাজার বিশেষ আত্মীয়তা ছিল। অতএব সর্ব্বাগ্রে কৃষ্ণনগরের রাজবংশের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতে অগ্রসর হইতেছি।

 অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কৃষ্ণনগর দক্ষিণবঙ্গের রাজধানী ছিল। এখনও কলিকাতার পরে কৃষ্ণনগর অপরাপর কতিপয় সমৃদ্ধিশালী, ও সভ্যতালোকসম্পন্ন প্রধান নগরের মধ্যে একটী প্রথম-শ্রেণী-গণ্য নগর। কলিকাতাতে যে কিছু নূতন আলোচনা উঠে, যে কিছু চিন্তা বা ভাব-তরঙ্গ উত্থিত হয়, তাহার আন্দোলন ত্বরায় কৃষ্ণনগরে ব্যাপ্ত হইয়া থাকে; এজন্য কলিকাতার সহিত কৃষ্ণনগরের ঘনিষ্ঠ মানসিক ও আধ্যাত্মিক যোগ আছে। ভক্তিভাজন রামতনু লাহিড়ী মহাশয় বঙ্গদেশের, যে নব যুগের সূচনা ও বিকাশক্ষেত্রে প্রাদূর্ভুত হইয়াছিলেন, সেই ক্ষেত্রের সমগ্রভাব হৃদয়ে ধারণ করিতে হইলে কলিকাতা ও কৃষ্ণনগরের সামাজিক জীবনকে এক সঙ্গে দেখা আবশ্যক। একারণেও কৃষ্ণনগর ও কৃষ্ণনগরের রাজবংশের কিঞ্চিৎ ইতিবৃত্ত অগ্রে বলার প্রয়োজন। উক্ত ইতিবৃত্ত আমি যথাসাধ্য সংক্ষিপ্ত ভাবে বর্ণন করিব। কিন্তু তাহা হইলেও মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও রাজা শ্রীশচন্দ্র এই রাজদ্বয়ের বিবরণ অপেক্ষাকৃত সবিস্তররূপে বর্ণন করিতে হইবে; কারণ ইহাঁরা কৃষ্ণনগরের, শুধু কৃষ্ণনগরের কেন সমগ্র নদীয়ার, খ্যাতি প্রতিপত্তিলাভ বিষয়ে বিশেষরূপে সহায়তা করিয়াছেন।

 নদীয়ার রাজারা এদেশে বহুকাল সুপ্রসিদ্ধ। আমরা বালককালে পঞ্জিকাতে প্রথম পৃষ্ঠাতেই পড়িতাম “শ্রীশচন্দ্র নৃপতেরনুজ্ঞয়া” অর্থাৎ শ্রীশচন্দ্র নৃপতির আজ্ঞা ক্রমে সংকলিত। অনুসন্ধান করিলেই শুনিতাম নদীয়ার রাজারা হিন্দুসমাজপতি, কুলধর্ম্মের রক্ষক, ও গুণিগণের উৎসাহ দাতা। এই দেশীয় রাজগণ একসময়ে দেশের মহোপকার সাধন করিয়াছেন। যখন সমগ্র দেশ যবন রাজাদিগের করকবলিত হইয়া মুহ্যমান হইতেছিল, তখন তাঁহারা স্বীয় মস্তকে ঝড়বৃষ্টি সহিয়া দেশমধ্যে জ্ঞানী ও গুণীজনকে রক্ষা করিয়াছেন; এবং শিল্প, সাহিত্য, কলাদির উৎসাহদান করিয়াছেন। যবনাধিকার কালে দেশীয় রাজগণ অনেক পরিমাণে সর্ব্বময় কর্ত্তা ছিলেন। তাঁহাদের দেয় নিৰ্দ্ধারিত রাজস্ব দিলেই তাঁহারা স্বীয় অধিকার মধ্যে যথেচ্ছ বাস করিতে পারিতেন। সুতরাং তাঁহারা পাত্র মিত্র সভাসদে পরিবেষ্টিত হইয়া সুখেই বাস করিতেন। জ্ঞানী ব্যক্তিগণ অনেক সময়ে ইঁহাদের আশ্রয়ে বাস করিয়া নিরাপদে স্বীয় স্বীয় প্রতিভাকে বিকাশ করিবার অবসর পাইতেন। ইহার নিদর্শন এখনও বিদ্যমান রহিয়াছে। এখনও পুরাতন রাজধানী সকলের সন্নিকটেই, বিষ্ণুপুরের সুগায়ক ও কৃষ্ণনগরের সুকারিকরদিগের ন্যায়, শিল্প সাহিত্যাদির ভগ্নাবশেষ দৃষ্ট হইতেছে।

 অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়া-রাজ কৃষ্ণচন্দ্র এ বিষয়ে মহাকীর্ত্তি লাভ করিয়াছিলেন। বস্তুতঃ, বিক্রমাদিত্যের রাজসভা না থাকিলে যেমন আমরা কালিদাসের অপূর্ব্ব কীর্ত্তি পাইতাম না, তেমনি গুণগ্রাহী কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের রাজসভা না থাকিলে ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল পাইতাম না।

 ১৬৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ২৩ ডিসেম্বর দিবসে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কার্য্যাধ্যক্ষ জব চার্ণক বাঙ্গালার সুবাদারের সহিত বিবাদ করিয়া, হুগলীর কুঠী পরিত্যাগ পূর্ব্বক, ব্রাহ্মণী পত্নী সমভিব্যাহারে হুগলীর ১২ ক্রোশ দক্ষিণস্থিত গঙ্গাতীরবর্ত্তী সুতানুটী নামক গ্রামে আসিয়া এক নিম্ববৃক্ষতলে আপনার শিবির ও নূতন কুঠীর ভিত্তি স্থাপন করেন। তৎপরে চার্ণক কিছু দিনের জন্য সেখান হইতেও তাড়িত হইয়া হিজলীর নিকটে গিয়া কুঠী স্থাপন করিয়াছিলেন; কিন্তু পুনরায় ১৬৯০ সালের আগষ্ট মাসে ফিরিয়া আসিয়া সুতানুটীতে কুঠী নির্ম্মাণ করেন। ইহাই কালে মহানগরী কলিকাতারূপে পরিণত হইয়াছে। প্রথমে ইহা একটী বাণিজ্যের স্থানমাত্র ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগেই ইহা ইংরাজ গবর্ণমেণ্টের রাজধানীরূপে নির্ণীত হয়। সেই সময় হইতে ইহার শ্রীবৃদ্ধি আরম্ভ হয়; এবং উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যেই ইহা ভারতের একটা সর্ব্বাগ্রগণ্য নগরীরূপে পরিগণিত হইয়াছে। কলিকাতার অভ্যুদয়ের পূর্ব্বে নবদ্বীপের রাজাদিগের রাজধানী কৃষ্ণনগরই বঙ্গদেশের সর্ব্ব প্রধান স্থান ছিল, এবং নদীয়া জেলা সকল প্রকার সভ্যতা ও শিষ্টাচারের উৎপত্তিস্থান ছিল। কৃষ্ণনগরের রাজবংশ এই সকল সভ্যতা ও শিষ্টাচারের উৎস-স্বরূপ ছিলেন। যেমন একদিকে নবদ্বীপবাসী পণ্ডিতগণ জ্ঞান-প্রভা-দ্বারা দেশকে সমুজ্জল করিয়াছিলেন, এবং নবদ্বীপের সুখ্যাতি দেশ বিদেশে ব্যাপ্ত হইয়াছিল, তেমনি নদীয়া জেলার লোকের সভ্যতা, শিষ্টাচার, সুরসিকতা, শিল্প-কুশলতা, সাহিত্যানুরাগ প্রভৃতির খ্যাতি সর্ব্বত্র প্রচার হইয়াছিল। যে রাজবংশের আশ্রয়ে থাকিয়া নদীয়ার এই খ্যাতি প্রতিপত্তি হইয়াছিল তাঁহাদের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত অগ্রে দিতেছি।

 উক্ত রাজবংশের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই—এরূপ জনশ্রুতি যে ১০৭৭ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গেশ্বর আদিশূর কোনও যজ্ঞ সম্পাদনার্থ কান্যকুব্জ হইতে পাঁচজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ আনয়ন করেন। ভট্টনারায়ণ তাঁহাদের মধ্যে একজন। এই ভট্টনারায়ণ হইতে উনবিংশ পুরুষ পরে কাশীনাথ নামে একজন জন্ম গ্রহণ করেন। ইনি ভূম্যধিকারী ও ধনবান ছিলেন। বিক্রমপুর ইহাঁদের আদিস্থান ছিল। কাশীনাথ সম্রাট আকবরের অধিকার কালে বাঙ্গালার নবাবের দৌরাত্ম্যে বিক্রমপুর হইতে তাড়িত হন। পথে নবাবের সেনানীকর্ত্তৃক ধৃত ও নিহত হন। কাশীনাথের আসন্ন-প্রসবা বিধবা পত্নী আন্দুলিয়া নিবাসী, বাগওয়ান পরগণার জমিদার, হরেকৃষ্ণ সমাদ্দারের ভবনে আশ্রয় প্রাপ্ত হন। সমাদ্দারের ভবনে তাঁহার একটী পুত্র সন্তান জন্মে। তাহার নাম রামচন্দ্র রাখা হয়। নিঃসন্তান হরেকৃষ্ণ, তাহাকে স্বীয় পুত্ররূপে গ্রহণ করিয়া তাহাকে সমাদ্দার উপাধি প্রদান করেন। রামচন্দ্র সমাদ্দারের চারিটী পুত্র তন্মধ্যে ভবানন্দই সুপ্রসিদ্ধ। এই ভবানন্দ, বিদ্রোহী যশোহররাজ প্রতাপাদিত্যের দমনার্থে প্রেরিত, সম্রাট জাহাঙ্গিরের সেনাপতি রাজা মানসিংহকে বিশেষ সাহায্য করেন। তন্নিবন্ধন সম্রাট তাঁহার প্রতি প্রসন্ন হইরা তাঁহাকে নবদ্বীপ প্রভৃতি কয়েকটী পরগণার জমিদারী ও মজুমদার উপাধি প্রদান করেন। এই ভবানন্দ মজুমদার কৃষ্ণনগরের রাজবংশের প্রতিষ্ঠাকর্ত্তা।

 পূর্ব্বে মাটিয়ারি নামক স্থানে এই রাজবংশের রাজধানী ছিল। কিন্তু ভবানন্দের পৌৎত্র রাঘব বর্ত্তমান কৃষ্ণনগরে রাজধানীর পত্তন করেন। তখন ঐ স্থানে রেউই নামে একটি ক্ষুদ্র গ্রাম ছিল। ঐ গ্রামে বহুসংখ্যক গোপজাতীয় লোকের বাস ছিল। ঐ সকল গোপ মহাসমারোহ পূর্ব্বক কৃষ্ণের পূজা করিত বলিয়া রাঘবের পুত্র রুদ্র রাজধানীর নাম কৃষ্ণনগর রাখিলেন। তদবধি কৃষ্ণনগর বঙ্গদেশের ইতিবৃত্তে প্রসিদ্ধ স্থান হইয়া উঠিল। তদবধি কৃষ্ণনগরই এই রাজগণের বাসস্থান হইয়া রহিয়াছে। কেবল মধ্যে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র একবার মহারাষ্ট্রীয়দিগের উপদ্রবে উত্ত্যক্ত হইয়া কৃষ্ণনগর পরিত্যাগ পূর্ব্বক ইহার ছয় ক্রোশ দূরে, নিজ জ্যেষ্ঠ পুৎত্র শিবচন্দ্রের নামে, শিবনিবাস নামক এক নগর স্থাপন করিয়া তাহাতে কিছু দিন বাস করিয়াছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্রের পৌৎত্র ঈশ্বরচন্দ্র শিবনিবাস ত্যাগ করিয়া কৃষ্ণনগরে অবস্থিত হন। সুতরাং রামতনু লাহিড়ী মহাশয়ের জন্মকালে কৃষ্ণনগরই ঐ রাজবংশের রাজধানী ছিল। এক্ষণে ইষ্টারণ বেঙ্গল রেলওয়ের শিবনিবাস নামক ষ্টেশন ঐ শিবনিবাসের পরিচয় দিতেছে।

 ভবানন্দ মজুমদারের সময় হইতে ইঁহাদের জমিদারির উত্তরোত্তর উন্নতিই হইতে থাকে। অবশেষে কৃষ্ণচন্দ্রের সময় ৮৪টী পরগণা এই রাজ্যের অন্তর্ভূত হয়। কবিবর ভারতচন্দ্র তাহার নিম্নলিখিত বিবরণ দিয়াছেন —

অধিকার রাজার চৌরাশী পরগণা,
খাড়ি জুড়ী আদি করি দপ্তরে গণনা॥
রাজ্যের উত্তর সীমা মুরশিদাবাদ,
পশ্চিমের সীমা গঙ্গা ভাগিরথী খাদ।
দক্ষিণের সীমা গঙ্গা-সাগরের ধার,
পূর্ব্ব সীমা ধুল্যাপুর বড় গঙ্গা পার॥

 নদীয়ার রাজগণ এই বিস্তীর্ণ রাজ্যের অধিকারী ছিলেন; বহু সংখ্যক পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য রাখিতেন; সর্ব্বদাই দেশের অপরাপর রাজগণের সহিত যুদ্ধ বিগ্রহে প্রবৃত্ত থাকিতেন; এবং নামতঃ যবন রাজাদিগের অধীনে থাকিয়াও সর্ব্ব বিষয়ে স্বাধীন রাজার ন্যায় বাস করিতেন।

 এই রাজবংশের রাজগণের মধ্যে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রই সমধিক প্রসিদ্ধ। রুদ্রের পুৎত্র রামজীবন; রামজীবনের পুৎত্র রঘুরাম; রঘুরামের পুৎত্র কৃষ্ণচন্দ্র। ১৭১০ খ্রীষ্টাব্দে কৃষ্ণচন্দ্রের জন্ম হয়। ইঁহার জীবদ্দশাতেই বঙ্গদেশ মুসলমান-রাজাদিগের হস্ত হইতে ইংরাজদিগের হস্তে নিপতিত হয়। এই কারণে ইঁহার জীবনবৃত্ত কিঞ্চিৎ বিস্তারিতরূপে বর্ণন করা আবশ্যক বোধ হইতেছে।

 যখন রঘুরামের দেহান্ত (১৭২৮ খ্রীষ্টাব্দে) হয়, তখন কৃষ্ণচন্দ্রের বয়ঃক্রম অষ্টাদশ বৎসর মাত্র ছিল। কিন্তু এই স্বল্প বয়সেই কৃষ্ণচন্দ্রের কার্য্যকুশলতা ও স্বীয় অভীষ্ট সাধনে চাতুরীর বিশেষ প্রমাণ পাওয়া গিয়াছিল। এরূপ জনরব তাঁহার পিতা কোনও অনির্দ্দেশ্য কারণে তাঁহাকে উত্তরাধিকারিত্বে বঞ্চিত করিয়া স্বীয় ভ্রাতা রামগোপালকে রাজ্যের উত্তরাধিকারী করিয়া যান। তদনুসারে রামগোপাল নবাব সন্নিধানে রাজ্যের অধিকার প্রার্থনা করেন। কৃষ্ণচন্দ্র নাকি এক অপূর্ব্ব চাতুরী খেলিয়া স্বীয় পিতৃব্যকে বিষয়ে বঞ্চিত করিয়াছিলেন।

 ইহার কিছুকাল পরে বঙ্গদেশের দক্ষিণ বিভাগে মহারাষ্ট্রীয়দিগের উপদ্রব অত্যন্ত প্রবল হয়। দিল্লীর সম্রাট, মহারাষ্ট্রপতি শিবজীকে শান্ত রাখিবার মানসে, তাঁহাকে দাক্ষিণাত্যের কোন কোনও প্রদেশের চৌথ অর্থাৎ উৎপন্ন শস্যের চারিভাগের এক ভাগ দিতে প্রতিশ্রুত হইয়াছিলেন। শিবজীর মৃত্যুর (১৬৮০ খ্রী) পরে একশতাব্দীর মধ্যেই একদিকে মহাষ্ট্রীয়দিগের অভ্যুত্থান অপরদিকে দিল্লীশ্বরের শক্তির অবসান হইল। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে নাগপুরবাসী মহারাষ্ট্রীয়গণ তাহাদের প্রাপ্য চৌথ আদায়ের ছল করিয়া দিল্লীর সম্রাটের অধিকারভুক্ত নানাস্থান আক্রমণ করিতে লাগিল। ক্রমে তাহাদের উপদ্রব বঙ্গদেশেও ব্যাপ্ত হইল। এই মহারাষ্ট্রীয় উপদ্রব বঙ্গদেশের ইতিহাসে বর্গীর হাঙ্গামা নামে প্রসিদ্ধ হইয়াছে। বর্গীর হাঙ্গামাতে বঙ্গদেশে ধনী দরিদ্র সকলকেই ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিল। ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দে নবাব আলিবর্দ্দী খাঁ বাঙ্গালার নবাবী পদে প্রতিষ্ঠিত হন। তাঁহার সময় হইতেই এই বর্গীর হাঙ্গামা আরম্ভ হয়। গঙ্গার পূর্ব্বপারের স্থান সকলে সমৃদ্ধিশালী নগর অধিক ছিল না বলিয়া বর্গীগণ প্রথমে সেদিকে দৃষ্টিপাত করে নাই। এজন্য পশ্চিম পারের অনেক লোক গঙ্গার পূর্ব্বপারে পলাইয়া আসে। অনেকে ফরাসডাঙ্গাতে ফরাসিদিগের আশ্রয়ে আসিয়া বাস করে। অনেকে কলিকাতাতে ইংরাজদের শরণাপন্ন হয়। এই সময়েই বর্দ্ধমানাধিপতি তিলকচাঁদের জননী পুত্রসহ পলাইয়া মুলাযোড়ের সন্নিহিত কউগাছি গ্রামে আসিয়া বাস করেন। সেখানে রাজভবনের গড় এখনও বিদ্যমান। ক্রমে বর্গীরা পূর্ব্বপারেও পদার্পণ করিতে আরম্ভ করে। তখন কলিকাতার চারিদিকে “মারহাট্টা ডিচ্‌” নামক পরিখা খনন করা হয়। সেই সময়ে নদীয়াপতি কৃষ্ণচন্দ্র কোনও নিরাপদ স্থানে বাস করিবার অভিপ্রায়ে কৃষ্ণনগরের ছয় ক্রোশ উত্তরে একটী স্থান মনোনীত করিয়া, সেখানে রাজধানী স্থাপন করেন; এবং তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র শিবচন্দ্রের নামে তাহার নাম শিবনিবাস রাখেন। ঐ নগরকে তিনি রাজপ্রাসাদ, দেবমন্দির ও আত্মীয় কুটুম্বের বাসভবনে পূর্ণ করিয়াছিলেন। “শিবনিবাসের দক্ষিণ দিকে কৃষ্ণপুর নামক এক গ্রাম পত্তন করিয়া তথায় বহুসংখ্যক গোপজাতির বসতি করান। তাহারা রাজসরকারে নানাবিধ কার্য্য করিত। এক্ষণে তাহারা কৃষ্ণপুরে গোড়ো বলিয়া খ্যাত।” নগরের এক ক্রোশ পূর্ব্ব উত্তরে ইচ্ছামতী নদীতীরে এক গঞ্জ স্থাপন করেন এবং তাহার নাম কৃষ্ণগঞ্জ রাখেন। ঐ গঞ্জের নিকটস্থ গ্রামও কৃষ্ণগঞ্জ বলিয়া খ্যাত।

 কৃষ্ণচন্দ্রের অধিকারের মধ্যকালে নবাব আলিবর্দ্দী খাঁ পরলোক গমন করেন; এবং তাঁহার দৌহিত্র বিখ্যাত সিরাজদ্দৌলা বাঙ্গালার সিংহাসনে আরোহণ করেন। সিরাজদ্দৌলা সুখপ্রিয় তরলমতি অব্যবস্থিত-চিত্ত লোক ছিলেন। তাঁহার রাজত্বকালে তাঁহার বিবিধ অত্যাচারে রাজ্যের প্রধান প্রধান ব্যক্তিগণ উত্ত্যক্ত হইয়া উঠিলেন; এবং কিরূপে তাঁহাকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া যোগ্যতর কোনও ব্যক্তির হস্তে রাজ্যভার অর্পণ করিতে পারেন এই মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন। মুর্শিদাবাদবাসী জগৎশেঠ নামক একজন ধনবান ব্যক্তির ভবনে এই মন্ত্রণা-সভার অধিবেশন হইতে লাগিল। এইরূপ জনশ্রুতি যে রাজা মহেন্দ্র, রাজা রাম নারায়ণ, রাজা রাজবল্লভ, রাজা কৃষ্ণদাস, মীরজাফর প্রভৃতি প্রথমে এই মন্ত্রণার মধ্যে ছিলেন। তাঁহাদের দ্বারা আহুত হইয়া কৃষ্ণচন্দ্র পরে আসিয়া তাহাতে যোগ দেন; এবং তাঁহারই পরামর্শক্রমে ইংরাজদিগের সাহায্য প্রার্থনা করা স্থিরীকৃত হয়। কোনও কোনও ইতিহাস লেখক এই কথার প্রতিবাদ করিয়াছেন। তাঁহারা বলেন কৃষ্ণচন্দ্রের এই মন্ত্রণা সভার সহিত যোগ ছিল না। কিন্তু ক্ষিতীশবংশাবলীচরিত-লেখক বলিয়াছেন কৃষ্ণনগরের রাজবাটীতে এ প্রবাদ চলিত আছে, যে পলাশীর যুদ্ধের পর ক্লাইব সাহেব কৃষ্ণচন্দ্রকৃত সাহায্যের প্রতিদানস্বরূপ তাঁহাকে পাঁচটি কামান উপহার দিয়াছিলেন। সে পাঁচটী কামান অদ্যাপি কৃষ্ণনগরের রাজবাটীতে বিদ্যমান আছে।

 নবাব সিরাজদ্দৌলা নিহত হইলে আলিবর্দী খাঁর জামাতা মীরজাফর তদীয় সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। এই সময় হইতে ইংরাজগণ বাঙ্গালার প্রকৃত শাসনকর্ত্তা হইলেন বটে, কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্রের দুঃখ সম্পূর্ণরূপে ঘুচিল না। মীরজাফর অল্পদিনের মধ্যেই স্বীয় পুত্র মীরণকে রাজকীয়পদে অভিষিক্ত করিয়া নিজে রাজকার্য্য হইতে অবসৃত হইলেন। ১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দে বজ্রাঘাতে মীরণের মৃত্যু হইল; এবং মীরজাফরের জামাতা মীরকাসিম নবাবের পদে প্রতিষ্ঠিত হইলেন। ইংরাজদিগের সহিত মীরকাসিমের মনোবাদ ঘটে। তিনি ইংরাজদিগের রাজধানী হইতে অপেক্ষাকৃত দূরে থাকিবার আশয়ে মুঙ্গেরে স্বীয় রাজধানী স্থাপন করেন। ইহার পরে তিনি দেশের মধ্যে যে যে বড় লোককে ইংরাজদের বন্ধু মনে করিতেন, বা ইংরাজদিগকে তুলিবার পক্ষে সহায় বলিয়া বিশ্বাস করিতেন, তাহাদিগকে ধরিয়া মুঙ্গেরের দুর্গে বন্দী ও হত্যা করিতে প্রবৃত্ত হন। তদনুসারে কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র শিবচন্দ্রকে মুঙ্গেরের দুর্গে কিছু দিন বন্দী করিয়া রাখেন। ইংরাজদিগের ভয়ে হঠাৎ মুঙ্গের ছাড়িয়া পলায়ন করা আবশ্যক না হইলে, মীরকাসিম বোধ হয় সপুত্র কৃষ্ণচন্দ্রকেও হত্যা করিতেন। কিন্তু ইংরাজেরা আসিয়া পড়াতে পিতাপুৎত্রে সে যাত্রা রক্ষা পাইয়াছিলেন।

 ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ইংরাজগণ দিল্লীর সম্রাট সাহ আলমের নিকট বাঙ্গালা বিহার ও উড়িষ্যা এই তিন প্রদেশের দেওয়ানী সনন্দ প্রাপ্ত হইয়া রাজস্বের উন্নতি বিধানে মনোযোগী হন। কিন্তু তাঁহাদের অনভিজ্ঞতাবশতঃ রাজস্ব সংক্রান্ত সমুদয় কার্য্য ঘোর বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়িয়া গেল। কি জানি কিরূপ দাঁড়ায় এই ভয়ে জমিদারগণ প্রজাকুলের নিকট স্বীয় স্বীয় বাকি প্রাপ্য আদায় করিয়া লইতে লাগিলেন। অনেক প্রজা নিঃস্ব হইয়া গেল। ইহার উপরে ১৭৬৮ ও ১৭৬৯ এই দুই বৎসর অনাবৃষ্টি হইয়া শস্যের সম্পূর্ণ ক্ষতি করিল। তাহার ফলস্বরূপ দেশে ভয়ানক মন্বন্তর উপস্থিত হইল। এরূপ দুর্ভিক্ষ এদেশে আর হয় নাই। ১২৭৬ বঙ্গাব্দে ঘটিয়াছিল বলিয়া এই দুর্ভিক্ষ “ছিয়াত্তুরে মন্বন্তর” নামে চিরদিন বাঙ্গালীর মনে মুদ্রিত হইয়া রহিয়াছে। সেই ভয়ানক মহামারীর বিশেষ বর্ণনা এখানে দেওয়া নিষ্প্রেয়াজন। এইমাত্র বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে ১৭৭০ সালের জানুয়ারী হইতে আগষ্ট পর্য্যন্ত এই নয়মাসের মধ্যে সমগ্র বঙ্গদেশে প্রায় এক কোটি লোকের এবং কেবলমাত্র কলিকাতা নগরে ১৫ই জুলাই হইতে ১৫ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৭৬০০০ লোকের মৃত্যু হয়। এরূপ হৃদয়-বিদারক দৃশ্য কেহ কখনও দেখে নাই। পথে ঘাটে, হাটে বাজারে, খানা খন্দে, দলে দলে মানুষ মরিয়া পড়িয়া থাকিত; ফেলিবার লোক পাওয়া যাইত না। আশ্চর্য্যের বিষয় এই নব-প্রতিষ্ঠিত ইংরাজরাজগণ এই মহামারী নিবারণের বিশেষ কোনও উপায় অবলম্বন করেন নাই।

 ইহার পরে ইংরাজ গবর্ণমেণ্ট বঙ্গদেশকে নানা পরগণাতে ভাগ করিয়া জমিদারদিগের সহিত রাজস্বের নূতন বন্দোবস্ত করিতে প্রবৃত্ত হন। সেই সময় কৃষ্ণচন্দ্র স্বীয় জ্যেষ্ঠ পুত্র শিবচন্দ্রের নামে জমিদারির নূতন বন্দোবস্ত করিয়া লন। ১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দে রাজা এক দান পত্র লিখিয়া শিবচন্দ্রকে সমুদয় জমিদারীর মালিক করেন। তৎপরে কৃষ্ণনগরের এক ক্রোশ পূর্ব্বে অলকানন্দ নদীতীরে গঙ্গাবাস নামে এক সুরম্য ভবন নির্ম্মাণ করাইয়া তথায় বাস করেন। এই স্থানে ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দে ৭৩ বৎসর বয়সে তাঁহার দেহান্ত হয়।

 কৃষ্ণচন্দ্রের দুই মহিষী ছিলেন। প্রথমার গর্ভে শিবচন্দ্র, ভৈরবচন্দ্র, হরচন্দ্র, মহেশচন্দ্র ও ঈশানচন্দ্র এই পঞ্চ পুত্র জন্ম গ্রহণ করেন; কনিষ্ঠার গর্ভে শম্ভুচন্দ্রের জন্ম হয়। শম্ভুচন্দ্র পিতার বিরুদ্ধাচারী হইয়া তাঁহার অপ্রিয় হইয়াছিলেন। শিবচন্দ্র রাজপদ প্রাপ্ত হইলে তিনি স্বীয় জননীর সহিত হরধাম নামক স্থানে গিয়া বাস করিলেন। অপরেরা শিবনিবাসেই রহিলেন। এখনও শিবনিবাস ও হরধামে এই রাজবংশের শাখাদ্বয় বিদ্যমান আছে।

 কৃষ্ণচন্দ্র কার্যক্ষম দৃঢ়চেতা অধ্যবসায়শীল লোক ছিলেন। তিনি যৌবনের প্রারম্ভ হইতেই যেরূপ বিপজ্জালে জড়িত হইয়াছিলেন এবং তাঁহার অধিকার কালে রাজ্য মধ্যে যতপ্রকার বিপদ ঘটিয়াছিল, এরূপ কোনও এক ব্যক্তির ভাগ্যে ঘটিতে দেখা যায় না। অথচ কোনও বিপদে তাঁহাকে অভিভূত করিতে পারে নাই। অসীম প্রত্যুৎপন্ন-মতিত্বগুণে তিনি সমুদয় বিপজ্জাল কাটিয়া বাহির হইতেন। চতুর্দ্দিকে যখন বিপদ ঘিরিয়া আসিত তখনও তিনি পাত্র-মিত্র-সভাসদ লইয়া আমোদ প্রমোদে কালযাপন করিতেন। গুণগ্রাহিতা ও গুণিগণের উৎসাহদান কার্য্যে ইনি বিক্রমাদিত্যের অনুসরণ করিয়াছিলেন। ইঁহার রাজসভা সুপণ্ডিত, সুকবি, সুগায়ক ও সুরসিকগণে পূর্ণ ছিল। ইঁহার অধিকার কালে নবদ্বীপে হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত, কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি প্রভৃতি, গুপ্তিপাড়া গ্রামে প্রসিদ্ধ সুকবি বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার প্রভৃতি, ত্রিবেণীতে জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন প্রভৃতি, শান্তিপুরে রাধামোহন গোস্বামী প্রভৃতি, সুপণ্ডিতগণ যশঃ-প্রভাতে বঙ্গদেশকে সমুজ্জ্বল করিতেছিলেন। রাজা ইহাঁদের অনেককে বৃত্তি ও নিস্কর ভূমিদান করিয়া গিয়াছেন। ইঁহারই রাজসভাতে কবিবর ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর বিরাজিত ছিলেন।

 ভারতচন্দ্র ১৬৩৪ শকে অর্থাৎ ১৭১২ খ্রীষ্টাব্দে বৰ্দ্ধমানান্তর্গত পেঁড়োগ্রামে জন্মগ্রহণ করিয়া, বাল্যে সংস্কৃত ও পারস্য ভাষা শিক্ষা পূর্ব্বক, নানাদেশ পরিভ্রমণানন্তর, অবশেষে ফরাসডাঙ্গাতে ফরাসি রাজ্যের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর আশ্রয়ে আসিয়া প্রতিষ্ঠিত হন। কৃষ্ণচন্দ্র বিষয় কর্ম্ম উপলক্ষে মধ্যে মধ্যে ফরাসডাঙ্গাতে ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর নিকট আসিতেন। সেখানে তাঁহার সহিত ভারতের সাক্ষাৎ হয়। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁহার গুণে আকৃষ্ট হইয়া তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া কৃষ্ণনগরে লইয়া যান। এখানে রাজাদেশে তিনি “অন্নদামঙ্গল” রচনা করেন। এতদ্ভিন্ন হালিসহর পরগণার অন্তর্গত কুমারহট্টগ্রাম-বাসী বৈদ্যজাতীয় কবি সুপ্রসিদ্ধ রামপ্রসাদ সেনও এই সময়ে প্রাদুর্ভূত হন। তিনি কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ না হইয়াও তাঁহার সাহায্য লাভে বঞ্চিত হন নাই। এই সময়েই গোপালভাঁড় প্রভৃতি বিখ্যাত উপস্থিত বক্তা ও সুরসিকগণ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাতে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ইহা বলিলে বোধ হয় অত্যুক্তি হয় না, যে বঙ্গদেশ যে আজিও ভারত সাম্রাজ্যের মধ্যে বিদ্যা, বুদ্ধি, সুরসিকতা প্রভৃতির জন্য প্রতিষ্ঠা লাভ করিতেছে, কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভা তাহার পত্তন-ভূমিস্বরূপ ছিল।

 কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্র প্রভূতশক্তিশালী হইয়াও ধর্ম্ম বা সমাজ সংস্কারের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন। এমন কি যে প্রাচীন কুরীতি-জালে দেশ আবদ্ধ ছিল, সে জালকে তিনি আরও দৃঢ় করিবার প্রয়াস পাইয়াছিলেন। এরূপ জনশ্রুতি আছে যে রাজা রাজবল্লভ স্বীয় স্বল্পবয়স্ক তনয়ার বৈধব্য-দুঃখ দর্শনে কাতর হইয়া দেশ মধ্যে বিধবা-বিবাহের প্রথা প্রবর্ত্তিত করিবার প্রয়াস পাইয়াছিলেন। কেবল কৃষ্ণচন্দ্রের গুপ্ত প্রতিকূলতাচরণবশতঃই তিনি সে সংস্কার সাধনে কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই। স্মার্ত্ত ভটাচার্য্যের যে সকল বিধি ব্যবস্থার ভারে প্রাচীন বঙ্গসমাজ বহুদিন ক্লেশ পাইতেছিল, কৃষ্ণচন্দ্র সেই ভার লঘু না করিয়া বরং দুর্ব্বহ করিয়াছিলেন। এরূপ শুনিতে পাওয়া যায় তিনিই যশোহর জেলাস্থ পিরালী ব্রাহ্মণদিগের উপবীত গ্রহণাধিকার রহিত করিয়া তাহাদিগকে জাত্যংশে অতি হীন করিয়া ফেলেন; এবং এ প্রদেশের বৈদ্যগণের উপবীত ধারণ নিষেধ করেন। এ জনশ্রুতি কতদূর সত্য তাহা বলিতে পারি না।

 রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরে রাজা শিবচন্দ্র, (১৭৮২ হইতে ১৭৮৮ পর্য্যন্ত) তৎপরে রাজা ঈশ্বরচন্দ্র,(১৭৮৮ হইতে ১৮৭২ পর্যন্ত) নদীয়ার রাজসিংহাসনে আসীন হন। শিবচন্দ্র অতিশয় ধর্ম্মনিষ্ঠ, উদার, ও স্বজন-পোষক ছিলেন। রাজা ঈশ্বরচন্দ্র অমিতব্যয়ী ও উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির লোক ছিলেন। তিনি অকারণ অনেক অর্থের অপব্যয় করিতেন। একবার একটা বানরের বিবাহ দিয়া লক্ষাধিক টাকা উড়াইয়াছিলেন। তাঁহার সময় হইতেই বাকী খাজনার জন্য জমিদারী বিক্রয় হইতে আরম্ভ হয়। রাজস্ব আদায়ের সুব্যবস্থা বিধান, কৃষিকার্য্যের উন্নতি সাধন, ও দুর্ভিক্ষাশঙ্কা নিবারণাদির অভিপ্রায়ে, ১৭৮৬ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিস বাহাদুর এতদ্দেশীয় জমিদারদিগের সহিত দশ বৎসরের জন্য় বার্ষিক দেয় রাজস্ব নির্দ্ধারণ করেন। কথা থাকে যে বিলাতের কর্ত্তৃপক্ষের অভিমত হইলে এই বন্দোবস্তই চিরস্থায়ী হইবে। তদনুসারে ১৭৯৩ সালে সেই বন্দোবস্ত চিরস্থায়ী হয়। প্রথমে দশ বৎসরের জন্য হইয়াছিল বলিয়া অদ্যপি ইহা দশশালা বন্দোবস্ত নামে প্রসিদ্ধ। এই দশশালা বন্দোবস্তের প্রচলন হইতেই বঙ্গদেশের অনেক জমিদারের জমিদারি হ্রাস হইতে লাগিল। মুসলমান নবাবদিগের সময়ে যদিও ভূম্যধিকারিগণ বাকি খাজনার জন্য সময়ে সময়ে কারারুদ্ধ ও নিগৃহীত হইতেন, তথাপি তাঁহাদের জমিদারী অক্ষুণ্ণ থাকিত। সময়ে সময়ে নবাবের কৃপাকটাক্ষ পড়িলে নিষ্কৃতি লাভও করিতে পারিতেন। কিন্তু ইংরাজগণ একদিকে যেমন ভূম্যধিকারিগণের সহিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করিলেন, অপরদিকে তেমনি নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে রাজস্ব না দিলে জমিদারি নিলামে চড়াইবার নিয়ম প্রবর্ত্তিত করিলেন। এই নিলামের কিস্তীর প্রভাবে অনেকের জমিদারী হস্তান্তর হইয়া যাইতে লাগিল। তাই কৃষ্ণচন্দ্রের সময় যে নদীয়া রাজ্যের ক্রমিক উন্নতি লক্ষিত হইয়াছিল, ঈশ্বরচন্দ্রের সময় হইতে তাহা নিলামে চড়িতে লাগিল ও ক্ষয় প্রাপ্ত হইতে থাকিল।

 ঈশ্বরচন্দ্রের পর গিরীশচন্দ্র রাজা হন। (১৮০২ হইতে ১৮৪১ পর্য্যস্ত)। গিরীশচন্দ্র রাজ্য প্রাপ্ত হইয়া রাজকার্য্যে মনোনিবেশ না করিয়া ধর্ম্মানুষ্ঠানের আড়ম্বরে প্রভূত অর্থ ব্যয় করিতে আরম্ভ করেন। পূর্ব্বে উল্লেখ করা গিয়াছে কৃষ্ণচন্দ্রের সময় ৮৪ পরগণা নদীয়া রাজ্যের অন্তর্গত ছিল; গিরীশচন্দ্রের সময়ে তাহ ৫।৭-খানি পরগণা ও কতকগুলি নিষ্কর গ্রামে দাঁড়াইল। এই রাজার সময়ে ইঁহাদের জমিদারীর সারভূত প্রসিদ্ধ উখড়া পরগণা নিলাম হইয়া যায়। এই দারুণ দুর্ঘটনার পর গিরীশচন্দ্র একজন তান্ত্রিক ব্রহ্মচারীর প্ররোচনায় নিতান্ত সুরাসক্ত ও অমিতব্যয়ী হইয়া পড়েন। গিরীশচন্দ্র নিঃসন্তান হওয়াতে একটী দত্তক পুত্র গ্রহণ করেন ও তাহার নাম শ্রীশচন্দ্র রাখেন। এই দত্তক পুত্রকে জমিদারীর ভার দিয়া ১৮৪১ খ্রীষ্টাব্দে গিরীশচন্দ্র লোকান্তরিত হন। পূর্ব্বপুরুষদিগের ন্যায় এই রাজাও গুণিগণের উৎসাহদাতা, কাব্যরসামোদী ও সঙ্গীতাদির অভিজ্ঞ ছিলেন। ইঁহার অধিকার কালে, দিল্লীর প্রসিদ্ধ গায়ক কায়েম খাঁ ও তাঁহার তিন সুবিখ্যাত পুত্র মিয়া খাঁ, হস্মু খাঁ ও দেলাওর খাঁ অসিয়া কৃষ্ণনগরে প্রতিষ্ঠিত হন। তাঁহাদের আগমনে কৃষ্ণনগরে সঙ্গীত বিদ্যার চর্চ্চা বিশেষরূপে প্রবল হইয়াছিল। যুবরাজ শ্রীশচন্দ্র ইহাদেরই নিকটে গীতবাদ্য শিখিয়াছিলেন।

 শ্রীশচন্দ্র বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া বিষয় কার্য্যে মনোনিবেশ করিলেন। প্রথমে তিনি নষ্ট বিষয়ের পুনরুদ্ধারে মনোযোগী হইলেন। তৎপরে নদীয়া জেলাস্থ অনেক ভদ্রলোককে সমবেত করিয়া রাজবাটীতে এক সাধারণ হিতকরী সভা স্থাপন করিলেন; এবং স্বয়ং তাহার সভাপতি হইয়া কার্য্য নির্ব্বাহ করিতে লাগিলেন। এই সভার সাহায্যে রাজা একটী মহদুপকার সাধন করিয়াছিলেন। যে সকল ব্যক্তির নিষ্কর ভূমি বাজাপ্ত হইয়াছিল, ভূম্যধিকারিদিগের দ্বারা আবেদন করাইয়া তাহা প্রত্যর্পণ করিতে গবর্ণমেণ্টকে বাধ্য করিয়াছিলেন। ভূম্যধিকারিগণের এই মহদুপকার সাধন করিয়াই শ্রীশচন্দ্র নিরস্ত হন নাই। দেশের ও সমাজের সর্ব্ববিধ উন্নতিকর বিষয়ে মনোযোগী হইয়াছিলেন। তিনি প্রথমতঃ পণ্ডিতগণের সহিত স্মৃতি প্রভৃতি প্রাচীন গ্রন্থ সকল পাঠ করিয়া শাস্ত্রীয় বিধির দ্বারা বিধবা-বিবাহের বৈধতা প্রতিপন্ন করিতে প্রয়াসী হন। এরূপ শুনিতে পাওয়া যায়, নবদ্বীপের পণ্ডিতগণের প্রতিবন্ধকতা নিবন্ধনই সম্পূর্ণ কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই।

 দেশে ইংরাজী শিক্ষা বিস্তার বিষয়েও শ্রীশচন্দ্র বিশেষ উৎসাহী হইয়াছিলেন। ১৮৪৫ খ্রীষ্টাব্দে, গবর্ণর জেনেরল সার হেনরি হার্ডিঞ্জ বাহাদুরের অধিকারকালে, কৃষ্ণনগর কালেজ প্রতিষ্ঠিত হইলে, শ্রীশচন্দ্র, পূর্ব্ব পুরুষের রীতি লঙ্ঘন পূর্ব্বক, স্বীয় পুত্রকে কৃষ্ণনগর কলেজে ভর্ত্তি করিয়া দিয়াছিলেন; এবং নিজে কলেজ কমিটীর সভ্যপদ গ্রহণ করিয়াছিলেন।

 ১৮৪৪ খ্রীষ্টাব্দে তিনি রাজবাটীতে একটী ব্রাহ্ম সমাজ স্থাপন করেন; এবং তাঁহারই প্রার্থনানুসারে ভক্তিভাজন দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর মহাশয় হাজারিলাল নামক একজন প্রচারককে সমাজের আচার্যের কার্য্য করিবার জন্য প্রেরণ করেন। এরূপ শুনিতে পাওয়া যায় যে একজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ না পাঠাইয়া হাজারিলালকে প্রেরণ করাতে রাজা দুঃখিত হইয়া রাজবাটী হইতে ব্রাহ্ম সমাজকে স্থানান্তরিত করেন।

 ইহার কিঞ্চিৎপরে কলিকাতার অনুকরণে কৃষ্ণনগরে মিশনারিদিগের বিরুদ্ধে আন্দোলন উপস্থিত হয়। সেই সময়ে শ্রীশচন্দ্র নিজভবনে একটা অবৈতনিক ইংরাজী বিদ্যালয় স্থাপন করিয়া বালকদিগকে শিক্ষা দিতে আরম্ভ করেন।

 শ্রীশচন্দ্রের জীবনের অবসানকাল যেরূপ হইল তাহা অতীব শোচনীয়। ক্ষিতীশবংশাবলী-চরিত-লেখক তাহা এইরূপে বর্ণন করিয়াছেন। “রাজা বাল্যাবস্থা হইতে পৈঁত্রিশ বর্ষ বয়ঃক্রম পর্য্যন্ত, নিজের ও স্বদেশের হিত বিধান ও মঙ্গলসাধনে সতত রত ছিলেন। তাহার পর কলিকাতাবাসী কতিপয় মধুরভাষী ধনশালী ব্যক্তির সুধাচ্ছাদিত বিষপূরিত সংসর্গে তাঁহার আন্তরিক ও বাহ্যিক ভাবের বিস্তর বিপর্য্যয় হইতে লাগিল। তাঁহার বিষয় কার্য্যে মনোনিবেশ করা অতি ক্লেশকর জ্ঞান হইতে লাগিল; এবং সুহৃদ্বর্গের সুহৃদ্বাক্য কর্ণকুহরে কণ্টকবৎ বোধ হইয়া উঠিল। আহার, বিহার, শয়ন, সকলই নিয়ম-বহির্ভূত হইতে আরম্ভ হইল; দিবানিশি কেবল মদিরাপানে ও গীতবাদ্যের আমোদে কালাতিপাত করিতে লাগিলেন। দুই বৎসর মধ্যে তাঁহার মনোবৃত্তি নিস্তেজ হইয়া উঠিল এবং শরীর অবসন্ন হইয়া আসিল। অবশেষে ১২৬৩ বাং (ইংরাজী ১৮৫৭) অব্দের অগ্রহায়ণ মাসের একবিংশ দিবসে ৩৮ বৎসর বয়সে কালগ্রাসে পতিত হইলেন।”

 শ্রীশচন্দ্র লোকান্তরিত হইলে রাজা সতীশ চন্দ্র তাঁহার পদে প্রতিষ্ঠিত হইলেন। তখন তাঁহার বয়ঃক্রম বিংশতি বৎসর। এই রাজার সময়ে বর্ণনীয় বিষয় অধিক কিছুই নাই। ইনি বিষয়াধিকার প্রাপ্ত হইয়াই বিষয় কার্য্যে অবহেলা পূর্ব্বক কেবল কুসঙ্গীদের সঙ্গে নানাদেশ ভ্রমণে কালযাপন করিতে লাগিলেন। গিরীশ চন্দ্রের ন্যায় আয়ব্যায়ের প্রতি ইঁহারও দৃষ্টি ছিল না।

 ইনি ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দে ২৫ অক্টোবর দিবসে গুরুতর সুরাপান নিবন্ধন উৎকট পীড়াগ্রস্ত হইয়া মশুরি পাহাড়ে গতাসু হন।

 সতীশ চন্দ্র বিলাতী সভ্যতা ও বিলাতী রীতি নীতির অতিশয় পক্ষপাতী ছিলেন; এবং মধ্যে মধ্যে এদেশীয় ও ইংরাজ ভদ্রলোকদিগকে রাজবাটীতে
মহারাজা ক্ষিতীশ চন্দ্র রায় বাহাদুর
নিমন্ত্রণ করিয়া এক সঙ্গে আহার বিহার করিতেন। এই কারণে তাঁহার দেহান্ত হইলে কৃষ্ণনগর কলেজের তদানীন্তন অধ্যক্ষ লব সাহেব বলিয়াছিলেন—“এখানকার ইংরেজ ও বাঙ্গালীদিগের মধ্যে মহারাজা গ্রন্থিস্বরূপ ছিলেন, তাঁহার অভাবে সেই গ্রন্থি ছিন্ন হইয়াছে; এবং অচিরাৎ আর কেহ যে ঐ রূপ গ্রন্থিস্বরূপ হইবেন তাহারও প্রত্যাশা নাই”।

 সতীশ চন্দ্রের পত্নী এক দত্তক পুত্র গ্রহণ করেন তাঁহার নাম ক্ষিতীশ চন্দ্র রাখা হয়। ইনিই এক্ষণে নদীয়ার রাজপদে প্রতিষ্ঠিত আছেন। ইনি বিদ্যা বুদ্ধি ও সচ্চরিত্রতার জন্য সর্ব্বজন-প্রশংসিত।

 বর্ত্তমান শতাব্দীর প্রারম্ভে যেমন একদিকে নদীয়ার রাজগণের রাজশক্তি হ্রাস পাইতে লাগিল, তেমনি অপর দিকে, ইংরাজ-রাজ্য স্থাপন ও বিষয় বাণিজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে, কতকগুলি মধ্যবিত্ত ভদ্র পরিবার কৃষ্ণনগরে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়া অগ্রগণ্য হইয়া উঠিলেন। এই সকল পরিবারের মধ্যে লাহিড়ীগণ প্রধানরূপে উল্লেখ-যোগ্য; কারণ তাঁহাদের যশঃপ্রভা ত্বরায় দেশ মধ্যে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িল। কৃষ্ণনগরে লাহিড়ী বংশের আগমন সম্বন্ধে আদি তত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে নিৰ্দ্ধারণ করা কঠিন। এইমাত্র জানিতে পারা যায়, যে এই বংশের পূর্ব্ব পুরুষগণ বরেন্দ্রভূমি অর্থাৎ রাজসাহী পরগণার কোনও স্থানে বাস করিতেন। সেখান হইতে বোধ হয় বিবাহ-সূত্রে কৃষ্ণনগরে আগমন করেন। ক্ষিতীশবংশাবলী-চরিত-লেখক দেওয়ান কার্ত্তিকেয় চন্দ্র রায় মহাশয় স্বলিখিত আত্ম-জীবনচরিতে লিখিয়াছেন —“ভবানন্দের প্রপৌত্র রাজা রুদ্রের সময় হইতে রুদ্রের পৌত্র রাজা রঘুরামের সময় পর্য্যন্ত আমার অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ ষষ্ঠীদাস চক্রবর্ত্তী ও তাঁহার পুত্র রাম রাম চক্রবর্ত্তী দেওয়ানী পদে নিযুক্ত ছিলেন, এইরূপ বোধ হয়। আমাদের কুলশাস্ত্রে যে যে স্থানে যষ্ঠীদাস চক্রবর্ত্তী ও রাম রাম চক্রবর্ত্তীর নামের উল্লেখ আছে, তাঁহারা দেওয়ান বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন।” অতএব দেখা যায় যে বহু পূর্ব্ব হইতে এই রায়বংশীয়গণ বহুপুরুষ ধরিয়া কৃষ্ণনগরের রাজসংসারে দেওয়ানী পদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। পদে, সম্ভ্রমে ও কুলমর্যাদাতে ইঁহারা বঙ্গদেশে বিখ্যাত হইয়াছেন। এমন কি ষষ্ঠীদাস চক্রবর্ত্তী বারেন্দ্র শ্রেণীর মধ্যে কুলীনের এক নূতন দল স্থাপন করেন; সে জন্য ইহাঁরা মতকর্ত্তার বংশ বলিয়া বারেন্দ্র দলের মধ্যে সন্মানিত। কুল-মর্য্যাদা-সম্পন্ন দেওয়ানগণ স্বীয় স্বীয় দুহিতার বিবাহ দিবার জন্য সময়ে সময়ে কৃষ্ণনগরের রাজাদিগের দ্বারা নাটোরের রাজাকে অনুরোধ করিয়া, তাঁহাদের সাহায্যে, বরেন্দ্রভূমি হইতে কুলীনদিগকে আনাইয়া নদীয়ার রাজধানীতে প্রতিষ্ঠিত করিতেন। অনুমান করি এইরূপে লাহিড়ী, খাঁ, সান্নাল প্রভৃতি প্রসিদ্ধ বারেন্দ্র শ্রেণীর কুলীন ব্রাহ্মণগণ কৃষ্ণনগরের সন্নিধানে আসিয়া বাস করিয়াছেন।

 লাহিড়ী বংশের পূর্ব্ব পুরুষদিগের মধ্যে কে সর্ব্বপ্রথমে দেওয়ানবংশে বিবাহ করিয়া নদীয়া জেলাতে আসিয়া বাস করিয়াছিলেন তাহা বলিতে পারি না। অনুসন্ধানে যতদূর জানিয়াছি তাহা এই, পূর্ব্বে এইবংশের পূর্বপুরুষগণ দেওয়ানদিগের সহিত মাটিয়ারিতে বাস করিতেন। সেখান হইতে কৃষ্ণনগরে আসেন। রামতনু বাবুর বৃদ্ধ প্রপিতামহ রামহরি লাহিড়ী কৃষ্ণনগরে আসিয়া স্থায়ীরূপে বাস করেন। রামহরির দুই পুত্র রামকিঙ্কর ও রামগোবিন্দ। রামকিঙ্কর বয়সে জ্যেষ্ঠ এবং বুদ্ধিমত্তা গুণে শ্রেষ্ঠ হওয়াতে রাজসরকারে মুন্সীর কাজ প্রাপ্ত হন। রামকিঙ্কর অপুৎত্রক, তিনি ক্ষেমঙ্কর নামে একজনকে দত্তক গ্রহণ করিয়াছিলেন। রামগোবিন্দের পঞ্চ পুৎত্র। কিঙ্কর উপার্জক ও অপুৎত্রক, গোবিন্দ বহু কুটুম্বভারে পীড়িত; এরূপ স্থলে হিন্দু একান্নভুক্ত পরিবারে সচরাচর যাহা ঘটিয়া থাকে, তাহাই ঘটিল। কিঙ্কর ও গোবিন্দকে পৃথক হইতে হইল। কিঙ্কর নিজ সহোদরের প্রকৃতি জানিতেন। তিনি অধিকাংশ বিষয় সম্পত্তি একদিকে ও শালগ্রাম শিলা এবং দেবসেবার্থ রক্ষিত সামান্য পৈতৃক ভূসম্পত্তি অপরদিকে রাখিয়া গোবিন্দকে যথা ইচ্ছা মনোনীত করিতে বলিলেন। গোবিন্দ শালগ্রাম শিলা লইয়া পৃথক হইলেন; এবং ঘোর দারিদ্র্যে বাস করিতে লাগিলেন। গোবিন্দ যে ধার্ম্মিকতাতে শ্রেষ্ট ও সর্ব্বজনপূজিত ছিলেন, তাহার অপর প্রমাণ আছে। কবিবর ভারতচন্দ্র তাঁহার প্রণীত অন্নদামঙ্গল গ্রন্থে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার যে বর্ণনা দিয়াছেন তন্মধ্যে রাজার পারিষদবর্গের মধ্যে উক্ত ভ্রাতৃদ্বয়ের উল্লেখ করিয়াছেন।

কিঙ্কর লাহিড়ী দ্বিজ মুন্সী প্রধান।
তার ভাই গোবিন্দ লাহিড়ী গুণবান॥

 কবিবর গোবিন্দের নাম উল্লেখ করিতে গিয়া তাঁহাকে গুণবান আখ্যা দিয়াছেন। ইহাতেই প্রমাণ তিনি সে সময়ে ধার্ম্মিকতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। গোবিন্দের পঞ্চ পুৎত্রের মধ্যে দ্বিতীয়ের নাম কাশীকান্ত। কাশীকান্ত কিছুকাল দিনাজপুরের রাজার অধীনে কর্ম্ম করিয়াছিলেন। তিনি অতি রাশভারি লোক ছিলেন। পরিবার পরিজন তাঁহার ভয়ে সর্ব্বদা ভীত থাকিত। পরিবারস্থ বালকগণ তাঁহার ভয়ে অসৎপথে পদার্পণ করিতে সাহসী হইত না। রামতনু লাহিড়ীর জ্যেষ্ঠ সহোদর কেশব চন্দ্র লাহিড়ী বালককালে পাঠে অনাবিষ্ট ছিলেন, সেজন্য পিতামহ কাশীকান্ত লাহিড়ী একদিন তাঁহাকে পদাঘাত করেন। কেশবচন্দ্র লাহিড়ী উত্তরকালে সর্ব্বদা বলিতেন যে সেই পদাঘাতে তাঁহার চেতনা করিয়া দিয়াছিল; তিনি তৎপরে পাঠে নিবিষ্ট হন। কাশীকান্তের দুই সংসার ও দুই পুৎত্র। প্রথম পুৎত্র ঠাকুরদাস লাহিড়ী কিছুকাল রাজা গিরীশচন্দ্রের অধীনে তাঁহার কার্য্যকারকের পদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন; এই সময়ে তিনি লাহিড়ী দেওয়ান নামে পরিচিত হন। তখন তিনি অধিকাংশ সময় কলিকাতাতে বাস করিয়া নদীয়ারাজের প্রতিনিধি স্বরূপ গবর্ণর-জেনেরালের লেভীতে যাওয়া প্রভৃতি সমুদয় রাজকার্য্য সমাধা করিতেন।

 কনিষ্ঠ রামকৃষ্ণ অতি ধর্ম্মপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি শেষ দশায় ধর্ম্মানুষ্ঠান লইয়াই ব্যস্ত থাকিতেন। যে পর্য্যন্ত দেহে বল ছিল স্বপাকে আহার করিতেন। মৃত্যুর কিছু কাল পূর্ব্ব হইতে এই নিয়ম করিয়াছিলেন যে প্রাতে উঠিয়া যে ব্রাহ্মণের মুখ দেখিতেন তাহাকে একটী সিকি দান করিতেন। সূর্য্যোদয়ের অগ্রে স্নানাদি সমাপন করিয়া জপ পূজা প্রভৃতিতে বহু সময় যাপন করিতেন। তৎপরে অত্যাবশ্যক গৃহকর্ম্ম ও অতিথি সৎকারাদিতে অনেক সময় ব্যয়িত হইত। অবশেষে প্রায় অপরাহ্ণ ৪টার সময়ে আহার করিতেন। শেষ দশায় একমাত্র বিধবা কন্যা ভবসুন্দরী পিতার সেবা শুশ্রূষা ও ধর্ম্মানুষ্ঠানের সহায়তা করিতেন।

 রামকৃষ্ণের আট পুত্র ও দুই কন্যা জন্মে। পুৎত্রদিগের মধ্যে জ্যেষ্ঠ কেশবচন্দ্র কৃতী হইয়া বিষয় কার্য্যে লিপ্ত হন। ইনি পারস্য় ও ইংরাজী ভাষায় শিক্ষিত হইয়া প্রথমে কলিকাতার সন্নিকটবর্ত্তী আলিপুরে কেরাণীর পদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তৎপরে যশোহরের জজের হেডক্লার্ক বা সেরেস্তাদারের পদে উন্নীত হন। ইঁহাকে ধার্ম্মিক হিন্দু গৃহস্থের আদর্শ বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। ইনি ধর্ম্ম পথে থাকিয়া যে কিছু উপার্জ্জন করিতেন তাহা বৃদ্ধ পিতা মাতার সেবায় ও ভ্রাতা ও ভগিনীগণের পালনে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। রামতনু বাবুর মুখে শুনিয়াছি তাঁহার জ্যেষ্ঠের পিতৃমাতৃ-ভক্তি অপরিসীম ছিল। কৃষ্ণনগর হইতে পিতার পত্র আসিলে, তিনি, তাহা অগ্রে ভক্তিভরে মস্তকে ধারণ করিতেন, তৎপরে খুলিয়া পাঠ করিতেন। কেবল তাহা নহে, কৃষ্ণনগরে লাহিড়ী পরিবারে একথা প্রচলিত আছে যে তিনি মধ্যে মধ্যে বাড়ীতে গিয়া স্বীয় জননীকে দেবপূজার কাষ্ঠাসনে বসাইয়া তাম্রকুণ্ডে তাঁহার পদদ্বয় স্থাপন-পূর্ব্বক পুষ্প চন্দনদ্বারা পূজা করিতেন। তাঁহার ধর্ম্মপরায়ণা মাতা নাকি দেবার্চ্চনার জন্য ব্যবহৃত তাম্রকুণ্ডে পা রাখিতে চাহিতেন না। পুৎত্র বলপূর্ব্বক পদদ্বয় তাহাতে সন্নিবেশিত করিলে, তিনি ভয়ে কাঁপিতেন, এবং বলিতেন—“কেশব! কেশব! কর কি, আমার যে গা কাঁপচে”। কেশব বলিতেন—“রাখ রাখ, তুমিই আমার আরাধ্য দেবতা”। এমন পিতার পুৎত্র ও এমন জ্যেষ্ঠের কনিষ্ঠ যিনি তাঁহাতে আমরা যে প্রকার সাধুভক্তি দেখিয়াছিলাম তাহা কিছুই বিচিত্র নহে।

 রামতনু বাবু রামকৃষ্ণের পঞ্চম পুৎত্র ও সপ্তম সন্তান। তাঁহার অগ্রে কেশবচন্দ্র ভিন্ন আর তিন সহোদর ও দুই সহোদরা জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহাদের সকলেই অল্প বয়সে গত হইয়া কেবল কেশবচন্দ্র ও ভবসুন্দরী থাকেন। রামতনু বাবুর পরে আর তিন সহোদর জন্মেন। তাঁহাদের নাম রাধাবিলাস, শ্রীপ্রসাদ ও কালীচরণ। রাধাবিলাস কলেজ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া যশোহরে স্বীয় জ্যেষ্ঠের সাহায্য করিতে যান। সেখানে ম্যালেরিয়া জ্বরে দুই ভ্রাতার মৃত্যু হয়। কালীচরণ বাবু কলিকাতা মেডিকেল কলেজে শিক্ষালাভ করিয়া চিকিৎসক হইয়া বাহির হন; এবং কয়েক বৎসর পূর্ব্ব পর্য্যন্ত কৃষ্ণনগরে ডাক্তারি করিতেন। তাঁহার বাল্যকালের বিষয়ে দেওয়ান কার্ত্তিকেয় চন্দ্র রায় স্বলিখিত আত্ম-জীবন-চরিতে এই প্রকার বর্ণন করিয়াছেন;—“কালীচরণও আমাকে যার পর নাই ভাল বাসিতেন। তিনি কলিকাতা হইতে আমার প্রয়োজনীয় পুস্তক সকল আনিয়া দিতেন; এবং বাটীতে অবস্থান কালে আমার পাঠের বিষয়ে বহু আনুকুল্য করিতেন। * * * * কালীচরণ বড় খোস-পোষাকী ছিলেন। তিনি মেডিকেল কালেজে যে ছাত্রবৃত্তি পাইতেন, তাহাতে উত্তম উত্তম ধুতি উড়ানী ও বিনামা ক্রয় করিতেন। যখন বাটী আসিতেন তখন ইহার কোন দ্রব্য আমাকে জেদ করিয়া দিতেন; আর কহিতেন “ছোড়্ দাদা, এসকল দ্রব্য তোমার অঙ্গে যেমন ভাল দেখায় তেমন আমার অঙ্গে দেখায় না।”

 বাল্যে কালীচরণ বাবুর যে সহৃদয়তা দৃষ্ট হইয়াছিল, তাহা চিরজীবন তাঁহাকে পরিত্যাগ করে নাই। উত্তরকালে তিনি যখন কৃষ্ণনগরের সর্ব্বপ্রধান চিকিৎসকরূপে বিরাজ করিতেছিলেন, তখন তাঁহার মধুর ব্যবহার, সুমিষ্ট ভাষা, ও দীনে দয়া দেখিয়া সকলেরই চিত্ত বিশেষরূপে আকৃষ্ট হইয়াছিল। তাঁহার মুখ দেখিলেই রোগীর অর্দ্ধেক রোগ পলাইয়া যাইত। তিনি দীন দরিদ্রদিগকে বিনা ভিজিটে দেখিতেন; এবং অনেক সময়ে নিজ ঔষধালয়
ডাঃ কালীচরণ লাহিড়ী।
হইতে বিনামূল্যে ঔষধ যোগাইতেন। এ সম্বন্ধে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। তন্মধ্যে একটী এই,—একবার তাঁহার নিজ ঔষধালয়ে তাঁহার স্বাক্ষরিত একখানি ব্যবস্থা-পত্র আসিল। দেখা গেল ঔষধের ব্যবস্থা লিখিয়া, সর্ব্বশেষে লিখিয়াছেন, ‘একগাড়ি খড়’; অর্থাৎ ঔষধের সঙ্গে একগাড়ি খড় পাঠাইতে হইবে। এই ব্যবস্থা লইয়া অনেক হাসাহাসি হইল। কেহই ইহার কারণ নির্ণয় করিতে পারিল না। অবশেষে কালীবাবু ফিরিয়া আসিলে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বলিলেন, “চিকিৎসা করিতে গিয়া দেখিলাম রোগীর ঘরের চালে খড় নাই; এই হিমের দিনে যদি সমস্ত রাত্রি হিম লাগে তবে আর আমার চিকিৎসা করিয়া ও ঔষধ দিয়া ফল কি? তাই ভাবিলাম ঔষধের সঙ্গে একগাড়ি খড় পাঠান যাক্।” যে সহৃদয়তাতে এতদূর করিতে পারে তাহাতে যে কালীবাবুকে সর্ব্বজনপ্রিয় করিয়াছিল, তাহাতে আশ্চর্য্য কি? তাঁহাকে দেখিলে আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই প্রীত হইতেন। তিনি চিকিৎসার্থ আহূত হইয়া কোনও গৃহস্থের গৃহে পদার্পণ করিবামাত্র বালকবালিকাদিগের মধ্যে আনন্দধবনি উত্থিত হইত। ইহারই উল্লেখ করিয়া স্বৰ্গীয় দীনবন্ধু মিত্র মহাশয় তাঁহার প্রণীত “সুরধুনী কাব্যে” বলিয়াছেন;—

“কোমল স্বভাব তাঁর মধুর বচন,
ছেলেরা আনন্দে নাচে পেলে দরশন;
ছেলেদের কালীবাবু, ছেলেরা কালীর,
উভয়েতে মিশে যায় যেন নীরে ক্ষীর।”

 রাধাবিলাসি ও শ্রীপ্রসাদ রামতনু বাবুর ন্যায় মহাত্মা ডেবিড হেয়ারের প্রতিষ্ঠিত স্কুলে শিক্ষালাভ করেন। শ্রীপ্রসাদও বিদ্যাশিক্ষা বিষয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে জ্ঞানালোক লাভ করিয়া পরিতৃপ্ত থাকিতে পারেন নাই। দেশের বালকদিগকে ইংরাজী শিক্ষা দিবার জন্য স্বীয় বাসভবনে একটী ইংরাজী বিদ্যালয় স্থাপন করিয়া স্বয়ং শিক্ষকতা কার্য্যে প্রবৃত্ত হন। এ সম্বন্ধে ক্ষিতীশবংশাবলী-চরিত-লেখক নিম্নলিখিত বিবরণ দিয়াছেন;—“১২৪৩ কি ৪৪ রাঃ অব্দে কৃষ্ণনগর-নিবাসী দেশ-হিতৈষী শ্রীযুক্ত শ্রীপ্রসাদ লাহিড়ী নিজ নিকেতনে এক অবৈতনিক ইংরাজী বিদ্যালয় স্থাপন করেন! * * * তিনি আন্তরিক যত্ন ও পরিশ্রমপূর্ব্বক অধ্যাপন করিতেন এবং দরিদ্র ছাত্রগণকে পাঠ্যপুস্তক ও কাগজ কলম দিতেন। এই সকল কারণে অনতিকাল মধ্যে তাঁহার বিদ্যালয়ে অনেক বালক পড়িতে লাগিল।”

  শ্রীপ্রসাদ যৌবনের প্রারম্ভে যে পরোপকার-প্রবৃত্তির পরিচয় দিয়াছিলেন, উত্তরকালেও তাহা প্রচুর পরিমাণে তাঁহার চরিত্রে প্রকাশ পাইয়াছিল। তিনি ইংরাজী, সংস্কৃত ও পারসী ভাষাতে বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন; এবং সেজন্য কৃষ্ণনগরের জজের শেরেস্তাদারের পদ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এরূপ শুনিয়াছি যে কার্য্যদক্ষতার গুণে পরিশেষে ডেপুটী কালেক্টরের পদে উন্নীত হন, কিন্তু সে পদ ভোগ করিতে পারেন নাই; তৎপূর্ব্বেই ভবধাম পরিত্যাগ করেন। যখন তিনি শেরেস্তাদারী পদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, তখন তাঁহার বেতন ৮০ টাকা মাত্র ছিল। তিনি মনে করিলে অবৈধ উপায়ে প্রভূত সম্পত্তি সঞ্চয় করিয়া রাখিয়া যাইতে পারিতেন। কিন্তু যে ধর্ম্মভীরুতা এই লাহিড়ীবংশের একটা প্রধান লক্ষণ দেখিতেছি, তাহা তাঁহাতেও প্রচুর মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। সুতরাং সে সকল পথে কখনও পদার্পণ করেন নাই। প্রত্যুত এই ৮০ টাকা বেতন হইতে যথাসাধ্য গরীব দুঃখীর সাহায্য করিতেন। পূজার সময়ে এদেশের লোক কয়েকদিনের জন্য জগতের দুঃখ শোক ভুলিয়া, নববস্ত্র পরিধান করিয়া, উৎসবানন্দে আপনাদিগকে নিক্ষেপ করিয়া থাকে; গরীবের গরীব যে তাহারও প্রাণে এই সময়ে নববস্ত্র পরিবার সাধ হয়। শ্রীপ্রসাদের কোমল ও পরদুঃখকাতর হৃদয় কথঞ্চিৎ পরিমাণে গরীবদের সেই সাধ পূরণ করিবার জন্য ব্যগ্র হইত। তিনি পূজার সময়ে গরীব দুঃখীদের মধ্যে নববস্ত্র বিতরণ করিবার নিয়ম করিয়াছিলেন। তদ্ভিন্ন, সময়ে অসময়ে দীন জনের দুঃখ দেখিলেই তাঁহার দক্ষিণ হস্ত উন্মুক্ত হইত। তিনি গোপনে অনেক দান করতেন। আমি বিশ্বস্ত ব্যক্তির মুখে শুনিয়াছি, একবার তিনি একজন বিপন্ন আত্মীয়ের সাহায্যার্থ নিজ বেতনের অর্দ্ধেক দিয়া তাঁহাকে বলিয়া দিলেন, “কাহাকেও বলিও না।” ইহা কৃষ্ণনগরের লাহিড়ী বংশেরই অনুরূপ কার্য্য।

 এতক্ষণ গুণধাম গোবিন্দ লাহিড়ী, মহাশয়ের পঞ্চ পুত্রের মধ্যে মধ্যম পুত্র কাশীকান্ত লাহিড়ীর শাখাস্থ ব্যক্তিগণের গুণাবলীরই কথা বলিতেছি। এতদ্ব্যতীত তাঁহার আর চারিটী পুত্র ছিল। তন্মধ্যে জ্যেষ্ঠ কৃষ্ণকান্ত বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হইয়া পূর্ব্ববঙ্গে ময়মনসিংহ জেলাতে গিয়া বাস করেন। তাঁহার শাখা এখনও সেখানে বিদ্যমান আছে। তাঁহাদের বিষয়ে বিশেষ কিছু জানি না। চতুর্থ পুত্র কালীকান্ত অপুত্রক গত হন। তৃতীয় গৌরীকান্ত ও পঞ্চম শম্ভুকান্ত, ইঁহাদের শাখাদ্বয় কৃষ্ণনগরের সন্নিহিত দৌলিয়া ও বাগানবাড়ী নামক স্থানদ্বয়ে অবস্থিত হইয়াছেন। কাশীকান্তের শাখা কৃষ্ণনগর কদমতলাতে বাস করেন। এই জন্য তাঁহারা কদমতলার লাহিড়ী-পরিবার নামে অভিহিত; এবং অপরেরা দৌলিয়া ও বাগানের লাহিড়ী—পরিবার নামে আখ্যাত। গুণধাম গোবিন্দ লাহিড়ীর গুণাবলীর নিদর্শন অপর শাখাদ্বয়েও প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। তাঁহাদের অনেকের কথা উল্লেখ করিবার প্রয়োজন নাই। এক জনের বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করিলেই যথেষ্ট হইবে। ইঁহাতে লাহিড়ী বংশের ধর্ম্ম-প্রবণতা আর এক আকারে ফুটিয়াছিল। ইঁহার নাম দ্বারকানাথ লাহিড়ী। ইঁহার জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই:—

 অনুমান ১৮২৭ কি ১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দে দ্বারকানাথ জন্ম হয়। ইনি বাগানের শম্ভুকান্ত লাহিড়ীর পৌত্র ও নীলমণি লাহিড়ীর পুত্র। শৈশবেই ইনি পিতৃহীন হইয়া জননীর সহিত মাতুলালয়ে বাস করিতে থাকেন। পঞ্চদশ বৎসর পর্য্যন্ত বোধ হয় শ্রীপ্রসাদ লাহিড়ীর প্রতিষ্ঠিত স্কুলে সামান্যরূপ বাঙ্গালা ও ইংরাজী শিক্ষা করিয়া থাকিবেন। পঞ্চদশ বৎসর বয়ঃক্রম কালে এরূপ কোন ঘটনা ঘটে, যাহাতে ইঁহার জননী দারুণ মনঃপীড়া প্রাপ্ত হন। জননীর দুঃখ দেখিয়া সেই পঞ্চদশবর্ষীয় বালক এই প্রতিজ্ঞা করিয়া মাতুলালয় হইতে বহির্গত হন, যে নিজে উপার্জ্জন-ক্ষম হইয়া মাতার দুঃখ দূর করিতে না পারিলে আর আত্মীয় স্বজনকে মুখ দেখাইবেন না; বা কাহাকেও নিজের সংবাদ দিবেন না। এই প্রতিজ্ঞা করিয়া কয়েক আনা পয়সা মাত্র পথের সম্বল লইয়া পদব্রজে দুই তিন মাস হাঁটিয়া আগরাতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে একজন শান্তিপুর-নিবাসী বাঙ্গালী ভদ্রলোক তাঁহার প্রতি কৃপা-পরবশ হইয়া তাঁহাকে স্বীয় ভবনে আশ্রয় দেন; এবং তাঁহার বিদ্যাশিক্ষার বন্দোবস্ত করিয়া দেন। কয়েক বৎসরের মধ্যেই দ্বারকানাথ ইংরাজী বিদ্যাতে পারদর্শী হইয়া সর্ব্বশ্রেষ্ঠ রৌপ্য ও স্বর্ণপদক পারিতোষিক পাইলেন; এবং কালেজ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া আগরাতেই একটা উচ্চ বেতনের কর্ম্ম পাইলেন। প্রথম বেতন পাইয়াই জননীকে পত্র লিখিলেন; এবং তাঁহার যাইবার জন্য পাথেয় পাঠাইলেন। ভগ্নহৃদয়া মাতা বহুকাল পরে নিরুদ্দেশ সন্তানের পত্র ও তাঁহার প্রেরিত অর্থ পাইয়া কতই ক্রন্দন করিলেন। ক্রমে জননী আগরাতে উপস্থিত হইলেন। সেখানে দ্বারকানাথ মাতৃসেবা ও গৃহধর্ম্মে প্রবৃত্ত হইলেন। যথাসময়ে তাঁহার দুইটী কন্যাসন্তান জন্মিল। দ্বারকানাথ যখন বিষয় কর্ম্মে ব্যাপৃত ছিলেন, তখন ধর্ম্ম বিষয়ে সর্ব্বদা চিন্তা করিতেন; এবং ধর্ম্মতত্ত্ব নির্ণয়ের জন্য নানা শাস্ত্র অধ্যয়ন করিতেন। এই সময়ে একজন উপরিতন কর্ম্মচারীর সংশ্রবে আসিয়া তাঁহার খৃষ্টীয় ধর্ম্মের প্রতি আস্থা জন্মিল; এবং তিনি প্রকাশ্যভাবে উক্ত ধর্ম্মে দীক্ষিত হইলেন। ইহার পর যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন, তাঁহার আরাধ্যা জননী দেবীর প্রতিকূলতাবশতঃ তাঁহার জীবন ঘোর নির্য্যাতনময় হইয়াছিল। তাঁহার কনিষ্ঠা কন্যা সেই নির্য্যাতনের ও স্বীয় পিতার অপরাজিত ধৈর্য্যের যে বিবরণ দিয়াছেন তাহার কিয়দংশ নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছি।

 “জননীর বিশ্বাস ছিল বাইবেল প্রভৃতি ধর্ম্মশাস্ত্র পোড়াইয়া দিলে, উপাসনা কালে ব্যাঘাত জন্মাইলে, মত বিপর্য্যয় ঘটিবার সম্ভাবনা; এবং এই ভ্রমবশতঃ যতদূর সম্ভব পুত্রের ধর্ম্মসাধনায় বাধা জন্মাইতে অবহেলা করিতেন না। কত যে ধর্ম্মশাস্ত্র প্রভৃতি দগ্ধ করিয়াছেন তাহা কি বলিব! কতবার বাইবেল লুকাইয়া রাখিতেন। আর প্রায় এমন দিন যাইত না, যাহাতে মাতার দুর্ব্যবহারে ও কঠোর পীড়নে সন্তান কষ্ট না পাইতেন। মাতা যতদিন জীবিত ছিলেন ক্রমাগত বলিতেন—“এমন ছেলে বিধর্ম্মী এ কি প্রাণে সয়?” বহুকালব্যাপী এই ঘোর নির্য্যাতনেও সে প্রকৃতি কখনও চঞ্চল হয় নাই; ধর্ম্মবিশ্বাস বিন্দুমাত্রও বিচলিত হয় নাই; এবং একদিনের জন্যও কেহ কখনও মাতার প্রতি তাঁহাকে অসম্মান বা অশ্রদ্ধা প্রকাশ করিতে দেখে নাই। সেই সদানন্দ শান্তমূর্ত্তি সব প্রতিকুল অবস্থায় সমান ধীর থাকিত। তিরস্কার উৎপীড়ন অম্লানভাবে অটল ধৈর্য্যের সহিত বহন করিয়াছেন। এমন গভীর মাতৃভক্তির দৃষ্টান্ত অতি বিরল! উপার্জ্জনের সমুদয় টাকাই মাতার হস্তে দিতেন। মাতা হাতে তুলে যা দিতেন তাতে কখনও দ্বিরুক্তি ছিল না। খৃষ্টের ত্যাগস্বীকার, স্বর্গীয় অতুলন ধৈর্য্য, ক্ষমাশীলতা, তিনি জীবনের প্রতি কার্য্যে, তাঁহার প্রভুর আদর্শ যেন প্রতিফলিত করার জন্যই তদীয় শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন! এমন খ্রীষ্টগত জীবন জগতে দুর্লভ! রবিবারগুলি তাঁহার জীবনের যেন আরও পরীক্ষা ও কষ্টের দিন ছিল। রবিবার যে খ্রীষ্টশিষ্যের কি সাধনার দিন তাহা তাঁহার জীবনে সুস্পষ্ট দেখেছি। বিশেষ আহারাদি সে দিন হইত না; কেবল নির্জ্জনে বসে শাস্ত্র পাঠে ও প্রার্থনাদিতে সময় যাপিত হইত। আর মাতাও সে দিন যেন অধিক বিষাদে, মনঃক্ষোভে, তিরস্কার পীড়নে, সন্তানের সংশোধন করিবেন ভেবে সকল প্রকার কষ্ট দিতেন; নানা প্রকারে সাধনার ব্যাঘাত জন্মাইতেন। কিন্তু তিনি সকলই অবিচলিত ভাবে বহন করে ক্লেশজনিত বিষাদের মৃদু হাসিতে কেবল বলিতেন—“মা আমার শাস্ত্রে কি আছে জানিলে তুমি কখনও এমন করিতে না।” * * * পুত্রের প্রতি এই কঠোর ব্যবহার যে দেখিত সেই অবাক্ হইত। সকলেই বলাবলি করিত—“এত ধৈর্য্য কোথায় পাইল, যাতে নিয়ত মার এত অন্যায় এমন করে সয়ে থাকে।”

 যে পরিবারে এরূপ পিতার স্মৃতি থাকে সে পরিবার ধন্য! যে বংশের লোকে মাতার পদ্বদয় তাম্রকুণ্ডে স্থাপন পূর্ব্বক পূজা করিতে পারে, সে বংশের পক্ষে এই মাতৃভক্তি আর আশ্চর্য্যের বিষয় কি? এই চরিত্রের গুণেই, ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের সময়, সিপাহীগণ যখন আগরানগর আক্রমণ করে, এবং প্রত্যেক ইংরাজ ও প্রত্যেক দেশীয় খ্রীষ্টানকে হত্যা করিতে প্রবৃত্ত হয়, তখন তৎপ্রদেশীয় হিন্দুগণই তাঁহাকে লুকাইয়া রাখিয়া তাঁহার প্রাণরক্ষা করিয়াছিল। এই চরিত্র দেখিয়াই সুরাপান-নিবারিণী সভার সুপরিচিত বক্তা রেভারেণ্ড ইভান্স (Rev. Evans)—যিনি ১৮৫৭ সালে ৮ মাস কাল দ্বারকানাথের সহিত আগরার কেল্লাতে বন্দী ছিলেন—বলিয়াছিলেন;—‘Meek as a lamb, humble as a baby, true as steel’—অর্থাৎ তিনি নিরীহতাতে মেষশাবক, বিনয়ে শিশু, ও সত্যনিষ্ঠাতে ইস্পাত স্বরূপ ছিলেন। এই চরিত্রের গুণে মুগ্ধ হইয়াই ভক্তিভাজন রামতনু লাহিড়ী মহাশয় আমাকে একবার বলিয়াছিলেন —“বয়সে সে আমার কনিষ্ঠ ভাই ছিল, কিন্তু চরিত্রগুণে আমার পিতৃস্থানীয়!”

 দুঃখের বিষয় দ্বারকানাথের জীবন অকালেই বিলীন হইয়াছিল। ১৮৬৪ সালের অক্টোবর মাসে তিনি ইহলোক পরিত্যাগ করেন।

 এইরূপে দেখা যাইতেছে এই লাহিড়ী বংশীয় ব্যক্তিগণের অনেকেই সহৃদয়, সদাশয়, ধর্ম্ম-পরায়ণ, পরোপকারী ও সত্যনিষ্ঠ লোক ছিলেন। এরূপ কুলে এরূপ গৃহে জন্মগ্রহণ করিয়া যে রামতনু লাহিড়ী মহাশয় চরিত্রগুণে সর্ব্বজনপূজিত হইবেন তাহাতে আর আশ্চর্য্যর বিষয় কি? যে সাধুতা গুণধাম গোবিন্দ লাহিড়ী হইতে নামিয়া আসিয়াছিল এবং যাহা ধর্ম্ম-পরায়ণ রামকৃষ্ণে উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ পাইয়াছিল, তাহাই এই বংশের ব্যক্তিগণকে বিভূষিত করিয়াছিল। এখনও এই লাহিড়ী পরিবারস্থ ব্যক্তিগণ কৃষ্ণনগরে মান সম্ভ্রমে অগ্রগণ্য হইয়া বাস করিতেছেন। ইহাঁদের অনেকে বিষয় কর্ম্ম উপলক্ষে দেশের নানাস্থানে বিক্ষিপ্ত হইয়া রহিয়াছেন। কিন্তু যিনি যেখানে গিয়াছেন, প্রায় সকলেই সাধুতা, সত্য-নিষ্ঠা, এবং পরোপকারাদি গুণে প্রতিবেশিবর্গের শ্রদ্ধা ভক্তি আকর্ষণ করিয়াছেন।