রূপসী বোম্বেটে/দ্বিতীয় খণ্ড/প্রথম পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় খণ্ড

প্রথম পরিচ্ছেদ


দিগন্তব্যাপী মেঘান্ধকার-সমাচ্ছন্ন নিশায় অবিশ্রান্ত বৃষ্টির মধ্যে আততায়ী কর্ত্তক আক্রান্ত হইয়া প্যা্ট্রিক স্মিথ ডেকের উপর হইতে যখন সমুদ্রবক্ষে নিক্ষিপ্ত হয়,—সেই সময় সে রেলিং-সংরক্ষিত একটি ‘লাইফ-বেণ্ট’ টানিয়া লইয়াছিল। সেই ‘লাইফ-বেণ্ট’টি হাতে লইয়াই সে আটলাণ্টিক মহাসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ-ভঙ্গীয় ফেনোর্ম্মি-মুখর অন্ধকার বক্ষে নিপতিত হইল!—সে সময় তাহার বাহ্যজ্ঞান বিলুপ্তপ্রায়।

 সমুদ্রে পড়িয়া চেতনা সঞ্চার হইলে, মুহূর্ত্তে মধ্যে সে তাহার সে উভয় হস্তে লাইফ, শোচনীয় অবস্থা হৃদয়ঙ্গম করিতে সমর্থ হইল, বেণ্টটি আঁকড়িয়া ধরিয়া তাহার ভিতর মাথা পুরিয়া দিল, এবং তাহার চক্রের উপর উভয় বাহু সংস্থাপিত করিয়া সমুদ্রে ভাসিতে লাগিল।—দুই একবার হাবুডুবু খাইলেও লাইফ-বেল্টের উপর নির্ভর করায় স্মিথকে আর ডুবিতে হইল, না; সে স্তম্ভিত হৃদয়ে ভীতিবিস্ফারিত নেত্রে চারি দিকে চাহিয়া দেখিল। উর্দ্ধে মেঘমণ্ডিত অন্ধকার আকাশ, চতুর্দ্দিকে উত্তাল তরঙ্গসঙ্কুল আট্‌লাণ্টিক মহাসমুদ্রের সীমাহীন বারিরাশি, পদতলে অতলস্পর্শ সমুদ্র-গর্ভ! তখনও অশ্রান্ত বেগে বৃষ্টি পতিত হইতেছিল; আকাশে মেঘের কোলে বিদ্যুতের নীলাভ লোল জিহ্বা! সেই সুতীব্র বিদ্যুৎ-শিখায় তাহার চক্ষু ধাঁধিয়া গেল; কড় কড় বজ্রধ্বনিতে তাহার কর্ণ বধির হইল।  স্মিথ আবার চক্ষু মেলিয়া সম্মুখে চাহিল; দেখিল ‘ওরিনকো’ জাহাজের আলোক ক্রমে দিক্-চক্রবাল রেখায় মিলাইয়া যাইতেছে। মুহূর্ত্তের জন্য সে তাহা দেখিতে পাইল; কিন্তু বৃষ্টির ধারা-প্রাচুর্য্যে তাহার দৃষ্টি অবরুদ্ধ হইল। পুনর্ব্বার চক্ষু মেলিয়া আর সে জাহাজের আলোক দেখিতে পাইল না; দেখিল, অন্ধকার—জগদ্ব্যাপ: অনন্ত অন্ধকার তাহাকে গ্রাস করিতে উদ্যত! ভয়ে সে পুনর্ব্বার চক্ষু মুদিল;—হৃদয়েও নিরাশার বিরাট গাঢ় অন্ধকার; স্তিমিত জীবনদীপ নির্ব্বাপিত-প্রায়!

 স্মিথ সেই বেল্টের উপর ভাসিতে ভাসিতে ক্ষীণ স্বরে বলিল, “এবার বুঝি প্রাণ বাঁচে না! এমন বিপদে ত কখন পড়ি নাই। শয়তান যে ধর্ম্মাত্মা পাদরীর পোষাক পরিয়া আমার স্কন্ধে ভর করিবে, আমাকে সমুদ্রে ডুবাইয়া মারিবে, ইহা কে মনে করিয়াছিল? প্রভু আমাকে খুব সাবধানে থাকিতে বলিয়াছিলেন। নিজের দোষেই এই বিপদে পড়িলাম! কোন দিকে ত কোনও জাহাজ দেখিতেছি; কতক্ষণ এ ভাবে ভাসিব?—আমার আর উদ্ধারের আশা নাই। কিন্তু এ বয়সে কাহার মরিতে ইচ্ছা হয়? অদৃষ্টে কি এই ছিল? শেষে সমুদ্রে পড়িয়া প্রাণ হারাইতে হইল!”

 স্মিথ সমুদ্র-তরঙ্গে উৎক্ষিপ্ত হইয়া অকুলে ভাসিয়া চলিল। কোন্ দিকে সে যাইতেছে, তাহা সে জানে না; কতক্ষণ সে জলে ভাসিল, তাহাও সে বুঝিতে পারিল না। ক্রমে শীতে তাহার হাত পা আড়ষ্ট হইয়া গেল, দাতে দাঁতে বধিতে লাগিল। বৃষ্টি ধরিলে সে কিছু দূরে একটি উজ্জ্বল আলোক দেখিতে পাইল। তাহার বোধ হইল, উহা কোনও জাহাজের আলোক।—জাহাজখানি কত দূরে আছে, তাহা সে বুঝিতে পারিল না; কিন্তু আলোক দেখিয়া। তাহার হৃদয়ে ক্ষীণ আশার সঞ্চার হইল। সে যথাসাধ্য চীৎকার। করিয়া জাহাজের লোকজনকে ডাকিতে লাগিল। কিন্তু তাহার বিদীর্ণ কণ্ঠের আর্ত্তনাদ জাহাজস্থ কোনও লোকের কর্ণগোচর হইল না। কেবল সেই জাহাজের ডেকে উপবিষ্ট ‘টাইগার’ বহু দূরে থাকিয়াও সেই স্বরের আভাস পাইয়াছিল; তাই সে সমুদ্রের দিকে চাহিয়া কাতর। স্বরে চীৎকার করিতেছিল, এবং স্মিথের কণ্ঠস্বরের প্রতি মিঃ ব্লেকের দৃষ্টি আকৃষ্ট করিবার চেষ্টা করিতেছিল।—উহাই মিঃ ব্লেকের জাহাজ ‘কর্সেয়ার। কর্সেয়ার’ দ্রুতবেগে তাহার গন্তব্য পথে চলিয়া গেল; আলোক অদৃশ্য হইল।—স্মিথের হৃদয় আবার নিরাশার, অন্ধকারে নিমজ্জিত হইল।

 এই ভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়া গেল। ক্রমে পূর্ব্বাকাশ পরিষ্কার হইল; সমুদ্রবক্ষে উষালোক প্রতিবিম্বিত হইল। স্মিথের আর হাত পা নাড়িবার শক্তি রহিল না, সে চতুর্দ্দিকে ধূমময় দেখিতে লাগিল; সেই অবস্থায় তাহার বোধ হইল, দুরে একখানি জাহাজ পাল তুলিয়া মুক্তপক্ষ বিহঙ্গের ন্যায় সেই দিকে অগ্রসর হইতেছে। সে পুনর্ব্বার ভগ্নস্বরে সাহায্য প্রার্থনা করিল; কিন্তু তাহার কণ্ঠরোধ হইয়া আসিয়াছিল, তাহার বিদীর্ণ কণ্ঠের আর্ত্তনাদ দূরবর্ত্তী জাহাজে পহুছিল না। সে নিতান্ত নির্জ্জীব হইয়া পড়িয়াছিল, কয়েক ঢোক লোনা জল উদরস্থ হওয়ায় সে অত্যন্ত যন্ত্রণা অনুভব করিল; তাহার শ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিল; শেষে তাহার সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইল। অরুণকিরণে পূর্ব্ব গগন সুরঞ্জিত হইবার পূর্বেই তাহার অসাড় দেহ তরঙ্গাভিঘাতে সমুদ্রের নীল জলে ভাসিয়া চলিল।—তাহার দেহের সমস্ত ভার ‘লাইফ-বেল্টের’ উপর না পড়িলে হয় ততক্ষণ সে আটলাণ্টিকের অতলস্পর্শ গর্ভে অদৃশ্য হইত।—স্মিথের স্বর্ণাভ কেশদামে, পাণ্ডুর মুখে ও মুদিত নেত্রে প্রভাতারুণের হিরন্ময় কিরণ প্রতিবিম্বিত হইতে লাগিল।

   *   *   *   *   

 ‘আনাবেল’ নামক সুবৃহৎ “সদাগরী জাহাজের কাপ্তেন মাষ্টার্শ প্রাচীন ও বহুদর্শী কাপ্তেন। পূর্ব্বে তিনি প্যাসেঞ্জার ষ্টীমারে কাপ্তেনী করিতেন; কিন্তু তাঁহার পরিচালিত একখানি প্যাসেঞ্জার জাহাজ সমুদ্রে ডুবিয়া যাওয়ায় কর্তৃপক্ষ তাহাকেই দোষী করেন। জাহাজের আরোহী ও নাবিকগণ সকলেই রক্ষা পাইয়াছিল বটে, কিন্তু জাহাজডুবি হওয়ায় কোম্পানীর অত্যন্ত ক্ষতি হইয়াছিল। কাপ্তেন মাষ্টার্শের কোনও দোষ না থাকিলেও, কর্তৃপক্ষের বিচারে তিনি পদচ্যুত হইলেন। তিনি নানা প্রমাণ প্রয়োগে নিজের নির্দ্দোষিতা প্রতিপন্ন করিলে, এক বৎসর পরে তাঁহাকে এই সদাগরী জাহাজের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত করা হয়। সেই সময় হইতে তিনি ‘আনাবেলে’র কাপ্তেনী করিতেছেন।

 স্মিথ যে সময় সংজ্ঞাহীন ভাবে সমুদ্রে ভাসিয়া যাইতেছিল, সেই সময় ‘আনাবেল্‌’ মাল লইয়া আমেরিকার দিকে অগ্রসর হইয়াছিল; অতি প্রত্যুফে কাপ্তেন ডেকের উপর বেড়াইতে বেড়াইতে দেখিলেন, কিয়দ্দূরে সমুদ্র-তরঙ্গে কি একটা ভাসিয়া যাইতেছে!-তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেই দিকে চাহিলেন, মানুষ নহে ত? -ঠিক বুঝিতে না পারিয়া তিনি দূরবীক্ষণের সাহায্য গ্রহণ করিলেন। দূরবীণ দিয়া দেখিলেন, একটি মানুষ সমুদ্রে ভাসিয়া যাইতেছে!—নিকটে বা দূরে কোনও জাহাজের চিহ্ন নাই, এখানে মানুষ কোথা হইতে আসিল? পূর্ব্ব-রাত্রে ঝড় বৃষ্টির সময় কোনও জাহাজ ডুবিয়াছে কি না তাহাও বুঝিতে পারিলেন না। কিন্তু ভাসমান মনুষ্যটি জীবিত কি মৃত। দেখিবার জন্য তাঁহার আগ্রহ হইল। যদি এখনও তাহার দেহে প্রাণ থাকে, তাহা হইলে তাহার প্রাণরক্ষা করা একান্ত কর্ত্তব্য স্থির করিয়া কাপ্তেন জাহাজ থামাইবার আদেশ দিলেন। জাহাজ থামিলে কয়েক জন নাবিককে ‘জলি বোটে’ সমুদ্রে নামাইয়া দেওয়া হইল।

 প্রায় এক ঘণ্টা পরে নাবিকেরা স্মিথের নিস্পন্দ দেহ ‘জলি বোটে’ তুলিয়া জাহাজে প্রত্যাগমন করিল।

 কাপ্তেন মাষ্টার্শ দেখিলেন, যুবকের চেতনা নাই, প্রাণ আছে। কি না সন্দেহ! তিনি আর মুহুর্ত্ত কাল নষ্ট না করিয়া সহযোগী— গণের সহিত স্মিথের সংজ্ঞা-সঞ্চারের চেষ্টা করিতে লাগিলেন। দীর্ঘ কালের চেষ্টার পর স্মিথের বক্ষের স্পন্দন অনুভূত হইল। ক্রমে জীবনের লক্ষণ প্রকাশ পাইলে, কাপ্তেন স্মিথের নিকট হইতে উঠিলেন; অনুচরদের বলিলেন, “ইহাকে তুলিয়া আমার কেবিনে লইয়া যাও; আমার শয্যার পার্শ্বে একটি শয্যা প্রস্তুত করিয়া: তাহাতে ই হাকে শয়ন করাও।—আমি উহার পরিচর্যার ভার লইলাম। আর কয়েক মিনিট বিলম্ব হইলে বেচারাকে আর বাঁচাইতেও পারিতাম না।”

 এতক্ষণ পরে লাইফ-বেণ্টটির দিকে তাঁহার দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল; তিনি দেখিলেন, লাইফ-বেল্টের গাত্রে মোটা মোটা কালো হরফে লিখিত আছে, “ওরিনকো!”

 কাপ্তেন অস্ফুট স্বরে বলিলেন, “ওরিনকো!—ইহা দক্ষিণ আমেরিকার সদাগরী জাহাজ।, এই যুবক সেই জাহাজের আরোহী ছিল বুঝিলাম, কিন্তু সমুদ্রে পড়িল কিরূপে? ওরিনকো ডুবিয়া যায় নাই ত?—এখন আমি করি কি? কেপ টাউনে পঁহুছিবার পূর্ব্বে আর কোথাও ত এই যুবককে নামাইয়া দিতে পারিব না। ইহার স্বজনেরাও তাহার পুর্ব্বে ইহার কোনও সংবাদ পাইবে॥”

 কাপ্তেন স্মিথের পরিচর্যায় প্রবৃত্ত লইলেন, কিন্তু দিবা রাত্রির মধ্যে তাহার চেতনা-সঞ্চার হইল না। পর দিন প্রভাতে স্মিথ চক্ষ মেলিয়া চাহিল; দেখিল, সে একখানি জাহাজের কেবিনে সুকোমল। শয্যায় শয়ন করিয়া আছে। তাহার সর্ব্বঙ্গে বেদনা, পার্শ্ব পরিবর্ত্তনেরও শক্তি নাই!—কাপ্তেন তখন কার্যোপলক্ষে অন্যত্র গমন করিয়াছিলেন।

 কাপ্তেন কার্য্যশেষে স্মিথের সহিত সাক্ষাৎ করিলে, স্মিথ তাঁহাকে তাহার বিপদের কাহিনী বলিল। কেবল তাহার প্রকৃত নাম গোপন। করিল; কি উদ্দেশ্যে সে সাল্‌ভেরিটা রাজ্যে যাইতেছিল—তাহাও বলিল না।

 দুই একদিনের মধ্যেই স্মিথ উঠিয়া বেড়াইতে সমর্থ হইল। মিঃ ব্লেক তাহার সংবাদ না পাইয়া কিরূপ উৎকণ্ঠিত হইয়াছেন, তাহা বুঝিতে পারিয়া সে তাঁহাকে সংবাদ পাঠাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিল। কিন্তু কোথায় তাঁহাকে সংবাদ পাঠাইবে? যে-কোনও-একটা বন্দরে নামিবার জন্য তাহার প্রবল অগ্রিহ হইল।

 তিন সপ্তাহ পরে ‘আনাবেল্‌’ জাহাজ টেবিল উপসাগরে প্রবেশপূর্ব্বক একটি বৃহৎ বন্দরে নঙ্গর করিল। স্মিথ কাপ্তেনের নিকট বিদায় লইয়া টেলিগ্রাফ অফিসে ছুটিল; এবং মিঃ ব্লেকের লণ্ডনস্থ ভবনে। গৃহকত্রী মিসেস্‌ বার্ডেলের নিকট টেলিগ্রাম করিয়া মিঃ ব্লেকের সংবাদ জিজ্ঞাসা করিল।

 সেই রাত্রেই স্মিথ টেলিগ্রামের উত্তর পাইল,—“মঃ ব্লেক এখানে নাই; কোথায় গিয়াছেন সংবাদ নাই। তোমাদের উভয়ের জন্য বড়ই চিন্তিত আছি।”

 প্রভু কোথায়, বুঝিতে না পারিয়া স্মিথ সি, মার্টিনাকে তার করিয়া ষ্টীমার আফিসে গেল; এবং ইংলণ্ডে কবে জাহাজ ছাড়িবে, তাহার সন্ধান লইয়া একটি হোটেলে সেই রাত্রির মত আশ্রয় লইল। সিনর মার্টিনা স্মিথকে টেলিগ্রাম-যোগে জানাইলেন, “যাঁহার সংবাদ জানিবার জন্য উৎসুক হইয়াছ, তিনি গুরুতর আহত হইয়াছিলেন। সুস্থ হইয়া নিরুদ্দেশ-যাত্রা করিয়াছেন!”।

 স্মিথ এই টেলিগ্রাম পাইয়া ভাবিতে লাগিল এখন আমি কি করি? প্রভু আহত হইয়াছিলেন! কে তাঁহাকে আঘাত করিল? আঘাত কি গুরুতর হইয়াছিল?—লণ্ডনে গিয়া সিনর মেন্‌ডোজার সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না। হয় ত সিনর। মেন্‌ডোজা প্রভুর কোনও সংবাদ পাইয়া থাকিবেন।” .

পর দিন ইংলণ্ডের ষ্টিমার ছাড়িল। স্মিথ একখানি টিকিট কিনিয়া ‘ডেন্‌লি কাস্‌ল’ নামক জাহাজে ইংলণ্ডে যাত্রা করিল।