রূপসী বোম্বেটে/প্রথম খণ্ড/সপ্তম পরিচ্ছেদ

সপ্তম পরিচ্ছেদ


মিঃ ব্লেক আততায়ীর ছুরিকাঘাতে সাল্‌ভেরিটা-রাজধানীর সেই অন্ধকারপূর্ণ সঙ্কীর্ণ গলিতে ভূতলশায়ী হইলে তাঁহার চেতনা বিলুপ্ত হইয়াছিল; সে কথা বোধ হয় পাঠকগণের স্মরণ আছে।

 চেতনাসঞ্চার হইলে তিনি দেখিতে পাইলেন, একটি জীর্ণ কুটীরের এক প্রান্তে একটি অপরিচ্ছন্ন শয্যায় শায়িত আছেন।

 মিঃ ব্লেক চক্ষু মেলিয়া একবার চারি দিকে চাহিলেন, তাহার পর উঠিবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু তখনও তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ আড়ষ্ট, স্কন্ধের বেদনাও অসহ্য; তিনি উঠিতে পারিলেন না। তিনি বুঝিলেন, তাঁহার পার্শ্বপরিবর্ত্তনেরও শক্তি নাই!

 তিনি চক্ষু মুদিত করিয়া ভাবিতে লাগিলেন—এই অপরিচিত স্থানে তিনি কখন আসিয়াছেন, কে-ই বা তাঁহাকে এখানে আনিয়াছে? কিন্তু কোনও কথা তাহার মনে পড়িল না; নানা চিন্তায় তাঁহার মন অস্থির হইয়া উঠিল। হঠাৎ কাহার পদশব্দে তাঁহার চিন্তা-স্রোত অবরুদ্ধ হইল; তিনি চক্ষু মেলিয়া দেখিলেন, একটি যুবতী সেই কক্ষে প্রবেশ করিয়াছে। তিনি নির্ণিমেষ নেত্রে যুবতীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন, কিন্তু তাহাকে চিনিতে পারিলেন না।

 যুবতী ধীরে ধীরে আসিয়া তাঁহার শয্যা-প্রান্তে উপবেশন করিল, তাঁহার চেতনাসঞ্চার হইয়াছে দেখিয়া তাহার মুখ প্রফুল্ল হইল; সে তাহার বেদনাক্লিষ্ট, পাণ্ডুর মুখের দিকে চাহিয়া কোমল স্বরে, বলিল, “আপনি বোধ হয় এখন অনেকটা সুস্থ হইয়াছেন? আপনাকে সুস্থ দেখিয়া আমি বড়ই আনন্দিত হইয়াছি।”

 যুবতী স্পেনীয় ভাষায় এ কথা বলিল; মিঃ ব্লেক এই ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি যুবতীর মুখের দিকে চাহিয়া বুঝিলেন, এক সময় সে বড় সুন্দরী ছিল। প্রথম যৌবনের রূপ-মাধুরী এখন আর নাই বটে, তথাপি তাহার যৌবনের লাবণ্য সম্পূর্ণরূপে অন্তর্হিত হয় নাই। মিঃ ব্লেক বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে ক্ষণকাল তাহার মুখের দিকে চাহিয়া স্পেনীয় ভাষায় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমি কোথায়?”— তখনও তিনি এত দুর্ব্বল যে, কথা কয়টি স্পষ্ট উচ্চারিত হইল না।

 যুবতীলিল, “আপনি এখানে নিরাপদে আছেন, আপনার আর আশঙ্কা নাই; আশা করি দুই একদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হইতে পারিবেন। আপনার কোনও শত্রু আপনার কাঁধে ছোরা মারিয়াছিল। আঘাত এমন গুরুতর হইয়াছিল যে, আমার মনে হইয়াছিল হয় ত আপনার প্রাণবিয়োগ হইয়াছে। কিন্তু আপনার শরীর ইস্পাতের মত কঠিন, আর আপনার দেহেও বোধ হয় অসাধারণ শক্তি ছিল; তাই ছোরা খাইয়াও আপনি এ যাত্রা রক্ষা পাইয়াছেন। কোনও ক্ষীণজীবী দুর্ব্বল লোকের এত রক্তপাত হইলে সে কখনও বাঁচিত না।—আপনার ক্ষত প্রায়, শুকাইয়া উঠিয়াছে।”

 এবার মিঃ ব্লেকের পূর্ব্ব-কথা স্মরণ হইল; তিনি ঈষৎ আবেগের সহিত বলিলেন, “হাঁ, আমার মনে পড়িয়াছে বটে। কিন্তু আপনি বলিলেন, আমার ক্ষত প্রায় শুকাইয়া উঠিয়াছে; এমন গভীর ক্ষত ত দুই একদিনে শুকায় না! আমি কত দিন এখানে পড়িয়া আছি?”

 যুবতী বলিল, “দশ দিন আপনি এই ঘরে জীবম্মৃত-বৎ পড়িয়া ছিলেন; এই দশ দিনের মধ্যে একবারও আপনার চেতনাসঞ্চার হয় নাই।”

 মিঃ ব্লেক সবিস্ময়ে বলিলেন, “দশ দিন? আজ কি বার?”

 যুবতী বলিল, “আজ বুধবার, আপনাকে যে দিন এখানে লইয়া আসি-সে দিন সোমবার। গত পূর্ব্ব-সপ্তাহের সোমবার হইতে আজ পর্য্যন্ত এই দশ দিন আপনি আমার আশ্রয়ে আছেন।”

 মিঃ ব্লেক কুঞ্চিত করিয়া কি চিন্তা করিতে লাগিলেন। তিনি বুঝিলেন, তাঁহার জাহাজ তাঁহার সন্ধানে দুই দিন পূর্ব্বে যথা-নির্দিষ্ট স্থানে আসিয়া তাঁহাকে না দেখিয়া নিশ্চয়ই ফিরিয়া গিয়াছে। জাহাজের কাপ্তেন ও তাঁহার অধীনস্থ কর্ম্মচারীরা কি মনে করিতেছে, কে বলিবে? জাহাজখানি এখন কোথায়, তাহাও ত জানিবার কোনও উপায় নাই! স্মিথ কোথায় কি করিতেছে?— তিনি যে কার্য্যের ভার লইয়া এই দূরদেশে আসিয়াছিলেন— তাহারই বা কত দূর। কি হইল?—কিছুই বুঝিতে না পারিয়া তিনি অত্যন্ত বিচলিত হইয়া: উঠিলেন।

 তাহার এই বিচলিত ভাব লক্ষ্য করিয়া যুবতী বলিল, “আপনাকে অত্যন্ত চিন্তাকুল দেখিতেছি; এখন আপনি সকল চিন্তা পরিত্যাগ করুন। আপনার শরীর এখনও বড় দুর্ব্বল; এ শরীরে চিন্তার ভার সহ্য হইবে না।”

 মিঃ ব্লেক যুবতীর কৃষ্ণবর্ণ প্রশান্ত নয়ন-তারকার দিকে দৃষ্টি সন্নিবদ্ধ করিয়া বলিলেন, “আমি বড়ই দুর্ভাবনায় পড়িয়াছি; চেষ্টা করিলেও যে সে চিন্তা পরিত্যাগ করিতে পারিব, এরূপ আশা নাই। আপনি আমার জীবন দান করিয়াছেন, আপনার সেবা শুশ্রষা ভিন্ন এ যাত্রা নিশ্চয়ই আমার প্রাণরক্ষা হইত না; আপনার নিকট আমি। কতদূর ঋণী, তাহা আমার প্রকাশ করিবার শক্তি নাই। আপনি আমার আন্তরিক ধন্যবাদ গ্রহণ করুন।”

 যুবতী ব্যগ্রভাবে বলল, “না, না, আমি আপনার ধন্যবাদের পাত্রী নহি'; আমার সকল কথা শুনিলে আপনি বুঝিবেন, এ আমার নিকট আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কোনও কারণ নাই।”

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “আপনি আমার জীবন রক্ষা করিয়াছেন, তথাপি আপনার নিকট আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কারণ নাই! আপনি কেন যে এ কথা বলিতেছেন, তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না।”

 যুবতী চক্ষু অবনত করিয়া অত্যন্ত কুষ্টিত ভাবে বলিল, “মহাশয়, সত্যই আমার নিকট আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কোনও কারণ নাই। আপনি যখন গুপ্ত সমিতির আডডা হইতে বাহির হন, সেই সময় আমি নিঃশব্দে আপনার অনুসরণ করিয়াছিলাম। আমার ইচ্ছা ছিল, হঠাৎ আপনাকে আক্রমণ করিয়া—আপনার কাছে যাহা কিছু থাকে তাহা কাড়িয়া লইব। লোকের ‘গাঁট-কাটা'ই আমার পেশা।—কিছু লাভের আশাতেই আমি আপনার অনুসরণ করিছিলাম; কিন্তু কিছু দূর অগ্রসর হইয়া দেখিলাম, আর একজন লোক আপনার পশ্চাতে লাগিয়াছে। সে হঠাৎ আপনাকে আক্রমণ করিয়া আপনার কাঁধে ছুরি বসাইয়া পলায়ন করিল! সে বোধ হয় মনে করিয়াছিল—ছুরিকাঘাতে আপনার প্রাণবিয়োগ হইয়াছে। কিন্তু লোকটা আপনার পকেট না মারিয়াই সরিয়া পড়িল, ইহা দেখিয়া আমি বড়ই বিস্মিত হইলাম; কি উদ্দেশ্যে, সে আপনাকে আক্রমণ করিয়াছিল, তাহা বুঝিতে পারিলাম না।

 “যাহা হউক, আমি তৎক্ষণাৎ আপনার নিকট উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, ক্ষতমুখ হইতে প্রবল বেগে রক্ত ঝরিতেছে, রক্তে আপনার সর্ব্বাঙ্গ ভিজিয়া গিয়াছে; রক্তে সেই স্থানের মাটী পর্য্যন্ত কাদা হইয়াছে। আপনি মৃতবৎ পড়িয়া আছেন। কিন্তু আমি পিশাচী, আমার হৃদয়ে দয়া মায়া নাই; আপনার সেই শোচনীয় অবস্থা দেখিয়াও আমার মনে করুণার উদ্রেক হইল না। আমি আপনাকে এখানে তুলিয়া আনিলাম বটে, কিন্তু আপনাকে বাঁচাইবার জন্য নহে;—আমার ইচ্ছা ছিল, আপনার কাছে যাহা কিছু পাই, তাহা হস্তগত করিয়া আপনার মৃতদেহ কোনও একটা নর্দ্দমায় ফেলিয়া দিব!—কিন্তু আপনাকে এখানে আনিয়া আমার মনের ভাব পরিবর্ত্তিত হইল; কেন হইল,তাহা আমি বলিতে পারি না। বহু দিন হইতে পরের সর্ব্বনাশ করিয়া আসিতেছি; কোনও পাপে আমার সঙ্কোচ নাই, কুষ্ঠ নাই। আমি স্বহস্তে কত লোকের সর্ব্বনাশ করিয়াছি। আমার কবলে পড়িয়া কত ধনবান যুবক সর্ব্বস্বান্ত হইয়াছে, তাহার সংখ্যা নাই; কিন্তু আপনার সর্ব্বস্ব হস্তগত করিয়াও আমি আপনাকে হত্যা করিতে পারিলাম না। হত্যা করা দূরে থাক, আমি আপনার পরিচর্য্যার নিযুক্ত হইলাম; আপনার ক্ষত উত্তমরূপে ধুইয়া ‘ব্যাণ্ডেজ’ বাঁধিয়া দিলাম; যাহাতে আপনার প্রাণ রক্ষা হয়—আহার নিদ্রা ত্যাগ করিয়া সেই চেষ্টা করিতে লাগিলাম। আপনার পকেটে যাহা কিছু ছিল, তাহা বাহির করিয়া লইয়া সিন্দুকে রাখিয়াছি; আমি কিছুই আত্মসাৎ করি নাই, কেবল আপনার পরিচর্য্যার জন্য ঔষধাদি কিনিতে যে দুই এক টাকা লাগিয়াছে-তাহাই খরচ করিয়াছি মাত্র।”

 পতিতা স্পেনীয় যুবতীর কথা শুনিয়া মিঃ ব্লেকের বিস্ময়ের সীমা রহিল না,কয়েক মিনিট পর্য্যন্ত তিনি বাঙ্‌নিস্পত্তি করিতে পারিলেন না; অনেকক্ষণ পরে তিনি বলিলেন, “তুমি রাক্ষসী হইতে পার, পিশাচী হইতে পার,—কিন্তু আমার নিকট তুমি দেবী। ভগবান পতিতের উদ্ধার কর্ত্তা, তিনি অনাথের নিরাশ্রয়ের রক্ষক। তাঁহার কৃপাতেই তোমার দুর্ম্মতি দূর হইয়াছে। তুমি আমার জন্য যাহা করিয়াছ, তাহার উপযুক্ত পুরস্কার মানুষে দিতে পারে না, পরমেশ্বরই তোমাকে পুরস্কার দিবেন। তবে আমার যাহা সাধ্য, তোমার জন্য অবশ্যই তাহা করিব।”।

 যুবতী বলিল, “না মহাশয়! আমি আপনার নিকট কোনও পুরস্কারের প্রার্থনা করি না; আমার অর্থের আকাঙ্ক্ষা নাই, কারণ আমার প্রচুর অর্থ আছে।আপনি দুর্ব্বল, আর অধিক কথা কহিবেন না; তবে একটা কথা জানিতে চাই,—এ দেশে আপনার কোনও আত্মীয় বন্ধু আছেন?—আমি-”

 যুবতীর কথা শেষ হইবার পূর্ব্বেই রুদ্ধদ্বারে কে করাঘাত করিল, সঙ্গে সঙ্গে বহির্ভাগে কুকুরের চীৎকার হইল। যুবতী তাড়াতাড়ী, উঠিয়া একটা পিস্তল লইয়া বাহিরে যাইবার উদ্যোগ করিতেছে, দেখিয়া মিঃ ব্লেক ব্যগ্র ভাবে বলিলেন, “গুলি করিও না। স্বরে বুঝিয়াছি, এ কুকুর আমার ও আমার বন্ধুরা বোধ হয় এখানে আমার সন্ধানে আসিতেছেন।”

 যুবতী পিস্তল নামাইয়া দ্বার খুলিয়া বাহিরে গেল; দুইজন ভদ্রলোক টাইগারের পশ্চাতে সেই কক্ষে প্রবেশ করিলেন। ইহাদের একজন কাপ্তেন পেণ্টল্যাণ্ড, অন্যজন তাঁহার জাহাজের ইঞ্জিনিয়ার ম্যাকে।

 টাইগার সেই কক্ষে প্রবেশ করিয়াই এক লম্ফে মিঃ ব্লেকের শয্যাপ্রান্তে উপস্থিত হইল; এবং আগ্রহপূর্ণ দৃষ্টিতে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া লেজ নাড়িতে লাগিল।—টাইগারের প্রভুভক্তি সকলেরই হৃদয় স্পর্শ করিল॥

 কাপ্তেন বলিলেন, “পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ,—অনেক কষ্টে আপনাকে খুঁজিয়া বাহির করিয়াছি। আপনার এই কুকুর সঙ্গে লইয়া ম্যাকে ও আমি আজ দুই দিন ধরিয়া আপনাকে কোথায় না খুঁজিয়াছি! আপনি কি পীড়িত ছিলেন? কি অসুখ? অসুখ গুরুতর নহে ত?”।

 মিঃ ব্লেক মৃদু হাস্যে বলিলেন, “একজন লোক আমার কাঁধে একখানা ছুরি বিধাইয়া দিয়াছিল; এমন জখম হইয়াছিলাম যে—বাঁচিবার আশা ছিল না। কিন্তু পরমেশ্বরের ইচ্ছা নহে যে, হঠাৎ আমি এখানে মারা যাই।”

 কাপ্তেন সবিস্ময়ে বলিলেন, “কি সর্ব্বনাশ! আপনি কোন সাহসে এই সকল বদ্‌মায়েসের আড্ডায় আসিয়াছিলেন? আপনি যে বাঁচিয়াছেন, ইহাই আশ্চর্য্য! এমন কদর্য্য স্থানে একাকী বেড়াইলে কোন্ দিন আপনার প্রাণ যাইবে।”

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “প্রাণ ত প্রায় গিয়াছিল; ছুরিকাঘাতে আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িলে সদাশয়া মহিলাটি আমাকে এই কুটীরে আনিয়া সেবা-শুশ্রুষা দ্বারা আমার প্রাণরক্ষা করিয়াছেন। এখন তোমরা আমাকৈ গোপনে এখান হইতে বাহির করিয়া লইয়া যাইতে পারিবে? যাহারা আমাকে হত্যা করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, আমি যে বাঁচিয়াছি, ইহাতাহাদিগকে জানিতে দেওয়া হইবে না।”

 কাপ্তেন বলিলেন, “এ আর কঠিন কাজ কি? আপনাকে এখান হইতে গোপনেই লইয়া যাইব। আমি একখানি গাড়ী আনিতেছি, সেই গাড়ীতে আপনি হোটেলে চলুন। একটা ঝুঁটা দাড়ি পরিলে কেহই আপনাকে চিনিতে পারিবে না।—এখন আপনাকে একটা মন্দ সংবাদ দিব, বড়ই দুঃখের সংবাদ।”

 মিঃ ব্লেক ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “কু-সংবাদ? কি সংবাদ শীঘ্র বল।”

 কাপ্তেন পেণ্টল্যাণ্ড বলিলেন, “ওরিনকো জাহাজের কাপ্তেন ব্রাউন গত সপ্তাহে এখানকার বন্দরে আসিয়াছেন। তিনি আমাকে বলিয়াছেন, তাঁহার জাহাজে একটী যুবক আরোহী ছিল, তাহার নাম গেটস্‌। জাহাজ উত্তর আটলাণ্টিক মহাসাগরে প্রবেশ করিবার দুই দিন পরে সেই যুবক জাহাজ হইতে কিরূপে সমুদ্রে পড়িয়া গিয়াছে। তাহার আর সন্ধান হয় নাই। আপনি আমাকে বলিয়াছিলেন, আপনার একজন অনুচর এই নামে ‘ওরিনকো’. জাহাজে এখানে যাত্রা করিয়াছে;—সেইজন্যই আপনাকে এই দুঃসংবাদ জ্ঞাপন করা আবশ্যক মনে করিলাম”।

 মিঃ ব্লেক কাতর ভাবে বলিলেন, “কি সর্ব্বনাশ! এ কথা কি সত্য?”

 কাপ্তেন বলিলেন, “সম্পূর্ণ সত্য। আপনাকে এমন দুঃসংবাদ দিতে হইল, বড়ই দুঃখের বিষয়। আশা করি, অন্য কোনও জাহাজের লোক তাহাকে সমুদ্র হইতে তুলিয়াছে;—এমনও ত অনেক সময় ঘটে।”

 মিঃ ব্লেক অশ্রুপূর্ণ নেত্রে বলিলেন, “না, সে আশা নাই।—তোমরা আমাকে অত্যন্ত বিচলিত দেখিতেছ? আমার এই কারতা মার্জ্জনা কর। সেই যুবক আমার পুত্রের ন্যায় প্রিয়তম; তাহার ন্যায় আত্মীয় সংসারে আমার আর কেহ নাই।”

 কাপ্তেন পেণ্টল্যাণ্ড ও মিঃ ম্যাকে ক্ষুন্ন মনে মিঃ ব্লেকের নিকট বিদায় লইলেন। টাইগার নড়িল না, তাঁহার পাশে বসিয়া রহিল।

 মিঃ ব্লেক দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরাইয়া কাতর স্বরে বলিলেন, “আহা বেচারা আমার দোষেই অকালে প্রাণ হারাইল! শেষে শত্রুর তাহাকে সমুদ্রে ডুবাইয়া মারিল! সংসারে আমার মুখের দিকে চাহিতে সে ভিন্ন আর যে কেহই ছিল না; এমন বিশ্বাসী, প্রভুভক্ত অনুচর আমি আর কোথায় পাইব? আমার বন্ধু, সখা, বয়স্য, আমার পরামর্শদাতা, সুহৃদ—এমন আর কে আছে? আমার জীবনের এক অংশ উজাড় হইয়া গেল! উঃ, কি কষ্ট! আমি কি কোন দিন স্বপ্নেও ভাবিয়াছিলাম, এমন করিয়া তাহাকে হারাইব?”।

 পূর্ব্বোক্তা স্পেনীয় রমণী হঠাৎ সেই কক্ষে প্রবেশ পূর্ব্বক মিঃ ব্লেককে অত্যন্ত বিমর্ষ দেখিয়া তাহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল; কোমলস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার অসুখ বাড়িয়াছে কি? আপনাকে এত কাতর দেখিতেছি কেন?”

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “না, আমার অসুখ বাড়ে নাই; আমার যে বন্ধুরা আসিয়াছিলেন, তাঁহাদের নিকট একটা বড় দুঃসংবাদ শুনিয়া . মনে অত্যন্ত আঘাত পাইয়াছি। আমার একটী স্নেরে পাত্রকে হারাইয়াছি। সে আমার পুত্রাধিক প্রিয়তম—একটি যুবক।”

 রমণী বলিল, “বড়ই দুঃখের কথা।”

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “আজ রাত্রেই আমি এখান হইতে চলিয়া যাইব। আমার বন্ধুরা আমাকে লইয়া যাইবার জন্যই এখানে আসিয়াছিলেন।”

 “তবে আপনার কিছু আহারের আয়োজন করি—” বলিয়া রমণী সেই কক্ষ পরিত্যাগ করিল।

 আহারের পর মিঃ ব্লেক একখানি গাড়ী আনাইয়া রমণীর, নিকট বিদায় গ্রহণ পূর্ব্বক তাহার গৃহ ত্যাগ করিলেন। রমণী অশ্রুপূর্ণ, লোচনে তাঁহাকে বিদায় দিল।  মিঃ ব্লেক পর দিন সাল্‌ভেরিটার নব-নির্ব্বাচিত সভাপতি সিনর মাটিনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চলিলেন।—যে জেলে মাছ ধরিতে গিয়া বোম্বেটেদের কাণ্ড দেখিয়াছিল, মিঃ ব্লেক সিনর মার্টিনার নিকট তাহার নাম জানিতে পারিলেন। তিনি উক্ত জেলের সহিত আলাপ করিয়া একটি নূতন তথ্য অবগত হইলেন। জেলে যে জাহাজখানা দেখিয়াছিল—সেই জাহাজখানির মত একখানি জাহাজ কয়েক সপ্তাহ পূর্ব্বে পোর্টো কষ্টার বন্দরে নঙ্গর করিয়াছিল।

 মিঃ ব্লেক জেলের নিকট হইতে ফিরিয়া পুনর্ব্বার সিনর মার্টিনার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন, তাঁহাকে বলিলেন, “শুনিলাম কয়েক সপ্তাহ পূর্ব্বে আপনাদের বন্দরে একখানি বিদেশী জাহাজ আসিয়াছিল; সে জাহাজখানি কাহার, সংবাদ রাখেন কি?”

 সিনর মার্টিনা বলিলেন, “হাঁ, কয়েক সপ্তাহ পূর্ব্বে একখানি নূতন ধরণের জাহাজ আসিয়াছিল বটে। জাহাজের মালিকের নাম মিঃ গ্র্যাণ্ট, ভয়ানক পয়সাওয়ালা লোক; সঙ্গে তাঁর এক ভাগিনেয়ী, অপূর্ব্ব সুন্দরী! তাহারা অনেক বড় লোকের নিকট হইতে পরিচয়পত্র আনিয়াছিলেন; তাহা দেখিয়া এখানে আমরা তাঁহাদের খুব আদর যত্ন করিয়াছিলাম। তাঁহারা এখানে কয়েক দিন বেশ আমোদে কাটাইয়া গিয়াছেন।”

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “মামা? তার সঙ্গে সুন্দরী ভাগিনেয়ী! যুবতীর কি নাম, স্মরণ আছে?”

 সিনর মার্টিনা বলিলেন, “হাঁ, স্মরণ আছে বৈ কি! যুবতীর নাম কুমারী কার্স টন। এমন সুন্দরী সচরাচর দেখা যায় না।”

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “কুমারী কার্স টন? তাহারা যে জাহাজে আসিয়াছিল? সেই জাহাজখানার নাম স্মরণ হয় কি?” সিনর মার্টিনা বলিলেন, “যুবতীর মামা মিঃ গ্র্যাণ্টের নিকট শুনিয়াছি, তাঁহাদের জাহাজের নাম ‘ফ্লোর-ডি-লিজ্‌'।—ব্যাপার কি?”।

 মিঃ ব্লেক বলিলেন, “খুব জটিল ব্যাপার বটে!”—মনে মনে বলিলেন, “কিন্তু আমি কি নির্ব্বোধ! এত অল্প সমরে তাহারা গা ঢাকা দিবে, ইহা বুঝিতে পারি নাই? দেখি, কত দূর কি করিয়া উঠিতে পারি।”

 মিঃ ব্লেক সিনর মার্টিনার নিকট বিদায় লইয়া ব্রিটিশ রাজদূতের আফিসে উপস্থিত হইলেন। যে সকল বৈদেশিক জাহাজ পোর্টো কষ্টায় নঙ্গর করে—বৃটিশ রাজদূতের আফিসে তাহার একটি তালিকা থাকে; মিঃ ব্লেক কয়েক সপ্তাহের দৈনন্দিন তালিকা লইয়া পরীক্ষা করিতে বসিলেন।

 মিঃ ব্লেক তালিকাগুলি খুঁজিতে খুঁজিতে দেখিলেন, কয়েক সপ্তাহ পূর্ব্বে এক দিন নিম্নলিখিত জাহাজগুলি পোর্টো কষ্টার বন্দরে উপস্থি হইয়াছিল,—“ভাল্‌পারেসো, চিলি, ফ্লোর-ডি-লিজ্‌।”

 দুই দিন পরের তালিকা এইরূপ,—“ভাল্‌পারেসো, ফ্লোর-ডি লিজ্‌, ফিজি দ্বীপের সুভা বন্দরে যাত্রা করিল।”

 মিঃ ব্লেক তালিকা বন্দ করিয়া হোটোলে ফিরিলেন, এবং তাঁহার জিনিস পত্র বাঁধিবার আদেশ দিলেন। তাহার পর পাইপ টানিতে টানিতে বলিলেন, “মামার নাম গ্র্যাণ্ট,—যুবতীর নাম কুমারী কার্স টন! নামে সাদৃশ্য নাই বটে, কিন্তু সম্বন্ধে সাদৃশ্য আছে। কুমারী কার্স টন যদি আমেলিয়া কার্টার না হয়, তাহা হইলে আমার গোয়েন্দাগিরিই বৃথা! প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন অষ্ট্রেলিয়া হইতে আসিয়াছে, আমেলিয়াও দীর্ঘকাল অষ্ট্রেলিয়ায় বাস করিয়াছে। হঠাৎ সে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে কেন আসিল, কি উদ্দেশ্যেই বা কোথায় অন্তর্ধান করিল? জটিল রহস্য বটে! কিন্তু আমাকে এ রহস্য ভেদ করিতে হইবে।”

 মিঃ ব্লেক হোটেল পরিত্যাগ করিবার পূর্ব্বে লণ্ডনে সিনর মেন্‌ডোজার নিকট একখানি পত্র পাঠাইলেন; পত্রের উপর তাহার অনুচর প্যাট্রিক স্মিথের নাম। পত্রখানি তিনি পুরু লেফাপায় পুরিয়া উত্তম রূপে গালা-মোহর করিয়া ডাকে দিলেন।

 পত্রখানি ডাকের বাক্সে ফেলিয়া মিঃ ব্লেক অস্ফুট স্বরে বলিলেন, “হয় ত পত্র লেখা বৃথা হইল; কোনও চলন্ত জাহাজের কাপ্তেন কি স্মিথকে সমুদ্র-গর্ভ হইতে উদ্ধার করিয়াছে? যদি সে এই বিপদ হইতে উদ্ধার লাভ করিয়া থাকে, তাহা হইলে নিশ্চয়ই লণ্ডনে ফিরিয়া গিয়া সিনর মেন্‌ডোজার সহিত সাক্ষাৎ করিবে। তখন পত্রখানি তাহার হস্তগত হওয়াই সম্ভব।”

 মিঃ ব্লেক বিষন্ন বদনে কর্সেয়ার জাহাজে পদার্পণ করিলেন। জাহাজের কাপ্তেন পেণ্টল্যাণ্ড জাহাজ চালাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া বসিয়াছিলেন; মিঃ ব্লেকের আদেশে জাহাজ দক্ষিণাভিমুখে চলিল। -এবার মিঃ ব্লেকের লক্ষ্য ফিজি দ্বীপ।