লিপিকা/পুরোনো বাড়ি
পুরোনো বাড়ি
১
অনেক কালের ধনী গরিব হয়ে গেছে, তাদেরই ঐ বাড়ি।
দিনে দিনে ওর উপরে দুঃসময়ের আঁচড় পড়চে। দেয়াল থেকে বালি খসে পড়ে, ভাঙা মেঝে নখ দিয়ে খুঁড়ে চড়ুইপাখি ধুলোয় পাখা ঝাপট দেয়, চণ্ডীমণ্ডপে পায়রাগুলো বাদলের ছিন্ন মেঘের মতো দল বাঁধ্ল।
উত্তর দিকের এক পাল্লা দরজা কবে ভেঙে পড়েচে কেউ খবর নিলে না। বাকি দরজাটা—শোকাতুরা বিধবার মত—বাতাসে ক্ষণে ক্ষণে আছাড় খেয়ে পড়ে, কেউ তাকিয়ে দেখে না।
তিন মহল বাড়ি। কেবল পাঁচটি ঘরে মানুষের বাস, বাকি সব বন্ধ। যেন পঁচাশি বছরের বুড়ো, তার জীবনের সবখানি জুড়ে সেকালের কুলুপ-লাগানো স্মৃতি;—কেবল একখানিতে একালের চলাচল।
বালি-ধসা ইঁট-বের-করা বাড়িটা তালি-দেওয়া-কাঁথা-পরা উদাসীন পাগ্লার মত রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে;
আপনাকেও দেখে না, অন্যকেও না।
২
একদিন ভোর রাত্রে ঐদিকে মেয়ের গলায় কান্না উঠ্ল। শুনি, বাড়ির যেটি শেষ ছেলে, সখের যাত্রায় রাধিকা সেজে যার দিন চল্ত, সে আজ আঠারো বছরে মারা গেল।
ক’দিন মেয়েরা কাঁদ্ল, তার পরে তাদের আর খবর নেই।
তার পরে সকল দরজাতেই তালা পড়ল।
কেবল উত্তর দিকের সেই একখানা অনাথা দরজা ভাঙেও না, বন্ধও হয় না; ব্যথিত হৃৎপিণ্ডের মত বাতাসে ধড়াস্ ধড়াস্ করে আছাড় খায়।
৩
একদিন সেই বাড়িতে বিকেলে ছেলেদের গোলমাল শোনা গেল।
দেখি, বারান্দা থেকে লালপেড়ে শাড়ি ঝুল্চে।
অনেকদিন পরে বাড়ির এক অংশে ভাড়াটে এসেচে। তার মাইনে অল্প, ছেলেমেয়ে বিস্তর। শ্রান্ত মা বিরক্ত হয়ে তাদের মারে, তারা মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে।
একটা আধা-বয়সী দাসী সমস্ত দিন খাটে, আর গৃহিণীর সঙ্গে ঝগড়া করে; বলে ‘“চল্লুম”, কিন্তু যায় না।
৪
বাড়ির এই ভাগটায় রোজ একটু আধটু মেরামত চল্চে।
ফাটা সাসির উপর কাগজ আঁটা হল; বারান্দায় রেলিঙের ফাঁকগুলোতে বাঁখারি বেঁধে দিলে; শোবার ঘরে ভাঙা জান্লা ইঁট দিয়ে ঠেকিয়ে রাখ্লে; দেয়ালে চুনকাম হ’ল, কিন্তু কালো ছাপগুলোর আভাস্ ঢাকা পড়ল না।
ছাদে আল্সের পরে গামলায় একটা রোগা পাতাবাহারের গাছ হঠাৎ দেখা দিয়ে আকাশের কাছে লজ্জা পেলে। তার পাশেই ভিত ভেদ করে অশথ গাছটি সিধে দাঁড়িয়ে; তার পাতাগুলো এদের দেখে যেন খিল্ খিল্ করে হাস্তে লাগ্ল।
মস্ত ধনের মস্ত দারিদ্র্য। তাকে ছোট হাতের ছোট কৌশলে ঢাকা দিতে গিয়ে তার আবরু গেল।
কেবল উত্তর দিকের উজাড় ঘরটির দিকে কেউ তাকায় নি। তার সেই জোড়-ভাঙা দরজা আজো কেবল বাতাসে আছ্ড়ে পড়চে—হতভাগার বুক-চাপ্ড়ানির মত।