লিপিকা/ভুল স্বর্গ
ভুল স্বর্গ
১
লোকটি নেহাৎ বেকার ছিল।
তার কোনো কাজ ছিল না, কেবল সখ ছিল নানা রকমের।
ছোট ছোট কাঠের চৌকোয় মাটি ঢেলে তার উপরে সে ছোট ছোট ঝিনুক সাজাত। দূর থেকে দেখে মনে হত—যেন একটা এলোমেলো ছবি, তার মধ্যে পাখীর ঝাঁক; কিম্বা এব্ড়ো খেব্ড়ো মাঠ, সেখানে গোরু চর্চে, কিম্বা উঁচু নীচু পাহাড়, তার গা দিয়ে ওটা বুঝি ঝর্ণা হবে, কিম্বা পায়ে চলা পথ।
বাড়ীর লোকের কাছে তার লাঞ্ছনার সীমা ছিল না। মাঝে মাঝে পণ কর্ত পাগ্লামি ছেড়ে দেবে, কিন্তু পাগ্লামি তাকে ছাড়্ত না।২
কোনো কোনো ছেলে আছে সারা বছর পড়ায় ফাঁকি দেয় অথচ পরীক্ষায় খামকা পাস করে ফেলে। এর সেই দশা হল।
সমস্ত জীবনটা অকাজে গেল অথচ মৃত্যুর পরে খবর পেলে যে, তার স্বর্গে যাওয়া মঞ্জুর।
কিন্তু নিয়তি স্বর্গের পথেও মানুষের সঙ্গ ছাড়ে না। দূতগুলো মার্কা ভুল করে’ তাকে কেজো লোকের স্বর্গে রেখে এল।
এই স্বর্গে আর সবই আছে, কেবল অবকাশ নেই।
এখানে পুরুষরা বল্চে, “হাঁফ ছাড়্বার সময় কোথা?” মেয়েরা বল্চে, “চল্লুম ভাই, কাজ রয়েচে পড়ে।” সবাই বলে, “সময়ের মূল্য আছে”; কেউ বলে না “সময় অমূল্য।” “আর ত পারা যায় না” বলে’ সবাই আক্ষেপ করে, আর ভারি খুসি হয়। “খেটে খেটে হয়রান হলুম” এই নালিশটাই সেখানকার সঙ্গীত।
এ বেচারা কোথাও ফাঁক পায় না, কোথাও খাপ খায় না। রাস্তায় অন্যমনস্ক হয়ে চলে, তাতে ব্যস্ত লোকের পথ আটক করে। চাদরটি পেতে যেখানেই আরাম করে’ বস্তে চায় শুন্তে পায় সেখানেই ফসলের ক্ষেত, বীজ পোঁতা হয়ে গেচে। কেবলি উঠে যেতে হয়, সরে’ যেতে হয়।
৩
ভারি এক ব্যস্ত মেয়ে স্বর্গের উৎস থেকে রোজ জল নিতে আসে।
পথের উপর দিয়ে সে চলে’ যায় যেন সেতারের দ্রুত তালের গতের মত।
তাড়াতাড়ি সে এলো খোঁপা বেঁধে নিয়েচে। তবু দুচারটে দুরন্ত অলক কপালের উপর ঝুঁকে পড়ে’ তার চোখের কালো তারা দেখ্বে বলে উঁকি মার্চে।
স্বর্গীয় বেকার মানুষটি একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল, চঞ্চল ঝর্নার ধারে তমাল-গাছটির মত স্থির।
জান্লা থেকে ভিক্ষুককে দেখে রাজকন্যার যেমন দয়া হয়, এ’কে দেখে মেয়েটির তেম্নি দয়া হল।
“আহা, তোমার হাতে বুঝি কাজ নেই!”
নিশ্বাস ছেড়ে বেকার বল্লে, “কাজ কর্ব তার সময় নেই।”
মেয়েটি ওর কথা কিছুই বুঝ্তে পার্লে না। বল্লে, “আমার হাত থেকে কিছু কাজ নিতে চাও?”
বেকার বল্লে, “তোমার হাত থেকেই কাজ নেব বলে দাঁড়িয়ে আছি।”
“কী কাজ দেব?”
“তুমি যে ঘড়া কাঁখে করে জল তুলে নিয়ে যাও তারি একটি যদি আমাকে দিতে পার।”
“ঘড়া নিয়ে কী হবে? জল তুল্বে?”
“না, আমি তার গায়ে চিত্র কর্ব।”
মেয়েটি বিরক্ত হয়ে বল্লে, “আমার সময় নেই, আমি চল্লুম।”
কিন্তু বেকার লোকের সঙ্গে কাজের লোক পার্বে কেন? রোজ ওদের উৎসতলায় দেখা হয়, আর রোজ সেই একই কথা, “তোমার কাঁখের একটি ঘড়া দাও, তাতে চিত্র কর্ব।”
হার মানতে হল, ঘড়া দিলে।
সেইটিকে ঘিরে ঘিরে বেকার আঁক্তে লাগ্ল, কত রঙের পাক, কত রেখার ঘের।
আঁকা শেষ হলে মেয়েটি ঘড়া তুলে ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখ্লে। ভুরু বাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা কর্লে, “এর মানে?”
বেকার লোকটি বল্লে, “এর কোনো মানে নেই।”
ঘড়া নিয়ে মেয়েটি বাড়ি গেল।
সবার চোখের আড়ালে বসে’ সেটিকে সে নানা আলোতে নানারকমে হেলিয়ে ঘুরিয়ে দেখ্লে। রাত্রে থেকে-থেকে বিছানা ছেড়ে উঠে দীপ জ্বেলে চুপ করে’ বসে’ সেই চিত্রটা দেখ্তে লাগল। তার বয়সে এই সে প্রথম এমন কিছু দেখেচে যার কোনো মানে নেই।
তার পরদিন যখন সে উৎসতলায় এল, তখন তার দুটি পায়ের ব্যস্ততায় একটু যেন বাধা পড়েচে। পা দুটি যেন চল্তে চল্তে আন্-মনা হয়ে ভাব্চে— যা ভাব্চে তার কোনো মানে নেই।
সেদিনও বেকার মানুষ একপাশে দাঁড়িয়ে।
মেয়েটি বল্লে, “কি চাও?”
সে বল্লে, “তোমার হাত থেকে আরো কাজ চাই।”
“কি কাজ দেব?”
“যদি রাজি হও, রঙীন সুতো বুনে বুনে তোমার বেণী বাঁধ্বার দড়ি তৈরি করে’ দেব।”
“কি হবে?”
“কিছুই হবে না।”
নানা-রঙের নানা-কাজ-করা দড়ি তৈরি হল। এখন থেকে আয়না হাতে নিয়ে বেণী বাঁধ্তে মেয়ের অনেক সময় লাগে। কাজ পড়ে থাকে, বেলা বয়ে যায়।
৪
এ দিকে দেখতে দেখতে কেজো স্বর্গে কাজের মধ্যে বড়ো বড়ো ফাঁক পড়্তে লাগল। কান্নায় আর গানে সেই ফাঁক ভরে উঠ্ল।
স্বর্গীয় প্রবীণেরা বড়ো চিন্তিত হল। সভা ডাক্লে। তারা বললে, “এখানকার ইতিহাসে কখনো এমন ঘটেনি।”
স্বর্গের দূত এসে অপরাধ স্বীকার কর্লে। সে বল্লে, “আমি ভুল লোককে ভুল স্বর্গে এনেচি।”
ভুল লোকটিকে সভায় আনা হল। তার রঙীন পাগ্ড়ি আর কোমরবন্ধের বাহার দেখেই সবাই বুঝ্লে, বিষম ভুল হয়েচে।
সভাপতি তাকে বল্লে, “তোমাকে পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে।”
সে তার রঙের ঝুলি আর তুলি কোমরে বেঁধে হাঁফ ছেড়ে বল্লে, “তবে চল্লুম।”
মেয়েটি এসে বল্লে, “আমিও যাব।”
প্রবীণ সভাপতি কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। এই সে প্রথম দেখ্লে এমন একটা কাণ্ড যার কোনো মানে নেই।