লিপিকা/নামের খেলা
নামের খেলা
১
প্রথম বয়সেই সে কবিতা লিখ্তে সুরু করে।
বহু যত্নে খাতায় সোনালী কালীর কিনারা টেনে তারি গায়ে লতা এঁকে, মাঝখানে লাল কালী দিয়ে কবিতাগুলি লিখে রাখ্ত। আর খুব সমারোহে মলাটের উপর লিখ্ত, শ্রীকেদারনাথ ঘোষ।
একে একে লেখাগুলিকে কাগজে পাঠাতে লাগ্ল। কোথাও ছাপা হ’ল না।
মনে মনে সে স্থির কর্লে, যখন হাতে টাকা জম্বে তখন নিজে কাগজ বের কর্বে।
বাপের মৃত্যুর পর গুরুজনেরা বার বার বললে, “একটা কোনো কাজের চেষ্টা কর, কেবল লেখা নিয়ে সময় নষ্ট কোরো না।”
সে একটুখানি হাস্লে আর লিখ্তে লাগ্ল। একটি দুটি তিনটি বই সে পরে পরে ছাপালে।
এই নিয়ে খুব আন্দোলন হবে আশা করেছিল। হ’ল না।২
আন্দোলন হ’ল একটি পাঠকের মনে। সে হচ্চে, তার ছোট ভাগনেটি।
নতুন ক খ শিখে সে যে-বই হাতে পায় চেঁচিয়ে পড়ে।
একদিন একখানা বই নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে মামার কাছে ছুটে এল। বললে, “দেখ দেখ, মামা, এ যে তোমারি নাম।”
মামা একটুখানি হাস্লে আর আদর ক’রে খোকার গাল টিপে দিলে।
মামা তার বাক্স খুলে আর-একখানি বই বের করে’ বললে, “আচ্ছা, এটা পড় দেখি।”
ভাগ্নে একটি একটি অক্ষর বানান করে’ করে’ মামার নাম পড়্ল। বাক্স থেকে আরও একটা বই বেরল, সেটাতেও পড়ে’ দেখে, মামার নাম।
পরে পরে যখন তিনটি বইয়ে মামার নাম দেখ্লে, তখন সে আর অল্পে সন্তুষ্ট হ’তে চাইল না। দুই হাত ফাঁক ক’রে’ জিজ্ঞেস কর্লে, “তোমার নাম আরো অনেক অনেক অনেক বইয়ে আছে; একশোটা, চব্বিশটা, সাতটা বইয়ে?”
মামা চোখ টিপে বল্লে, “ক্রমে দেখ্তে পাবি।”
ভাগ্নে বই তিনটে নিয়ে লাফাতে লাফাতে বাড়ির বুড়ি ঝিকে দেখাতে নিয়ে গেল।
৩
ইতিমধ্যে মামা একখানা নাটক লিখেছে। ছত্রপতি শিবাজী তার নায়ক।
বন্ধুরা বললে, “এ নাটক নিশ্চয় থিয়েটারে চল্বে।”
সে মনে মনে স্পষ্ট দেখ্তে লাগল, রাস্তায় রাস্তায় গলিতে গলিতে তার নিজের নামে আর নাটকের নামে যেন শহরের গায়ে উল্কি পরিয়ে দিয়েছে।
আজ রবিবার। তার থিয়েটার-বিলাসী বন্ধু থিয়েটার-ওয়ালাদের কাছে অভিমত আন্তে গেছে। তাই সে পথ চেয়ে রইল।
রবিবারে তার ভাগ্নেরও ছুটি। আজ সকাল থেকে সে এক খেলা বের করেছে, অন্যমনস্ক হ’য়ে মামা তা লক্ষ্য করে নি।
ওদের ইস্কুলের পাশে ছাপাখানা আছে। সেখান থেকে ভাগ্নে নিজের নামের কয়েকটা সীসের অক্ষর জুটিয়ে এনেছে। তার কোনোটা ছোট, কোনোটা বড়।
যে-কোনো বই পায় এই সীসের অক্ষরে কালী লাগিয়ে তাতে নিজের নাম ছাপাচ্চে। মামাকে আশ্চর্য্য ক’রে দিতে হবে।৪
আশ্চর্য্য করে দিলে। মামা এক সময়ে বস্বার ঘরে এসে দেখে, ছেলেটি ভারী ব্যস্ত।
কি কানাই, কি কর্ছিস্?
ভাগ্নে খুব আগ্রহ করে’ই দেখালে সে কি কর্চে। কেবল তিনটি মাত্র বই নয়, অন্ততঃ পঁচিশখানা বইয়ে ছাপার অক্ষরে কানাইয়ের নাম!
এ কি-কাণ্ড। পড়া-শুনোর নাম নেই, ছোঁড়াটার কেবল খেলা! আর এ কি-রকম খেলা!
কানাইয়ের বহু-দুঃখে-জোটানো নামের অক্ষরগুলি হাত থেকে সে ছিনিয়ে নিলে।
কানাই শোকে চীৎকার করে’ কাঁদে, তার পরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে, তার পরে থেকে থেকে দম্কায় দম্কায় কেঁদে ওঠে, কিছুতেই সান্ত্বনা মানে না।
বুড়ি ঝি ছুটে এসে জিজ্ঞেস কর্লে, “কি হ’য়েছে, বাবা?”
কানাই বল্লে, “আমার নাম।”
মা এসে বল্লে, “কি রে কানাই, কি হয়েছে?”
কানাই রুদ্ধকণ্ঠে বল্লে, “আমার নাম।”
ঝি লুকিয়ে তার হাতে আস্ত একটি ক্ষীরপুলি এনে দিলে, মাটিতে ফেলে দিয়ে সে বল্লে, “আমার নাম!”
মা এসে বল্লে, “কানাই, এই নে তোর সেই রেলগাড়ীটা।”
কানাই রেলগাড়ী ঠেলে ফেলে বল্লে, “আমার নাম।”
থিয়েটার থেকে বন্ধু এল।
মামা দরজার কাছে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস কর্লে, “কী হ’ল?”
বন্ধু বল্লে, ‘ওরা রাজী হ’ল না।”
অনেকক্ষণ চুপ করে’ থেকে মামা বল্লে,”আমার সর্ব্বস্ব যায় সেও ভাল, আমি নিজে থিয়েটার খুল্ব।”
বন্ধু বল্লে, “আজ ফুটবল ম্যাচ দেখ্তে যাবে না?”
ও বল্লে, “না, আমার জ্বরভাব।”
বিকেলে মা এসে বল্লে, “খাবার ঠাণ্ডা হয়ে গেল।”
ও বল্লে, “খিদে নেই!”
সন্ধ্যের সময় স্ত্রী এসে বল্লে, “তোমার সেই নতুন লেখাটা শোনাবে না?”
ও বল্লে, “মাথা ধরেছে!”
ভাগ্নে এসে বল্লে, “আমার নাম ফিরিয়ে দাও!”
মামা ঠাস্ করে’ তার গালে এক চড় কষিয়ে দিলে।