মীনু

 মীনু পশ্চিমে মানুষ হয়েচে। ছেলেবেলায় ইঁদারার ধারে তুঁতের গাছে লুকিয়ে ফল পাড়তে যেত; আর অড়র-ক্ষেতে যে বুড়ো মালী ঘাস নিড়োত তার সঙ্গে ওর ছিল ভাব।

 বড় হয়ে জৌনপুরে হল ওর বিয়ে। একটি ছেলে হয়ে মারা গেল, তার পরে ডাক্তার বল্‌লে, “এও বাঁচে কি না বাঁচে।”

 তখন তাকে কলকাতায় নিয়ে এল।

 ওর অল্প বয়েস। কাঁচা ফলটির মত ওর কাঁচা প্রাণ পৃথিবীর বোঁটা শক্ত করে আঁক্‌ড়ে ছিল। যা-কিছু কচি, যা-কিছু সবুজ, যা-কিছু সজীব, তার পরেই ওর বড় টান।

 আঙিনায় তার আট-দশ হাত জমি, সেইটুকুতে তার বাগান।

 এই বাগানটি ছিল যেন তার কোলের ছেলে। তারই বেড়ার পরে যে ঝুম্‌কো লতা লাগিয়েছিল এইবার সেই লতায় কুঁড়ির আভাস দিতেই সে চলে এসেচে।

 পাড়ার সমস্ত পোষা এবং না-পোষা কুকুরের অন্ন আর আদর ওরই বাড়িতে। তাদের মধ্যে সব-চেয়ে যেটিকে সে ভালোবাসত তার নাক ছিল খাঁদা, তার নাম ছিল ভোঁতা।

 তারই গলায় পরাবে বলে মীনু রঙীন পুঁতির মালা গাঁথতে বসেছিল। সেটা শেষ হল না। যার কুকুর সে বল্‌লে, “বৌ-দিদি, এটিকে তুমি নিয়ে যাও।”

 মীনুর স্বামী বল্‌লে, “বড় হাঙ্গাম, কাজ নেই।”

 কলকাতার বাসায় দোতলার ঘরে মীনু শুয়ে থাকে। হিন্দুস্থানী দাই কাছে বসে কত কী বকে; সে খানিক শোনে, খানিক শোনে না।

 একদিন সাররাত মীনুর ঘুম ছিল না। ভোরের আঁধার একটু যেই ফিকে হল সে দেখ্‌তে পেলে, তার জান্‌লার নীচেকার গোলক-চাঁপার গাছটি ফুলে ভরে উঠেচে। তার একটু মৃদু গন্ধ মীনুর জানলার কাছটিতে এসে যেন জিজ্ঞাসা করলে, “তুমি কেমন আছ?”

 ওদের বাসা আর পাশের বাড়িটার অল্প একটুখানি ফাঁকের মধ্যে ঐ রৌদ্রের কাঙাল গাছটি, বিশ্বপ্রকৃতির এই হাবা ছেলে, কেমন-করে’ এসে পড়ে’ যেন বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

 ক্লান্ত মীনু বেলায় উঠ্‌ত। উঠেই সেই গাছটির দিকে চেয়ে দেখ্‌ত সেদিনের মত আর ত তেমন ফুল দেখা যায় না। দাইকে বলত, “আহা দাই, মাথা খা, এই গাছের তলাটি খুঁড়ে দিয়ে রোজ একটু জল দিস্‌।”

 এই গাছে কেন যে ক’দিন ফুল দেখা যায় নি, একটু পরেই বোঝা গেল।

 সকালের আলো তখন আধ-ফোটা পদ্মের মতো সবে জাগ্‌চে, এমন সময় সাজি-হাতে পূজারি ব্রাহ্মণ গাছটাকে ঝাঁকানি দিতে লাগ্‌ল, যেন খাজনা আদায়ের জন্যে বর্গির পেয়াদা।

 মীনু দাইকে বল্‌লে, “শীঘ্র, ঐ ঠাকুরকে একবার ডেকে আন্‌‍।”

 ব্রাহ্মণ আস্‌তেই মীনু তাকে প্রণাম করে বল্লে, “ঠাকুর, ফুল নিচ্চ কার জন্যে?”

 ব্রাহ্মণ বল্‌লে, “দেবতার জন্যে।”

 মীনু বললে, “দেবতা ত ঐ ফুল স্বয়ং আমাকে পাঠিয়েচেন।”

 “তোমাকে?”

 “হাঁ, আমাকে। তিনি যা দিয়েছেন সে ত ফিরিয়ে নেবেন বলে দেন নি।”

 ব্রাহ্মণ বিরক্ত হয়ে চলে গেল।

 পরের দিন ভোরে আবার সে যখন গাছ-নাড়া দিতে সুরু কর্‌লে তখন মীনু তার দাইকে বললে, “ও দাই, এ ত আমি চোখে দেখ্‌তে পারিনে। পাশের ঘরের জান্‌লার কাছে আমার বিছানা করে দে!”

 পাশের ঘরের জান্‌লার সাম্‌নে রায়চৌধুরীদের চৌতলা বাড়ি। মীনু তার স্বামীকে ডাকিয়ে এনে বল্‌লে, “ঐ দেখ, দেখ, ওদের কি সুন্দর ছেলেটি! ওকে একটিবার আমার কোলে এনে দাও না!”

 স্বামী বল্‌লে, “গরীবের ঘরে ছেলে পাঠাবে কেন?”

 মীনু বল্‌লে, “শোন একবার! ছোট ছেলের বেলায় কি ধনী-গরীবের ভেদ আছে? সবার কোলেই ওদের রাজ-সিংহাসন।”

 স্বামী ফিরে এসে খবর দিলে, “দরোয়ান বল্‌লে, বাবুর সঙ্গে দেখা হবে না।”

 পরের দিন বিকেলে মীনু দাইকে ডেকে বল্‌লে, “ঐ চেয়ে দেখ্‌‍, বাগানে একলা বসে খেলচে। দৌড়ে যা, ওর হাতে এই সন্দেশটি দিয়ে আয়।”

 সন্ধ্যাবেলায় স্বামী এসে বল্‌লে, “ওরা রাগ করেছে।”

 “কেন, কী হয়েচে?”

 “ওরা বলেচে, দাই যদি ওদের বাগানে যায় ত পুলিসে ধরিয়ে দেবে।”

 এক মুহূর্ত্তে মীনুর দুই চোখ জলে ভেসে গেল। সে বল্‌লে, ‘আমি দেখেচি, দেখেচি, ওর হাত থেকে ওরা আমার সন্দেশ ছিনিয়ে নিলে। নিয়ে ওকে মার্‌লে! এখানে আমি বাঁচব না। আমাকে নিয়ে যাও।”