গল্প

 ছেলেটির যেম্‌নি কথা ফুট্‌ল অম্‌নি সে বল্‌লে, “গল্প বল!”

 দিদিমা বল্‌তে শুরু কর্‌লেন, “এক রাজপুত্তুর, কোটালের পুত্তুর, সদাগরের পুত্তুর—”

 গুরুমশায় হেঁকে বললেন, “তিন-চারে বারো।”

 কিন্তু তখন তার চেয়ে বড় হাঁক দিয়েছে রাক্ষসটা, “হাঁউ মাউ খাঁউ—” নাম্‌তার হুঙ্কার ছেলেটার কানে পৌঁছয় না।

 যারা হিতৈষী তারা ছেলেকে ঘরে বন্ধ করে গম্ভীর স্বরে বললে, “তিন-চারে বারো এটা হল সত্য; আর রাজপুত্তুর, কোটালের পুত্তুর, সওদাগরের পুত্তুর—ওটা হল মিথ্যে, অতএব—”

 ছেলেটির মন তখন সেই মানসচিত্রের সমুদ্র পেরিয়ে গেছে, মানচিত্রে যার ঠিকানা মেলে না; তিন-চারে বারো তার পিছে পিছে পাড়ি দিতে যায়, কিন্তু সেখানে ধারাপাতের হালে পানি পায় না।

 হিতৈষী মনে করে, নিছক দুষ্টমি, বেতের চোটে শোধন করা চাই।

 দিদিমা গুরুমশায়ের গতিক দেখে চুপ। কিন্তু আপদ বিদায় হতে চায় না, এক যায় ত আর আসে। কথক এসে আসন জুড়ে বস্‌লেন। তিনি সুরু করে দিলেন এক রাজপুত্রের বনবাসের কথা।

 যখন রাক্ষসীর নাক-কাটা চল্‌চে তখন হিতৈষী বল্‌লেন, ইতিহাসে এর কোনো প্রমাণ নেই; যার প্রমাণ পথে ঘাটে, সে হচ্চে তিন-চারে বারো।

 ততক্ষণে হনুমান লাফ দিয়েচে আকাশে, অত ঊর্দ্ধে ইতিহাস তার সঙ্গে কিছুতেই পাল্লা দিতে পারে না। পাঠশালা থেকে ইস্কুলে, ইস্কুল থেকে কলেজে ছেলের মনকে পুটপাকে শোধন করা চল্‌তে লাগ্‌ল। কিন্তু যতই চোলাই করা যাক্‌, ঐ কথাটুকু কিছুতেই মর্‌তে চায় না, “গল্প বল!”

 এর থেকে দেখা যায়, শুধু শিশুবয়সে নয়, সকল বয়সেই মানুষ গল্পপোষ্য জীব। তাই পৃথিবী জুড়ে মানুষের ঘরে ঘরে, যুগে যুগে, মুখে মুখে, লেখায় লেখায় গল্প যা জমে উঠেচে তা মানুষের সকল সঞ্চয়কেই ছাড়িয়ে গেছে।

 হিতৈষী একটা কথা ভালো করে ভেবে দেখে না, গল্প রচনার নেশাই হচ্চে সৃষ্টিকর্ত্তার সব-শেষের নেশা; তাঁকে শোধন কর্‌তে না পার্‌লে মানুষকে শোধন করার আশা করা যায় না।

 একদিন তিনি তাঁর কার্‌খানা-ঘরে আগুন থেকে জল, জল থেকে মাটি গড়্‌তে লেগে গিয়েছিলেন। সৃষ্টি তখন গলদ্‌‍ঘর্ম্ম, বাষ্পভারাকুল। ধাতু-পাথরের পিণ্ডগুলো তখন থাকে থাকে গাঁথা হচ্চে;—চারদিকে মালমসলা ছড়ানো আর দমাদম পিটনি। সেদিন বিধাতাকে দেখ্‌লে কোনোমতে মনে করা যেতে পার্‌ত না যে তাঁর মধ্যে কোথাও কিছু ছেলেমানুষী আছে। তখনকার কাণ্ডকার্‌খানা যাকে বলে “সারবান্‌।”

 তার পরে কখন্‌ শুরু হল প্রাণের পত্তন। জাগ্‌ল ঘাস, উঠ্‌ল গাছ, ছুট্‌ল পশু, উড়্‌ল পাখী। কেউবা মাটিতে বাঁধা থেকে আকাশে অঞ্জলি পেতে দাঁড়াল, কেউবা ছাড়া পেয়ে পৃথিবীময় আপনাকে বহুধা বিস্তার করে চল্‌ল, কেউ বা জলের যবনিকাতলে নিঃশব্দনৃত্যে পৃথিবী প্রদক্ষিণ কর্‌তে ব্যস্ত, কেউ বা আকাশে ডানা মেলে সূর্য্যালোকের বেদীতলে গানের অর্ঘ্যরচনায় উৎসুক। এখন থেকেই ধরা পড়্‌তে লাগল বিধাতার মনের চাঞ্চল্য।

 এমন করে বহু যুগ কেটে যায়। হঠাৎ এক সময়ে কোন্ খেয়ালে সৃষ্টিকর্ত্তার কারখানায় উনপঞ্চাশ পবনের তলব পড়্‌ল। তাদের সব-ক’টাকে নিয়ে তিনি মানুষ গড়্‌লেন। এতদিন পরে আরম্ভ হল তাঁর গল্পের পালা। বহুকাল কেটেচে তাঁর বিজ্ঞানে, কারু-শিল্পে; এইবার তাঁর সুরু হল সাহিত্য।

 মানুষকে তিনি গল্পে গল্পে ফুটিয়ে তুলতে লাগ্‌লেন। পশুপাখির জীবন হল আহার নিদ্রা সন্তানপালন; মানুষের জীবন হল গল্প। কত বেদনা, কত ঘটনা; সুখদুঃখ রাগবিরাগ ভালোমন্দের কত ঘাতপ্রতিঘাত। ইচ্ছার সঙ্গে ইচ্ছার, একের সঙ্গে দশের, সাধনার সঙ্গে স্বভাবের, কামনার সঙ্গে ঘটনার সংঘাতে কত আবর্ত্তন। নদী যেমন জলস্রোতের ধারা, মানুষ তেমনি গল্পের প্রবাহ। তাই পরস্পর দেখা হতেই প্রশ্ন এই, “কী হল হে, কি খবর, তার পরে?” এই “তার-পরের” সঙ্গে “তার-পরে” বোনা হয়ে পৃথিবী জুড়ে মানুষের গল্প গাঁথা হচ্চে। তাকেই বলি জীবনের কাহিনী, তাকেই বলি মানুষের ইতিহাস।

 বিধাতার রচা ইতিহাস আর মানুষের রচা কাহিনী, এই দুই কথায় মিলে মানুষের সংসার। মানুষের পক্ষে কেবল যে অশোকের গল্প, আক্‌বরের গল্পই সত্য তা নয়; যে রাজপুত্র সাত-সমুদ্র-পারে সাতরাজার-ধন-মাণিকের সন্ধানে চলে সেও সত্য; আর সেই ভক্তিবিমুগ্ধ হনুমানের সরল বীরত্বের কথাও সত্য যে-হনুমান গন্ধমাদনকে উৎপাটিত করে আন্‌তে সংশয় বোধ করে না। এই মানুষের পক্ষে আরঞ্জেব যেমন সত্য, দুর্যোধনও তেমনি সত্য। কোন্‌‍টার প্রমাণ বেশী, কোন্‌‍টার প্রমাণ কম সে হিসাবে নয়; কেবল গল্প হিসাবে কোন্‌‍টা খাঁটি, সেইটেই তার পক্ষে সবচেয়ে সত্য।

 মানুষ বিধাতার সাহিত্য-লোকেই মানুষ—সুতরাং না সে বস্তুতে গড়া, না তত্ত্বে—অনেক চেষ্টা করে’ হিতৈষী কোনমতেই এই কথা মানুষকে ভোলাতে পারলে না। অবশেষে হয়রান হয়ে হিতকথার সঙ্গে গল্পের সন্ধি-স্থাপন করতে সে চেষ্টা করে, কিন্তু চিরকালের স্বভাবদোষে কিছুতে জোড়া মেলাতে পারে না। তখন গল্পও যায় কেটে হিতকথাও পড়ে খসে, আবর্জ্জনা জমে ওঠে।