লুকোচুরি/প্রথম পরিচ্ছেদ
লুকোচুরি।
◇◇◇◇◇◇
প্রথম পরিচ্ছেদ।
◇◇◇◇◇◇
পশ্চিমগগনে শুকতারা উঠিয়াছে। রাত্রি প্রায় শেষ। প্রকৃতি নিস্তব্ধ—কেবল মলয়পবন প্রবাসীর দীর্ঘশ্বাসের ন্যায় থাকিয়া থাকিয়া শন্ শন্ শব্দে প্রবাহিত হইতেছে। জন-মানবের সাড়াশব্দ নাই; মধ্যে মধ্যে দুই একজন পুলিস-প্রহরীর ভয়ানক চীৎকার প্রকৃতির সেই গভীর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিতেছে। এমন সময় আমি একটা হত্যাকাণ্ডের অনুসন্ধান করিয়া থানায় ফিরিয়া আসিলাম।
সমস্ত দিবস কঠোর পরিশ্রম করিয়া এবং সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়া, আমি অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম; থানায় ফিরিয়া একটা নিভৃতস্থানে বসিয়া বিশ্রাম লাভ করিতে লাগিলাম।
ফুল্ল-ফুলবাস-স্নাত মৃদুমন্দ মলয়পবন সেবন করিয়া আমার অবসাদ দূর হইল এবং অতি অল্পকালের মধ্যেই নিদ্রাকর্ষণ হইল। আমার বাহ্যজ্ঞান লোপ হইল, ক্রমে গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত হইয়া পড়িলাম।
কতক্ষণ নিদ্রিত ছিলাম বলিতে পারি না। এক কনষ্টেবলের বিকট চীৎকারে আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল। চক্ষু উন্মীলন করিয়া দেখি, থানার সম্মুখেই একখানি ভাড়াটিয়া গাড়ী দাঁড়াইয়া রহিয়াছে এবং এক ভদ্র-যুবক সেই গাড়ী হইতে অবতরণ করিতেছেন।
যুবককে আমার গৃহে লইয়া যাইতে বলিয়া আমি গাত্রোত্থান করিলাম। তখন ঊষার আলোকে চারিদিক উদ্ভাসিত হইয়াছিল, উচ্চবৃক্ষশিরে স্বর্ণাভ সূর্য্যরশ্মি প্রতিবিম্বিত হইয়া নবোদ্গত পত্রগুলিকে স্নেহময় করিয়াছিল। বিহঙ্গমকুল আপন আপন কুলায় ত্যাগ করিয়া আহারান্বেষণে নিযুক্ত হইয়াছিল এবং রাখালগণ গোধন লইয়া ধীরে ধীরে মাঠের দিকে ধাবমান হইতেছিল।
তখনই আমি প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া অফিস-ঘরে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, যুবকের বয়স প্রায় আটাইশ বৎসর। তাঁহাকে দেখিতে শ্যামবর্ণ; হৃষ্টপুষ্ট, বলিষ্ঠ, নাতিদীর্ঘ ও নাতিখর্ব্ব। মুখ অতি সুন্দর, অঙ্গসৌষ্ঠব অতি চমৎকার।
আমি গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিবামাত্র যুবক আসন ত্যাগ করিয়া দণ্ডায়মান হইলেন এবং আমাকে অতি বিনীতভাবে নমস্কার করিলেন। তাঁহাকে উপবেশন করিতে অনুরোধ করিয়া আমি তাঁহার সম্মুখস্থ একখানি চেয়ারে বসিয়া পড়িলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মহাশয়ের নাম কি? কি অভিপ্রায়ে এমন সময়ে এখানে আসিয়াছেন?”
যুবক বিনীতভাবে উত্তর করিলেন, “আমার নাম অনাথনাথ মুখোপাধ্যায়। বিষম বিপদে পড়িয়াই আপনার শরণ লইয়াছি।”
আমি আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি বিপদ স্পষ্ট করিয়া না বলিলে আপনার কোন উপকার করিতে পারিব না।”
অনাথ বাবু ঈষৎ লজ্জিত হইলেন। তিনি বলিলেন, “যদি অনুগ্রহ করিয়া একবার আমাদের বাড়ীতে পদধূলি দেন, তাহা হইলে আমার স্ত্রীর মুখে সকল কথাই শুনিতে পাইবেন। কোথা হইতে একখানি পত্র পাইয়া তিনি ভয়ানক ভীত হইয়াছেন।”
আগন্তুকের অনুরোধ এড়াইতে পারিলাম না। আমি তখনই তাহার কথায় সম্মত হইলাম এবং যে গাড়ী করিয়া তিনি থানায় আসিয়াছিলেন, সেই গাড়ীতে গিয়া উপবেশন করিলাম।
শিয়ালদহ ষ্টেশন হইতে কিছুদূরে অনাথনাথের বাড়ী; অর্ধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা সেখানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। অনাথনাথের বাড়ীখানি দ্বিতল এবং নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে। বাড়ীখানি দ্বি-মহল। অনাথনাথ আমাকে প্রথম মহলের দ্বিতলস্থ বৈঠকখানায় লইয়া গেলেন এবং অতি যত্নের সহিত সেই স্থানে বসিতে বলিলেন।
বৈঠকখানা ঘরটী দৈর্ঘ্যে প্রস্থে দশ হাতের কম নহে। ঘরের ভিতর ঢালা-বিছানা,—প্রথমে মাদুর, তাহার উপর সতরঞ্চ, তাহার উপর একখানি অতি শুভ্র চাদর। বিছানার চারিদিকে চারিটা তাকিয়া, মধ্যস্থলে দুইটা বৈঠকের উপর দুইটা রূপা বাঁধান হুকা। ঘরের দেওয়ালে কয়েকখানি হিন্দু-দেবদেবীর ছবি, মধ্যে মধ্যে এক একটী জোড়া দেওয়ালগিরি।
আমাকে সেই ঘরে বসিতে বলিয়া অনাথনাথ অন্দরে গমন করিলেন এবং কিছুক্ষণ পরেই ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, “আমার স্ত্রী পার্শ্বের ঘরে আসিয়াছেন। দুইটী গৃহের মধ্যে যে দরজা আছে, সেইটী খুলিয়া দিতেছি। তাহা হইলে তিনি আমাদিগের কথাবার্তা শুনিতে পাইবেন এবং আবশ্যক হইলে সংশোধন করিতে পারিবেন।”
আমি কোন কথা কহিলাম না। অনাথনাথ গৃহমধ্যস্থ একটী দ্বার খুলিয়া দিলেন এবং ঠিক তাহার নিকটে গিয়া উপবেশন করিলেন। পরে আমাকেও সেই স্থানে যাইতে অনুরোধ করিলেন। আমিও অগত্যা সেইখানে গিয়া বসিলাম।
কিছুক্ষণ পরে অনাথনাথ একটা স্বর্ণ-নির্ম্মিত ক্ষুদ্র শূকর ও একখানি পত্র বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিয়া বলিলেন, “এই সোনার শূকর ও এই কাগজে অঙ্কিত শূকরমূর্ত্তি দেখিয়া আপনার মনে কি কোন সন্দেহ হয়? এই দুই পদার্থের মধ্যে কোন প্রকার সংশ্রব আছে কি?”
আমি দুইটী দ্রব্যই হাতে লইয়া উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করিলাম। দেখিলাম, স্বর্ণ-নির্ম্মিত ক্ষুদ্র শূকরটী মস্তকের অলঙ্কাররূপে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। শূকরটীতে অন্ততঃ দুই ভরি বিশুদ্ধ স্বর্ণ আছে, এবং উহা কোন ইংরাজকারিকরের দ্বারা গঠিত। দেশীয় কারিকর কর্ত্তৃক প্রস্তুত করা হইলে শূকরমূর্ত্তি ঐ প্রকার হইত না বলিয়াই আমার বিশ্বাস হইল। যে কাগজখানি পাইলাম, তাহাতেও অবিকল ঐ প্রকার শূকর-মূর্ত্তি অঙ্কিত ছিল। কিন্তু কাগজখানিতে অপর কতকগুলি লেখায় পরিপূর্ণ। লেখাগুলি কাগজে যেমন ছিল, নিম্নে সেইরূপ লিখিত হইল।
বছিনি হুএয়া দিইমৃ নপত্যু পত্রর রেপ্রজ সথন্য ন্ধামপ্র ননিস্তু পাশাত ইনাহ য়াজাও।”
আমি কিছুক্ষণ ঐ কাগজখানি অতি মনোযোগের সহিত দেখিতে লাগিলাম, কিন্তু দুঃখের বিষয়—সহজে উহার কোন অর্থ উপলব্ধি করিতে পারিলাম না।
আমাকে নিস্তব্ধ দেখিয়া অনাথনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিছু বুঝতে পারিলেন? আমিত যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াও সফল হইতে পারি নাই। শুনিয়াছি, আপনি এইরূপ অনেক পত্র পাঠ করিয়াছেন, এই প্রকার অনেক কঠিন রহস্য ভেদ করিয়াছেন, সেই জন্যই আপনার সাহায্য প্রার্থনা করিতেছি। আপনি এখানকার এবং অন্যান্য অনেক স্থানের দুর্বৃত্ত লোকদিগকে জানেন, অনায়াসেই তাহাদিগকে গ্রেপ্তার করিতে পারেন, সহজে কেহ আপনার চক্ষে ধূলি দিতে পারিবে না। এখন বলুন, আমি কি করিব?”
আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম, “কাগজখানিতে যাহা লেখা আছে তাহা এখন বুঝিতে পারিলাম না। কিন্তু কিছুক্ষণ চেষ্টা করিলে উহার মর্ম্ম ভেদ করিতে পারিব, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। এখন যদি আমার সাহায্য লওয়া আপনাদের অভিপ্রেত হয়, তাহা হইলে কোন বিষয় গোপন না করিয়া প্রথম হইতে সকল কথা বলুন। তাহা না হইলে আমি আপনাদের সাহায্য করিতে সক্ষম হইব না। প্রথমতঃ এই সোনার শূকর এবং এই কাগজখানি কোথায় পাইলেন, আর ইহার জন্যই বা আপনাদের এত ভয় কেন? সমস্ত কথা জানিতে পারিলে আমি প্রাণপণে আপনাদের সাহায্য করিব।”
অনাথনাথ একবার গৃহ মধ্যে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলেন। পরে বলিলেন, “এই বাড়ী আমার নহে,—আমার স্ত্রীয় দূর-সম্পর্কীয় এক খুড়ীর বাড়ী। এ বাড়ীতে আমরা দুজন, তিনি, তাঁহার এক দিদি এবং দুইজন দাসী ও এক ভৃত্য, এই কয়জনে বাস করি। আমার বাড়ী পূর্ব্ববঙ্গে—কিন্তু আমি কলিকাতাতেই বহুদিন হইতে বাস করিতেছি। বিবাহের পর আমার স্ত্রীর অনুরোধে আমিও এখানে বাস করিতে আরম্ভ করিয়াছি—”
বাধা দিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার স্ত্রী পূর্ব্বে কোথায় ছিলেন?”
অ। তাঁহার পিতার সহিত পশ্চিমে ছিলেন।
আ। পশ্চিমে? কোথায়?
অ। আজ্ঞা কানপুরে। তিনি কলিকাতায় মিলিটারি ডিপার্টমেণ্টে কর্ম্ম করিতেন। সহসা বদলি হইয়া কানপুরে গমন করেন। বিমলার তখন বিবাহ হয় নাই, সুতরাং সেও তাঁহার সহিত কানপুরে যান।
আ। বিমলা কে? আপনার স্ত্রীর নাম কি বিমলা?
অ। আজ্ঞে হাঁ।
আ। আপনার শ্বশুর পূর্ব্বে কোথায় থাকিতেন?
অ। এই বাড়ীতে।
আ। আপনার শ্বশুরকে দেখিয়াছেন?
অ। আজ্ঞে না, তাঁহার মৃত্যুর পর বিমলা পুনরায় কলিকাতায় আগমন করিলে আমাদের বিবাহ হয়।
আ। কতদিন বিবাহ হইয়াছে?
অ। ছয় মাসের অধিক নহে।
আ। সোনায় শূকরটী কোথা হইতে পাইয়াছেন?
অ। আমার শ্বশুর মহাশয়ের মৃত্যুর পর আমার স্ত্রীকে প্রায় তিন মাস কানপুরে থাকিতে হয়। শ্বশুর মহাশয় মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব্বে তাঁহার কয়েক জন বিশ্বাসী বন্ধুর হস্তে আপনার কন্যার লালন পালন ভার দিয়াছিলেন। তাঁহারাই উদ্যোগী হইয়া শ্বশুর মহাশয়ের বিষয়-সম্পত্তি বিক্রয় করতঃ নগদ টাকা করিয়া আমার স্ত্রীর নামে, ব্যাঙ্কে জমা দিয়াছিলেন এবং একজন বিশ্বাসী বৃদ্ধা রমণীর সহিত কলিকাতায় পাঠাইয়া দেন। তাঁহারাই আমার স্ত্রীকে ঐ শূকরটী দিয়াছিলেন।
আ। তাঁহারা উহা পাইলেন কোথায়?
অ। আমার শ্বশুরেরই জিনিষ—তাঁহার বাক্সে ছিল। তাঁহার বন্ধুগণ আর সমস্ত দ্রব্য বিক্রয় করিয়াছিলেন কিন্তু এই শূকরটী বিক্রয় করেন নাই।
আমি আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেন? যদি সকল জিনিষই বিক্রয় করিয়া থাকেন, তবে এটা রাখিলেন কেন?”
অ। দেখিতে শূকরের আকৃতি হইলেও উহা মাথায় কাঁটার ন্যায় ব্যবহার করিতে পারা যায় দেখিয়া এবং আমার স্ত্রী উহা ব্যবহার করিতে পারিবেন জানিয়া তাঁহারা ঐটী বিক্রয় করেন নাই।
আ। বেশ কথা। এখন বলুন, এই কাগজ দেখিয়া আপনার ও আপনার স্ত্রীর এত ভয় হইয়াছে কেন? আর কাগজখানিই বা কোথা হইতে পাইয়াছেন?
অ। কাল বেলা দশটার সময় আমার স্ত্রী ও তাঁহার খুড়ীমা আহার করিতে বসিয়াছেন, এমন সময়ে ডাকপিয়ন কতকগুলি পত্র দিয়া গেল। পত্র কয়খানির মধ্যে একখানি আমার স্ত্রীর নামে ছিল। অপর পত্রগুলি পাঠ করিয়া সকলের শেষে আমি সেই পত্রখানি খুলিয়া ফেলিলাম এবং ঐ শূকর-মূর্ত্তি ও সেই সাঙ্কেতিক ভাষা উভয়ই আমার নয়নগোচর হইল। আমার স্ত্রী তখনই আহার সমাপন করিয়া আমার নিকট আগমন করিলেন। আমিও তাহাকে পত্রখানি দেখাইলাম। তিনি উহা আমার হাত হইতে লইলেন এবং তখনই তাহার খুড়ীমার নিকট লইয়া গেলেন। আমারও এত কৌতূহল জন্মিয়াছিল যে, আমিও তাহার সহিত তাহার খুড়ীমার নিকট গমন করিলাম, কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, বৃদ্ধা যখনই ঐ কাগজের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন, তখনই তাঁহার মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করিল। তাঁহার মলিন মুখ দেখিয়া আমার বোধ হইল, তিনি অত্যন্ত ভীত হইয়াছেন। এত মনোযোগের সহিত তিনি কাগজখানি দেখিতেছিলেন যে, আমি সাহস করিয়া সে সময়ে তাঁহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম না। কিছুক্ষণ পরে বৃদ্ধা কিয়ৎ পরিমাণে সুস্থ হইলেন। আমি তখন তাঁহার ভয়ের কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম।
এই বলিয়া অনাথনাথ নিস্তব্ধ হইলেন। তাঁহার বাহ্যিক ভাব দেখিয়া বুঝিলাম, তিনিও ভীত হইয়াছেন। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তিনি কি বলিলেন?”
অ। তিনি যাহা বলিলেন, তাহা অতি ভয়ানক। শুনিলে হৃদকম্প উপস্থিত হয়। তিনি বলিলেন, আমার শ্বশুর মহাশয় বর্দ্ধমান জেলায় চাষবাস করিতেন। তাঁহার অধীনে প্রায় সহস্র বিঘা জমী ছিল, অনেক লোকজন তাঁহার বাড়ীতে প্রতিপালিত হইত। তাঁহার আয়ও যথেষ্ট ছিল। তাঁহার দোর্দণ্ড প্রতাপে স্বয়ং জমীদার পর্য্যন্ত ভীত হইতেন। কিন্তু সহসা একদিন সেই সমস্ত ত্যাগ করিয়া আমার স্ত্রী ও আর দুইটী পুত্রের সহিত কলিকাতায় চলিয়া আইসেন।
আ। আপনার শ্যালক দুইজন কি এখন জীবিত আছেন?
অ। আজ্ঞে না—তাহাদিগকে কলিকাতার এই বাড়ীতে রাখিয়া শ্বশুর মহাশয় কেবল বিমলাকে লইয়া স্বতন্ত্র একটী বাড়ী ভাড়া করেন এবং কমিশরিয়েটে একটী চাকরি যোগাড় করিয়া সেইখানেই কার্য্য করিতে থাকেন। কমিশরিয়েট মিলিটারি ডিপার্টমেণ্টেরই অন্তর্গত, এখানে কার্য্য করিলে প্রায়ই বদলি হইতে হয়। দুই তিনমাস চাকরী করিবার পর, তিনি কানপুরে বদলি হন। বিমলাও তাঁহার সহিত তথায় গমন করেন। একবৎসর অতীত হইতে না হইতে পুত্র দুইটী যে কোথায় অদৃশ্য হইলেন, তাহা কেহই বলিতে পারিল না কিন্তু তাঁহাদের আকস্মিক অন্তর্দ্ধানের পূর্ব্বে তাঁহারাও এই প্রকার শূকর-মূর্ত্তি-সমন্বিত পত্র পাইয়াছিলেন।
বাধা দিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কতদিন পূর্ব্বে আপনার শ্যালক দুইজন অদৃশ্য হইয়া গিয়াছেন।”
অনথনাথ কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, “জ্যেষ্ঠ প্রসাদ দাস প্রায় দেড় বৎসর হইল, এবং কনিষ্ঠ বীরেন্দ্রনাথ প্রায় একবৎসর পূর্ব্বে অন্তর্দ্ধান হইয়াছেন।
আ। সে সময় এ সংবাদ পুলিসে পাঠান হইয়াছিল কি?
অ। আজ্ঞে না। বিমলার খুড়ীমা বলিলেন, প্রথম শ্যালক প্রসাদদাস অদৃশ্য হইবার পর তিনি শ্বশুর মহাশয়কে সমস্ত ব্যাপার জানাইয়া একখানি পত্র লিখিয়াছিলেন। উত্তরে তিনি ঐ বিষয়ে আর কোন প্রকার গোলযোগ করিতে নিষেধ করিয়া দেন। সেই জন্যই তিনি থানায় সংবাদ দিতে পারেন নাই।
আ। প্রথম শ্যালকের অন্তর্দ্ধানের ছয়মাস পরে দ্বিতীয় শ্যালক অদৃশ্য হন। সম্ভবতঃ তাঁহার অদৃশ্য হইবার ছয়মাস পরে আপনার শ্বশুর মহাশয়ও অন্তর্দ্ধান হন, কেমন?
অনথনাথ সাগ্রহে উত্তর করিলেন, “আপনি যথার্থই অনুমান করিয়াছেন। যদিও শ্বশুর মহাশয়ের বন্ধুগণ আমার স্ত্রীকে তাঁহার মৃত্যু-সংবাদ প্রদান করিয়াছিলেন, তত্রাপি যখন আমার স্ত্রী তাঁহাকে দেখিতে ইচ্ছা করেন, তখন তাঁহারা কৌশলে বিমলাকে সান্ত্বনা করিয়াছিলেন। আমার স্ত্রী বলেন, তিনি মারা পড়েন নাই—নিশ্চয়ই আমার শ্যালকদিগের মত অদৃশ্য হইয়াছেন। কিন্তু পাছে বিমলা ভীত হন, এই ভয়ে ও সকল কথা বলেন নাই।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার স্ত্রীর তখন বয়স কত?”
অ। প্রায় তের বৎসর।
আ। তাঁহার পিতার মৃত্যু হইল কি না তিনি সহজেই জানিতে পারিতেন। তিনি ত একাই তাঁহার পিতার নিকট থাকিতেন।
অ। আজ্ঞে হাঁ,—একাই থাকিতেন বটে, কিন্তু তখন কোন প্রতিবেশীর বিবাহ উপলক্ষে বিমলাকে কয়েক দিনের জন্য সেখানে যাইতে হইয়াছিল। যখন বাসায় ফিরিয়া আসিতেছিলেন, সেই সময়ে তাঁহার পিতার মৃত্যু-সংবাদ প্রাপ্ত হইলেন।
আ। তাহা হইলে আপনার শ্বশুর ও দুইজন শ্যালক ঐরূপে অদৃশ্য হইয়াছেন। তাঁহাদের কি হইয়াছে অনুমান করিতে পারেন কি?
আ। আজ্ঞে আমিতো সামান্য বুদ্ধির লোক, কেমন করিয়া বলিব? তবে যতদূর বুঝিতে পারা যায়, তাহাতে দেখিতেছি, তাঁহারা আর এ জগতে নাই। যদি থাকিতেন, তাহা হইলে এত দিন অতীত হইল তিনজনের কেহ কি ফিরিয়া আসিতে পারিতেন না?
আ। আপনার স্ত্রী কি বলেন?
অ। তিনি আর বলিবেন কি? যখন তাঁহার খুড়ীর মুখে ঐ সকল কথা শুনিলেন, তখন তিনি চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। বলিলেন, এইবার তাঁহার পালা আসিয়াছে, এবং সেই অবধি নিতান্ত দুঃখিতভাবে কালযাপন করিতেছেন। এখন আপনি আমাদের ভরসা।