লেখকের কথা/বাংলা প্রগতি সাহিত্যের আত্মসমালোচনা
বাংলা প্রগতি সাহিত্যের আত্মসমালোচনা
পৌষ, ১৩৫৩ সংখ্যা “পরিচয়ে” প্রকাশিত “বাংলা প্রগতি সাহিত্যের আত্মসমালোচনা” শীর্ষক প্রবন্ধটি আমি সমগ্রভাবে প্রত্যাহার করছি। এদেশে শ্রেণী সংগ্রামের বর্তমান পর্যায় সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী প্রাপ্ত ধারণার ফলেই তার জন্ম।
এরূপ প্রত্যাহার ঘোষণার প্রয়োজন হবে ভাবিনি। আমার ধারণা ছিল নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল বিষয়টি সমগ্রভাবে পুনর্বিবেচনাসাপেক্ষ এবং এ লেখাটিও বাতিল বলে বিবেচিত হবে। প্রশ্নটা সামগ্রিক বিচারের, সুতরাং গুরুতর ভুল সত্ত্বেও কোন লেখায় কোন্ কোন্ সঠিক কথা বলা হয়েছে সেটা তুলে ধরবার চেষ্টা নিরর্থক এবং অনুচিত। সব কিছু বাতিল হোক বা না হোক, সব কিছুই নতুনভাবে বিচার করতে হবে। আনুষঙ্গিক বা আংশিক সত্য যদি বলা হয়ে থাকে, তার স্থান হবে ভুলভ্রান্তি সংশোধন করা ও নতুনভাবে বিচারের ভিত্তিতে লেখা প্রবন্ধে।
দেখা যাচ্ছে, অনেকের ধারণা এই যে, আমি এখনও উপরোক্ত প্রবন্ধের মতামত আঁকড়ে আছি। পুনর্বিবেচনার জন্য তাই এই প্রত্যাহার ঘোষণার প্রয়োজন হলো।
আমার এই প্রবন্ধটি সম্পর্কে ফাল্গুনের “পরিচয়ে” সিতাংশুবাবুর আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে। লেখাটি মার্ক্সবাদের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা পদ্ধতিকে, বৈঠকী তার্কিকের যেন-তেন-প্রকারেণ বিপক্ষকে (?) ঘায়েল করার স্তরে নামিয়ে আনার একটি নিদর্শন বলে মনে হয়েছে। লেখাটি নিয়ে বিশদ আলোচনার কোন প্রয়োজন নেই। আমি শুধু লেখাটির প্রথম প্যারাটির বিচার করবো, এবং ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক দু’-একটি অপ্রাসঙ্গিক অভিযোগের জবাব দেবো। কোন লেখার প্রথম প্যারা থেকেই যদি প্রমাণ করা যায় যে, সমালোচক তাঁর আলোচ্য প্রবন্ধটি ভালো করে না পড়েই মার্ক্সবাদের উদ্ধৃতি-ভূষিত আলোচনাটি লিখে ফেলেছেন, তখন সমস্ত লেখাটি নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন থাকে কি?
ঐতিহ্য সম্পর্কে আমার একটি মত ছিল, রবীন্দ্র গুপ্ত ঐতিহ্য বিচারের যে নতুন ‘ভিত্তি’ সরবরাহ করেন, আমি সেটা গ্রহণ করি। এই প্রসঙ্গে আমার আগের মতটা কি ছিল তার বিবরণ আমার প্রবন্ধে দাখিল করি। “আমার মতটা কি ছিল এবং কিভাবে আমি রবীন্দ্র গুপ্তের মত গ্রহণ করেছি একটু বলা দরকার।” [পরিচয়, পৌষ, পৃঃ ৩৬]
সিতাংশুবাবুকে পায় কে! নতুন মত গ্রহণের আগে আমার পুরনো মত কি ছিল তার বিবরণ থেকে উদ্ধৃতি তুলে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, আমি কেমন নতুন একটা মত মেনে নিয়েও তার বিরোধী কথা লিখছি!
আরও আছে, প্রথম প্যারাতেই আছে । প্যারার শুরুতেই সিতাংশুবাবু লিখেছেন যে, আমি “প্রকাশ রায়ের বক্তব্য রবীন্দ্র গুপ্তের লেখা” পড়ার পর মেনে নিয়েছি। এটা আংশিক সত্য অবলম্বন করে একটা মিথ্যাকে দাঁড় করাবার চেষ্টা। আমার প্রবন্ধে কি কোনরূপ অস্পষ্টতা আছে যে, শুধু ঐতিহ্য সম্পর্কে প্রকাশ রায়ের মতটা রবীন্দ্র গুপ্তের মতের ভিত্তিতে মেনে নিয়েছিলাম? প্রবন্ধের গোড়াতেই নম্বর দিয়ে লিস্ট দাখিল করেছি, প্রকাশ রায়ের কোন্ কোন্ বক্তব্য সম্পর্কে আমার কি বক্তব্য ছিল—এবং নম্বর (২ নং বক্তব্য) উল্লেখ করে স্পষ্টই বলেছি যে, রবীন্দ্র গুপ্তের লেখা পড়ে কেবল ঐতিহ্য সম্পর্কে আমার মত বদলেছি। প্রকাশ রায়ের লেখাকে রবীন্দ্র গুপ্ত মোটামুটিভাবে সমর্থন করেন— আমি তা করিনি। প্রকাশ রায়ের খণ্ডিত দৃষ্টি, বামপন্থী বিচ্যুতি না দেখা, যান্ত্রিকতা, প্রভৃতির যে সমালোচনা আমার প্রবন্ধে আছে, সেটা কি তার বক্তব্যকে মেনে নেওয়ার প্রমাণ?
সিতাংশুবাবু অভিযোগ করেছেন: “এই সম্পর্কে মানিকবাবু গত প্রগতি সাহিত্য সম্মেলনের ইস্তাহার রচনা নিয়েও কতগুলি কথা বলেছেন, যেগুলি সেই সম্মেলনের ইস্তাহার পুনর্লিখন কমিটির সভ্য হিসাবে তাঁর বলা ঠিক হয়েছে কিনা তাঁকে ভেবে দেখতে বলি।”
অর্থাৎ সিতাংশুবাবু বলতে চান, কমিটির সভায় কিছু না বলে পরে আমার প্রবন্ধে ইস্তাহারটির নিন্দা করা ঠিক হয়নি। কমিটির সভ্য হিসাবে পুনর্লিখিত ইস্তাহার সম্পর্কে আমার দায়িত্ব ভুলে গিয়েছি। নিজেকে বাঁচিয়ে অন্যদের নিন্দা করা আমার অন্যায় হয়েছে।
এও আরেকটা প্রমাণ যে, সিতাংশুবাবু আমার প্রবন্ধটি ভালো করে না পড়েই সমালোচনা করেছেন। ইস্তাহারটি সম্পর্কে কাকে বা কাদের কটাক্ষ করা হয়েছে আমার প্রবন্ধে? কোথায় অস্বীকার করেছি আমার দায়িত্ব? ইস্তাহারটি মনের মতো না হলেও সেটি গ্রহণযোগ্য বলার জন্য, ভালো একটি ইস্তাহার লেখার অক্ষমতার জন্য শুধু আমাকেই বরং আমি খোঁচা দিয়েছি। নিন্দা করেছি, “প্রগতি লেখক সংঘের সম্পাদক ও সম্মেলনের কার্যকরী সভাপতি”কে [ পরিচয়, পৌষ, পৃঃ ৪৫ ]। ইস্তাহার পুনর্লিখন কমিটির সভার বিবরণ স্মরণ আছে, কিন্তু আমিই যে ছিলাম সংঘের সম্পাদক ও সম্মেলনের কার্যকরী সভাপতি, সেটা আজ স্মরণ করিয়ে দিতে হচ্ছে সিতাংশুবাবুকে।
ইস্তাহার পুনর্লিখন কমিটির উল্লেখ আমার প্রবন্ধে নেই। উল্লেখ করলে এ স্বীকৃতিও অবশ্যই থাকতো যে, আমিও ওই কমিটির সভ্য ছিলাম।
৫১ পৃষ্ঠায় [ পরিচয়, ফাল্গুন সংখ্যা ] সিতাংশুবাবু লিখেছেন: “মানিকবাবুকে আশ্বাস দিচ্ছি তাঁকে শ্রমিক হতে হবে না, কেননা শ্রমিক হলেই সাহিত্য লেখা যায় না।”
শ্রেণী-সম্পর্ক, শ্রেণী-বিচ্যুতি, শ্রেণী-সংগ্রামে অংশ গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে আমি যা বলিনি তাই আমার বক্তব্য বলে, এবং আমি যা বলেছি সেটা বিকৃত করে উপস্থিত করেছেন, তাই কি যথেষ্ট ছিল না? এ ব্যক্তিগত মিথ্যা আক্রমণ কেন? আমি শ্রমিক হতে অনিচ্ছুক, এ নির্লজ্জ ঘোষণা তো আমার লেখায় কোথাও নেই! আমার লেখায় বরং শ্রমিকশ্রেণীকেই ষোল আনা বিপ্লবী, সেরা মানুষ বলে অভিনন্দিত করা হয়েছে।
মার্ক্সবাদ লেনিনবাদ থেকে চয়ন করে নয়, সিতাংশুবাবু নিজে আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন! অথচ শ্রমিক শব্দের মানেই তিনি জানেন না। তাই তিনি নির্বিবাদে ঘোষণা করেছেন, জগতের শ্রমিকশ্রেণীর নেতা স্টালিনও শ্রমিক নন!
বুঝতে পারা যায় যান্ত্রিক অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি সিতাংশুবাবুকে কোন্ ধাঁধায় ফেলেছে: কারখানায় না খেটে কি করে শ্রমিক হওয়া যায়? শ্রমিক না হয়েও শ্রমিকশ্রেণীর নেতা হওয়া সম্ভব, যেমন স্টালিন, কিন্তু কারখানায় না খাটলে শ্রমিক হবে কোন্ যুক্তিতে?
সিতাংশুবাবু নিজেই এ সমস্যার মীমাংসা করতে পারেন। শ্রমিকশ্রেণীর বন্ধু আছেন, শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থ, সংগ্রাম ও চেতনা ষোল আনা নিজের করে নিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর একজন হয়ে পড়ুন। দেখবেন, কারখানার মারফতে ছাড়া এভাবেও শ্রমিক হওয়া যায়—শ্রমিকশ্রেণীর একজন হওয়ার যুক্তিতে।