লেখকের কথা/ভারতের মর্মবাণী

ভা র তে র ম র্ম বা ণী


 ঐতিহাসিক ঘটনার ধারাবাহিক বাস্তবতাকে আশ্রয় করে ভারতের দেড়শ’ দু’শ’ বছরের জাতীয় জীবনের মর্মকথাকে মঞ্চের উপর নৃত্য-নাট্যের স্বল্প পরিসরের মধ্যে সার্থক রূপ দেওয়া কি সম্ভব? ভারতীয় গণ-নাট্যসঙ্ঘের কেন্দ্রীয়বাহিনীর অভিনীত ‘ভারতের মর্মবাণী’ প্রত্যক্ষ করবার আগে এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ ছিল। কারণ, নৃত্য-নাট্য সম্বন্ধে আমাদের অভিজ্ঞতা এই যে, ভাব ও কল্পনাই এর প্রাণ, ঘটনা তার প্রতীক মাত্র; ভাব ও কল্পনার রূপকধর্মী সাঙ্কেতিক ব্যঞ্জনার উপরেই নৃত্য-নাট্যের সার্থকতা নির্ভর করে। নৃত্য-নাট্যের সরলতা, স্পষ্টতা ও বলিষ্ঠতা আমাদের কাছে স্থুলতার সামিল। আমাদের ধারণা এই যে, নৃত্যগীত সমন্বিত প্রতীক-নাট্যে এই তিনটি গুণের সমাবেশ ঘটলে ভাবের গভীরতা ব্যাহত হয় এবং অবদানের সমগ্রতা রক্ষা করা যায় না। ‘তাসের দেশ’ ও সাধারণ ‘রামলীলা’ অভিনয়ের পার্থক্য মনে রাখলে এই সিদ্ধান্তে আসাই স্বাভাবিক। এ কথা খুবই সত্য যে, ‘তাসের দেশ’-এর টেকনিক অবলম্বন করলে ঐতিহাসিক ঘটনাশ্রয়ী ধারাবাহিকতার কাঠামো বর্জন করতে হয়, সময়-নিরপেক্ষ সমগ্র ভাব-সংঘাতের চুম্বক ভিত্তি করে, তাকেই রূপ দেবার চেষ্টা করতে হয়। অপরপক্ষে, ‘রামলীলা’র টেকনিক নিলে ঘটনা সাজিয়ে সাজিয়ে গড়ে তুলতে হয় বিস্তৃত কাহিনী, ঘটনার তাৎপর্য গেঁথে গেঁথে সম্পুর্ণতা দিতে হয় মূল ভাবধারাকে। এক্ষেত্রে ঘটনাই সর্বস্ব, কাজেই প্রত্যেকটি ঘটনাকে দিতে হয় কলাসম্মত গঠন ও রূপ। নৃত্য-নাট্য আবার বেশি দীর্ঘ হলে জমে না।

 এদিক দিয়ে বিচার করলে তবেই ঠিকমতো উপলব্ধি করা যায়, ‘ভারতের মর্মবাণী’ নৃত্য-নাট্যটির পরিকল্পনা ও অভিনয় ভারতীয় গণ-নাট্যসঙ্ঘের কত বড় কৃতিত্বের পরিচয়। ইংরেজের এদেশে পদার্পণের সময় থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত ভারতের জাতীয় জীবনের ইতিহাসকে উচ্চাঙ্গের নৃত্য-নাট্যে রূপায়িত করার একমাত্র যে টেকনিক, এঁরা সেটি খুঁজে বার করে কাজে লাগিয়েছেন; যার দ্বারা নৃত্য-নাট্যে, ঘটনার বাস্তব নির্দেশ ও ভাব-সংঘাতের রূপকধর্মী অভিব্যক্তির সমন্বয় ঘটানো সম্ভব হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের লোক-নৃত্য, পল্লীগীতি প্রভৃতির সরলতা, স্পষ্টতা ও বলিষ্ঠতা এঁরা এদের নৃত্য-নাট্যে সঞ্চারিত করেছেন। সব রকম বাহুল্য, জটিলতা ও আড়ম্বর বর্জন করা হয়েছে। সুর ও ধ্বনি সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা হয়েছে সাধারণ কয়েকটি যন্ত্র।

 পল্লী-চারণের গাথা, লোক-নৃত্য ও লোক-সঙ্গীতের ছন্দ সুর এবং ধ্বনি, ভঙ্গি আলোকপাত ও অপূর্ব অভিনয়-নৈপুণ্যের সমন্বয়ে ‘ভারতের মর্মবাণী’ হয়েছে মর্মস্পর্শী। বুদ্ধিবিলাসী থেকে সাধারণ দর্শক, সকলের কাছেই এর আবেদন সমান বলিষ্ঠ। আত্মকলহের সুযোগে এদেশে ইংরাজের প্রতিষ্ঠালাভ, দারিদ্র্য, জমিদারের অত্যাচার, যন্ত্রযুগ, রেলপথ, কারখানা, বণিকের শোষণ, যুদ্ধ, নতুন দুর্দশা, জাতীয় নেতাদের কারাবাস, অনৈক্য, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, আমলাতন্ত্রের আশ্রয়পুষ্ট মজুতদার ও অতিলোভী ব্যবসায়ীর পেষণে নিষ্পিষ্ট জনগণ, সমস্তই নৃত্য-নাট্যটিতে রূপ পেয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে আরম্ভ ও শেষ নয়। তাহলে ‘ভারতের মর্মবাণী’ অসম্পূর্ণ থেকে যেত। গোড়ায় পল্লীচারণের গাথায় আছে ভারতের অতীত গৌরবের কাহিনী, সমাপ্তিতে জনগণের মুক্তিকামনা রূপ নিয়েছে জাগ্রত জনগণের সমবেত দাবীর কাছে দেশী ও বিদেশী অত্যাচারীর পরাজয়ে।

 নৃত্য-নাট্যটির পূর্বে বাংলা, গান্ধার, অন্ধ্র, যুক্তপ্রদেশ প্রভৃতি বিভিন্ন প্রদেশের নাচ ও গান পৃথকভাবে দেখানো হয়েছে ওঙ্কার আহ্বান, লম্বার্দি নৃত্য, ধোবিনৃত্য, নবান্ন উৎসব, রামলীলা ইত্যাদিতে। এর দ্বারা লোক-নৃত্যের সঙ্গে সম্পুর্ণ পরিচয়হীন দর্শকের মনও প্রস্তুত হতে পেরেছে। এটা খুব বড় কথা। লোক-কলার মারফতে নতুন চিন্তা ও বর্তমান যুগের সমস্যাগুলিকে সামনে ধরবার জন্যে লোক-কলার খাঁটি রূপের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল, যাতে আমাদেরই অবহেলায় লুপ্তপ্রায় এই জাতীয় সাংস্কৃতিক সম্পদের মূল্য সম্বন্ধে আমরা সচেতন হয়ে উঠতে পারি।

 সংস্কৃতির কোন বিশিষ্ট রূপ ও ধারাকে সংস্কারের মতো রূপান্তরহীন করে রাখলে তার কোন ভবিষ্যৎ থাকে না, তার মৃত্যু অনিবার্য। লোক-কলাকে বাঁচাবার ও লোক-শিক্ষার বাহন হিসাবে তাকে কাজে লাগাবার উদ্দেশ্য তখনই সফল হতে পারে, যখন জনগণের জীবনের বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা স্থাপন করা যায়, তাদেরই জীবন্ত আনন্দ-বেদনা আশা-নিরাশা সঙ্কট ও সমস্যা রূপায়িত হয়। গণ-নাট্যসঙ্ঘ এটা উপলব্ধি করেছেন। তাঁরা তাই দেশের সামনে শুধু লোক-কলার কতকগুলি নমুনা ধরে দেশবাসীর কাছে আবেদন জানাননি— ‘জাতির এই সম্পদকে রক্ষা করা চাই!’ জানালে সেটা অরণ্যে রোদন হতো মাত্র । নিজেরাই তাঁরা কাজটা আরম্ভ করেছেন—দেশের সামনে শুধু আদর্শটা নয়, উপায়টাও ধরে দিয়েছেন। সকলের মন তাই নাড়া খেয়েছে, সাড়া মিলেছে।

 এই কার্যে ব্রতী তরুণ ও অ্যামেচার অভিনেতা ও অভিনেত্রী নিয়ে গড়া এই বাহিনীটির বয়স এক বছরও পূর্ণ হয়নি। এঁদের এই অপূর্ব অভিনয় নৈপুণ্য কোথা থেকে এল? কি এঁদের অভিনব সাফল্যের মর্মকথা? এর একটিমাত্র জবাব জানি—এঁরা শুধু শিল্প-প্রাণ নন, দেশপ্রাণও বটে। আর্টের জন্য আর্টের ধোঁয়ায় এঁদের চোখ কটকট করে না, শিল্পীর কর্তব্য সম্বন্ধে এঁদের দ্বিধাও নেই, দুর্বলতাও নেই। এই প্রসঙ্গে গণ-নাট্যসঙ্ঘের বাংলা শাখার এমনি অল্পবয়সী অ্যামেচার অভিনেতা অভিনেত্রীদের প্রদর্শিত ‘জবানবন্দী’ ও ‘নবান্ন’র কথা স্মরণীয়। এ দুটি নাটক নাট্য-জগতে কি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে কারো তা অজানা নয়। ‘নবান্ন’ অভিনয়ের জন্য আজ চেষ্টা করেও স্টেজ ভাড়া পাওয়া যায় না। সাধারণ রঙ্গমঞ্চের কর্তারা ভয় পেয়ে গিয়েছেন। অথচ এঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার কোন ইচ্ছাই গণ-নাট্যসঙ্ঘের নেই—এঁরা ব্যবসায়ী নন, লাভের টাকা শিল্পী বা পরিচালক কারো পকেটে যায় না। বাংলার দুর্ভিক্ষের জন্য বাংলা শাখা বোম্বাই ও পাঞ্জাবে সফর দিয়ে লক্ষাধিক টাকা সংগ্রহ করেছিল, ‘নবান্ন’ অভিনয়ের কয়েক হাজার টাকা বাংলায় মহামারীর চিকিৎসায় লেগেছে।

 রঙ্গালয়ের পরিচালকদের তবু এত আতঙ্ক কেন? সোজাসুজি প্রতিযোগিতার ভয় এঁদের নেই—এঁদের ভয় দর্শক সাধারণের রুচির পরিবর্তনে। কিন্তু সস্তা নাটক ও সস্তা অভিনয় দিয়ে দর্শককে ভোলাতে বাঙলা রঙ্গমঞ্চের কর্তারাই বা চাইবেন কেন? আর, তাঁরা যদিই বা মুনাফার লোভে তা চান, রঙ্গমঞ্চের শিল্পীরা কেন তাতে সায় দেবেন? তাঁরা কি নূতনতর সৃষ্টিতে ও সৃষ্টির তাগিদে সাড়া দিতে পারবেন না—এতই কি জড়তাপ্রাপ্ত হয়েছেন?

 এই আতঙ্ক ও প্রতিকূলতার প্রতিরোধের মধ্যেও গণ-নাট্যসঙ্ঘের আন্দোলনের ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেখতে পাই। দেশ এঁদের আন্দোলনকে সমর্থন ও গ্রহণ করেছে— সারা দেশে এঁদের প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে।

 কথা-শিল্পী হিসাবে ভারতীয় গণ-নাট্যসঙ্ঘের কাছে একটি ব্যক্তিগত ঋণের কথা স্বীকার না করলে অন্যায় হবে। নতুন প্রেরণা ও উদ্দীপনা পাওয়ার ঋণ নয়,― ওটা শুধু আমাকেই নয়, সকলকেই ওঁরা পরিবেশন করেছেন, সেজন্য ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞতা জানাবার প্রয়োজন ছিল না। সাহিত্যিক হিসাবে আমার একটি ভীরুতা সম্বন্ধে এঁরা আমাকে সচেতন করেছেন। পাঠক সাধারণকে একটু রেশিরকম ভোঁতা ও একগুঁয়ে মনে করার প্রতিক্রিয়া, অনেক লেখকের রচনাতেই কতগুলি অনাবশ্যক সতর্কতা হয়ে দেখা দেয় নানা ভাবে, এবং সমস্ত রচনাটিকে প্রভাবান্বিত করে। লেখকের ভীরুতাই এজন্য দায়ী। সঙ্ঘের অভিনব প্রচেষ্টাকে সাধারণ দর্শক যে রকম উদারতার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন, তাতে আমি উপলব্ধি করেছি যে, আমরাই, লেখক ও শিল্পীরাই, পাঠক ও দর্শক সাধারণের ঘাড়ে অযথা দোষ চাপাই, তাঁদের কতগুলি সঙ্কীর্ণতা ও বিরোধিতা স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নিই। আসলে তাঁরা আমাদের সব রকম সুযোগ ও স্বাধীনতা দিতে সর্বদাই প্রস্তুত, আমরাই তাঁদের এই উদারতা স্বীকার করতে ভয় পাই। আমি বিশ্বাস করি, নিজের এই দুর্বলতা চেনার ফলে আমার লেখার উন্নতি হবে।