লেখকের কথা/পাঠকগোষ্ঠীর আলোচনা

‘পা ঠ ক গো ষ্ঠী’ র আ লো চ না


পরিচয় সম্পাদক সমীপেষু,

 পৌষের পরিচয়ে প্রকাশিত বিষ্ণু দে মহাশয়ের পত্রখানির অকারণ তিক্ততা ও অসংযম সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। মার্ক্‌সীয় সাহিত্য বিচার সম্পর্কে তাঁর ভুল ধারণার মতো এই তির্যক অবিনিয়ও প্রতিবাদযোগ্য। শারদীয়া সংখ্যা পত্রিকাগুলির কয়েকটি ছোট গল্প সম্পর্কে নীহার দাশগুপ্তের যে নিবন্ধের বিরুদ্ধে তাঁর পত্রাঘাত, বিষ্ণুবাবুকে এতখানি বিচলিত করার মতো কিছুই তাতে খুঁজে পেলাম না। নীহারবাবু কেবল একস্থানে লিখেছেন: “অচিন্ত্যকুমারের তীক্ষ্ণধার ভাষা ও গল্প বলার কায়দার জোরে গল্পগুলি সুখপাঠ্য হয়ে উঠলেও কোন এক কবি-সমালোচকের মতো তাঁকে হেমিংওয়ের সঙ্গে তুলনা করতে পারবো না। বলতে পারবো না, ‘তাঁর গল্পের জীবন জীবনেরই মতো বিচিত্র, তিক্ত, মধুর, বিস্ময়কর মিশ্রাবেগ’।”

বিষ্ণুবাবুর সঙ্গে মতের পার্থক্য ঘোষণা করা ছাড়া এর মধ্যে আর কি আছে, বিষ্ণুবাবুর কাছে যা তাঁকে ব্যক্তিগত ভাবে গঞ্জিত করার মতো আপত্তিকর হতে পারে!

 নীহারবাবুর নিবন্ধটি ঠিক সমালোচনাও নয়, আলোচনা মাত্র। শারদীয়া সংখ্যার কতকগুলি গল্প পড়ে তিনি সংক্ষেপে তাঁর সাহিত্যিক মতামত ও পছন্দ অপছন্দের ভিত্তিতেই গল্পগুলির মোটামুটি বিচার, পরিচয়ে দশজনের সামনে ধরেছেন―দশজনেও যাতে আলোচনা করেন। এটা সাহিত্যিক সৎপ্রচেষ্টা।

 বিষ্ণুবাবুর মার্ক্‌সিস্ট দৃষ্টি বিকৃত না হলে নীহারবাবুর প্রবন্ধের মূল ত্রুটি তাঁর চোখে উল্টো প্রতিভাত হতো না, সমালোচনাটির দক্ষিণঘেঁষা দুর্বলতাকে ট্রট্স্কিমার্কা প্রতিক্রিয়াশীলতা বলে ভুল করতেন না। আমাদের সকল প্রগতিপন্থী সাহিত্য সৃষ্টি ও সমালোচনা প্রচেষ্টার মধ্যে এই বামপন্থী বৈধর্মের পরিচয়, নিজ শ্রেণী-মূল-গত মোহ ও ভ্রান্তির নাগপাশ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হবার অক্ষমতার প্রমাণ, কমবেশি আছে—কিন্তু সেটা কোনমতেই উগ্র বামত্বের ট্রট্‌স্কিমার্কা প্রতিক্রিয়াশীলতা হয়ে উঠতে পারে না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও অচিন্ত্যকুমার প্রসঙ্গে নীহারবাবু শিককাবাব ও সন্দেশে গুলিয়ে ফেলেননি। তিনি যে মূল কথাটা ধরতে পারেননি তা হলো এই যে, মানিক বা অচিন্ত্য একজনও ভালো শিককাবাব বা সন্দেশ বানাচ্ছেন না। নীহারবাবুর মার্ক্‌সিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি কাঁচা বলেই ‘গায়েন’ ও ‘মুচিবায়েন’-এর তুলনামূলক পার্থক্যটাই তাঁর কাছে বড় হয়ে উঠেছে, আজকের দিনের জীবনের গতির সঙ্গে বাস্তব ও সত্যধর্মী সামঞ্জস্য রাখার যে প্রগতিশীল ‘সৎপ্রচেষ্টা’টুকু ‘গায়েন’ গল্পে তাঁর চোখে পড়েছে তাতেই তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। সেই পুরাতন ফাঁকি রসসৃষ্টির খাতিরে, ‘মুচিবায়েন’-এ আজকের দিনের চাষাভুষো, সবার জীবনের প্রথম ও প্রধান সত্য, আড়ালে রয়ে গিয়েছে বলে তাঁর কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ‘গায়েন’-এর আপেক্ষিক সাহিত্যিক সার্থকতা। এবং এ হিসাবে কথাটা সত্যই। প্রগতির প্রচেষ্টাতে খুশি হওয়া বরং ভালো, প্রচেষ্টার অভাবকে বরণ করার প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মচ্যুতির চেয়ে। চাষাভুষো নিয়ে গল্প লিখবো বাবুদের মনোরঞ্জনের জন্য, যারা দেহরক্ষার ব্যাপার অনেকটা সহজ করে মন নিয়ে কারবার করার অবসর পায়, এবং ওই অবসর-সোহাগী মনের খাতিরে একেবারে চেপে যাব চাষাভুষো পুরুষটা ও নারীটার অবসরহীন অকথ্য কঠোর দেহরক্ষার সংগ্রাম, অথচ রসসৃষ্টি করবো, একমাত্র ওই ছুটি ভূখা দেহের যৌন সম্পর্কের ভিত্তিতে—সাহিত্যসৃষ্টির এ ফাঁকি আজ অচল না হয়ে গেলেও ধরা পড়ে গিয়েছে। চাষীমজুরদের দেহ নিয়ে সাহিত্যের হাটে এ ব্যবসা চালানোর সহজ সরল মানেই হলো, পশুপাখীর প্রেমলীলা দর্শনে যে মনের বিকার তৃপ্ত হয়, সাহিত্যের পর্যায়ে তুলে সেই মনের বিকারকেই তৃপ্তিদান। ‘মুচিবায়েন’ সত্যিই তাই অশ্লীল। সত্যিই অবান্তর। অনাথপিণ্ডদসুতার একমাত্র বস্ত্রদানের ফলে যে অশ্লীলতা গুরুদাসবাবু কল্পনা করেছিলেন, সেটা গুরুদাসবাবুরই শ্লীলতা অশ্লীলতা সম্পর্কে চেতনার প্রশ্ন— চাষীমজুর মেয়ে বৌয়ের গা থেকে একমাত্র ছেঁড়া কাপড়খানা কেড়ে নেওয়ার অশ্লীলতার সঙ্গে তার আকাশ পাতাল তফাত। দেহ তো আর অশ্লীল নয়, দেহের চেতনাও নয়— ঐ চেতনার বিকৃতিই শুধু অশ্লীলতা। গোর্কি বেঁচে থাকলে আচমকা আসরে টেনে নামানোর চমক সামলে, সবিনয়ে বিষ্ণুবাবুকে এই দৃষ্টিতে আরেকবার শোলোকভের উপন্যাসটি পড়বার অনুরোধ জানাতেন নিশ্চয়। ‘কম্যুনিস্ট ও কসাকদের দুর্বলতা বা যৌন আত্মদানেই শেষ’—কিন্তু এই শেষটাই আসল বা বইখানার শেষ কথা নয়। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় যৌন সম্পর্কের বিপর্যয় সম্পর্কে ‘হিউম্যানিটি আপরুটেড্’ বইখানার নিরপেক্ষ পর্যালোচনা পড়ে দেখলেও বিষ্ণুবাবুর সাহায্য হতে পারে, খেয়াল হতে পারে যে, যৌন বিপর্যয়েরও একটা বিপ্লবাত্মক সত্য থাকে—বিপ্লবটা বাদ দিলে যা অর্থহীন। কম্যুনিস্ট ও কসাকদের যৌন আত্মদানই শোলোকভের উপন্যাসটির প্রধান কথা বা মর্মকথা নয়— যদিও বিষ্ণুবাবু তাই ধরে নিয়েছেন। এবং ধরে নেওয়ার ফলে, তিনিই গোর্কিকে প্রতিক্রিয়াশীলতার পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছেন—নীহারবাবু নন। তাই কি দাঁড়ায় না কথাটা?— শোলোকভের উপন্যাসে কম্যুনিস্ট ও কসাকদের দুর্বলতা বা যৌন আত্মদান ছাড়া আর কিছুই ছিল না—তবু শুধু আর্টের খাতিরে গোর্কি বইখানা ছাপিয়ে ছিলেন! এই যদি ‘আর্ট’, এবং একেই যদি এতটা খাতির গোর্কি করে থাকেন, তাঁকে প্রতিক্রিয়াশীল বলতেই হবে। ‘একটা মানুষ জন্মালো’ গল্পে অশ্লীলতার দ্বারপথে পুঁজ রক্তের সঙ্গে মানুষের জন্মলাভের বর্ণনাটাই “মনে হয়” বিষ্ণুবাবুর মতে “ যেন” গোর্কির গল্পটির একমাত্র সার্থকতা—আর্টত্ব।

 বিষ্ণুবাবুর মার্ক্‌সিস্ট জ্ঞান যে কতদূর অপরিচ্ছন্ন তার আরেক প্রমাণ, লেখা থেকে লেখককে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার যুক্তির মধ্যে পাই। “অচিন্ত্যকুমার হাকিম কিনা তা জানবার প্রয়োজন গল্প সমালোচনায় নেই, তিনি কৃষকসভার রিপোর্ট থেকে গল্প লেখেন কিনা তাও জানবার প্রয়োজন নেই।” অর্থাৎ শুধু লেখার বিচার করো, লেখককে বাদ দিয়ে।লেখা যেন আকাশ থেকে পড়ে—লেখক সম্পর্কে কিছুই না জেনে যেন লেখার সমালোচনা সম্ভব! শোলোকভ বা গোর্কির জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায় না বাংলাদেশে তা যেন না জানলেও চলে সমালোচকের। অচিন্ত্যকুমারের কলম কেন অনেকদিন থেমে ছিল, কেন আবার পূর্ববঙ্গের চাষীদের নিয়ে বিশেষ ধরনের গল্পের ফসলের আশ্চর্য ফলন শুরু হলো! কেবলমাত্র পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের নিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে তিনি যে দু’তিনখানা গল্পের বই দান করলেন, বাংলা সাহিত্যে যা সম্পূর্ণ নতুন প্রচেষ্টা, কোন্ সূত্রে এই নতুন উপাদানের সন্ধান তিনি পেলেন, আইন আদালত তাঁর সাম্প্রতিক গল্পে কেন এতটা প্রাধান্য পেলো, এ সর না জেনেই যেন তার গল্পের সঠিক সমালোচনা সম্ভব! প্রকৃতপক্ষে, বিষ্ণুবাবু এখানে ‘আর্টের জন্যই আর্ট’-এর পক্ষেই একটু ঘুরিয়ে ওকালতি করেছেন। মার্কসবাদের মূলকথা উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, লেখকের শ্রেণীগত চেতনার হিসাব না ধরেও লেখার বিচার চলে, লেখক কোন শ্রেণীর দৃষ্টিতে চাষীশ্রেণীর জীবনকে দেখছেন, গল্পের সমালোচনায় তার খোঁজ করা গোয়েন্দাগিরির সামিল!

 কিন্তু প্রগতিশীল-সমালোচনা, গালাগালি বা দুর্নামের ভয়ে লেখককে ছেড়ে কথা কইতে রাজী নয়, সংগ্রামী বাঙালীর সংস্কৃতির লাল রাস্তা কে তৈরি করেছে আর কিসে তৈরি হয়েছে সে বিষয়ে উদাসীন থেকে, তরল দীপ্তির চটুল আগুনে সমাজ-চেতনার ফুলঝুরির মোহে, সাহিত্যিক স্পেশাল পাওয়ার্সের খেলা চলতে দিতে রাজী নয়। কৃষকসভার রিপোর্ট থেকে যিনি গল্প লেখেন তাঁকেও নয়। কলকাতায় বসে যিনি ‘গায়েন’ লেখেন, হাকিমের আসনে বসে যিনি ‘মুচিবায়েন’ লেখেন, মার্ক্‌সবাদ নিয়ে যিনি ঘরে বসে কাব্য করেন তাঁদেরও নয়!

 সংগ্রামী বাঙালীর সংস্কৃতির লাল রাস্তা তৈরি করতে হলে সংগ্রামী সমালোচনা ছাড়া চলবে কেন? পুরানো সংস্কৃতির ধাঁধাকে সাদরে বজায় রেখে নতুন সংস্কৃতি গড়া যায় না।

 হেমিংওয়ের বিশেষ পরিণতির সঙ্গে অচিন্ত্যকুমারের বিশেষ পরিণতির তুলনাকে, হেমিংওয়ের সঙ্গে অচিন্ত্যকুমারের তুলনা বলে ভুল করে, নীহারবাবু গজেন্দ্রগামিনী মহিলাকে হাতি মনে করার মতো ‘বাজিকর সমালোচকে’ পরিণত হয়েছেন! নীহারবাবুর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য থেকে বোঝা অসম্ভব ‘পার্থক্য’টা তাঁর খেয়াল ছিল কিনা। তিনিই সেটা জানেন। তবে তাঁর মন্তব্য থেকে ধরে নিলে বোধ হয় অন্যায় হবে না যে, এ বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন না। হেমিংওয়ের সঙ্গেই তিনি অচিন্ত্যকুমারের তুলনা করার অক্ষমতা জ্ঞাপন করেছেন। কিন্তু এতই কি ভুল একটা কথা তিনি বলে ফেলেছেন? বিশেষ পরিণতি কি এমনই একটা ছাঁকা জিনিস যা বিচ্ছিন্ন করে এনে তুলনা করা যায়? হেমিংওয়ের এবং অচিন্ত্যকুমারের মধ্যে আর সমস্ত তুলনা বাদ দিয়ে শুধু তুলনা করা যায় তাঁদের বিশেষ পরিণতির? কিসের ভিত্তিতে সে তুলনা হবে? নির্গুণ, নিরপেক্ষ তুলনা, ‘abstract’-এর অঙ্গীকার যে মার্ক্‌সীয় ধারণা প্রণালীতে অর্থহীন, বিষ্ণুবাবু নিজেই তার পরিচয় দিয়েছেন হেমিংওয়ের বিশেষ পরিণতির সঙ্গে অচিন্ত্যকুমারের বিশেষ পরিণতির তুলনা করতে গিয়েই। ‘ভয়াবহ মিতভাষিত্বের’ প্রচণ্ড সার্থকতা লাভ, স্পেনের ফ্যাসিস্ট যুদ্ধ, দুর্গত-সমাজ-ভাঙা অত্যাচারে অনাচারে জর্জর বাংলা, দেশজ শব্দের তীক্ষ্ণ মর্যাদালাভ, সস্তা কারুণ্য থেকে মুক্তি, বিষয়ানুগ মানবিকতা ইত্যাদি ফর্ম ও কণ্টেণ্টগত সর্বাঙ্গীনতার মধ্যেই তাঁকে পরিণতির ভিত্তি খুঁজতে হয়েছে। দু’জনের পরিণতির তুলনার অর্থই তাই দু’জনের রচনাবলীর তুলনা এবং চেতনা ও দৃষ্টির পরিবর্তনের তুলনাও।

 শেষ কথাটা মনে রাখেন না বলেই সাহিত্যিকের বিশেষ পরিণতি সম্পর্কে বিষ্ণুবাবুর ভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, অচিন্ত্যকুমারের চাকুরিয়া বা মধ্যবিত্তকে নিয়ে লেখা গল্প ও চাষীজীবনের গল্পের স্টাইলের পার্থক্যের ভুল ব্যাখা দিতে হয় এবং ওই পার্থক্যের মধ্যেই বিশেষ পরিণতি আবিষ্কার করে উৎফুল্ল হন। মধ্যবিত্ত বা চাকুরিয়াদের নিয়ে লেখা-গল্পের “প্রখর ব্যঙ্গ ও প্রায় নেতিবাচক অবজ্ঞা ” ওই শ্রেণীরই আত্মবিরোধের প্রকাশ, অচিন্ত্যবাবু নিজেও যে আত্মবিরোধের অংশীদার। চাষী জীবনের সঙ্গে তাঁর কোন বিরোধ নেই, চাষী জীবন তাঁর কাছে শুধু দর্শনীয় ও বুদ্ধি-মননীয় ব্যাপার, সুতরাং চাষী জীবনের গল্পে ব্যঙ্গ ও অবজ্ঞার সেই তীব্র করুণ প্রকাশ ঘটবে কি করে? এ ক্ষেত্রে ব্যঙ্গের চেহারা চাষী জীবনকে বিকৃত করায়, অবজ্ঞার স্ফূর্তি চাষীজীবনের দীনতাকে হীন করায়। তেভাগা আন্দোলনটা নাই বা এল গল্পে, একজন বাজনদারের বৌ দিলোই বা তার দেহটা আর এক বাজনদারকে ঘুষ। কিন্তু তেভাগা আন্দোলনের মধ্যে সমগ্র চাষী জীবনের যে সত্যটা প্রকাশ পেলো, মুখ বুজে অত্যাচার সয়ে না গিয়ে চাষী মেয়ে পুরুষ আজ সচেতনভাবে সংগ্রাম করে অত্যাচারের বিরুদ্ধে, এই সত্যকে গল্পের মধ্যে কোন্ আর্টের ধামায় চাপা দেওয়া চলবে? এ তো শুধু তেভাগার প্রশ্ন নয়, এটাই চাষী জীবন, এটাই তার চেতনা—এবং জীবনে তার সহস্র আত্মপ্রকাশ! গল্পে বাজনদারের বৌ শতবার দেহ ঘুষ দিক—বাংলার চাষাভুষোর শত শত বৌ বাস্তবে তা দিয়েছে এবং দিচ্ছে, কিন্তু গল্প কি হবে ওইটুকুই? এ কি মধ্যবিত্তের ঘরের বৌয়ের দেহ ঘুষ দেওয়া যে, শুধু নীতিবোধের ধর্ষণেই করুণ রস সৃষ্টি হবে? চাষী বৌ নিজের দেহকে পণ্য করলে চাষীর জীবনের বাস্তবতাতেই খুঁজতে হবে তার মর্ম, তাতেই ফুটবে তার করুণ রূপ। নতুবা হবে অশ্লীলতা, ন্যাচারালিজ্‌ম্‌।

 আমরা ভদ্রলোকেরা বলি: আহা, গরীবের বৌ অভাবের তাড়নায় দেহ বিক্রি করলো! আমাদের ভাবখানা এই, যেন আমাদের আহা বলবার জন্যই সে এ কাজটা করেছে, অন্যথা কোন প্রয়োজনই ছিল না ।

 এই জন্যই লেখা থেকে লেখককে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। বিষ্ণুবাবু যদি এই অমার্ক্‌সীয় দৃষ্টি বর্জন করতেন, তাহলে দেখতে পেতেন, অচিন্ত্যকুমারের যে বিশেষ পরিণতির কথা বলছেন তার বিশেষত্ব, নতুন দৃষ্টি, নতুন চেতনা, নতুন জীবনবোধ বা মানসজগতের সমাজমানসগত মৌলিক কোন পরিবর্তন নয়—পরিণতি শুধু এই যে, তিনি নতুন বিষয়কে উপাদান করে আরও পাকা হাতে লিখছেন। তাঁর আগের স্টাইল আরও দৃঢ়বদ্ধ হয়েছে, তাঁর আগের দৃষ্টি আরও ব্যাপক, জীবনক্ষেত্রকে আরও পরিষ্কারভাবে দেখছে, অভিজ্ঞতার সাহিত্যিক রূপায়ণ আরও ঘন ও শৃংখলাবদ্ধ হয়েছে। তাঁর চিন্তাজগতে বিপ্লবাত্মক কোনও মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। মধ্যবিত্তের জীবন একদিন ছিল তাঁর সাহিত্যের অবলম্বন। তারপর চাকরি জীবনে চাষীর জীবন, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের মুসলমান চাষীর জীবন, একভাবে তাঁর সামনে এল, একদিকের উলঙ্গ বাস্তবরূপে। ত্রিশংকু শ্রেণীর স্বপ্ন ও বাস্তবে একাকার অর্থহীনতা, ভ্রান্তি, বিরোধ ও ব্যর্থতা, এক কথায় সীমানার মধ্যেই আবদ্ধ মধ্যবিত্ত জীবনের আত্মবিচারগত বাস্তবতা যেভাবে তাঁর সাহিত্যে এসেছিল, তেমনিভাবেই এল চাষীর জীবনের বাস্তবতা। তফাত শুধু হল এই যে, চাষীর রিক্ততা তাঁর চোখে মূল্য পেলো মধ্যবিত্তের ব্যর্থতায়, জমির ট্র্যাজেডি, অনাচার অত্যাচারের মর্ম রূপান্তরিত হতে লাগল মানসিক দ্বন্দ্বে। তাদের সঙ্গে স্বভাবতঃই দেশজ শব্দ এল এবং লাভ করলো অচিন্ত্যকুমারেরই নিজস্ব তীক্ষ্ণতা।

 হেমিংওয়ের পরিণতির সঙ্গে অচিন্ত্যকুমারের পরিণতির তুলনা করতে হলে, আগে তাই দরকার হয় এই দৃষ্টিতে হেমিংওয়ের পরিণতি এবং অচিন্ত্যকুমারের পরিণতির বিচার। অচিন্ত্যকুমার ভালো গল্প লিখতেন। আজ আরও ভালো গল্প লিখছেন। তাঁর পূর্ণতর বিকাশ হয়েছে। বিকাশ পরিবর্তন নয়। ধারা পরিপুষ্ট হওয়া ধারাবাহিকতাই। সমাজ ভাঙা জর্জর বাংলার চাষীজীবনের আসল বাস্তবতা কোথায় তাঁর সাহিত্যে? কোথায় বাঁচার সংগ্রাম, যা তাদের হাসিকান্না আনন্দবেদনা প্রেমবিরহ নীতিদুর্নীতি কলহবিবাদ একতা প্রতিরোধ— জীবনের সমস্ত অভিব্যক্তিকে প্রভাবান্বিত করেছে?

 প্রগতিশীল সমালোচনা, কাঁচা সমালোচনা পর্যন্ত, আজ তাই প্রথমেই খোঁজ করে সৃষ্ট-সাহিত্য জীবনের এই সর্বাধিক সত্য, বাস্তবতার এই প্রধান সর্ত, সংগ্রামকে স্বীকার করেছে কিনা। তার মানে এই নয় যে, সমালোচক সৃষ্ট-সাহিত্যের সার্থকতা বিচারের একমাত্র মাপকাঠি বেঁধে দিয়েছেনরণভূমির সম্মুখ যুদ্ধের প্রাথমিক অঙ্গীকার, চাষী লাঠি নিয়ে জমির জন্য লড়ছে মরছে—শুধু এই হবে চাষী জীবনের গল্পের উপজীব্য, এরকম হুকুম জারি করেছেন। প্রগতিবাদী এটুকু জানে যে, তাতে সংগ্রামকেই মিথ্যা ঘোষণা করা হয়। চাষীর জীবনে, জনসাধারণের, জীবনে, অত্যাচারী শক্তির সঙ্গে সামনাসামনি সংঘর্ষ ছাড়া সংগ্রামের আর কোন রূপ নেই, অভিব্যক্তি নেই,—এ তো সংগ্রামকেই অস্বীকার করা, সাময়িক একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনায় পরিণত করা। জীবনে ও চেতনায় ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে বলেই সংগ্রাম সত্য। চাষী শুধু তেভাগা করে না আজ, সে নিজেই ভাবে আর বলে, আগের মতো বৌকে মারধোর করা চলবে না। মন্দির মসজিদ পুরুত মোল্লার কাছে আজও সে মাথা নোয়ায়, কিন্তু তেমন আর অভিভূত হয় না। কবিয়ালের মুখে রামায়ণের যুদ্ধ বা কুরুক্ষেত্রের গানের বদলে আজকের মানুষের মুক্তি-লড়ায়ের গানে তার রোমাঞ্চ হয় বেশি। তার প্রেম, বাৎসল্য, ঘৃণা লজ্জা ভয় ক্রোধ আজ মাটির নরম সহিষ্ণুতায় গড়া নয়, তাতে কাস্তের কাঠিন্য ও ধার আছে।

 বাংলার চাষী গরীবদের জীবন সাহিত্যগত করার দায়িত্ব সোজা নয়। বিষ্ণুবাবু যদি তাঁর “প্রগতিবিলাসী বন্ধুদের” সঙ্গে এ দায়িত্ব পালনের সৎপ্রচেষ্টায় যোগ দিতেন তা হলে তাঁর কাছে ধরা পড়তো, এ বিলাস কি কঠিন কষ্টসাধ্য ব্যাপার! সাহিত্যপাঠের সহক্ষমতা শুধু নয়, মিলেমিশে নিজেদের চেতনা পুনর্গঠনের, আত্মকেন্দ্রিকতা, ভ্রান্তি, সংস্কার ও সংকীর্ণতা অপনোদনের, এবং আরও অনেক কিছুর জন্য কি বিরামহীন অনলস সংঘবদ্ধ সাধনা চলছে! “শ্রদ্ধা বিনয় আর সততা এবং অনলস অধ্যয়নের দ্বারা আমরা সবাই যেন সাহিত্যের প্রগতি প্রসারেই সাহায্য করতে পারি, দলগত মনোভাবে নয়”— বিষ্ণুবাবু এ আশা করতে পারেন বলে আমাদের কম মুস্কিল নয়। কারণ তিনি আমাদের বন্ধু মানুষ। মুস্কিল একটা নয়। কী ও’ কাকে শ্রদ্ধা করবো? জনসাধারণকে, না জনসাধারণ থেকে বিচ্যুত জনসাধারণের সংজ্ঞা-মূল্য-নির্ধারণকারীকে ও তাঁর সংজ্ঞামূল্যকে? কোন্ বিনয় অভ্যাস করবো? মানবতা-বিচ্যুত আধ্যাত্মিক বিনয়, অথবা জনসাধারণের সঙ্গে আমাদের স্বাতন্ত্র্য ও উচ্চতা যা ঘুচিয়ে দেয় সেই বিনয়? কোন্ সততাকে মর্যাদা দেবো? জনসাধারণের প্রতি বিশ্বাস-ঘাতকতার প্রতীক আমার শ্রেণীর প্রতি যে সততা, অথবা আমাদের চেয়ে জনসাধারণ বড়, এই সততা? অনলস অধ্যয়ন চালাবো কিসের এবং কি উদ্দেশ্যে? বই পড়ে বিদ্যার জাহাজ হতে, না বই পড়তে পড়তে জনসাধারণের জীবনে নেমে গিয়ে জীবনকে জানতে?

 সাধে কি আমরা শ্রদ্ধা আর বিনয়, সততা এবং অনলস অধ্যয়নের দুটো দুটো মানের মধ্যে, ব্যক্তিগত মানে বাদ দিয়ে ব্যাপক জীবনের ব্যাপক মানে গ্রহণ করেছি! নইলে শুধু মানের ধাঁধায় ঘুরপাক খেয়ে প্রাণ যায়!

 এই আমাদের দলগত মনোভাব। এই আমাদের স্বজাতিপ্রীতি। দুটো দল, হয়ে গিয়েছে, উপায় কি! ব্যক্তিগতদের ব্যক্তিপ্রীতির দল এবং জনসাধারণের নৈর্ব্যক্তিক স্বজাতিপ্রীতির দল। দ্বিতীয় দলে গত না হলে প্রগতি হয় না।