লেখকের কথা/সাহিত্য সমালোচনা প্রসঙ্গ

সা হি ত্য স মা লো চ না প্র স ঙ্গ

 সম্পাদক বার বার তাগাদা দিয়েছেন, আমি বার বার সময় চেয়ে নিয়েছি। কারণ, একজন সৎ ও চিন্তাশীল ব্যক্তির “অনাগতের প্রতীক্ষায়”-এর (নতুন সাহিত্য, চৈত্র ১৩৫৯) মতো প্রবন্ধকে হঠাৎ গ্রহণ বা বর্জন করার মতো বিদ্যাবুদ্ধি আমার আছে কিনা জানা ছিল না।

 “নতুন সাহিত্য” সম্পাদকের অনুরোধটাও মারাত্মক— তিনি সরাসরি আমাকে কথাশিল্পীর অবশ্য পালনীয় একটি মূলনীতি লঙ্ঘন করার আহ্বান জানিয়েছেন। অচ্যুতবাবুর সমালোচনামূলক প্রবন্ধটি সম্পর্কে কোন পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণার দাবি তিনি জানাননি—ঐ প্রবন্ধে আমার সাহিত্য সম্পর্কে যে সমালোচনা আছে শুধু সে বিষয়ে আমার মতামত চেয়েছেন। অচ্যুতবাবুর বক্তব্য আমি কি ভাবে নিয়েছি এটুকু বলাই যথেষ্ট।

 বন্ধুবর গোপাল হালদার তাঁর জবাবের শুরুতেই এ প্রথা চালু করে সম্পাদকের বিপদে পড়া সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন।

 সম্পাদকের বিপদ। অভিমানে খোঁচা লাগায় লেখকরা চটে যাবেন, এটাই কি আসল কথা? নিজের সাহিত্যের শিল্পমূল্যের বিচারটা মনঃপুত না হলেই চটে যাবেন এরকম শিশুর মতো অভিমানী লেখককে শুধু ধমক দিয়ে চটানো কেন, মেরে ধরে কাঁদালেই বা কি আসে যায়? দুটো মিষ্টি কথার লজেন্স দিলেই তো আবার তার মুখে হাসি ফুটবে!

 নিজের লেখার সমালোচনা নিয়ে বাদপ্রতিবাদে নামার প্রথা চালু করার বিপদ বরং লেখকদেরই,—নীতিভঙ্গের বিপদ।

 নিজের বই সম্পর্কে কোন সমালোচনার জবাবে লেখকের কিছু বলা সাংঘাতিক অনিয়ম।

 নিন্দা বা প্রশংসা, অন্যায় আক্রমণ বা পিঠচাপড়ানো -এ সম্পর্কে তো বটেই, বই-এর কাহিনী, আঙ্গিক, শিল্পমূল্য ইত্যাদির বিচার-বিশ্লেষণ, সমালোচনা সঠিক বা বেঠিক হয়েছে সে বিষয়েও লেখক মুখ বুজে থাকতে বাধ্য। একটি গল্প বা উপন্যাস লিখে বাজারে ছাড়া পর কে কোথায় কেন কিভাবে কি বলছে না বলছে লেখক নীরবে শুনে যাবেন। নির্ভেজাল সদিচ্ছা ও সৎসাহস নিয়ে নিজে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে, সমালোচনার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণকে স্বীকৃতি দিয়ে বা প্রতিবাদ জানিয়ে লেখক কিছু বলতে গেলেই সেটা দাঁড়াবে লেখকের নিজের ব্যক্তিত্ব খাটিয়ে ও প্রচার চালিয়ে পাঠক ও সমালোচক মহল বইখানা কিভাবে নেবেন তাদের সেই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা।

 কিভাবে লিখবেন সে স্বাধীনতা লেখকের। সে লেখা বিচার করার স্বাধীনতা সকলের। এইজন্য অসৎ সমালোচকের উদ্দেশ্যমূলক সস্তা গালাগালিও লেখক নীরবে উপেক্ষা করবেন। অসৎ সমালোচককে শায়েস্তা করার দায় অবশ্য অন্যান্য সৎ সমালোচকের এবং সাহিত্য-রসিকের।

  নিজের বই সম্পর্কে নীরব থাকার নীতি কিন্তু লেখকের সমালোচক হবার স্বাধীনতা হরণ করে না। সাধারণভাবে সাহিত্যের এবং অন্যের বই-এর সমালোচনা করার অধিকার তাঁর সকলের মতোই বজায় থাকে। নিজের বই সম্পর্কে সমালোচকের বিচার-বিশ্লেষণ এবং মতামত সম্পর্কে চুপ করে থাকা নিয়ম হলেও সমালোচকের স্কুল অবাস্তব ভুল বা বিকৃতিগুলি লেখক দেখিয়ে দিতে পারেন। বই-এ যা আছে সমালোচনায় তা বিকৃত করলে অথবা যা নেই তা টেনে আনলে লেখকের প্রতিবাদ জানানো দোষের নয়।

  যেমন, 'ইতিকথার পরের কথা'র “জমিদার-নন্দন” বিলাত ফেরত উচ্চশিক্ষিত নায়কের নামে অচ্যুতবাবু অপবাদ দিয়েছেন যে, “আজকে, একচেটিয়া পুঁজিবাদের যুগে” তার মাথায় “গ্রামাঞ্চলে শিল্পবিস্তার করে জনসাধারণের জীবন উন্নয়ন” করার “বালখিল্য” কল্পনা এসেছে—সে আদর্শ “প্রথম অসহযোগ আন্দোলনের পর স্বাভাবিক ছিল।”

 এটা অচ্যুতবাবুর সম্পূর্ণ মনগড়া অপবাদ। বইটির কোথাও নেই যে, “জমিদার নন্দনটি”র মাথায় গ্রামাঞ্চলে শিল্পবিস্তারের কল্পনা গজিয়েছিল অথবা কাজে সে এরকম কোন চেষ্টা করেছিল।

  ভালোভাবে দেখাতে পেরেছি কি পারিনি সে প্রশ্ন আমার বিচার্য নয়। কিন্তু আমার নায়কটির আসল সমস্যা কী-বইটিতে সে বিষয়ে যথেষ্ট বলা হয়েছে। নিজের ‘উচ্চ শিক্ষা' নিয়ে কি করবে, উচ্চশিক্ষার মহান আদর্শের খাতিরে যৌবনের সেরা বছরগুলি সাধনায় খরচ করে দেশবিদেশ থেকে সঞ্চয় করা বিজ্ঞানের জ্ঞান এদেশে কিভাবে কোন কাজে লাগালে কিছু পয়সাও আসবে, তার স্বপ্ন তার সাধনাও সফল হবে—এই নিয়ে আমার নায়কটি ফাঁপরে পড়েছে। শিক্ষাদীক্ষার সার্থক প্রয়োগের সুযোগ সুবিধার অভাবের চাপে একজন উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তির এদেশের বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে খানিকটা নতুনভাবে শিক্ষা প্রচেষ্টায় নামার অর্থ গ্রামাঞ্চলে শিল্প বিস্তারের প্রচেষ্টা হবে কেন? কলকাতা থেকে দূরে নিজের সুবিধাজনক স্থানে রেলস্টেশনের ধারে কারখানা খোলার জন্য কি অচ্যুতবাবু আমার নায়কের কাজের মনগড়া অর্থ করেছেন?

 ‘জমিদার-নন্দন-’এ অচ্যুতবাবুর আপত্তির কারণটা বুঝলাম না। অন্য কোন ধনীর উচ্চ শিক্ষিত নন্দনকে নায়ক করলেও গুণের সার্থক প্রয়োগের সমস্যা থেকে যেত—কেবল কাহিনী, পরিবেশ ও চরিত্র হতো অন্যরকম।

 অচ্যুতবাবুর সমালোচনামূলক প্রবন্ধটি সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা শুরু করার আগে একটা কথা বলে নিই। অচ্যুতবাবুর বিচার-বিশ্লেষণের নীতি ও সাধারণ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লিখলেও কেউ যেন এই সিদ্ধান্ত করে বলবেন না যে, আমি লেখাটির গুরুত্ব বা মূল্য সম্পর্কে সচেতন নই। লেখাটি প্রকাশ করে অচ্যুতবাবু আমাদের সকলেরই কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। লেখাটি পড়ে অচ্যুতবাবুর সততা ও মননশীলতা সম্পর্কে এতটুকু সন্দেহ থাকে না। এরূপ লেখা এবং লেখাটি নিয়ে আলোচনা আমাদের চিন্তার অনেক অপূর্ণতা ও অশুদ্ধতা দূর করতে সাহায্য করে।

 প্রকৃতপক্ষে, বাংলা প্রগতি সাহিত্যের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমি যে আশাবাদী—এরূপ সমালোচনা যে প্রকাশিত হয় সেটা তার অন্যতম একটি কারণ।

 সততা ও স্বচ্ছতা এই লেখাটির একটি প্রধান গুণ। বিচারবিবেচনা করে যা সত্য বলে জেনেছেন পরিপূর্ণ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে সহজভাবে তিনি আমাদের সামনে তা ধরে দিয়েছেন। এই গুণটাই অন্য হিসাবে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়—সমালোচনার ভুলত্রুটি দুর্বল অসরল সমালোচনার চেয়ে বেশি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তাই বাধ্য হয়ে প্রতিবাদ জানাতে হচ্ছে যে, অনেক দামী কথা বলে থাকলেও বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের সম্পর্কে অচ্যুতবাবুর দৃষ্টিভঙ্গি বিভ্রান্তিকর। “অভিজ্ঞতার বাড়া শিক্ষা নেই” সত্য কথাই। কিন্তু পাঠক সমাজ নাড়া খাচ্ছে না, সাড়া দিচ্ছে না, গ্রহণ করছে না——এটাই কি বাংলার প্রগতিবাদী লেখকদের অভিজ্ঞতার শিক্ষা? পাঠক পাঠিকা —অর্থাৎ দেশের লোকের উপেক্ষা বা খাতিরটাই সাহিত্যের সার্থকতার নিরিখ। বাংলার লেখকরা অভিজ্ঞতা থেকে এই শিক্ষা লাভ করেছেন? লোকের মুখ চেয়ে বাংলার লেখকেরা দিশেহারার মতো একবার “প্রচারধর্মী” এবং একবার “সূক্ষ্মভাবে আঙ্গিক-সর্বস্ব” হয়ে যাচ্ছেন!

 অচ্যুতবাবুর এ সিদ্ধান্ত মানতে পারলে আমি নিজে অন্তত চিরদিনের জন্য লেখা বন্ধ করে সাহিত্যের ক্ষেত্র থেকে দূরে সরে গিয়ে বড়বাজারে মশলার দোকান নিতাম।

  দেশের লোকের গ্রহণ বা বর্জনের প্রশ্নটা মোটেই তুচ্ছ নয়—লেখকের কাছে বরং সেটাই প্রধান কথা। দেশের জন্যই তো লেখক লেখেন। কিন্তু লেখক কি নিজের স্বার্থে লেখেন? দেশের লোকের আদর আর অনাদরের হিসাবটা কি লেখক কষবেন নিজের স্বার্থের মানদণ্ডে?

  নিজের স্বার্থে পাঠকদের কাছে পাত্তা পাবার জন্য “প্রচারধর্মী” হয়ে সাহিত্যের আসরে নেমে সুবিধা হচ্ছে না দেখে “অভিজ্ঞতার শিক্ষা” স্বীকার করে পাঠকের মন যোগানোর জন্য ভোল পাল্টে লেখক “সূক্ষভাবে আঙ্গিক-সর্বস্ব” হবেন?

 অচ্যুতবাবু কী করে বাংলার লেখকদের এরকম ছোটলোক (খারাপ লোক অর্থে—গরীব চাষী মজুর অর্থে নয়) ভাবতে পারলেন কল্পনা করতেও আমার বিস্ময়ের সীমা থাকছে না।

 লেখক কে? পিতার মতো যিনি দেশের মানুষকে সন্তানের মতো জীবনাদর্শ বুঝিয়ে শিখিয়ে পড়িয়ে মানুষ করার ব্রত নিয়েছেন। পিতার মতো, গুরুর মতো জীবনের নিয়ম অনিয়ম, বাঁচার নিয়ম অনিয়ম শেখান বলেই অল্পবয়সী লেখক-শিল্পীও জাতির কাছে পিতার মতো, গুরুর মতো সম্মান পান। দেশের মানুষের মন যোগাতে চেয়েছিল বলে কি আমাদের কিশোর কবি সুকান্তকে দেশের বালবৃদ্ধবণিতা এত ভালোবাসে এত সম্মান করে? দেশের মানুষকে সন্তানের মতো দেখে কাব্যের মারফতে তাদের মানুষ করার ব্রত নিয়েছিল বলেই কিশোর কবিকে জাতি পিতার আসনে বসিয়েছে।

 এটাই আসল কথা। দেশের লোকের সস্তা খাতিরকে লেখক-শিল্পী খাতির করেন না। দরকার হলে দেশের মানুষকে কান মলে শাসন করার অধিকার খাটাতে লেখক-শিল্পীর দ্বিধা বা ভয় হবার কথা নয়। তেতো ওষুধ খেতে পচ্ছন্দ করবে না বলে বাপ কি রুগ্ন শিশুকে ওষুধ খাওয়ানো থেকে বিরত থাকেন? নানাভাবে মন ভুলিয়ে ধমক দিয়ে শাসন করে ওষুধ খাওয়ান।

 কাজেই বাংলার লেখকদের “অভিজ্ঞতার শিক্ষা” “মনস্তত্ত্বগত” কারণে তাঁদের সৃষ্টিতে কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের আবির্ভাব ঘট। প্রভৃতি বিচার অচ্যুতবাবু যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করেছেন তা সঠিক ধরে নিলে বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশান্বিত হবার বদলে চরম হতাশা জাগাই স্বাভাবিক।

  অচ্যুতবাবুর আঙ্গিকের বিচারও ত্রুটিপূর্ণ।

 ‘ইতিকথার পরের কথা'র চরিত্রগুলি 'আধা-নিউরোটিক কৃষক' আর ‘পুরো নিউরোটিক জমিদার-নন্দন' হয়ে দাঁড়িয়েছে কিনা—লেখকের নীরব থাকার নীতি অনুসরণ করেই যে আমি এ বিষয়ে কিছু বলবো না তা নয়, বলবার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু আঙ্গিক বিচারের যে নীতি অচ্যুতবাবু এখানে তুলে ধরেছেন আমি সেটা ভুল মনে করি।

 অচ্যুতবাবু বলেছেন, “বৃহত্তর জীবন-সত্যকে রূপায়িত করতে হলে জীবনের খণ্ড খণ্ড অংশ একত্র করলেই চলবে না।······ খণ্ডগুলিকে সমন্বিত করে এমন একটা সামগ্রিক রূপ দিতে হবে যাতে এই সামগ্রিকতা যে কোন খণ্ড অংশকে অতিক্রম করে যাবে।”

  তাঁর মতে, জীবনের খণ্ডিত অংশগুলি সমন্বিত করে তাতে এই সামগ্রিকতা না-দেওয়ার কৌশল কেবল সমাজের সংকীর্ণ ক্ষয়িষ্ণু একটা অংশের জীবন-সত্যকে (বাংলার মধ্যবিত্ত) রূপ দেওয়ার পক্ষে ‘অদ্ভুত উপযোগী'। জীবনের খণ্ড খণ্ড অংশ একত্রিত করে এই সামগ্রিকতা এনে দেওয়া বা না দেওয়াটা কি ব্যাপার? আমি তো জানি জীবনের খণ্ড খণ্ড অংশ বাছাই করে শিল্পকলা খাটিয়ে সাজিয়ে গেঁথে দেওয়াই গল্প উপন্যাস লেখার আঙ্গিকের মোট কথা—তারপর আর কি করার থাকে লেখকের?

 জীবনের খণ্ডিত অংশগুলি লেখকের বেছে নেবার কথা খেয়াল করেননি বলে অচ্যুতবাবু বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গিয়েছেন। সমাজের খণ্ডিত ও বিচ্ছিন্ন অংশের জীবন-সত্যই হোক, আর সমাজের বৃহত্তর জীবন-সত্যই হোক, সে সত্য কতটুকু রূপায়িত হবে তা নির্ভর করবে জীবনের খণ্ডগুলি বেছে নেওয়ার উপর। এই বেছে নেওয়ার কাজটা ঠিকমতো না হলে হাজার শিল্পকৌশল প্রয়োগ করেও লেখক সত্যকে রূপ দিতে পারবেন না।

 জীবনের খণ্ডাংশগুলি স্বভাবতঃই বাছাই হবে লেখকের চেতনা অভিজ্ঞতা অর্থাৎ জীবন-দর্শন অনুসারে। জীবন-সত্যকে রূপায়িত করার জন্য তাই প্রধান কথা হলো লেখকের ওই জীবন-সত্যটা ধরতে পারা ।

 শুধু বুদ্ধি দিয়ে জানা নয় যে, সমাজজীবনে ভাঙনের সঙ্গে সঙ্গে পুনর্গঠনের কাজও চলছে—ভাঙাগড়ার প্রক্রিয়াটা কি ভাবে ঘঠছে কেন ঘটছে নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে জানা, চেতনায় উপলব্ধি করা।

 মহাত্মা গান্ধীকে তাঁর খণ্ডগুলির যোগফল হিসাবে দেখলে অবশ্যই তাঁকে নিউরোটিক মনে হবে, কিন্তু গান্ধীচরিত্র ঠিকমতো ফোটাতে গেলে বাছাই করে নিতে হবে তাঁরই বিশেষ কতগুলি খণ্ড। কোন খণ্ডগুলি বেছে গান্ধীচরিত্রকে কেমন রূপ দেবেন তা নির্ভর করবে কে কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গান্ধীজিকে দেখে কোন খণ্ডগুলি বাছাই করবেন। একজন মার্ক্‌সবাদী এবং একজন অন্ধ গান্ধীভক্তের খণ্ড বাছাই করা স্বভাবতঃই একরকম হবে না এবং দু’জনের আঁকা গান্ধীচরিত্রও একরকম হবে না ।

 প্রিয়-বিরহকাতুরা রমণীর চব্বিশ ঘণ্টার চিন্তার তালিকা পড়লে হাসি পাবে সত্যই। কিন্তু এই উদাহরণটি তুলে ধরার মধ্যেও জীবন সত্য রূপায়ণে আঙ্গিকের ভূমিকা সম্পর্কে অচ্যুতবাবুর বিভ্রান্তি ধরা পড়ে। বিরহকাতুরার চব্বিশ ঘণ্টার চিন্তার মধ্য থেকে বাছাই করা চিন্তা নিয়ে ওস্তাদ শিল্পী কেন অনবদ্য সার্থক সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবেন না, যা পড়লে হাসি পাওয়ার বদলে অভিভূত করে দেবে? বিরহকাতুবার মনে কি প্রিয়তম ও অন্যান্য মানুষের সঙ্গে বিচিত্র বাস্তব জীবন সংগ্রামের স্মৃতি এবং আরও অনেক বাস্তব চিন্তা রেখাপাত করে না? কেউ যদি বিরহকাতুরার কেবল ছাঁকা বিরহ-বেদনা ঘটিত চিত্তা বেছে নিয়ে ব্যথার কাব্য রচনা করেন সেটা তাঁর জীবনদর্শনের বৈশিষ্ট্যের জন্যই করবেন।

  বন্ধুবর গোপাল হালদারের সাহিত্য সম্পর্কে অচ্যুতবাবু বলেছেন: ‘গোপালবাবুর আঙ্গিকে তাঁর বুদ্ধিজীবী সত্তার স্বাক্ষর রয়েছে। তার ফলে তাঁর উপন্যাসে কি ঘটেছে তাও সুন্দরভাবে উপস্থিত করেছেন এবং গোপালবাবুর উপন্যাসের চরিত্রগুলি কেন মেটাফিসিক্যাল, কেন তারা বদলায় না, কেন “কাহিনীর পর কাহিনী যোগ হয়ে যায় কিন্তু তাতে জীবনের কোন অন্ধকার কোণে নতুন আলোকপাত ঘটে না”—এর কারণ অচ্যুতবাবু বলছেন— এটাই তাঁর “আঙ্গিকের বিশেষত্ব”।

 অচ্যুতবাবু অত্যন্ত স্পষ্টভাবে অনুযোগও দিয়েছেন যে, গোপালবাবু তাঁর বই-এ একটিমাত্র কৃষক চরিত্রও আনতে সাহস পাননি।

 অথচ অচ্যুতবাবুর কাছে এ সত্য স্পষ্ট নয় যে, বুদ্ধিজীবী সত্তার জন্যই গোপালবাবুকে জীবনের এমন অংশগুলি বেছে নিতে হয় যাতে তিনি তাঁর ডায়ালেকটিক চিন্তাধারাকে কাহিনীর পর কাহিনী সাজিয়ে প্রকাশ করতে পারেন।

 আঙ্গিকের ভূমিকা সম্পর্কে বিভ্রান্তির জন্যই বর্তমান প্রগতি সাহিত্য সম্পর্কে অচ্যুতবাবু “আশান্বিত” হবার কারণে খুঁজে পাচ্ছেন না। প্রবন্ধের গোড়াতেই তিনি প্রগতিশীল শিল্পের স্থূল সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে সমাজ-জীবনের বাস্তবতার উল্লেখ করেছেন, কিন্তু সাহিত্যের বাস্তবতা বিচার করতে নেমে ওই বাস্তবতাকে পিছনে ঠেলে দিয়েছেন। সাহিত্যের বাস্তবতার বিচার অর্থাৎ সমাজ-জীবনের বাস্তবতায় যে জীবন-সত্য সাহিত্যে তা কিভাবে কতটুকু রূপায়িত হচ্ছে বা হচ্ছে না তার বিচার যে সর্বদা সমাজ-জীবনের বাস্তবতার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে করা দরকার এটা খেয়াল না রাখায় অচ্যুতবাবুর বিচার বিশ্লেষণ অবৈজ্ঞানিক হয়ে গিয়েছে।

 এদিকে আবার সঠিক জীবন-দর্শনের গুরুত্ব সম্পর্কে অচ্যুতবাবু মোটেই অচেতন নন। বর্তমান বাংলা প্রগতি সাহিত্যের স্বরূপ এবং লেখকদের সমস্যা যেমন নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন তেমনি সুন্দর ও সঠিকভাবে এই সমস্যার সমাধানও বাৎলিয়েছেন: আরও বেশি করে জীবনকে জানা, আরও একান্তভাবে নিবিড়ভাবে জীবনের সান্নিধ্যে যাওয়া ও তার গতি-প্রকৃতির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য উপলব্ধি করা। আঙ্গিকের জন্যও তিনি পূর্বসুরীদের সাহিত্য পড়তে বসে সঠিকভাবেই মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, সে আঙ্গিকে আজকের লেখকের কাজ হবে না।

 অচ্যুতবাবু লিখেছেন, “আসল কথা হলো, প্রগতিশীল লেখকদের আজকে এমন একটা সমস্যার সামনে পড়তে হয়েছে যা কোন কালের কোন লেখকের উপলব্ধি করতে হয়নি। লেখকেরা চিরদিনই তথ্যের থেকে তত্ত্বের দিকে যান; আজকের লেখকদের পরিক্রমণের পথ হলো তত্ত্বের থেকে তথ্যের দিকে। ফলে তথ্যের মধ্যে তত্ত্বকে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সীমায় আবিষ্কার করতে না পারার জন্যে লেখকেরা একবার স্থূলভাবে প্রচারধর্মী হয়ে পড়ছেন, আর একবার সূক্ষ্মভাবে আঙ্গিক-সর্বস্ব হয়ে পড়ছেন। এর একমাত্র সমাধান হলো আরও বেশি করে জীবনকে জানা, আরও একান্তভাবে নিবিড়ভাবে জীবনের সান্নিধ্যে যাওয়া ও তার গতিপ্রকৃতির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য উপলব্ধি করা। আঙ্গিকের জন্য পূর্বসূরীদের সাহিত্য পড়তে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে সে-আঙ্গিকে লেখকের কাজ হবে না। আর একটি কথা, শ্রমিক-কৃষকের জীবনের পটভূমিকা না হলে প্রগতিশীল সাহিত্য হয় না, এ ধারণা ভুল। জীবনের যে কোন একটি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে রোগ এবং রোগারোগ্যের প্রচেষ্টা মিলিয়ে আধুনিক সমাজব্যবস্থার যে-সমস্যা তার প্রতিফলন আবিষ্কার করা যায়।”

 এত অল্প কথায় অচ্যুতবাবু সমকালীন বাস্তবতার জন্য লেখকদের সমস্যা কি ও তার সমাধান কি তা ধরে দিয়ে এবং সমগ্র প্রবন্ধটির বিচার-বিশ্লেষণে দৃষ্টির গভীরতার পরিচয় দিয়েও আসল বিচারে কেন গোলমাল করে ফেললেন ভেকে প্রথমটা আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর আবিষ্কার করলাম যে, অনেক আনুষঙ্গিক সত্যকে সঠিকভাবে জেনেও সেইগুলিকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রয়োগ করতে না পারায় এই বিভ্রাট ঘটেছে।

  তিনি বলছেন “আসল কথা হলো: প্রগতিশীল লেখকদের আজকে এমন একটা সমস্যার সামনে পড়তে হয়েছে যা কোন কালের কোন লেখককে উপলব্ধি করতে হয়নি।” কিন্তু আজকের লেখকদের সমস্যাটা বিশেষ কেন—আজকের বাস্তবতা বিশেষ বলেই তো? সেইজন্যই আজ লেখকের প্রয়োজন জীবনের ঐতিহাসিক গতি-প্রকৃতির মূল নিয়ম জানার সঙ্গে বাস্তব জীবনকে ঘনিষ্ঠভাবে জানা এবং তার গতি-প্রকৃতির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য উপলব্ধি করা।

  বেশ কথা। আজ বাংলার সমাজ-জীবনের ভাঙাগড়ার বাস্তবতা কি, বাঙালীর জীবন-সত্যটা কি? কি স্বরূপ জীবনের অন্তর্নিহিত গতি প্রকৃতির?

 অচ্যুতবাবু সমাজ জীবনের বাস্তবতা মোটামুটি দেখিয়েছেন—বর্তমান সমাজ এমন একটা যুগ পরিবর্তনের আবর্তসংকুল সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে যে, তার আভ্যন্তরীণ শ্রেণীদ্বন্দ একটা চরম রূপ নিয়ে উপস্থিত। শোষিতশ্রেণী সমূহ একটা শ্বাসরোধকারী সামাজিক অবস্থানের থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রতিনিয়ত প্রকাশ্যে বা পরোক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বীশ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে রত। আজকের এই সামাজিক সত্যটি জীবনের যে-কোন স্তরের যে-কোন মানুষের সত্তার গভীরে অনুপ্রবিষ্ট। এই অত্যন্ত সাদা-মাটা সত্যটিকে স্বীকৃতি দান বর্তমান প্রগতি সাহিত্যের প্রধান লক্ষণ।

 ‘শোষিতশ্রেণী সমূহের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সংগ্রামের গতি-প্রকৃতি কি তা উপলব্ধি করে প্রগতিশীল লেখকের পক্ষে জীবনের কোন্ খণ্ডিত অংশগুলি বেছে নেওয়া সম্ভব এবং কোন আঙ্গিকে কিভাবে তা কতখানি রূপায়িত করা সম্ভব নির্ভুলভাবে এটা বিচার না করে প্রগতি সাহিত্যের সামগ্রিক গতি-প্রকৃতি ও শিল্পমূল্য সঠিক নির্ণয় করা সম্ভব নয়।

 বাস্তবতাকে অতিক্রম করে মিথ্যা কল্পনার রাজ্যে চলে যাবার সুযোগ ভাববাদী লেখকের আছে, ভাববাদী আদর্শগত জীবন দর্শনকে রূপ দেবার জন্য তিনি যত খুশি কল্পনার রং চাপাতে পারেন। কিন্তু বস্তুবাদী প্রগতিশীল লেখক বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন না। বস্তুবাদী লেখক অবশ্যই বাস্তবতার রিপোর্টার নন, তিনি শিল্পীতিনিও কল্পনার রঙে-রসেই তাঁর কাহিনী রূপায়িত করবেন, কিন্তু মিথ্যার সঙ্গে তাঁর কল্পনার কারবার থাকবে না। এই জন্যই তাঁর বাস্তবজীবনের গতি-প্রকৃতি ভালো করে জানা দরকার—তাঁর কল্পনা যাতে বাস্তবতাকে অতিক্রম করে ফাঁকা আদর্শবাদিতার মিথ্যায় পরিণত না হয়, জীবনবিরোধী হয়ে না ওঠে।

 অচ্যুতবাবু কি জানেন বাংলা প্রগতি-সাহিত্য প্রচারধর্মী হয়েছিল জীবন-বিরোধী মিথ্যা আদর্শবাদিতা থেকে আত্মরক্ষার জন্য? এটা ত্রুটি, বাস্তবজীবনের গতি-প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের অভাবেরই সুস্পষ্ট নিদর্শন কিন্তু মিথ্যাকে তুলে ধরার চেয়ে সাহিত্যে প্রচারধর্মী হওয়া ঢের ভালো—সমাজ ও সাহিত্যের রূপান্তর গ্রহণের বিশেষ স্তরে প্রচারধর্মী হওয়াটাই তাই সাহিত্যের প্রগতি লক্ষণ এবং আশার কথা হয়ে দাঁড়ায়।

 এই প্রচারধর্মিতা থেকে মুক্তিলাভের চেষ্টা ও ব্যাকুলতা তা’ সূক্ষ্ম আঙ্গিক—সর্বস্বতার রূপই নিক বা অন্য যে কোন রূপই নিক, সেটাও তখন হয় সাহিত্যে প্রগতি বজায় থাকার লক্ষণ এবং আশার কথা।

 বাংলার সমাজ জীবনের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে, শ্রেণী সংগ্রাম ও শ্রেণী সম্পর্কের বর্তমান রূপ এবং ঐতিহাসিক গতি-প্রকৃতির বিচার বিশ্লেষণের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের বিচার-বিশ্লেষণ করলে অচ্যুতবাবু দেখতে পেতেন সমগ্র বাংলা সাহিত্যের মধ্যে প্রগতিসাহিত্যের বর্তমান রূপটাই অনিবার্য ছিল এবং এই প্রগতিসাহিত্য সম্পর্কে হতাশার কিছুমাত্র কারণ নেই। বাংলার প্রগতি সাহিত্যের মধ্যে প্রচুর সম্ভাবনার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে, পথটা দুর্গম ও এলোমেলো হলেও এ সাহিত্য সামনের দিকেই এগিয়ে চলেছে।

 আত্মসন্তুষ্টি মারাত্মক। হতাশ হবার কারণ না থাকলেও চোখ-বোজা আত্মসন্তুষ্টির বিপদ সম্পর্কে সচেতন করার দিক থেকে অচ্যুতবাবুর প্রবন্ধটি মূল্যবান। আমি তাঁকে অভিনন্দন জানাই।

 আমিও সেই অনাগতের প্রতিক্ষায় আছি যিনি একদিন মহান সৃষ্টির মধ্যে বাংলা সাহিত্যের নবতম রূপ সার্থকভাবে রূপায়িত করতে পারবেন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না সেই অনাগত আকাশ থেকে নেমে আসবেন, বাঙালীর জীবন ও সাহিত্যের বাস্তব যাত্রাপথেই তার আবির্ভাব ঘটবে।