লেফ্টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/অগ্নি হইতে স্ত্রীলোক রক্ষা
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ।
অগ্নি হইতে স্ত্রীলোক রক্ষা।
কয়েক দিন ধরিয়া প্রত্যহ সুরেশ রেঙ্গুনের সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি আফিস সকলে ঘুরিয়া বেড়াইলেন, যাঁহার হস্তে কোন চাকুরি প্রদানের ক্ষমতা আছে, তাঁহারই সহিত দেখা করিলেন, কিন্তু চাকুরি পাওয়া দূরে থাকুক, চাকরি পাইবার যে কোন রূপ আশা আছে, এরূপও বোধ হইল না; তখন তিনি নিতান্ত হতাশ হইয়া প্যাগডা সজ্জিত রেঙ্গুন নগর পরিত্যাগ করিয়া অন্যত্র গিয়া কাজকর্ম্মের চেষ্টা করিবার ইচ্ছা করিলেন। তাঁহার পূর্ণ শনির দশা, সহস্র চেষ্টা করিয়াও তিনি কোন বিষয়েই কোন সুবিধা করিতে পারিলেন না।
যে দিন রাত্রে তিনি রেঙ্গুন হইতে রওনা হইবেন, সেই দিন সন্ধ্যার সময় তিনি রেঙ্গুনের রাজপথে একবার শেষ বেড়াইতে বাহির হইলেন।—তিনি কিয়দ্দূর যাইতে না যাইতে তাহার কর্ণে মনুষ্য কোলাহল প্রবেশ করিল,—তিনি একটু অগ্রসর হইয়া বুঝিলেন নিকটে আগুণ লাগিয়াছে। সুরেশ এরূপ কোন ঘটনা উপস্থিত হইলে নিশ্চিন্ত থাকিবার পাত্র ছিলেন না। ‘‘আগুণ আগুণ’’ চীৎকার শুনিয়াই তিনি দৌড়াইয়া সেই দিকে গেলেন। দেখিলেন একটি বাড়ীতে আগুন লাগিয়াছে, সেই সময়ের প্রবল বাতাসে আগুন ক্রমে ভয়ানক প্রবল হইয়া উঠিতেছে, নিকটস্থ দুই একটা বাড়ীতে লাগিকাছে। হাজার হাজার লোক সেই খানে জমিয়াছে, কি জন কয়েক ব্যতীত অপর সকলে দাঁড়াইয়া কেবল তামাসা দেখিতেছে। যাহা জল লইয়া আসিয়া আগুণ নিবাইবার চেষ্টা করিতেছিল, তাহায় শত চেষ্টাতেও আগুণকে নির্বাপিত করিতে পারিতেছিল না। বাতাসের সহায়তা পাইয়া না ভয়াবহ ভাবে প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিতেছিল। সুরেশ নিকটে গিয়া যাইয়া আগুণ নিবাইবার চেষ্টা করিতেছিল, যথাসাধ্য তাহাদের সাহায্য করিতে লাগিলেন, কিন্তু তাহাদের শত চেষ্টায় আগুন নিবিল না, —একের পর অন্য বাটী গ্রাস করিতে লাগিল।
সহসা সেই মহা কোলাহল ভেদ করিয়া একটা রমণীয় আর্তনাদ শ্রুত হইল। সকলে চমকিত হইয়া বাড়ীর দিকে চাহিল দেখিল এক যুবতী সেই অগ্নি প্রজ্জ্বলিত বাটীর দ্বিতল গবাক্ষে, অগ্নি ও ধূমের মধ্যে দণ্ডায়মানা, তাহার চক্ষু বিস্ফারিত, হস্ত প্রসারিত, বদন আকাশের দিকে উত্তোলিত। দেখলেই স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় ভয়ে যুবতীয় চক্ষু বিস্ফারিত, রক্ষা পাইবার আশায় হস্ত প্রসারিত ও ভগবানের প্রতি দৃষ্টির জন্য বদন আকাশের দিকে উদ্বেলিত। এ দৃশ্য দেখিয়া জনতাস্থ সহস্র লোকের হৃদয়ে বিশেষ বেদনা লাগিল সত্য, কিন্তু কেহই সেই রমণীকে রক্ষা করিবার জন্য চেষ্টীত হইল না। এক্ষণে বাটীটীকে অগ্নি যেরূপ গ্রাস করিয়াছিল তাহাতে এই রমণীকে উদ্ধার করিবার চেষ্টা আর আপনার প্রাণ বলি দেওয়া একই কথা। সেই সহস্র সহস্র লোকের চক্ষের সম্মুখে যুবতীকে অ্রগ্নিতে ঘেরিল, আর রক্ষা পাইবার কোন আশা নাই। দর্শকগণ ভীত ও স্তম্ভিত হইয়া এই ভয়াবহ লোমহর্ষণ ব্যাপার দেখিতে লাগিল, কাহারও মুখ হইতে একটা শব্দও বাহির হইল না।
এইরূপে এই রমণী চক্ষের উপর অগ্নিতে ভস্মীভূত হইবে, সুরেশের প্রাণে ইহা সহিল না। ইহাকে রক্ষা করিবার জন্য তিনি একবার চেষ্টা করিয়া দেখিতে ইচ্ছুক হইলেন এবং তখনই অমনি চীৎকার করিয়া নিকটস্থ লোকজনকে একখানা মই আনিতে বলিলেন। জনতাস্থ সকলেই রমণীর জন্য বিশেষ ব্যথিত হইয়াছিলেন, তাহাকে রক্ষা, করিবার জন্য যে চেষ্টা হইবে ইহাতে তাহাদের সকলের হৃদয়ই উৎফুল্ল হইল। কয়েকজন ছুটিয়া গিয়া একটা মই আনিল। তখন সুরেশ এক কলসি জল নিজের মাথায় ঢালিয়া চক্ষের নিমিষে মই যাহিয়া অগ্নি পরিবেষ্টিত সেই গবাক্ষের নিকট উঠিলেন। জনতা লোকেরা তাহার অসীম সাহস দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া নীরবে দাড়াইয়া রহিল; স্পন্দিত হৃদয়ে তাঁহার অভূতপূর্ব সাহসিক কার্য্য দেখিতে লাগিল।
লম্ফ দিয়া সুরেশ অগ্নিময় গৃহে প্রবিষ্ট হইলেন। রমণী তখনও সেইরূপ ভাবে সেই খানে দণ্ডায়মানা, বোধ হয় তাহার সংজ্ঞা নাই, তাহার চারিদিকে মহারোলে অগ্নি জ্বলিতেছে, ধূমে গৃহ পূর্ণ হইয়া গিয়াছে; আর এক মুহুর্ত বিলম্ব করিলে সুরেশ বা রমণী কাহারই প্রাণ রক্ষা হইবার সম্ভাবনা নাই। কিন্তু রমণী নীরব, নিস্তব্ধ, কাষ্ঠ পুত্তলিকার ন্যায় দণ্ডায়মান। তাঁহার কেশদাম আলুলায়িত, অর্ধদগ্ধ। তাহার বস্ত্র উন্মুক্ত, তাহার হস্ত প্রসারিত, তাহার আত্মরক্ষা করিবার জন্য তাহার নিজের আর কোন ক্ষমতাই নাই। তাহার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া সুরেশ মূহুর্ত মধ্যে তাহা বুঝিলেন তিনি একবার ফিরিয়া গবাক্ষর দিকে চাহিলেন —দেখিলেন ধূ ধূ করিয়া গবাক্ষ জ্বলিতেছে — সে পথে বহির্গত হইয়া যাইবার আর উপায় নাই। —তিনি ব্যকুলে গৃহের চারিদিকে চাহিলেন,কোন দিক দিয়া বাহির হইবার উপায় নাই;—অগ্নি ঘোর রোলে চারিদিক ঘেরিয়াছে। তখন সুরেশ অনন্যোপায় হইয়া সবশে সেই গবাক্ষে পদাঘাত করিলেন; —ভীম পদাঘাতে সেই অর্দ্ধ দগ্ধ গবাক্ষ মহাশব্দে খসিয়া নীচে গিয়া পড়িল। তিনি নিমেষ মধ্যে রমণীকে ক্রোড়ে তুলিলেন, নিমেষ মধ্যে ভগ্ন গবাক্ষমুখে আসিলেন,—কিন্তু একি সর্বনাশ। জানালার সঙ্গে সঙ্গে আঘাত লাগিয়া মইও নিম্নে পতিত হইয়াছে।
তিনি চীৎকার করিয়া নিম্নস্থ লোকদিগকে আবার প্রাচীরে মই লাগাইতে বলিলেন। গোলযোগে ও লোকের কোলাহলে প্রথমে তাঁহার কথা কেহ শুনিতে পাইল না।—তিনি তখন মহা চীৎকার করিতে লাগিলেন। যখন নিম্ন লোকেরা তাহাকে দেখিল ও তাহার কথা বুঝল, তখন তাহারা তৎক্ষণাৎ মই লাগাইয়া দিল এবং ১০ জনে সবলে সেই মই চাপিয়া রাখিল। সুরেশ অতি কষ্টে রমণীকে ক্রোড়ে লইয়া মই অবলম্বনে ক্রমে নিম্নের দিকে আসিতে লাগিলেন। যখন অর্ধেক নামিয়াযেন তখন সহসা মই ভাঙ্গিয়া গেল, তিনি রমণী সহ নিয়ে পড়িলেন। কি্নতুত নিম্নস্থ লোকেরা ছুটিয়া গিয়া তাহাদের উভয় কেই ধরিল;—নতুবা উভয়েই গুরুতর আঘাত পাইতেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।
সুরেশ নিম্নে আসিয়া দাঁড়াইতে পারিলেন না, তাহার মাথা ঘুরিয়া গেল; —তিনি মুর্চ্ছিত হইলেন। বলা বাহুল্য তিনি অর্দ্ধ দগ্ধ হইয়াছিলেন। বিশেষতঃ ধূমে তাহার প্রায় শ্বাসরোধ হইয়া আসিয়াছিল। তিনি নিম্নে পৌছিলে তাহার যে কি হইল, তাহা আর তাহার জ্ঞান নাই। যখন তাহার সংজ্ঞা হইল, তখন তিনি দেখিলেন যে তিনি তাহার বন্ধুর বাড়ীতে শায়িত আছেন;— যে রমণীকে তিনি উদ্ধার করিয়াছিলেন, তিনি ও তাহার আত্মীয় মগগণ বিশেষ যত্নে তাহ'র শুশ্রূষা করিতেছেন। তিনি শুনিলেন যে তাহার পকেটে একখানা কাগজে তাহার বন্ধুর ঠিকানা দেখিয়া লোকেরা তাহাকে সেইখানে লইয়া আসিয়াছিল, নতুবা হয়ত তাহাকে অপরিচিতের আলয়ে যাইতে হইত।
রমণীর শুশ্রুষার কয়েকদিনের মধ্যেই সুরেশ সুস্থ ইয়া উঠিলেন—কিন্তু তিনি বুঝিলেন যে রমণী তাহাকে প্রাণের সহিত ভাল বাসিতে আরম্ভ করিয়াছেন। তিনি এ ভালবাসায় প্রতিদান করিতে অক্ষম, —তিনি রমণীর হৃদয়ে যে বেদনা দিলেন তাহাতে তিনি নিজেও হৃদয়ে বিশেষ বেদনা পাইলেন। কিন্তু উপায় নাই। তিনি যথা সম্ভব শীঘ্র রেঙ্গুন ত্যাগ করিতে স্থিরপ্রতিজ্ঞ হইয়া তাহারই সুবিধা খুঁজিতে লাগিলেন।