লেফ্টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/ডাকাতের সহিত যুদ্ধ
ষোড়শ পরিচ্ছেদ।
ডাকাতের সহিত যুদ্ধ।
একদিন সুরেশ রেঙ্গুনে নদীতে নৌকারোহণ করিতে গেলেন; সে সময়ে তিনি নৌকা চড়িতে বড়ই ভাল বাসিতেন। যদিও তাঁহার অর্থের সচ্ছলতা একেবারেই ছিল না, তবুও সুন্দর ইরাবতীনদীর স্বচ্ছজলে একবার নৌকারোহণ না করিয়া তিনি নিরস্থ থাকিতে পারিলেন না। কিছু দিয়া একখানি ক্ষুদ্র নৌকা ভাড়া করিয়া তিনি বহুক্ষণ ইরাবতী নদীতে নৌকা চড়িয়া বেড়াইলেন। ক্রমে ফিরিয়া ঘাটে আসিতে প্রায় সন্ধ্যা হইল, তখন তিনি নৌকা হইতে নামিয়া ধীরে ধীরে গৃহাভিমুখ চলিলেন। নৌকার দাঁড় টানিয়া তিনি ঘর্ম্মাক্ত হইয়াছিলেন, এক্ষণে পদব্রজে যাইবার সময় তাঁহার শরীরে মৃদু মধুর বাতাস লাগায় তাঁহার প্রাণ উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। সন্ধ্যার পর অন্ধকারে রেঙ্গুনের রাস্থায় যে বিপদের সম্ভাবনা আছে, তিনি তাহা একেবারে ভুলিয়া গেলেন। তিনি সম্পূর্ণ নিরস্ত্র, এমন কি তাঁহার হস্তে একটী ষষ্টিও নাই; তবে কলিকাতার বাল্যকাল হইতে তিনি একগাছি ছোট রুল সঙ্গে সঙ্গে রাখিতেন, এখানেও এটী ছাড়িয়া তিনি কখন কোন স্থানে যাইতেন না। অদ্যও তাহার সঙ্গে তাহায় চির সহচর রুলগাছটী ছিল।
সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। আকাশে তারকারাজি একে একে ফুটিয়া উঠিয়াছে, চন্দ্র না উঠিলেও রাস্তা একেবারে অন্ধকার হয় নাই, মধ্যে মধ্যে কোন কোন দোকান হইতে ভালো পড়িয়া রাস্তা আলোকিত করিয়াছে। সন্ধ্যার পর রেঙ্গুনের রাস্তায় বড় লোক চলাচল করে না; সুরেশ দুই দশ জন দরিদ্র মগকে গৃহে ফিরিতে দেখিতে পাইলেন। বাঙ্গালা দেশের শ্রমজীবিগন যেরূপ সমস্ত দিনের পর গৃহে ফিরিবার সময় গলা ছাড়িয়া গান করে, মগেরা তাহা করে না। সুরেশ যাহাদিগকে দেখিলেন, তারা নীরবে গৃহাভিমুখে চলিয়াছে। তিনিও নীরবে বাসার দিকে যাইতে ছিলেন, নানা চিন্তায় তাঁহার মন ব্যাকুলিত। একবার ঘোর হতাশ আসিয়া তাহাকে গ্রাস করিতেছে, আবার পর মূহুর্তেই আশায় মন প্রাণ পূর্ণ হইয়া যাইতেছে। যাহা হইয়া গিয়াছে, যাহা হইবে, এই সকল ভাবিতে ভাবিতে সুরেশ বাসার দিকে আসিতেছিলেন।
সহসা একটা শব্দে তিনি চমকিত হইয়া উঠিলেন। তাহার বোধ হইল যেন কি তাহার পাশ দিয়া চলিয়া গেল। সেটা নিকটস্থ প্রাচীরে গিয়া লাগায় সুরেশ শব্দে বুঝিলেন, সেখানি দা, দূর হইতে কে ছুটিয়াছে। তিনি দাড়াইলেন, গলিটী ভাল করিয়া দেখিলেন। কিন্তু তৎক্ষণাৎ আর একখানি দা তাহার পার্শ্ব দিয়া চলিয়া গেল। কেবল অদৃষ্টবলে এই শানিত দা দুখানা তাঁহার গায়ে লাগিল না; লাগিলে তিনি হত না হইলেও যেগুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হইতেন সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।
তিনি অন্ধকারে দুই ব্যক্তিকে অস্পষ্ট দেখিতে পাইলেন, কিন্তু আর সময় নাই। তিনি দেখিলেন যে, ঐ দুই ব্যক্তি তাঁহার দিকে দৌড়িয়া আসিতেছে। তখন তাহার বন্ধুর কথা মনে পড়িল, রেঙ্গুনেয় রাস্তায় যে নানা বিপদ ঘটিকার সম্ভাবনা, তাহ। তিনি এখন বুঝিলেন। আর তাহার জীবনের যে আশা নাই, তাহাও তিনি বুঝিতে পারিলেন। যম যে তাহাকে মৃত্যুর জন্যই রেঙ্গুনে আনিয়াছেন, তাহাও তিনি ভাবিলেন; কিন্তু মরিতে তিনি ভীত নহেন। ভয় কাহাকে বলে তাহা তিনি জানিতেন না। যদি মরিতে হয়, বীরের ন্যায় মরিব, মনে মনে ইহা স্থির করিয়া তিনি সদৃঢ়রূপে রুল ধরলেন।
মগ দুজন তাহার নিকটস্থ হইল। একটা বাঙ্গালী বালককে আক্রমণ করিয়া লুটিয়া লওয়া অতি সহজ কার্য্য ভাবিয়া তাহারা কেবলমাত্র একজন সুরেশকে ধরিতে আসিল। অমনি সুরেশ এমনই বজ্রমুষ্টিতে রুলদ্বারা তাহার মস্তকে প্রহার করিলেন যে সে তৎক্ষণাৎ ঘুরিয়া পড়িল। তখন অপর মগ একটু থমকাইয়া পড়িল, কিন্তু সুরেশ তাহার রুল দ্বারা তাহাকে প্রায় করিবার পূর্বেই সে আসিয়া তাহার উপর আক্রমণ করিল,—হ্যাঁচকা টান মারিয়া তাহার হস্ত হইতে রুল কাড়িয়া লইল। তখন সুরেশ তাহাকে জড়াইয়া ধরিলেন, দুইজনে ঘোর মল্লযুদ্ধ আরম্ভ হইল। উভয়েই সেই অন্ধকারময় রাজপথে পড়িয়া গিয়া উতয়েই উভয়কে পরাজিত করিবার প্রয়াস পাইতে লাগিলেন। কিন্তু সুরেশ দেখিলেন মগ তাহাপেক্ষা বলবান, —আর কিয়ৎক্ষণ মধ্যেই সে তাহা অস্থি চুর্ণ করিয়া দিবে, সে তাঁহাকে জড়াইয়া ধরিয়া সবলে মর্দন করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। কিন্তু ভগবান তাঁহার সহায় সে দিন তাহার মৃত্যুদিবস নহে। তিনি যখন প্রায় সংজ্ঞাহীন হইয়া পড়েন, ঠিক সেই সময়ে সেই রাস্তায় অনেক আলো দেখিতে পাওয়া গেল, লোকেরও কোলাহল শ্রুত হইল, অমনি সুরেশ ডাকাত ডাকাত বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিলেন। যাহারা আসিতেছিলেন, তাহারা বরযাত্রী। তাঁহার চীৎকারে তাহারা সত্বর সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন দস্যু তাঁহাকে ছাড়িয়া দিয়া তাহার সঙ্গীকে টানিয়া লইয়া অন্ধকারে একটা গলির ভিতর অন্তর্দ্ধান হইল। সুরেশ তাঁহার মুক্তিদাতাদিগকে ধন্যবাদ দিয়া বাসভিমুখে প্রস্থান করিলেন।