লেফ্‌টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/ব্রহ্মে গমন

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ।


ব্রহ্মে গমন।

 যত সময় অতীত হইতে লাগিল, সুরেশের মন ততই কলিকাতা ত্যাগ করিবার জন্য ব্যাকুল হইল। কলিকাতা ত্যাগ করিবার জন্য তিনি এতই ব্যগ্র হইয়া উঠিলেন যে এক দিন ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া কোংর আফিসে গিয়া রেঙ্গুনের একখানি ডেক টিকিট ক্রয় করিলেন। এত স্থান থাকিতে রেঙ্গুনে যাইবার জন্য তিনি কেন ইচ্ছুক হইলেন, ইহার উত্তরে বলা যায় যে, বিলাত যাইবার কোন উপায় না দেখিয়া সুরেশ বর্ম্মায় যাওয়াই স্থির করিলেন। অল্প পয়সায় জাহাজে নূতন দেশে যাইতে ইচ্ছা করিলে রেঙ্গুনই সর্ব্বাপেক্ষা প্রশস্ত স্থান। যেখানেই হউক দেশ হইতে অন্যত্র গিয়া কোন কার্য্যকর্ম্ম করাই তাঁহার একান্ত বাসনা।

 আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি সে সময়ে ব্রহ্মদেশ এখনকার মত সভ্য বা ইংরাজ-রাজ্যের সুশৃঙ্খলাপ্রাপ্ত হয় নাই। উপর ব্রহ্ম তখনও দেশীয় রাজার অধীন ছিল;—লোয়ার বর্ম্মা ইংরাজগণ দখল করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তখনও সুবন্দোবস্ত করিতে পারেন নাই। ইংরাজী জানা লোকেরও তখন ব্রহ্মদেশে বিশেষ অভাব ছিল; এই সকল কারণে সেখানে গেলে চাকুরী সহজে মিলিবার সম্ভবনা আছে ভাবিয়া সুরেশ রেঙ্গুন যাত্রা করিলেন।

 কয়েক দিনের মধ্যেই সুরেশ নির্বিঘ্নে রেঙ্গুনে আসিয়া পৌছিলেন। বলা বাহুল্য তাহার হস্তে সামান্য মাত্রই অর্থ ছিল; যাহা ছিল কোন কাজ না মিলিলে তাহাতে বহু দিন চলিবার সম্ভাবনা ছিল না। কাজেই সুরেশ মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন যে, জাহাজ হইতে নামিয়াই কোন কাজের চেষ্টা করিবেন। নূতন স্থানে নূতন লোকের মধ্যে তিনি আসিলেন; — তিনি কাহাকে চিনেন না, কেহ তাহাঁকে চিনে না। যেখানে খুব সস্তায় থাকিতে পারা যায় প্রথমে তিনি সেইরূপ একটা বাসা খুজিতে বাহির হইলেন। কিন্তু তাহার সৌভাগ্যক্রমে জাহাজ হইতে নামিয়া কিছু দূর যাইতে না যাইতে তাহার পূর্ব পরিচিত একটা বন্ধুর সহিত সাক্ষাৎ হইল। ইনি রেঙ্গুনে চাকুরী করিতেছিলেন। সুরেশের নিকট সকল নিয়া তিনি তাহাকে নিজ বাসায় লইয়া গেলেন। সুরেশের বাসার জন্য আর ভাবিতে হইল না। এক্ষণে নিশ্চিন্ত মনে তিনি কোন কাজের সন্ধান করিতে লাগিলেন।

 যেখানে যেখানে চাকুরী পাইবার সম্ভাবনা, পর দিন হইতেই সুরেশ সেই সেই স্থানে গিয়া চাকুরীর চেষ্টা করিতে লাগিলেন। এখন রেঙ্গুন যেরূপ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হইয়াছে যখন গিয়াছিলেন, তখন সে ছিল না। এরূপ অপরিষ্কার সহর অন্যত্র কোন স্থান ছিল কি না বলা যায় না। তার উপর সহরের রাজপথে রাত্রে দলে দলে বদমাইসগণ ফিরিত;— কাহাকে একাকী নির্জনে পাইলে আক্রমণ করিয়া সর্বস্ব কাড়িয়া লইত।

সুবিধা পাইলে খুন করিতেও তাহারা কিছু মাত্র সঙ্কুচিত হইত না। এই সকল দুর্ব্বৃত্ত মগগণ প্রায় লুটপাট করিয়া ধৃত হইত না। পুলিশ ইহাদের কিছুই করিতে পারি না। এমন কি দিনের বেলায়ও ইহারা ইহাদের অস্ত্র দা হস্তে লইয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গলিঘুজিতে লুটের প্রত্যাশায় বসিয়া রহিত, সুবিধা পাইলেই লোকজনের সর্বস্ব কাড়িয়া লইত। এরূপ বিপদসঙ্কুল সহর পৃথিবীর আর কুত্রাপি ছিল না; এত দুর্ব্বৃত্ত লোকও বোধ হয় অন্যত্র দেখা যাইত না। মগেরা চিরকালই লুটপাট করিয়া জীবিকা নির্বাহ করিত; যখন সুরেশ রেঙ্গুন গিয়াছিলেন, তখন এই স্থানের মগগণ পূর্ব্ব স্বভাব তখনও ভুলিতে পারে নাই।

 সুরেশের বন্ধু তাহাকে এ সকল কথা বলিয়া সাবধান করিয়া দিয়াছিলেন, কিন্তু ভয় কাহাকে বলে সুরেশ তাহা জানিতেন না,বন্ধুর কথায় যে তিনি বিশেষ কর্ণপাত করিয়াছিলেন, এরূপ বোধ হয় না। বিশেষতঃ তিনি গৃহে বসিয়া থাকিতে পারেন না, চাকুরীর চেষ্টায় তাহাকে সকল সময়েই সহরের সকল স্থানে যাইতে হইতেছে। বদমাইসের ভয় করিলে চাকুরীর চেষ্টা করা হয় না।