লেফ্টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/খ্রীষ্টধর্ম্মে দীক্ষা
চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ।
খ্রীষ্টধর্ম্মে দীক্ষা।
পাঠকগণ অবগত আছেন যে, সুরেশ খৃষ্টান হইয়াছেন। যিনি বাল্যকালে এত হিন্দু ছিলেন, যিনি নীলকুঠিতে সাহেবদিগের নিকট রাত্রি যাপন করিলে জাতি যাইবে মনে করিয়াছিলেন, তিনি কিরূপে অবশেষে খৃষ্টধর্ম অবলম্বন করিলেন, এক্ষণে আমরা তাহাই বলিব।
তাঁহার উচ্ছৃঙ্খলতা দিন দিন এত বৃদ্ধি হইতে লাগিল যে তাঁহার প্রিয় খুল্লতাত কৈলাস বাবুও তাঁহার উপর বিরক্ত হইয়া উঠিলেন, তিনিও মধ্যে মধ্যে তাঁহাকে ভর্ৎসনা করিতে আরম্ভ করিলেন। কৈলাস বাবুর অপেক্ষা গিরিশ বাবু কড়া লোক ছিলেন; তিনি পুত্রের এইরূপ চরিত্রে বিশেষ ক্রোধান্ধ হইলেন, এক দিন সুরেশকে আগাগোড়া বেত লাগাইলেন;—কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। খ্রীষ্টানদিগের মধ্যে থাকিয়া সুরেশের হিন্দুধর্ম্মে একেবারেই আস্থা ছিল না। মহাবৈষ্ণব গিরিশ বাবুর চক্ষে ইহা মহা পাতক বলিয়া প্রতীত হইল; তিনি পুত্রকে ভর্ৎসনা করিয়া, প্রহার করিয়া নিরস্ত হইলেন না,—তাঁহাকে ত্যজ্য পুত্র করিবেন বলিয়া ভয় দেখাইলেন।
উদ্ধত ও উচ্ছৃঙ্খল সুরেশ পিতার তাড়নায় ক্ষিপ্ত প্রায় হইয়া উঠিলেন। বালককাল হইতেই তিনি স্বাধীন চেতা, পরের অধীনে পরের করতলস্থ হইয়া থাকা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব; পিতার শাসন তাঁহার পক্ষে অসহ্য হইয়া উঠিল, তিনি আত্মীয় স্বজন এমন কি পিতাকেও ত্যাগ করিয়া সকলের সহিত সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিলেন। কেবল এক জননী, তাঁহারই স্নেহ বন্ধনে বন্ধ হইয়া সুরেশ এখনও গৃহ ত্যাগ করেন নাই। পিতা কর্ত্তৃক ভর্ৎসিত বা প্রহারিত হইলে তাঁহার স্নেহময়ী জননীই তাঁহাকে কোল দিয়া তাঁহার হৃদয়ে শান্তিবারি প্রদান করিতেন।
একদিকে পিতা পুত্রকে ত্যজ্যপুত্র করিবার জন্য ক্রমে হৃদয়কে দৃঢ় করিতেছেন, অপরদিকে পুত্রও গৃহ, আত্মীয় স্বজন সমস্ত পরিত্যাগ করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইতেছেন; এরূপ গৃহবন্ধন আর কয়দিন রহে? একদিন পিতা পুত্রে মহা কলহ উপস্থিত হইল, পুত্র আর সহ্য করিতে পারিলেন না; আর জীবন থাকিতে গৃহে ফিরিবেন না প্রতিজ্ঞা করিয়া সুরেশ গৃহ হইতে বহির্গত হইলেন। তিনি বরাবর লণ্ডনমিশনস্থ তাঁহার খ্রীষ্টান বহুদিগের নিকট গমন করিলেন। তাঁহাদের নিকট হৃদয় খুলিয়া সকল কথা, প্রাণের সমস্ত কথা, বলিলেন। তাঁহার যেরূপ মনের ভাব, বন্ধুগণও ঠিক সেই ভাব ব্যক্ত করিলেন। দুর্ব্বলতা কিছুই নহে, যাহার হৃদয়ে বল নাই, তাহার কিছুই নাই, কোন ক্রমেই আর তাঁহার অন্ততঃ উপস্থিত কিয়ৎদিন বাড়ী যাওয়া কর্ত্তব্য নহে,—তাঁহার বন্ধুগণ সকলেই তাঁহাকে এই পরামর্শ দিলেন। সুরেশের প্রাণে তাঁহাদের কথা লাগিল, তিনিও প্রতিজ্ঞা করিলেন যে সেই দিন হইতে তিনি আত্মীয়স্বজনের সহিত আর কোন সম্বন্ধই রাখিবেন না। তাঁহার বন্ধুগণের মধ্যে অনেকেই তাঁহাকে তাঁহাদের বাড়ীতে যতদিন তাঁহার ইচ্ছা তত দিন থাকিবার জন্য অনুরোধ করিতে লাগিলেন। যৌবনে যুবকগণ ভবিষ্যৎ বিপদাপদের কথা একেবারেই ভাবেন না। যাঁহারা সুরেশকে এইরূপে আমন্ত্রণ করিলেন, তাঁহারা একবারও ভাবিলেন না যে তাঁহাদের জনক জননীগণ এ বন্দোবস্তে রাজি হইবেন কি না।
সুরেশ ইহাতে সম্মত হইলেন না। তিনি জানিতেন যে তাঁহার বন্ধুবান্ধবগণ ধনী নহেন,—তাঁহাদের বা অন্য কাহারই গলগ্রহ হইয়া থাকা সুরেশের প্রকৃতিতে লেখে নাই,—স্বাধীনচেতা সুরেশ কাহারই ভারস্বরূপ হইয়া থাকিতে সম্মত নহেন। এই সকল কারণে সুরেশ লণ্ডন মিসনের প্রিন্সিপাল আসটন সাহেবকে সকল কথা খুলিয়া বলিলেন। সুরেশ নিতান্ত উচ্ছৃঙ্খল হওয়া স্বত্বেও আসটন সাহেব সুরেশকে স্নেহ করিতেন। তিনি মিষ্টকথা কহিয়া তাঁহার প্রাণের শান্তির জন্য তাঁহাকে বাইবেল পড়িতে অনুরোধ করিলেন। সুরেশের তখনকার মানসিক অবস্থা বর্ণনায় প্রয়াস পাওয়া বৃথা,—হিন্দুধর্ম্মের প্রতি তাঁহার জাতক্রোধ জন্মিয়াছে, কারণ তাঁহার আত্মীয়গণ হিন্দু। হিন্দু নাম থাকিলে পাছে তাঁহার আত্মীয় স্বজনগণ তাঁহাকে পুনরায় গৃহে লইয়া যাইতে আইসেন, এই ভয়ে তিনি কালবিলম্ব না করিয়া খ্রীষ্টধর্ম্মে দীক্ষিত হইয়া পড়িলেন। সুরেশ এখনও বালক বই নহেন, তবে তিনি এমনই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে মনে মনে স্থিরসঙ্কল্প করিলেন আর কখনও বাড়ী ফিরিবেন না। এখন তিনি খ্রীষ্টান, গৃহ শূন্য, অর্থ শুন্য, তিনি অর্থ উপার্জ্জন করিয়া যে আত্ম পোষণ করিবেন,—এ ক্ষমতা তাঁহার হয় নাই,—তবুও এক মুহূর্ত্তের জন্যও তাঁহার মন টলিল না,—তিনি ভীত হইলেন না;—মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন, যতই কেন কষ্ট হউক না গৃহে কখনও ফিরিব না। তাঁহার খ্রীষ্টান হওয়ার সংবাদ পাইয়া তাঁহার আত্মীয় স্বজন তাঁহার সহিত সকল সম্বন্ধ পরিত্যাগ করিলেন। তাঁহার পিতা গিরিশ বাবু তাঁহাকে ত্যজ্যপুত্র করিলেন ও জীবনে আর তাঁহার মুখ দেখিবেন না শপথ করিলেন। সুরেশ গৃহ-শূন্য, অর্থ-শূন্য, কলিকাতার রাজপথে সহায় হীন ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন।
আসটন সাহেব এই সময়ে নানা রূপে সুরেশকে সাহায্য করিয়াছিলেন। তিনি লণ্ডন মিশনকলেজে তাঁহাকে বাস করিতে দিয়াছিলেন;—সুরেশের ভোজন ও বাসের জন্য এক পয়সাও লাগিত না। ইচ্ছা করিলে তিনি লেখা পড়া শিখিয়া বিদ্বান্ হইয়া অন্যান্য দেশীয় খৃষ্টানদিগের ন্যায় ভবিষ্যতে সুখ স্বচ্ছন্দে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিতে পারিতেন; কিন্তু সুরেশের স্বভাব সে রূপ ছিল না। লেখা পড়া করিবার জন্য তাঁহার জন্ম হয় নাই; অথচ তিনি পরের গলগ্রহ হইয়া থাকিবার পাত্রও নহেন;—কাজেই তিনি কোন রূপ একটা চাকরী জোগাড়ের জন্য চারি দিকে নানা স্থানে চেষ্টা পাইতে লাগিলেন। নানা স্থানে চেষ্টা করিয়াও সুরেশ কোন চাকুরী জোগাড় করিতে পারিলেন না; একে তাঁহার বয়স অল্প, তাহার উপর লেখা পড়া কম, তাঁহাকে কে কি কার্য্য দিবে? তিনিই বা কি কার্য্য করিতে পারিবেন?
গবর্ণমেণ্ট আফিস, সওদাগরি আফিস, রেল আফিস, ডক, জেটি;—যেখানে কোন চাকুরী পাইবার সম্ভাবনা আছে, সুরেশ সেই সেই খানেই গেলেন, কিন্তু কোথাও কিছু হইল না। লোকে তাহার দুঃখে সহানুভুতি না কবিরা বরং তাহাকে বিদ্রুপ করিত। বিশেষত তিনি খ্রীষ্টান হইরাছেন শুনিয়া দেশীয় কেরাণীগণ তাঁহাকে নানা রূপে অপমানিত করিতেন। সুরেশ বাধ্য হইরা এই সকল হাসি বিদ্রুপ সহ কণিতেছিলেন; উপায় নাই। একটা না একটা কোন কিছু না করিলে নয়।
তাঁহার চাকরীর বয়স নহে, তাহায় পিতা বা আত্মীয় স্বজনের এরূপ অবস্থা নহে যে তাহাকে এই অবস্থায় চাকরীর জন্য লালায়িত হইয়া কলিকাতার রজেপথে ঘুরিয়া বেড়াইতে হয়। উচ্ছৃঙ্খল না হইলে তাহায় পিতা বা খুল্লতাত আহ্লাদের সহিত তাহাকে আদর যত্ন করিতেন, তাহার ও কর্তব্য ছিল এ বয়সে এরূপ করিয়া না বেড়াইয়া লেখা পড়ায় মন দিয়া বিদ্বান হই- বার চেষ্টা করা। তিনি ইচ্ছার সে সমস্ত নষ্ট করিয়া রাজপথে দাড়াইয়াছেন;—ইচ্ছায় বিপদকে ডাকিয়া আনিয়াছেন,— তিনি ক্রোধে গৃহ ত্যাগ করিয়া স্নেহময়ী জননীর হৃদয়ে দারুণ আঘাত দিয়াছেন। পিতৃপুরুষের আদরের সনাতনধর্মকে পরি- ত্যাগ করিয়াছেন;—এ রূপ অবস্থায় তাহার ক্লেশ হইলে সে জন্য তিনি ব্যতীত অন্য কেহ দায়ী নহে।
যখন নিরাশার মেঘ সুরেশকে আবরিত করিতেছিল, যখন তিনি জীবনে হতাশ হইতেছিলেন, সেই সময়ে তাহার জীবনের সেই ঘোর অমানিশার মধ্যে একটা কালো দেখা দিল। তিনি স্পেন্সেস হোটেলে একটা সামান্য চাকরী পাইলেন। জাহাজের ঘাটে ও রেলওয়ে ষ্টেশনে তাহাকে থাকিতে হইত,কোন সাহেবমেম আসিলে তিনি তাহাদিগকে স্পেন্সেস হোটেলে লইয়া আসিতেন। তাহাদের মালামাল রেল বা জাহাজ হইতে জানা বা রেলে বা জাহাজে পাঠাইয়া দেওয়া,—তাহাদিগকে কলি- কাতার নানা দর্শনীয় স্থান দেখান, —সুরেশের ইহাই কার্য্য ছিল। সুরেশ শুদ্ধ করিয়া ইংরাজী বলিতে না জানিলেও বেশ তাড়াতাডি ইংরাজী বলিতে পারিতেন। যে সকল সাহেব মেমের সহিত তাহাকে কথা কহিতে হইত, তাহাদের অনেকেই বাঙ্গালা বা হিন্দী জানিতেন না, সুতয়াং; সুরেশ যে ইংরাজী জানিতেন তাহতেই তাহায় কাজ বেশ ভালরূপ চলিয়া যাইত। তিনি যে কাজে এই সময়ে নিযুক্ত হইয়াছিলেন, তাহা হইতে অন্যত্র গিরা অন্য রূপে জগতব্যপী নাম করিতে পারিবেন, তাহা সে সময়ে কে ভাবিয়াছিল। তবে এ সময়ে এইরূপে সাহেবদের মধ্যে থাকিতে পাইয়া যে সাহেবদিগের অবতাবের তাহার বিশেষ বহুদর্শিতা জন্মিয়াছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।
এই রূপে সুরেশ কিয়দ্দিবস স্পেন্সেস হোটেলে রহিলেন। কিন্তু বহু দিন এ চাকরী তাহার ভাল লাগিল না, এক কার্য্যে বহু দিন মনোনিবেশ করিয়া থাকা উহায় পক্ষে অসম্ভব। তাহার মন চঞ্চল হইয়া উঠিল। তিনি প্রত্যহই গঙ্গার তীরে যাইতেন, প্রায়ই সাহেবদিগকে আনিতে বা তুলিয়া দিতে জাহাজে যাইতেন। এইরূপে জাহাজে যাওয়া আসায় তাহার প্রাণ বিলাত যাইবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠল। রাত্রি দিন শয়নে স্বপনে সর্বদা তাহার একই চিন্তা, তিনি দেশ ত্যাগ করিয়া যে কোন উপায়ে একবার বিলাত যাইবেনই যাইবেন, তাহারই জন্য শত প্রকার উপায় উনি মনে মনে করিতে লাগিলেন,কিন্তু কোনটীই তাহার মনের বাসনা পূর্ণ করিবার পক্ষে সুবিধাজনক বলিয়া বোধ হইল না। এই রূপে মাসের পর মাস কাটিয়া গেল, সুরেশের বিলাত ভ্রমণ ইচ্ছা পূর্ণ হইবার কোনই সম্ভাবনা হইল না। যে সকল সাহেব বিলাত হইতে এদেশে বেড়াইতে আসিতেন এবং যাহারা স্পেন্সেস হোটেলে বাস করায় সুরেশের সহিত সর্বদাই কথা বার্তা কহিতেন, সুরেশ তাহাদের অনেকের নিকট তাহার মনের বাসনা জ্ঞাপন করিয়া তাহাদের সঙ্গে যাইতে চাহিয়া ছিলেন, কিন্তু তাহাতেও কোন ফল হইল না। সাহেবেরা তাহার কথায় কেবল মৃদু হাস্য করিতেন।
সুরেশ জানিতেন বিলাত যাইবার টাকার জন্য যদি তিনি তাহার আত্মীয় স্বজনের নিকট গমন করেন, তাহা হইলে তাহাতে কোনই ফল হইবে না, তাহারা এক পয়সাও দিবেন না। তাহাকে সকলেই ভুলিয়াছিল, কেবল ভুলেন নাই তাহার স্নেহময়ী জননী; কিন্তু তাহার হাতে টাকা নাই যে তিনি তাহাকে টাকা দিয়া তাহার জীবনের উদ্দেশ্য ও উচ্চাভিলাস পূর্ণ কয়াইবেন! সুরেশের পিতায় ভয়ে তিনি পুত্রের সহিত দেখা করিতেও সাহস করিতেন না। বাড়ীতে কেহ না থাকিলে তিনি সুরেশের কনিষ্ঠকে দিয়া সুরেশের প্রিয় আহারীয় দ্রব্য কখন কখন তাহাকে পাঠাইয়া দিতেন। সুরেশের খুল্লতাতও মধ্যে মধ্যে তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিতেন, কিন্তু ইহাতে্ সুরেশের ভবিষ্যত জীবনের কোনই কিছু হইল না। সুরেশ তৃণের ন্যায় সংসার স্রোতস্বিনী বক্ষে ভাসিয়া চলিলেন।
সমুদ্র যাত্রা করিয়া দেশ বিদেশে ভ্রমণ করিব, ক্রমে এ ইচ্ছা সুরেশের মস্তিষ্কের সহিত যেন সংমিশ্রিত হইয়া গেল। তাহার প্রকৃতিতে সমুদ্র যাত্রা, সমুদ্রে সমুদ্রে নাবিকদিগের তার জীবন যাত্রা নির্বাহ করা, যেন সতসিদ্ধ বলিয়া তাহার নিকট বোধ হইতে লাগিল। ভ্রমণ বৃত্তান্তের নানা পুস্তক পাঠ করিয়া নানাদেশ ভ্রমণে তাহার প্রাণ ব্যাকুল হইয়া উঠিল। কোন গতিকে এদেশ ত্যাগ করিয়া যাইবার এ সুরেশ উন্মত্ত হইলেন।
এ সময়ে তিনি লণ্ডন মিশন কলেজে বসবাস করিতে ছিলেন। আসটন সাহেব ও সপরিবারে সেইস্থানে থাকিতেন। তিনি বরাবরই সুরেশকে স্নেহ করিতেন —এক্ষণে সুরেশ খৃষ্টান হইয়া একরূপ তাহার পরিবার ভুক্ত হইয়া পড়িয়াছি লেন। তাহারা সকলেই তাহাকে বিশেষ আদর যত্ন করিতেন। অবসর মত একটু পড়াশোনা করিয়া সুরেশ আত্মোন্নতি করেন, আসটন সাহেব সর্বদাই সে বিষয়ে বিশেষ যত্ন করিতেন। এখন যেরূপ চাকরীই সুরেশ করুন না কেন, লেখা পড়ার একটু উন্নতি করিলে যে ভবিষ্যতে ভাল হইতে পারে, আসটন সাহেব সদাই সুরেশকে এ বিষয়ে উপদেশ দিতেন। সংসার হয় বিদ্যা নয় ধন না থাকিলে যে কেহই কাকে মানুষ বলিয়া গণ্য করে না, তাহা এসংসারে আমরা কে না বুঝি? আসটন সাহেব ইহা জানিতেন, এবং তাহাই তিনি সুরেশকে লেখা পড়ায় অবসর মত মন দিতে বিশেষ জেদাজিদি করিতেন; কিন্তু তাহার সদুপদেশ বধির কর্ণে প্রদত্ত হইত, সুরেশের সহিত সরস্বতীয় চির বিবাদ,—পড়া শোনা করিবার লোক তিনি নহেন। কিরূপে দেশ বিদেশ ভ্রমণ করিবেন, ইহাই তাহার প্রাণের একান্ত আকাঙ্খা, সর্বদা এই ইচ্ছাই তাহার মস্তিষ্কে ঘুর্ণায়মান, পড়াশোনা করিবে কে? আসটন সাহেব ইহা নিতেন, তবুও তিনি সুরেশকে ভাল বাসিতেন ও আদর যত্ন করিতেন। তিনি সুরেশকে কি ভাবে দেখিতেন, তাহা নিম্ন লিখিত পত্রখানি পাঠ করিলেই বুঝতে পারা যাইবে। আসন সাহেব সুরেশের ভাইকে এই পত্রখানি দিয়া ফাদার লাফোঁ সাহেবের নিকট পাঠাইয়া দিয়াছিলেন,—
“ইনি বাবু সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসের ভ্রাতা। সুরেশ আমাদের ছাত্র এবং প্রায় ২১ বৎসর হইল খৃষ্ট ধর্ম অবলম্বন করিয়াছিলেন। আমি তাহাকে বড় ভাল বাসিতাম এবং আমাদের পরিবারে তিনি ছেলের মত ছিলেন। কিন্তু কিয়দ্দিন পরে তাঁহার মন বড়ই চঞ্চল হইল। বিলাত দেখিবার জন্য তিনি পাগল হইলেন। বি, আই ষ্টিমারে সহকারি স্টুয়ার্ড হইয়া তিনি বিলাত, গিয়াছিলেন। সেখানে তিনি আমার পিতা মাতার সঙ্গে দেখা করেন, তাঁহারা তাহাকে বিশেষ যত্ন করেন। বিলাতে নানা কষ্ট পাইয়া অবশেষে তিনি জামরাক সাহেবের সার্কাসে চাকরি পান; এবং শীঘ্রই তাহার দলে সিংহের সহিত খেলা করিতে আরম্ভ করেন। এইরূপে এই দলের সহিত তিনি ইয়োরোপের প্রায় সকল সহরে গিয়াছিলেন। এইরূপে নানা স্থানে ঘুরিয়া তিনি ব্রেজিলে উপস্থিত হন। এদেশে নানা চাকুরি করিয়া অবশেষে ব্রেজিল দেশীয় সৈন্যদলে প্রবিষ্ট হন। এক্ষণে উন্নতি লাভ করিয়া লেফটেনেণ্ট হইয়াছেন।
“তিনি কতকগুলি প্লাকার্ড ও সম্বাদ পত্র তাহার আত্মীয় দিগকে পাঠাইয়াছেন। আমার বোধ হয় এগুলি সব পর্টুগিজ ভাষায় লেখা। তাহার আত্মীয়গণ এগুলির অনুবাদ পাইবার জন্য বিশেষ ব্যগ্র হইয়াছেন। আমার মনে হইল হয়ত আপনি বা ফাদারগণের মধ্যে অন্য কেহ পর্টুগিজ ভাষা পাঠ করিতে পারিবেন। বিশেষ পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুবাদ করিবার বোধ হয় আপনাদিগের সময় হইবে না। ইহাদের ভাবার্থ পাইলেই আমরা বিশেষ অনুগ্রহিত মনে করিব।”