লেফ্‌টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/কলিকাতায় প্রত্যাবর্ত্তন

উনবিংশতি পরিচ্ছেদ।


কলিকাতায় প্রত্যাবর্ত্তন।


 কলিকাতায় ফিরিয়া আসিয়া সুরেশ কোন পাকা চাকুরী যোগাড় করিতে পারিলেন না। যখন যাহা জুটিতে লাগিল, তখন তাহাই করিতে লাগিলেন; এবং সর্ব্বদাই সর্ব্বত্র চেষ্টায় রহিলেন। তাহার সময় তখন মন্দ,—তিনি শত চেষ্টায় কোন ভাল চাকুরী পাইলেন না। তবে তাহার অনাহারের কষ্ট ছিলনা। আসটন সাহেব তাহাকে সর্ব্বদা অবাধে লণ্ডন মিশন বোর্ডিংয়ে বাস করিতে অনুমতি দিলেন। তিনি ইচ্ছা মত সেইখানে বাস করিতে ও ভোজন করিতে পাইতেন, এ বিষয়ের জন্য তাঁহার কোন চিন্তা ছিল না। তবে ভোজন ও বাসের সংস্থান হইলেও লোকে নিজ খরচের জন্য দুই চারি টাকা চাহে, সুরেশের এক্ষণে তাহারই অভাব।

 মান্দ্রাজ হইতে ফিরিয়া আসিয়া তিনি একদিন বাটীতে যখন তাহার পিতা ও খুল্লতাত ও অন্যান্য পুরুষগণ অনুপস্থিত ছিলেন, সেই সময়ে মায়ের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। তাহার জননী কাহাকে কিছু না বলিয়া তাহাকে কয়েকটী টাকা দিলেন। তিনি তাহাকে মধ্যে মধ্যে গোপনে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য অনুরোধ করিলেন, বলিলেন যতদিন না কোন চাকুরি হয়, মধ্যে মধ্যে তাহার সহিত দেখা করিলে তিনি তাঁহাকে কিছু কিছু টাকা দিবেন, কিন্তু সুরেশের জননীর সহিত সাক্ষাৎ প্রায়ই ঘটিত না।

 এক্ষণে সুরেশের স্বভাবের অনেক পরিবর্তন ঘটিয়াছে। সংসারের বিপদাপদের অপেক্ষা স্বভাবকে নরম করিবার আর উৎকৃষ্টতর যন্ত্র কিছুই নাই। সংসার সমুদ্রের মহাতরঙ্গে পতিত হইয়া সুরেশেরও ঔদ্ধত্য লোপ পাইয়াছিল। তিনি বুঝিয়াছিলেন যে লেখা পড়ার উন্নতি না করিলে সংসারে বড় হইবার কোন আশা নাই। এক্ষণে পড়া শোনা করিবার বা তাহার যথেষ্ট সময় ছিল, কিন্তু পুস্তকে বহুক্ষণ মনোনিবেশ করিয়া থাকা তার পক্ষে অসম্ভব, কিন্তু দেখিয়া শুনিয়া তিনি বুঝিলেন, একটু লেখা পড়ার উন্নতি করা একান্ত আবশ্যক-তাহাই এক্ষণে তিনি সময় পাইলেই কোন না কোন পুস্তক পাঠ করিতেন। তিনি উপন্যাসের বড় প্রিয় ছিলেন না, যে সকল পুস্তকে নূতন নূতন দেশের বর্ণনা আছে, নূতন নূতন শিখিবার বিষয় আছে, তিনি সেই সকল পুস্তকই পাঠ করিতেন।

 এইরূপে ক্রমে তাহার লেখা পড়ায় উন্নতি হইতে লাগিল, কিন্তু তাহার জীবনের একমাত্র আশা এখনও দুর হয় নাই, এখনও তিন দিন রাত বিলাত যাইবার উপায় উদ্ভাবন করিয়া থাকেন, মনে মনে এ সম্বন্ধে কত গড়েন ভাঙ্গেন, ইহার জন্য কত লোকের নিকট গমন করেন, কিন্তু কোন স্থানেই কিছু করিতে পারেন না। তিনি তাহা আশা পূর্ণ হইবার কোন সম্ভাবনাই দেখিলেন না। সময় পাইলেই তিনি গঙ্গার তীরে জেটিতে জেটিতে ঘুরিয়া বেড়াইতেন। সুবিধা হইলেই সেলার্সহোমে গিয়া জাহাজি গোরাদিগকে একটু সুরা পান করাইয়া তাহাদের মুখে সমুদ্রের কথা, বিপদ আপদের কথা, নানা দেশের কথা শুনিতেন। যতই তিনি এই সকল শুনিতেন, ততই তাঁহার বিলাত দেখিবার জন্য মন পাগল হইয়া উঠিত। যদি জাহাজের গোরা হইয়াও বিলাত যাইতে হয়, তাহাও যাইবেন, —যেন তেন উপায়ে যাওয়াই চাই। এই উদ্দেশ্যে তিনি যে সকল ফার্ম্মের জাহাজ আছে, সেই সকল স্থানে গমন করিয়া নিজ ইচ্ছা জ্ঞাপন করিলেন, কিন্তু কেহই তাঁহার কথায় কর্ণপাত করিলেন না। তিনি যাহাদের নিকট গেলেন, তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ তাহার কথা শুনিয়া মৃদু হাস্য করিলেন, কেহ কেহ বা বিরক্ত হইয়া রূঢ় ভাবে তাঁহাকে তাড়াইয়া দিলেন। কিন্তু সুরেশ তবুও আশা ছাড়িলেন না; সুরেশ হতাশ হইবার পাত্র ছিলেন না।