লেফ্টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/স্বদেশকে বিদায়
বিংশতি পরিচ্ছেদ।
স্বদেশকে বিদায়।
এইরূপে দিনের পর দিন সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাটিয়া গেল, সুরেশের আশা পূর্ণ হইবার সম্ভাবনা সেই রূপ সুদূর পরাহতই রহিল। যখন এইরূপে হতাশ চিত্তে কলিকাতায় রাজপথে তিনি ফিরিতেছিলেন, সেই সময়ে এক দিন তাহার সৌভাগ্যক্রমে বি, এস, এন, কোং একখানি জাহাজের কাপ্তেন সাহেবের সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইল। কাপ্তেন সাহেবের জাহাজ সম্প্রতি কলিকাতায় আসিয়াছে, মাল নাবান, মাল বোঝাই করা, জাহাজ রঙ্গ করা প্রভৃতিতে জাহাজ প্রায় মাসাধিকের উপর কলিকাতায় থাকিবে। কাপ্তেন সাহেব নিতান্ত দয়াবান ও সদাশয় ব্যক্তি ছিলেন, —ভারতবাসীর প্রতি বিন্দুমাত্র তাহার বিদ্বেষ ভাব ছিল না। তাহার নিকট তিনিও যেরূপ মানুষ, সুরেশও সেইরূপ মানুষ —বিশেষতঃ সুরেশ তাহার স্বদেশীয় ভাষায় তাহার সহিত কথোপকথন করিতে পারেন ইহাতে তিনি সুরেশের সহিত কথাবার্তা কহিয়া বিশেষ প্রীত হইলেন। যদি তাঁহা দ্বারা সুরেশের কোন উপকার হয়, তাহা তিনি আনন্দের সহিত করিবেন বলিয়া তিনি সুরেশকে সাদর সম্ভাষণ করিয়া বিদায় হইলেন।
সুরেশ কাপ্তেন সাহেবের জাহাজের নাম ও ঠিকানা জানিয়া লইয়াছিলেন; সেইদিন হইতে তিনি প্রত্যহ জাহাজে গিয়া কাপ্তেন সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিতেন। এইরূপ যাওয়া আশায় উভয়ে বিশেষ সৌহৃদ্য জন্মিল, সাহেব পুত্র নির্বিশেষে সুরেশকে স্নেহ করিতে লাগিলেন। প্রথমে সুরেশ কাপ্তেনসাহেবকে নিজের মনের কথা কিছুই প্রকাশ করেন নাই। পরে এক দিন তিনি নিজের সমস্ত অবস্থা জানাইয়া প্রাণের ইচ্ছা তাহাকে জ্ঞাপন কবিলেন। এত অল্প বয়সে যে তিনি দেশ ত্যাগ করিয়া বিদেশে গমন করেন, এ প্রস্তাবে সাহেব অনুমোদন করিলেন না। পরে সুরেশের অনুনয় বিনয়ে তিনি সুরেশকে লণ্ডনে লইয়া যাইতে সম্মত হইলেন। তিনি সুবেশকে তাহার জাহাজের অ্যাসিষ্টাণ্ট স্টুয়ার্ডের পদে নিযুক্ত করলেন।
কয়েক দিন পরেই জাহাজ কলিকাতা ছাড়িয়া বঙ্গোপসাগরের দিকে চলিল। বালক সুরেশ;—কারণ তখন তাঁহার বয়স ১৭ বৎসরের উর্দ্ধ নহে——ব্যাকুল নেত্রে জাহাজের ডেকে উপর দাড়াইয়া একবার শেষ কলিকাতা দেখিয়া লইলেন। জাহাজ ছাড়িয়া যাইতেছে দেখিবার অনেক লোক গঙ্গা তীরে দাঁড়াইয়াছে; —কিন্তু তাহাদের মধ্যে সুরেশের আপনায় বলিবার কেহই ছিল না। তিনি যে অন্যের মত দেশ, স্বজন, জনক জননী সকল পরিত্যাগ করিয়া দূর বিদেশে প্রস্থান করিতেছেন, তাহা কেহ জানি না; দেখিল না, কেহ তাঁহার জন্য এক ফোটা চক্ষের জল ফেলিল না!
সে সময়ে সুরেশের প্রাণের যে কি অবস্থা তার বর্ণনা করা অনাবশ্যক। তিনি কোথা যাইতেছেন, কি করিবেন, তাহার স্থিরতা নাই। তিনি দূর বিদেশে বিদেশীর মধ্যে যাইতেছেন, তার অদৃষ্টে কি আছে তা কে বলিতে পারে! স্নেহময়ী জননীকে কাঁদাইয়া তিনি চিরদিনের জন্য চলিলেন, ইহাতে হার হয় হির হইতে লাগিল। তিনি কতবার ভাবিলেন,— এখনও সময় আছে, কাপ্তেন সাহেবকে বলিয়া ডেঙ্গায় নামিয়া পড়ি; —আর বিলাত দেখিয়া কাজ নাই। কিন্তু তৎক্ষণাৎ হৃদয়ের দুর্বলতাকে শমিত করিলেন;—চক্ষের জল চক্ষে মুছিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া জন্মভূমির নিকট হইতে চিরদিনের জন্য বিদায় লইলেন।
এ রূপ ভাবে ডেকের উপর দাঁড়াইয়া তিনি জন্মভূমিকে যে শেষ দেখা দেখিবেন এক্ষণে সুরেশের সে অবস্থাও নাই। তিনি জাহাজে চাকুরী লইয়াছেন, জাহাজের চাকর,—তাহার শত কার্য্য করিবার আছে,তিনি এরূপ ভাবে থাকিলে চলিরে কেন? জাহাজের কাপ্তেন ও অন্যান্য কর্মচারিগণই বা তাহাকে ইহা করিতে দিবেন কেন? রুমালে মুখ মুছিয়া হৃদয়ের বেদনা হয়ে লুকাইয়া সুরেশ জাহাজের যে স্থানে তাহাকে কাজ করিতে হইবে সেইস্থানে গমন করিলেন।