লেফ্টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/নব অনুরাগ
আমরা পূর্বেই বলিয়াছি যে, যদিও সুরেশ হিংস্রক পশু বশীকরণ কার্য্যেই শিক্ষিত হইয়াছিলেন বটে, তথাপি তিনি অবসর পাইলেই গণিতশাস্ত্রাদি আলোচনায় নিযুক্ত হইতেন। বস্তুতঃ এই সকল অনুশীলনে তিনি স্বভাবতঃ কেমন আনন্দ অনুভব করিতেন। তিনি চিকিৎসাবিদ্যায় কথঞ্চিৎ অতিজ্ঞ ছিলেন, অঙ্ক ও অন্যান্য শাস্ত্রেও বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন। এবং লাটীন গ্রীক প্রভৃতি প্রাচীন ভাষায় ও সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন। দার্শনিক তত্ত্ব ও গুপ্তবিদ্যানিচরে তাঁহার সাতিশয় অনুরাগ ছিল, বিশেষতঃ ইন্দ্রজাল ও কিমিয়া বিদ্যায় তিনি সাতিশয় আসক্ত ছিলেন। শীত ও গ্রীষ্মকালে সমধিক রাত্রি জাগরণ করিয়া সুরেশ তাহার সেই ক্ষুদ্র পাঠাগারে বসিয়া অনন্য মনে অধ্যয়নে রত থাকিতেন, অথবা কাচ যন্ত্রাদি ও মুচি লইয়া রাসায়নিক পরীক্ষায় বিব্রত থাকিতেন। নিরত প্রধাবমান কালস্রোত কোথা দিয়া চলিয়া যাইত, জানিতেও পারিতেন না।
ঘটনাক্রমে সুরেশের সহিত একদা স্থানীয় চিকিৎসককন্যার সাক্ষাৎ ঘটে। এই প্রথম সন্দর্শনেই তৎপ্রতি তাঁহার প্রেমের সঞ্চার হয়, কিন্তু উক্ত রমণী তখনও তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হয়েন নাই। অনন্তর যথারীতি তাঁহারা উভয়ে উভয়ের সহিত পরিচিত হইলেন,—তাঁহার পক্ষে উহা বাহুল্য বলিয়া প্রতীত হইল। যাহা হউক, এই পরিচয়ের পর হইতে পথে, শকটে, বিপণীতে, উভয়ের সাধারণ বন্ধুগৃহে প্রভৃতি নানাস্থানে পরস্পরের প্রায়ই দেখা সাক্ষাৎ ঘটিত। ক্রমে ক্রমে তিনি সেই রমণীর প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হইয়া পড়িলেন, কিন্তু রমণী সে সম্বন্ধে তাঁহাকে বিশেষ উৎসাহ প্রদান করিতেন না। পরে তিনিই আবার তাঁহার জীবনের গতি পরিবর্তিত ও শূন্য অংশ পূর্ণ করেন।
স্ত্রীলোকেরা সাধারণত কল্পনা বহুল বিচিত্র জীবনের অনুরাগিণী; তজ্জন্যই দেখা যায় যে, সৃষ্টির প্রক্কাল হইতেই তাহারা বীরবিক্রমের পক্ষপাতী। সর্ব্ব জাতির ইতিহাসেই ইহর প্রচুর উদাহরণ দেখিতে পাওয়া যায়। ফলে, রমণীরা স্বয়ম্বরা হইলে অনেক স্থলেই ধনবান্ অপেক্ষা নিঃস্ব ব্যক্তকেই বরমাল্য প্রদান করে,যদি তাঁহার জীবন এইরূপ হয় এবং এইরূপ পরিণয়ে দাম্পত্য প্রেমে চিরসুখিনী হইয়া থাকে। সেই জর্ম্মাণ রজ্জুনর্তকীর কথাই ভাবিয়া দেখুন না,—অভাগিনী এই অপরিচিত, নরভূক্জন্তু সহবাসে আসন্ন মৃত্যুমুখেস্থিত ভারতবাসীর অঙ্কশায়িনী ইবার আশায়, জনৈক বর্দ্ধিষ্ণু ভূম্যধিকারী যুবার অযাচিত পাণিপ্রর্থনা অগ্রাহ্য করিয়াছিল।
যদিও উক্ত চিকিৎসককন্যা প্রথমে সুরেশকে তৎপ্রতি অনুরাগ প্রদর্শনে অণুমাত্রও উৎসাহ প্রদান করেন নাই, কিন্তু সেই অটল প্রকৃতি সিংহপালকের প্রার্থনা তিনি অধিক কাল অপূর্ণ রাখিতে সক্ষম হয়েন নাই। সুরেশ এতাবৎ কাল ভয় কাহাকে বলে জানিতেন না,—অসংখ্য ভীতিপূর্ণ আসন্ন মৃত্যু অদ্যাপি তাহাকে বিচলিত করিতে সক্ষম হয় নাই। নানা মূর্ত্তিতে মৃত্যু অদ্যাবধি তাহাকে নানা বিভীষিকা প্রদর্শন করিয়াছে,—মারী ভয়ে ভীতি, ক্রীড়নশীল সর্পকুলের দংশনাশক, শিক্ষিত ব্যাঘ্র বা সিংহ নিচয়ের দংশন ভয়, এবং তৎশিক্ষিত করিকুশের দশনভীতি, প্রভৃতি কিছুতেই তিনি অণুমাত্রও শঙ্কিত হয়েন নাই। উপস্থিত প্রেমই তাহার জীবনের এক মাত্র বন্ধন; যদি তাহাতে নিরাশ হয়েন, তাহা হইলে মৃত্যু তদপেক্ষা শতগুণে বাঞ্ছনীয় বলিয়া তাহার মনে হইত। এ সকল উদ্দেশ্যবিহীন বৃথা বাক্য নহে-প্রকই সুরেশের প্রণয়িনী ঘটনা-বৈচিত্র্যময় জীবনের প্রতি স্বভাবতই আকৃষ্ট হইতেন এবং সেই কারণেই সুরেশের প্রতি কথঞ্চিৎ পক্ষপাতীও হইয়াছিলেন। সুরেশের নির্ভিকতা, জীবনকে অতি সামান্য তৃণ অপেক্ষায় লঘু জ্ঞান, বিনা দ্বিধায় কি নৃশংস ব্যাঘ্র, কি ভয়াবহ অহিকুল, কি ভীষণদন্ত বারণ, কি তীব্রচক্ষুষ্মান ক্রূরমতি বন্য মার্জার (Lynx) প্রভৃতি হিংস্রক জন্তু মুখে অগ্রসর হইতে প্রবৃত্ত দেখিয়া ভীষক দুহিতা বস্তুতঃই মোহিত াহইয়াছিলেন। বিবিধ বন্যজন্তু তাঁহার সেই মোহিনী তীব্র দৃষ্টিপ্রভাবে তাহাদের স্বাভাবিক হিংস্র ও দুর্দ্দান্তভাব ভুলিয়া নিমেষে গৃহপালিত পশুদিগের মত শান্তমূর্তি ধারণ করিয়া তাঁহার বশীভূত হইত।ক্রমে উভয়ের মধ্যে ধীরে ধীরে যতই ঘনিষ্ঠতা বর্দ্ধিত হইতে লাগিল-পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্ব জন্মিল, ততই রমণী স্বীয় পূর্ব্ব গাম্ভীর্য্য পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। রমণীজন মুলত লজ্জা ভাৱতের ন্যায় পৃখিবীর অন্য কোনও অংশেই পরিদৃষ্ট হয় না; স্পেন ও পর্টুগালবাসীদিগের মধ্যে অবশ্য কতক পরিমাণে আছে বটে, কিন্তু ফরাসী ও মার্কিনদিগের মধ্যে আদৌ নাই। অদ্যাপি ব্রেজিলে মহিলাকুলের বাচালতা সামাজিক ব্যভিচাররূপে পরিগণিত হয়। ফলতঃ পুরুষদিগের সহিত অবাধে সংমিশ্রণ ব্রেজিল-বালাদিগের পক্ষে রীতিবিরুদ্ধ; কিন্তু অন্য কোনও পাশ্চাত্য প্রদেশে এরূপ নিয়ম দেখা যায় না।
কিন্তু প্রেম নির্দিষ্ট সমাজ বন্ধনীর অধীন নহে;—নহিলে তুষার ধবল ডেস্ভিমোনা সুন্দরী কৃষ্ণকায় সুরেশের চরণতলে অত্মসমর্পণ করিয়া আপনার নারীজন্ম ও জীবন সার্থক করিবার জন্য এত লালায়িত হইত না। মদনের মোহন শাসনের অপ্রতিহত প্রভাবে ক্রমে সেই সুদূৰ ভারতবাসী যুবক ও ব্রেজিলবাসী ভিষক্বালার হৃদয় দুইটী একীভূত হইতে লাগিল। বালা প্রায়ই তাঁহাকে তাঁহার নানা স্থানের কীর্তিকাহিনী বর্ণনা করিতে অনুরোধ করিতেন এবং সুরেশ যখন সেই সকল ঘটনাবলী অস্ফুটস্বরে ব্যক্ত করিতেন, তিনি উৎকর্ণ হইয়া নিবিষ্টচিত্তে তা শ্রবণ করিতেন—সেই সকল আশ্চর্য্য কাহিনী শুনিতে শুনিতে তাঁহার হৃদয়ে কই তরঙ্গ উঠিত, গণ্ডদেশ রক্তিমাবর্ণ ধারণ করিত, চক্ষু বিস্ফারিত ও সমুজ্জল হইত-তিনি যেন দেখিতেন, পৃথিবীতে আর কিছুই নাই; কেবল দেশে বিদেশে সুরেশচন্দ্র মহামহিমায় সৌন্দর্য্যে বীর্য্যে সর্ব্বস্থানে কীর্তীকলাপের বিজয়মালিকা পরিয়া দেবমূর্তিতে চারিদিক আলো করয়া আছেন। তিনি অন্তরে তিনি বাহিরে। তাঁহার প্রশংসাবাদ করিতে ভাষায় অভাব হইত বলিয়া ভিষক্দুহিতা মুগ্ধ দৃষ্টিতে প্রিয়তমের প্রতি চাহিয়া থাকিতেন ও দৃঢ়তর মুষ্টিতে সুরেশের করপেষণ করিতেন।