লেফ্‌টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/রণবিভাগে

চতুস্ত্রিংশৎ পরিচ্ছেদ।



রণবিভাগে।

 একদিন তিনি কথাপ্রসঙ্গে রহস্যচ্ছলে প্রকাশ করেন যে, সুরেশকে সৈনিক সজ্জায় বোধ হয় বড়ই সুন্দর দেখায়। এই রহস্যবাক্য সুরেশের মনে গম্ভীর আদেশ বলিয়া প্রতীত হইল। সৈনিকশ্রেণীভুক্ত হইয়া প্রণয়িনী সমীপে তাঁহার অনুরাগ প্রমাশিত করিতে কৃতসংকল্প হইয়া তিনি সাগ্রহে সেনানীদলে প্রবিষ্ট হইলেন এবং সানন্দে কঠোর সামরিক নিয়মাবলী প্রতিপালনে রত রইলেন। সৈনিক দলভুক্ত হইয়া তিনি দেখিলেন যে, তিন বৎসর কাল অবিচ্ছেদে তিনি এই কর্মে নিযুক্ত থাকিতে বাধ্য, এবং ইচ্ছা করিলেই এখন বার সেই পূর্বের মত দেশ পর্য্যটনে সক্ষম নহেন। একবার যখন তিনি নিয়মাবদ্ধ হইয়াছেন তখন আর পলায়নের উপায় নাই-কারণ, সর্ব্বদেশের সমর নীতির কঠোরবিধান অনুসারে পলাতক সৈনিক মাত্রেই কারাবাস বা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হইয়া থাকে। বলা বাহুল্য যে, প্রণয়িনীর প্রেমপরীক্ষার্থই তিনি সৈনিকশ্রেণীভুক্ত ইয়াছিলেন,—সম্ভতঃ তিনি নিজ এণয়বেগও দেখাইতে পারিবেন;—দেখাইলেন যে, প্রণয়িনীর জন্য তিনি অগ্নিতে প্রবেশ করিতে পারেন, দ্রব লৌহ গলাধঃকরণ করিতেও দ্বিধা করেন না। তিনি সামান্য সৈন্যরূপে প্রবেশ করেন, সৈনিক জীবন সর্ব্বপ্রদেশেই সমক্লেশকর।

 সুরেশ ব্রেজিল সম্রাটের অধীনে সৈন্য নিযুক্ত হইলেন। ব্রেজিলে তখনও এখনকার ন্য়ায় সাধারণ তন্ত্র স্থাপিত হয় নাই। প্রকৃতপক্ষে তিনি সমপদস্থ সাধারণ সৈনিকদিগের অপেক্ষা উন্নত ছিলেন। তিনি সাতটী ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন এবং যদিও প্রাচ্য বা প্রতীচ্য কোন বিশ্ব বিদ্যালয়ে বিদ্যাশিক্ষা করেন নাই তথাপি যে তথাবিধ অধিকাংশ সুশিক্ষিত ব্যক্তি অপেক্ষা শিক্ষিত ছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। তিনি স্বচেষ্টায় নানাবিধ অসামান্য বিদ্যা অর্জ্জন করিয়াছিলেন-সঙ্কটাপন্ন ও শ্রান্তিজনক ক্রীড়াবসানে যে অবসর পাইতেন, সেই সময়টুকু নানা জ্ঞানানুশীলনে অতিবাহিত করিয়া তৎসমুদায়ে বুৎপন্ন হইয়াছিলেন। এতৎসত্বেও জাতি ও বর্ণের জন্য তাঁহার পদোন্নতির অন্তরায় ঘটিল—তাঁহায় সম্বন্ধে ব্রেজিলেও বর্ণপার্থক্য বিষম অপরাধ বলিয়া পরিগণিত হইল! কিয়ৎকাল তাঁহাকে সাধারণ অশ্বারোহী সেনানী নিচয়ের কষ্টসমূহ ভোগ করিতে হইল-স্বহস্তে স্বীয় অপরিচর্য্যা ও শস্ত্র পরিষ্কার করিতে হইত।

 দেখা যায়, ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে তিনি সাণ্টাক্রুজে ক্ষুদ্র এক দল সেনানীয় নায়করূপে কর্পোরাল পদে অধিষ্ঠিত। সাণ্টাক্রুজে সম্রাটের অশ্ব চারণের একটা মাঠ ছিল, কর্পোরাল সুরেশচন্দ্র তথাকার অশ্বরক্ষককদিগের তত্বাবধায়ক নিয়োমিত হয়েন। এই স্থানে তিনি বহু দিবস অবস্থান করেন। এখানে তাঁর বিশেষ কার্য্য ছুিই ছিল না;—পাঠ, রাসায়নি্‌ক পরীক্ষা এবং প্রণয়পাত্রীর প্রেম চিন্তায় কালাতিবাহিত করিতেন। তাঁহার প্রেমপুত্তলি যদিও সশরীরে সেখানে ছিলেন না, কিন্তু তাঁহার মূর্ত্তি সুরেশের হৃদয়ে সর্ব্বদা জাগরুক ছিল। উহা প্রবাসে সঙ্গিনী, দুর্দ্দিনের সহচরী, অবসাদে সঞ্জীবনী ও জীবনের সুখচিন্তা হইয়াছিল। যে রত্ন লাভাশায় তিনি অশেষ অসুবিধা অন্তরায় উপেক্ষা করিয়া সৈনিকবৃত্তি অবলম্বন করেন, যে স্থানে জাতিবর্ণের বিষম ব্যবধান তাঁহাদের সুখসৌভাগ্যের বিশেষ অন্তরায় ছিল, মোহিনী প্রতিমায় স্নেহশীতল স্পর্শ ব্যতীত তথায় কিসে তাঁহাকে সঞ্জীবিত রাখে।

 কিছুকাল পরে তিনি সাণ্টাক্রুজ হইতে রায়ো-ডি-জেনেরোয় হাঁসপাতাল তত্ত্বাবধানে প্রেরিত হয়েন। এই স্থানে অবস্থানকালে তিনি প্রকৃতপক্ষে অন্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেন, তদ্ব্যতীত ইতঃপূর্ব্বেই পুস্তকাধ্যয়ন করতঃ চিকিৎসা বিদ্যায় পারদর্শী হইয়াছিলেন। ক্রমে তিনি অন্ত্র বিদ্যায় এরূপ সিদ্ধহস্ত হইলেন যে, বিনা দ্বিধায় ও নির্ভীক চিত্তে অধিকাংশ অন্ত্র চিকিৎসা সম্পাদন করিতেন। অধিকন্তু চিকিৎসা বিদ্যায় তাঁহার পূর্ব্ব হইতেই বিশেষ অনুরাগ ছিল, এক্ষণে তাহা সমধিক বর্দ্ধিত হইল। বস্তুতঃ এই সময়ে এতৎসম্বন্ধে তিনি তাঁহার পিতৃব্যকে ও অন্যান্য দেশীয় বন্ধু বান্ধবকে সানন্দে বহুসংখ্যক পত্র লিখিয়াছিলেন। প্রকৃতই এই চিকিৎসা শাস্ত্রের অনুশীলন যেন তাঁহাকে প্রণয় পাত্রীর সহিত ঘনিষ্ঠতর বন্ধনে আবদ্ধ করিতেছে বলিয়া তাঁহার মনে হইত,—চিকিৎসক কন্যার চিকিৎসা বিদ্যানুরাগ স্বতঃসিদ্ধ।

 সুরেশের তিন বৎসর সৈনিক পদে নিযুক্ত থাকিবার অঙ্গীকারপত্র ১৮৮৯ সালে ফুরাইল। ইচ্ছা করিলে এক্ষণে তিনি রণ, বিভাগ পরিত্যাগ করিয়া মনোমত অন্য কোনও কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতে পারিতেন; কিন্তু এই তিন বৎসর কাল একক্রমে সমর বিভাগে নিয়োজিত থাকিয়া এবং কষ্টকর পদাদি অতিক্রম করিয়া তিনি এই বিভাগে অনুরক্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। এখন আর সহসা একার্য্য পরিত্যাগ করিতে ইচ্ছা হইল না। তিনি অশ্বারোহী সৈন্য হইতে পদাতি শ্রেণীতে পদ পরিবর্ত্তন করিয়া লইলেন এবং অনতিবিলম্বে সেই শ্রেণীর বন্দুক চালাইবার প্রথা ও অন্যান্য কর্তব্যনীতি সর্ব্বথা শিক্ষা করলেন। সুরেশ যদি নির্দ্দিষ্ট তিনবৎসর পরেই সমর-বিভাগ পরিত্যাগ করিতেন, তাহা হইলে জগৎবাসী ব্রেজিল সৈন্যাধ্যক্ষ রূপে জনৈক ভারতবাসীর অসম সাহসিকতা এবং অগণ্য অরাতি সৈন্য বিপক্ষে অদ্ভুত বীরত্ব কাহিনী শুনিতে পাইতেন না। তিনি অন্ত্র চিকিৎসক বা সিংহপালক রূপে কখনই এরূপ ভুবন বিখ্যাত যশোলাভ করিতে বা এরূপ উন্নত পদমর্য্যাদা ও কীর্ত্তিকলাপে বিভূষিত হইতে সক্ষম হইতেন না। কিন্তু জগৎপাতা ইচ্ছাময়ের নির্দ্দেশ যে, তিনি মেকলে প্রভৃতি অন্যান্য প্রাচ্য গ্রন্থকারগণের বাঙ্গালিদিগের কাপুরুষতা সম্বন্ধে শ্লেষবাক্য ব্যর্থ করিয়া নাথেরয়ের বিখ্যাত যুদ্ধে স্বনাম ধন্য হইবেন এবং জগৎ সমক্ষে প্রতীয়মান করিবেন যে, যদিও ইংরাজ রাজা তাঁহাকে অস্ত্রশস্ত্র এনে বিমুখ, তথাপি তিনি মহারাজ্ঞী ও মাতৃভূমির রক্ষার্থে তরবারি ধারণে সম্যক্‌ সিদ্ধহস্ত। বাঙালীমাত্রক ভীরু ও কাপুরুষ নহে। কার্য্যক্ষেত্রে পড়িলে তাহারা বজ্রনাদী কামানের মুখে অবলীলাক্রমে রণভঙ্গে মাতিতে পারে এবং যে কোন দেশের সুদক্ষ সৈনিকদিগের সহিত সমভাবে আপনাদের বীরবিক্রম দেখাইতে অসমর্থ নহে।