লেফ্‌টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/প্রেম

একত্রিংশ পরিচ্ছেদ



প্রেম।

 এমন মানুষ নাই, যাহার হৃদয়ে কখন না কখন প্রেম দেখা দিয়াছে। বোধ হয় কেবল হিন্দু যোগীগণই নিজ নিজ সাধনার বলে হৃদয় হইতে দুর্দমনীয় প্রেমবৃত্তি উচ্ছেদ করিতে সমর্থ হইয়া ছেন। ইহারাই কেবল যোগ-সাধনার বলে ইন্দ্রিয় দমন করিয়া জিতেন্দ্রিয় হইতে সমর্থ হইয়াছেন। সাধারণ মানুষের পক্ষে ইন্দ্রিয় সংযমন একরূপ অসম্ভব-এমন মানুষ নাই, যিনি, জীবনের কোন না কোন সময়ে, হৃদয়ের সৌন্দর্য্য পিপাসায় পীড়িত হইয়া কামিনীর কমনীয়রূপে আকৃষ্ট না হইয়াছেন ও প্রেমের তরঙ্গে পতিত হইয়া আত্মহারা না হইয়াছেন।

 সুরেশ প্রেমের হাত এড়াইতে পারিলেন না। আমরা পূর্বেই বলিয়াছি যে সারকাসের জারমান বালিকার প্রতি তাঁহার প্রাণ আকৃষ্ট হইয়াছিল, কিন্তু তিনি জানিতেন যে জারমান বালিকাকে লাভ করা তাহার পক্ষে অসম্ভব, এই জন্য তিনি তার হৃদয়কে দমন করিতেছিলেন, বালিকাকে ভুলিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা পাইতেছিলেন। বালিকা সারকাস পরিত্যাগ করিয়া দেশে চলিয়া যাওয়ায় তাঁহার হৃদয়ে দারুণ আঘাত লাগিয়াছিল, কিন্তু তিনি সেই হৃদয় বেদনার মধ্যেও মনে একটু সাত্বনা পাইলেন। ভাবিলেন, বালিকার নিকট হইতে দূরে থাকিলে, বালিকাকে না দেখিলে তিনি তাহাকে হৃদয় হইতে অন্তহৃত করিতে পারিবেন; এবং এই উদ্দেশে-বালিকার সহিত সকল সম্বন্ধ বিছিন্ন করিবার জন্য-তিনি তাহার পত্রের দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ করিলেন। কিন্তু হায়! এত করিয়াও তিনি সেই সুন্দর মুখখানি ভুলিতে পারিলে না; অহোরাত্রি সেই সুন্দর মুখখানি তাঁহার হৃদয়ে প্রতিফলিত হইয়া তাঁহাকে ব্যাকুল করিতে লাগিল। বালিকার সহিত আর কখনও দেখা হইবার সম্ভাবনা ছিল না, এবং বহুদিন দেখা সাক্ষাৎ না হইলে তিনি চাই কি তাহাকে ভুলিলেও ভুলিতে পারিতেন। কিন্তু তগবান অন্যরূপ ব্যবস্থা করিলেন, তিনি মনে মনে বাহা স্থিয় করিলেন ঘটনাচক্রে তাহা উল্টাইয়া গেল।

 সুরেশ সারকাস দলের সহিত ইয়োরোপের নানা শহরে ফিরিতেছিলেন। এইরূপে ঘুরিতে ঘুরিতে তিনি জারমান দেশীয় একটী নগরে উপস্থিত হইলেন। সহসা একটা দোকানে তিনি সেই জারমান বালিকাকে দেখিলেন। তিনি এক্ষণে আয় বালিকা নাই, পূর্ণ যৌবনে ভাসমানা, সুরেশও এখন আর সেই পূর্ব্বের শ্বশ্রুহীন সুরেশ নাই, তিনিও যৌবনে পদার্পণ করিয়াছেন। বহুকাল উভয়ে উভয়কে দেখেন নাই, উভয়ের আকৃতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটিয়াছে, কিন্তু উভয়ে উভয়ের কেহও কাহাকে বিস্মৃত হন নাই। যখন উভয়ে উভয়ের সম্মুখীন হইলেন, তখন উভয়েই স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইলেন, কাহারও বাঙ্‌নিস্পত্তি হইল না। যদিও বহুদিন উভয়ে সাক্ষাৎ নাই, তবুও এইরূপ সহলা উভয়ের দর্শনে উভয়েই বুঝিলেন যে তাঁহাযরা পরস্পর পরম্পরকে ভুলিতে পারেন নাই। ক্ষণেক নিস্পন্দ থাকিয়া কিঞ্চিৎ পরে উভয়ে উভয়ের হস্ত ধারণ করিয়া সেই দোকান হইতে বহির্গত হইলেন। নিকটস্থ উদ্যানেয় নির্জন বৃক্ষনিয়স্থ বেঞ্চে বসিয়া উভয়ে কত কথা কহিলেন;—কত দিনেযর কত কথা, সে কথার শেষ নাই, বিরাম নাই। সে প্রেমিক যুগলের এম কথোপকথন কত মধুর, কত কোমল তাহা প্রেমিক ভিন্ন অপরে বুঝিবেন না।

 সে দিনের জন্ত উভয়ে উভয়কে প্রেমালিঙ্গন করিয়া বিদায় হইলেন, কিন্তু সেই সাক্ষাৎ শেষ সাক্ষাৎ নহে;—সেই দিন হইতে প্রয়ই প্রত্যহ উভয়ে গোপনে ও নির্জনে সাক্ষাৎ করিতে লাগিলেন। যুবতী ধনাঢ্য ব্যক্তির কন্যা, পিতৃমাতৃহীন হওয়ায় তিনিই এক্ষণে ঐশ্বর্যের একমাত্র উত্তরাধিকারিণী;—সুতরাং তাঁহাকে বিবাহ করিবার জন্য দেশের মান্যগণ্য অনেকে ব্যগ্র, এরূপ স্থলে যুবতীর আত্মীয় স্বজনগণ যে অজ্ঞাত কুলশীল এক অপরিচিত কৃষ্ণবর্ণ ভারতবাসীর সহিত, সামান্য পশু শিক্ষকের সহিত তাহার বিবাহে সম্মত হইবেন, ইহা কখনই সম্ভব নহে। যাতে যুবতী যুবকের সহিত সাক্ষাৎ করতে না পারেন তাঁহারা প্রাণপণে তাহারই চেষ্টা করিতে লাগিলেন; কিন্তু এই কালের শ্রোতস্বিনী ন্যায় প্রেমের এত প্রবল তরঙ্গময়ী, কে সেই বেগেয় প্রতিবন্ধক হইতে পারে। যুবতীর আত্মীয় স্বজন যতই প্রতিবন্ধকতাচরণ করিতে লাগিলেন, তাঁহার প্রেম স্রোতও ততই প্রবল হইয়া উঠিতে লাগিল। যে কোন উপায়ে হউক তিনি প্রত্যহ গোপনে সুরেশের সহিত সাক্ষাৎ করিতে লাগিলেন। উভয়ে উভয়ের প্রেমে উন্মত্ত হিতাহিত কাণ্ডাকাণ্ড সমস্তই ভুলিলেন, এরূপ ব্যাপারে বাহা হয়,—তাহাই ঘটিল,—যুবতী কলঙ্কের ডালা মাথায় করিলেন।

 এ কথা বহুকাল গোপন রহিল না। ক্রমে যুবতীর আত্মীয় স্বজন সকলেই যুবতীর এই অপকলঙ্কের কথা শুনিলেন, তখন তাঁহারা ক্রোধান্ধ হইয়া সুরেশের প্রাণ সংহার করিবার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞ হইলেন। সুরেশের আর জারমানিতে থাকা হইল না, তিনি প্রাণ রক্ষা করিবার জন্য জারমানি পরিত্যাগ করিলেন। জারমানি পরিত্যাগ করিয়াও তিনি নির্ভয় বা নিশ্চিন্ত হইতে পারিলেন না। যুবতীর আত্মীয়গণ তাহার পশ্চাতানুসরণ করিলেন, নগরে নগরে তাহার অনুসন্ধানে লোক লাগাইলেন। অগত্যা সুরেশ বাধ্য হইয়া ইয়োরোপ পরিত্যাগ করিলেন। আটলাণ্টিক মহাসাগর উত্তীর্ণ হইয়া সুরেশ আমেরিকায় প্রস্থান কৱিলেন। বহুদিবস হইতে তাঁহার আমেরিকা দেখিষার সাধ ছিল, এক্ষণে এক বৃহৎ সারকাস দলে নিয়োজিত হওয়ায় তাহার সেই বহু দিনের পোষিত ইচ্ছা পূর্ণ হইবার সুবিধা হইল। তিনি সেই দলের সহিত মার্কিন দেশে যাত্রা করিলেন।