লেফ্‌টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/শুভাদৃষ্টের পথে

ত্রিংশৎ পরিচ্ছেদ।



শুভাদৃষ্টের পথে।


 সুরেশের খ্যাতি ভাল কুস্তিবাজ ৰা জিম্‌নাষ্টিককারী বলিয়া নহে। দুর্দ্দমনীয় হিংস্র পশু বশীভূত করিবার ক্ষমতার জন্যই তিনি বিখ্যাত। মহাদুর্দ্দান্ত ভয়ানক ভয়ানক আফ্রিকাদেশীয় সিংহসিংহনিকে তিনি কুকুরের ন্যায় বশ করিতেন,—অবলীলাক্রমে তাহাদের পিঞ্জরে প্রবিষ্ট হইয়া তাহাদের সহিত ক্রীড়া করিতেন। তাঁহার অত্যদ্ভুত সাহসে দর্শকমণ্ডলী স্তম্ভিত ও বিস্মিত হইয়া থাকিতেন। নিশ্বাস ফেলিতে সাহস করিতেন না। আমেরিকা-দেশীয় অসভ্যজাতির সহিত তিনি যে পরে বিপুল সাহসে ঘোর যুদ্ধ করিয়াছিলেন,—তাহাপেক্ষা এই সকল হিংস্র পশুর সহিত ক্রীড়া কম সাহসের কার্য্য নহে।

 এইরূপে যখন তিনি সারকাসদলে থাকিয়া বিলাতের নানা সহরে ঘুরিতেছিলেন, সেই সময়ে তাঁহায় সৌভাগ্যক্রমে এক দিন বিখ্যাত হিংস্রপশু-বশকারী প্রফেসর জামবাক্ সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ হইল। হিংস্রপশু বশ করিতে ইহার সমকক্ষ আর কেহ ছিল না,—হিংস্রপশুদিগের স্বভাব দেখিবার জন্য ইনি নানা দেশের ঘোর অঙ্গলে প্রবেশ করিয়াছেন,— ভারতবর্ষে আসিয়াও ভারতের নিবিড় অরণ্য মধ্যে ব্যাঘ্র, ভল্লুক হস্তীর সহিত বাস করিয়াছেন,—ইয়োরোপে ইহার তুল্য পশুশকারী আর কেহ ছিলেন না। সুরেশকে দেখিয়া, সুরেশের সাহসে, সুরেশের তীক্ষ্ণবুদ্ধিতে, সুরেশের মানসিক বলে, তিনি সুরেশের প্রতি আকৃষ্ট হইলেন এবং নিজ সহকারীরূপে তাঁহাকে পশুবশ কার্য্য শিক্ষা দিবার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। সুরেশ তাহাই চাহেন,—এত দিনে অদৃষ্টদেৰী তাঁহার প্রতি সুপ্রসন্না হইলেন,—তিনি ধন মান যশের পথে অগ্রসর হইলেন। জামবাক্ সাহেব প্রস্তাব করিবামাত্র তিনি সাগ্রহে তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। সারকাস পরিত্যাগ করিয়া তাঁহার সহিত তিনি তাহার পশুশালায় প্রস্থান করিলেন।

 এখানে জামবাক্ সাহেবের অধীনে তিনি নানা হিংস্রজন্তু বশ করিয়া তাহাদের সহিত নানা ক্রীড়া কৌতুক করিতে লাগিলেন। সিংহ ও ব্যাঘ্র বশ করা ও তাহাদের সহিত ক্রীড়া করাই ও তাঁহার বড় প্রিয় কার্য ছিল। তিনি অল্প দিনের মধ্যেই এই দুঃসাহসিক কার্যে এত সুদক্ষ হইলেন যে জামাবাখ্ সাহেব দেখিয়া বিশেষ প্রীত হইলেন,—প্রকৃতই তাঁহার সহকারীদিগের মধ্যে সুরেশের সমকক্ষ আর কেহই ছিল না।

 এইরূপে দুই বৎসর কাল জামবাক্ সাহেবের নিকট থাকিয়া তিনি পুনরায় সারকাস দলে প্রবেশ করিলেন। এক্ষণে সারকাসে তিনি ব্যাঘ্র সিংহের সহিত খেলা দেখাইয়া দর্শকদিগকে মোহিত ও স্তম্ভিত করিতে লাগিলেন। যখন যেখানে তাহার খেলা হইয়াছিল সেইস্থলে সকলেই তখন তাঁহার অমানুসিক সাহসে মুগ্ধ হইয়াছিলেন। অনেক রাজন্যবর্গের সম্মুখেও ক্রীড়া দেখাইয়া তিনি বিশেষ প্রশংসা লাভ করিয়াছিলেন। এইরূপে সমস্ত ইয়োরোপে তাঁহার নাম প্রচার হইতে লাগিল;—সকলেই তাঁহাকে চিনিল। অবশেষে ১৮৮২ খৃষ্টাব্দে লগুনে যে মহা প্রদর্শনী হয়, সুরেশ সেই প্রদর্শনীতে সিংহ ও ব্যাঘ্রের সহিত ক্রীড়া করিয়া জগদ্‌ব্যাপী খ্যাতি লাভ করিলেন। এই সময়ে তিনি বহু সংখ্যক মেডেল ও সার্টিফিকেট পাইয়াছিলেন, এখানে সে সকলের উলেখ নিষ্প্রয়োজন।

 সারকাস দলের সহিত ঘুরিতে ঘুরিতে তিনি এক সময়ে হামবার্গ নগরে উপস্থিত হইলেন। এই স্থানে গাজেনবাক নামক এক সাহেবের এক বৃহৎ পশুশালা ছিল। ইনি দেশ ও বিদেশ হইতে নানা পশু আনয়ন করিয়া তাহাদিগকে নানা রূপে শিক্ষা দিয়া তৎপরে ভিন্ন ভিন্ন দেশের পশুশালায় বা ভিন্ন ভিন্ন সারকাস দলে এই সকল পশু বিক্রয় করিতেন। ইহাই ইঁহার ব্যবসা ছিল এবং এই ব্যবসায়ে ইনি বিলক্ষণ অর্থ উপার্জন করিতেন। হিংস্র পশুর সহিত সুরেশের ক্রীড়া দেখিয়া ইনি সুৱেশকে নিজ পশুশালায় নিযুক্ত করতে ব্যগ্র হইলেন এবং সারকাসে যে বেতন পাইতেন, তাহাপেক্ষা অধিক বেতন দিতে স্বীকৃত হইলেন। সুরেশও সারকাস পরিত্যাগ করিয়া গাজেনবাক সাহেবের পশুশালার কার্য গ্রহণ করিলেন।

 এখানে সুরেশ সিংহ, ব্যাঘ্র, ভল্লুক, হস্তী প্রভৃতি পশুদিগকে মানা ক্রীড়া শিক্ষা দিতে লাগিলেন, এবং নিজে, অন্য পশুর কথা দূরে থাকুক দুর্দান্ত সিংহ ব্যাঘ্রকে কুকুর বিড়ালের ন্যায় করিয়া তাহাদের সহিত খেলা করিতেন,—তাহারা তাঁহর হাত চাটিত, গা চাটিত, -তিনি তাহাদের ভয়াবহ মুখের ভিতর তাঁহার মস্তক প্রবেশ করিয়া দিতেন,—এই সকল ভয়ানক পশু যে তাঁহার প্রাণ নাশ করিতে পারে এক মুহুর্তের জন্য তাহা তিনি তাবিতেন না। ভয় বলিয়া যে কিছু পাদার্থ তাহার হৃদয়ে আছে তাহা বোধ হইত না। একটা ব্যাঘ্রকে তিনি শৈশষ হইতে শিক্ষা দিয়াছিলেন,—ইহার নাম রাখিয়াছিলেন ফ্যানি-এটী ইঁহার এতই অনুগত হইয়াছিল যে কুকুরও বোধ হয় তত হয় না।—সুরেশকে ইহার সহিত খেলা করিতে দেখিলে লোকে স্তম্ভিত, বিস্মিত ও মুগ্ধ হইত। একটা হস্তীকে তিনি এমনই শিক্ষিত করিয়াছিলেন যে তিনি না খাওয়াইলে সে খাইত না। জোগ কার্ল নামক জনৈক ব্যবসায়ী বহু মূল্যে এটী ক্রয় করেন, কিন্তু তিনি এটীকে লইয়া গিয়া মহাবিপদে পড়িলেন। সুরেশের অভাবে সে আহায় পরিত্যাগ করিল-কিছুতেই আহার করিল না। কার্ল সাহেব এমন শিক্ষিত হস্তী পরিত্যাগ করিতে না পারিয়া, অগত্যা তিনি অধিক বেতনে সুয়েশকে আপনার পশুশালায় নিযুক্ত করিতে বাধ্য হইলেন।

জামবাক সাহেবের কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া সুরেশ বহু দিবস কার্ল সাহেবের নিকট কাজ করিতে লাগিলেন। এখানেও তিনি বিশেৰ খ্যাতি লাভ করিলেন। হিংস্র পশুগণ যেন তাঁহার আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব,—তিনি সর্ব্বদা ইহাদের সহিতই বাস করিতেন,—ইহাদের সহিত, ইহাদের নিকট, আহার বিহার করিতেন-স্বহস্তে ইহাদিগকে আহার দিতেন,—ইনিও ইহাদিগকে ভালবাসিতেন, তাহারাও তাঁহাকে ভালবাসিত। তাঁহার শিক্ষিত পত সকল বহু মূল্যে বিক্রয় হইতে লাগিল,—সঙ্গে সঙ্গে সুরেশের বহু অর্থাগম হইতে লাগিল। ধনে মানে এক্ষণে তিনি একজন বিশিষ্ট সাম্ভ্রান্ত লোক। এক্ষণে তিনি আর সে সুরেশ নাই।