লেফ্‌টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/বঙ্গ ও বঙ্গবাসী

অবতরণিকা।

বঙ্গ ও বঙ্গবাসী।

 অনন্ত রত্নপ্রসবিনী ভারতভূমি পৃথিবীর অক্ষয় শস্যভাণ্ডার; বঙ্গভূমি তাঁহার পরম আদরের পরমাসুন্দরী তনয়া। পূণ্যবতী মাতার আদরিণী কন্যা শোভাময়ী, শান্তিময়ী, স্নেহময়ী, অন্নপূর্ণাস্বরূপিণী। বঙ্গের সৌন্দর্য্যগৌরব ভীষণতায় নহে, এখানে প্রকৃতিদেবীর সহাস্যোজ্জ্বল মিগ্ধমাধুরী মহিমা—অপরূপ রূপমাধুরী। সমুন্নত পর্ব্বতশিরে সুশোভন বৃক্ষরাজি বঙ্গের শোভা সম্পত্তি নহে; পর্ব্বতমালা ভেদ করিয়া প্রবল শ্রোতস্বতী এখানে উদ্দামগতিতে প্রবাহিতা নহে, ঘনপত্রপল্পবাচ্ছাদিত ভীষণ অধিত্যকা প্রদেশ ও এখানে নাই। কিন্তু শস্যশ্যামলা সদা হাস্যময়ী সমতলভূমি—উদার, পবিত্র মোহন, সরল সৌন্দর্য্যে পূর্ণ। পাষাণভাঙ্গা প্রবল প্রবাহিণী বঙ্গভূমিতে আসিয়া ধীর মন্থর গতিতে ঘুরিয়া ফিরিয়া বক্রগতিতে ক্রীড়া করিতেছে। বক্ষে অগণ্য সুখশান্তিপূর্ণ নগরী। নগরী অসংখ্য সুরল, সহাস্য, শান্তি প্রাণ নরনারীপূর্ণ, গৃহে গৃহে তাহাদের আনন্দ উৎসব—প্রতি উৎসবে প্রেমভক্তি শত ধারায় উৎসারিত। সে প্রেমতরঙ্গমালা শান্ত নহে অথচ বিপুল বিশাল বেগবতী সঞ্জী বনী। সমগ্র মানব বৃত্তির সম্পূর্ণ বিকাস। জগতে তাহার তুলনা নাই। স্নেহ শান্তিমাখা সহস্রমুখিনী হইয়া অজস্র ধারায় সেই বিশাল প্রেমসমুদ্রে মিশিয়াছে। গভীরতার উহা অসীম, বিচিত্রতায় অনন্ত, আস্বাদনে অনন্ত আবেশ—আবেশে পরমতৃপ্তি। এই দুঃখ দারিদ্রপূর্ণ মলিন মর্ত্ত্যধামের সকল জঞ্জাল তাহাতে ভাসিয়া যায়।

 এই বিচিত্র মোহিনী মাধুরীর লীলাস্থলে স্থানে স্থানে যে, ভীষণ সৌন্দর্য্যের অঙ্কপাত নাই, তাহা নহে,—থাকিলেও সৌন্দর্য্যসাগরে তাহা ভাসিয়া গিয়াছে। পতিতপাবনী গঙ্গাধারায়, ব্রহ্মপুত্রের পুণ্য প্রবাহে এবং অসংখ্য উপনদী ও শাখানদীর সংস্পর্শে বঙ্গ সদাই সরসশ্যামলা। অতীতকালের কত কীর্ত্তিকাহিনী সেই পবিত্র ধারার অণু পরমাণুতে মিশাইয়া রহিয়াছে। আর পুণ্যপ্রবাহ ভাগীরথীর সেই তারিণী জননীমূর্তি—অপরে কে তাঁহার স্বরূপ বুঝে। অন্যে জননীকে সামান্যা স্ত্রীজাতি মাত্রই দেখে, কিন্তু সন্তান কতক বুঝে, কি স্নেহশীতলা সর্ব্বাপদ্‌নাশিনী সর্ব্বভয়বারিণী জননী।

 পূর্ব্বেই বলিয়াছি, বঙ্গভূমি অন্নপূর্ণা মূর্ত্তিতে বিরাজিতা, খনিজ সম্পদে ও তিনি দরিদ্রা নহেন। ষড়ঋতু পর্য্যায়ক্রমে বিবিধ উপহার লইয়া দেবীর পূজা করিয়া থাকে। এই ধনজনপূর্ণ বিশাল বিচিত্র প্রদেশে জল বায়ুও বিচিত্র; কিন্তু সাধারণতঃ সরস বা সদার্দ্র। সমুদ্রের নিকটবর্ত্তী বলিয়াই যে, এরূপ তাহা নহে; প্রকৃতির দুর্ভেদ্য নিয়মবশে বিশাল সমুদ্রগর্ভ হইতে এই প্রদেশ উত্থিত হইয়াছে বলিয়া অনেকে উর্ব্বরতা ও আর্দ্রতার কারণ নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। বিজ্ঞানবিদ্ বলেন, অতি পূর্ব্বে অতীতের দুর্ভেদ্য তমসাচ্ছাদিত গহ্বরে অনন্তকালের বিরাট জঠর অন্বেষণ করিয়া স্থিরীকৃত হইয়াছে, এক্ষণে পৃথিবীর মানচিত্রে যে স্থান বঙ্গচিত্রে সুশোভিত, এক সময় সেই সুখভূমি, প্রকৃতির বিশাল জলময়ী মূর্ত্তির কুক্ষিগর্ভে ছিল। অনন্ত সাক্ষী হিমালয়ের তটভূমিতে তাহার তরঙ্গাভিঘাত হইত। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান প্রভৃতি বিভিন্ন আর্য্য জাতির পূর্ব্বপুরুষেবা তখন মধ্যআসিয়ার বিস্তৃত অধিত্যকায় সুখে পশুচারণ করিত, আর অগ্নি প্রভৃতি বিশ্বশাসিনী বিভিন্ন শক্তিকে সকল বিশ্বাসে উন্মুক্ত প্রাণে উপাসনা করিয়া সঙ্গীততরঙ্গে দিগন্ত প্রতিধ্বনিত করিত। হিমালয়ের অত্যুচ্চ পাষাণ গাত্রে আজিও শঙ্খ ও বিবিধ সামুদ্রজীবের কঙ্কালচিহ্ণ রহিয়াছে। তাহাতে নিঃসংশয়িতরূপে প্রমাণ হয়, এক সময়ে তথায় বঙ্গোপসাগরের তরঙ্গাভিঘাত হইত। এক সময়ে তথায় বজ্রসার কঠোর প্রকৃতির সহিত তরঙ্গ রঙ্গময়ী বিশাল জলময়ী প্রকৃতির নিত্য সংঘর্ষ হইত। ক্রমে বৎসরের পর বৎসর, শতাব্দীর পয় শতাব্দী, যুগেয় পর যুগ চলিয়া গিয়াছে। কালচক্রে নিয়তিয় আবর্ত্তনে বিশাল সাগর গর্ভ হইতে এই রূপরসগন্ধস্পর্শময়ী অগণ্য মানবের আবাসভূমি বঙ্গ গঠিত, সজ্জিত ও শোভিত হইয়াছে। সেই অবিরত সংঘর্ষফলে যা প্রাকৃতিক নিয়মবশে কেমন করিয়া সলিল হইতে প্রদেশ জন্মিল, বিজ্ঞানে সেই জটিল বহস্য—প্রকৃতির লীলা বর্ণিত হইয়াছে। আমরা এস্থলে তাহার উল্লেখ মাত্র করিলাম।

 বঙ্গভূমি অগণ্য মানবের বাসস্থান হইয়া অবধি ইহার জল বায়ু আপনার দুর্ব্বলকর প্রভাব প্রকাশ করিতেছে। প্রাচীন আর্য্যগণ যখন তাঁহাদের বিজয়িণী গতিতে উত্তর-ভারত অতিক্রম করিয়া এই পরম রমণীয় প্রদেশের প্রান্তে পদার্পণ করিলেন, ঐতিহাসিক বলেন, তখন উহা অসংখ্য কৃষ্ণকায় জাতির বাসস্থান ছিল। তাহারা সভ্যতা সম্পর্কমাত্রশূন্য, আকৃতিগত পার্থক্য ব্যতীত শিক্ষা সংস্কারে তাহারা পশু কি মানব, বুঝিবার বিশেষ উপায় ছিল না। জ্ঞানের সহিত অজ্ঞানের, আর্য্যদিগের সহিত এই কৃষ্ণকায় বর্ব্বরদিগের সংঘর্ষে সেই আদিম অধিবাসীবা পরাভূত হইলে উহাদের কতকগুলি সেই নবাগত আর্য্যজাতির বশ্যতা স্বীকার করিল। কিয়দংশ বা আপনাদের বন্যজীবনের মহিমা অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য নিকটবর্ত্তী দুর্ভেদ্য দুর্গম পার্ব্বত্য প্রদেশের বনজঙ্গলে আশ্রয় লইল। ইতিহাসে অবগত হওয়া যায়, এই আদিম অধিবাসীর মধ্যে যারা বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিল, তাহারা বিজয়ী আর্য্যজাতির দাস ও সেবকরূপে আত্মসমর্পণ করিল। এইরূপে আর্য্যজাতির সহিত তাহাদের দাস্য নিয়ন্ত্রিত হইল। যাহা হউক, এ স্থলে এই সকল প্রাচীন ইতিহাস আলোচনার আমাদের বিশেষ আবশ্যক নাই।

 আর্য্যগণ এই প্রদেশে আসিয়া দেখিলেন, ভূমি উর্ব্বরা, জল বায়ু মৃদু ও সরস। ক্রমে স্থানীয় প্রকৃতি এই বীজয়ী আর্য্যবীরদিগের উপর আপনার দুর্জ্জয় প্রভাব বিস্তার করিতে লাগিল। অল্পায়াসে প্রচুর শস্য উৎপাদিত হইতে লাগিল; প্রকৃতির মাধুরীতে অন্তর কোমল ও মৃদু করিয়া তুলিল; তাঁহারা ক্রমশঃ অবিরত কার্য্যোদ্যোগের মহামহিমা অল্পাধিক বিস্মৃত হইতে লাগিলেন। ক্রমে আলস্যের বশীভূত হইলেন। তখন সেই দীর্ঘ নিশ্চিন্ত অবসরে কার্য্যপ্রবণ শান্তিময় জীবনে চিরশান্তির কথা—ধর্ম্মান্দোলনের প্রাদুর্ভাব ঘটিতে লাগিল। সেই ধর্ম্ম-তত্ত্বালোচনায় ফলে একে একে শরীরের বল ও সমর রঙ্গের আনন্দ নৃত্য অন্তর্হিত হইয়া আসিতে লাগিল। এই আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে আরও মনে হয়, অনায়াসে বা অল্পায়াসে প্রচুর শস্য সম্পদ লাভই যদি জাতীয় বলবীর্য্য অবসানের প্রধান রা একমাত্র কারণ হয়, তাহা হইলে গ্রীস ও ইটালির নিকট এক কালে প্রায় সমগ্র পৃথিবীবাসী কেন মস্তক অবনত করিয়াছিল। উর্ব্বরতায় গ্রীস ও ইটালি অতুল্য। আজ না জানি কোন দুর্ভেদ্য নিয়তিবশে সেই প্রচণ্ড দুর্জ্জয় জাতির বীরদর্পের অবসান হইয়াছে, কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া যখন যুনানী ও সোমকগণ জগতীতলে বীরগৌরবে যশঃ সৌরভে পৃথিবী পূর্ণ করিয়াছিল, তখন কি তথাকার ভূমি উর্ব্বরা ছিল না? এখনও স্বাধীনতার লীলাক্ষেত্র বিজ্ঞানের বিহারভূমি ইউনাইটেড ষ্টেটসের স্থানে স্থানে ভূমি যে রূপ উর্ব্বরা অথচ সেই সেই প্রদেশ যে রূপ কর্ম্মপ্রাণ বীরজাতির বাসভূমি, তাহাতে কেমন করিয়া বলি, উব্বরতাই বীরগর্ব্ব অবসানের প্রধান কারণ! অন্নপূর্ণার সন্তান হইলেই কি অসুরনাশিনী শ্যামামূর্ত্তি বিস্মৃত হইতে হইবে।

 দ্বিতীয় কথা, বায়ুর আদ্রতা—ভূমি সজলা, সমুদ্রগর্ভ হইতে অনুচ্চ। তাহা হইলে উচ্চ স্থানের অধিবাসীরাই পৃথিবীর প্রধান জাতি হইত। আর ইংলণ্ডেব ন্যায় সজল বায়ুসেবিত দেশবাসি গণের বিশাল সাম্রাজ্যে সূর্য্যদেব অস্তাচলে গমন করেন না, শুনিতে পাইতাম না। নিয়তির দুর্ভেদ্য রহস্য, প্রকৃতির বিচিত্র লীলাপট উত্তোলন করিয়া জাতীয় অধঃপতনের বিশাল মর্ম্মান্তিক ইতিহাস এস্থলে আমাদের আলোচ্য নহে। প্রসঙ্গক্রমে প্রধানতঃ এই মাত্র বলিতেছি—স্থানীয় প্রকৃতিক্রমে অদৃষ্টচক্রে নিয়তিবশে একটা বিজয়ী বীরজাতির চিত্তবৃত্তি বঙ্গে আসিয়া বিভিন্ন পরিণতি প্রাপ্ত হইয়াছে। তাহা স্থানীয় প্রকৃতির বিশ্ববিজয়ী বিজয় নিশান।

 বঙ্গের বিস্তৃত বিশ্বস্ত পুরাবৃত্ত নাই, সুতরাং প্রাচীনকালের বীরত্ব গৌরবও নাই। যাহা আছে, তাহা মেকলে প্রমুখ লিপি কুশল ঐতিহাসিকের অমূলক কল্পনা এবং ভারত আকাশের প্রচণ্ড ধুমকেতু মুসলমান ঐতিহাসিকদিগের রচনা। তবে প্রকৃত ইতিহাস কোথায় পাইর। বহুকাল পরপদদলিত ইতিবৃত্তহীন জাতির ইতিবৃত্ত কোথায়? এতকাল পরাধীন, অত্যাচারিত ও পরপদদলিত হইয়াও যাহারা সরল পবিত্র প্রফুল্ল হৃদয় লইয়া জীবিত রহিয়াছে, তাহাদের ইতিহাস কি রূপ। কোন্ অপূর্ব্ব জীবনী শক্তিতে তাহারা প্রাচীন হইয়াও নবীন হৃদয়—শত বিঘ্ন বিপদ পাতেও সদাই উৎফুল্ল—গৃহে গৃহে আনন্দ কোলাহল—হৃদয়ের কোমলতা কিছুতেই ঘুচে না; গৌরবষ্ট হইয়াও গৌরবহীন নহে!

 সেই বীরদর্প মৃদুতায় পরিণত হইয়াছে বটে, তাহা বলিয়া বঙ্গভূমি অধুনাও বীরশূন্যা নহে। ইংরাজ ঐতিহাসিক মেকলের তীব্রোক্তি বাঙ্গালী দাসের জাতি; শঠতা, মিথ্যাবাদিতা, ভীরুতা প্রভৃতি যত কিছু নীচতা থাকিতে পারে, বাঙ্গালী জীবন কেবল তাহাতেই গঠিত। আজ বলিয়া নহে চিরকাল। একটী জাতীয় চরিত্রে অতগুলি কলঙ্কের বোঝা চাপাইয়া তিনি আপনার হৃদয়ের দুর্ব্বহ ভার লাঘব করিলেন বলিয়া তাহা ইতিহাস নামে পরিচিত হইবে না। উহা সদাশয় ইংরাজজাতির উপযুক্ত নহে। অথবা ঘাতকের নিকট সুষমাময়ী রমণী বা সহাস্য সুন্দর বালকের সৌন্দর্য্য দেখিবার অবসর কোথায়!

 আর এক জাতীয় কঅলঙ্ক—অশীতিপর বৃদ্ধ লক্ষণসেনের বিনা যুদ্ধে পলায়ন। সপ্তদশসংখ্যক যবন অশ্বারোহী আসিয়া রাজপুরীতে প্রবেশ করিল আর বঙ্গেশ্বর অদৃষ্টের অবশ্যম্ভাবী পরাজয় স্থিরনিশ্চয় করিয়া অন্তঃপুরের গুপ্তপথ দিয়া পলায়ন করিলেন। শত্রুদিগকে বাধা দিবার কেহ রহিল না, কেহ বাধা দিল না। এইরূপে বঙ্গের স্বর্ণসিংহাসন বিজাতীয় ম্লেচ্ছের করতলগত হইল। বঙ্গ সৌভাগ্যরবি চিরকালের জন্য অস্তমিত হইল। সপ্তদশ মাত্র অশ্বারোহী দ্বারা একটা বিশাল সাম্রাজ্য অধিকৃত হইল, এই অপূর্ব্ব উপন্যাসে কল্পনায় নবীন লীলা থাকিতে পারে, কিন্তু মনস্বী ব্যক্তি তাহা ইতিহাস বলিয়া বিশ্বাস করিবেন না। বিশেষতঃ সেই হিন্দু স্বাধীনতার সময় যবনজাতির প্রতি যেরূপ বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছিল, তাহাতে রাজা পলায়ন করলেই রাজ্যবাসী পর্য্যন্ত বাধা মাত্র না দিয়া উর্দ্ধশ্বাসে পলাইবে, ইহা বিশ্বাসের অযোগ্য। হইতে পারে, ভীমার্জ্জুন শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় ছদ্মবেশে বা কোন মোহনমন্ত্রবশে জরাসন্ধপুরীপ্রবেশের ন্যায় সেই সপ্তদশ সংখ্যক অশ্বারোহী রাজপুরীতে প্রবেশ করিয়াছিল। হইতে পারে, শ্রীকৃষ্ণেরই ন্যায় কোন পরম যোগী বিশ্বহিতৈষী বৃথা রক্তপাত নিবৃত্তির জন্য পলানের পরামর্শ দিয়াছিলেন। ছলনায় হউক, আর প্রকৃত ভক্তিপাত্র বলিয়া অচল ভক্তিবশেই হউক, রাজা পলায়ন করিলেন। হইতে পারে, সমস্ত বিঘ্ন বাধা অতিক্রম করিয়া যবন যখন পুরী প্রবেশ করিয়াছে, রাজ্যরক্ষা ও আত্মরক্ষার আর উপায় নাই, তখন পলায়ন কি জগতের ইতিহাসে একটী অসাধারণ দুরপনেয় কলঙ্ক কাহিনী! বিশেষতঃ বিশ্বাসঘাতকতার বলে, সপ্তদশজন মাত্র অশ্বারোহী যদি অবাধে পুরী প্রবেশ করিয়া থাকে, তাহাকে সপ্তদশ অশারোহীতে দেশজয় বলে না। নিদ্রিত বা অন্ধ, হস্তপদবদ্ধ মহাবীরের গলদেশে ফাঁসি লাগাইবার জন্য সপ্তদশ কেন, একজন অশ্বারোহী হইলেই যথেষ্ট।

 এই স্থলে আবার সেই কথা। যখন বিশ্বাসঘাতকতায় বঙ্গগৌরব নষ্ট হইয়াছে, তখন বাঙ্গালীজাতি যে বিশ্বাসঘাতক তাহাতে আর সন্দেহ কি? যুক্তি অপূর্ব্ব, হৃদয়গ্রাহিণীও বটে। বিশ্বাসঘাতকতায় বঙ্গ বিজিত হইরাছে সত্য কিন্তু তাহা বলিয়া বিশ্বাসঘাতকতা ইহাদিগের চরিত্র নহে। বিশাল পৃথিবীতে এমন কোন্ স্বর্গভূমি আছে, যেখানে বিশ্বাসঘাতকতা নাই,—যে দেশের ইতিহাসের অধ্যায় এইরূপ বিশ্বাসঘাতকতায় কলঙ্কিত নহে? তাহা বলিয়া কোন মূর্খ ___, সেই সেই জাতি বিশ্বাসঘাতক। মানবজাতি মধ্যে সর্ব্বত্র সদসৎব্যক্তি আছে, বৈচিত্র্যের জন্য বুঝি চিরকালই থাকিবে।

 স্বীকার করিলাম, কেবল সপ্তদশসংখ্যক যবন বীরদ্বারা বঙ্গদেশ বিজিত হইয়াছে, কিন্তু আফগানদিগকে তাহার অর্দ্ধ ভাগ মাত্র জয় করিতে এক শতাব্দীরও অধিক অতিবাহিত করিতে হইয়াছিল। কত সহস্র রীর অজস্রধারে শোণিত বিসর্জ্জন করিয়া আংশিক বিজয় লাভে অধিকারী হয়। মুসলমানদিগের পূর্ণ সৌভাগ্যের সময় বঙ্গের স্থানে স্থানে স্বাধীন নরপতি ছিলেন, তাঁহাদের সৈন্য সমস্তই বাঙ্গালী। এখন একটী সন্দেহ, হয়ত তাঁহারা বড় বড় জমীদায় ছিলেন। পশ্চিম ভারত হইতে সিপাহী আনিয়া রাজ্য করিতেন। তখন পশ্চিম হইতে সিপাহী আমদানী হইত না—বঙ্গের পাইক বিখ্যাত ছিল। পলাশীর যুদ্ধেও তাহারা অসাধারণ বীরবিক্রম প্রদর্শন করিছে। কেহ কেহ বলেন, বঙ্গের বীরত্ব প্রকাশে আর কাজ কি? একটী দ্বারবান রাখিতে হইলে, তাহাও পশ্চিম হইতে আনাইতে হয়। ইহার উত্তরে এইমাত্র বলা যাইতে পারে, এখন পশ্চিম ভারতীয় দ্বারবান রাখা ফরাসীদেশের সুইস দ্বারবান রাখার ন্যায় একটা রীতি দাঁড়াইয়াছে।

 সে বাহা হউক, মুসলমান রাজত্বে অধিকাংশ বঙ্গবাসী যখন কোন না কোন শান্তিময় উপায়ে জীবিকা অর্জ্জন করিত, তখনও কিয়দংশ বাঙ্গালী ব্যায়ামাদি বিবিধ সামরিক ক্রীড়া কৌশলে সময়াতিপাত করিত। সময়ে সময়ে সেই সম্প্রদায়ের মধ্য হইতে এমন এক এক জন অসাধারণ সামরিক পুরুষ আবির্ভূত হইয়াছেন, যাঁহারা সর্ব্ব দেশে সর্ব্বকালে প্রকৃত বীরত্ব গৌরবে বরণীয়। মোগলদিগের পূর্ণ প্রতাপের সময়েও বঙ্গে যশোহরাধিপতি প্রতাপাদিত্য ছিলেন। যে সকল অমর বীরগাথা তাঁহাকে চিরস্মরণীয় করিয়া রাখিয়াছে, তিনি যে একাকীই সেই প্রভূত যশের একমাত্র অধিকারী, তাহা নহে। প্রতাপের অনুচর পার্শ্বচর সহকারীরাও যে এক এক জন অসাধারণ সমরকুশল বীরপদবাচ্য ছিলেন, তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই। তাঁহাদের অনেকেও এক এক জন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতাপ। নেপোলিয়নের ন্যায় রণবীর পৃথিবীর মধ্যে অল্পই জন্মগ্রহণ করিয়াছেন কিন্তু তাঁহার সহকারী মধ্যেও অনেক ক্ষুদ্র নেপোলিয়ন ছিল। বর্ত্তমানের দিকে অগ্রসর হইলেও আরও শত সহস্র উদাহরণ পাওয়া যাইবে, বাঙ্গালায় সাহসিকতা বা বীরবিক্রম অন্তর্হিত হয় নাই। তবে সুবিধা থাকিলে শক্তির পরিচালনা থাকিলে তাহা সমধিক বিকাশ পাইতে পারিত। যাহা হউক, এই সম্বন্ধে এ স্থলে অধিক বিস্তারের আবশ্যকতা নাই। বঙ্গগরিমা প্রচারও ইহার উদ্দেশ্য নহে, কিন্তু এ কথা সর্ব্বদা স্মরণ রাখা কর্ত্তব্য, গর্ব্ব ও গৌরব দুইটি স্বতন্ত্র। আর গর্ব্ব দূষিত হইলেও আত্মগৌরব সমাদরের সামগ্রী।

 বিদেশীর বিবেচক ব্যক্তিগণ যে বাঙ্গালীকে একেবারেই বুঝেন না, তাহা নহে। মহতের অন্তর কবে মহত্ত্ব ধারণায় অক্ষম। বিদ্বান্ ও মূর্খ, ধীর ও হঠকারী, সাধু ও অসাধু সকল জাতির মধ্যেই আছে। সম্প্রতি ষ্টীভেন্স নামে কোন সাহেব অযাচিত কৃপাবশে বাঙ্গালীর চরিত্র সমালোচনায় আপনার যে পরিচয় প্রদান করিয়াছেন এবং নিশ্চিন্ত নির্ব্বাক না থাকিতে পারিয়া তদুত্তরে মান্যবর ওল্ডহাম সাহেব যে, মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন, আমরা তাহার মর্ম্মার্থ লিপিবদ্ধ করিয়া এই জটিল অপ্রীতিকর সমস্যার উপসংহার করি।

 “ষ্টীভেন্স সাহেব বাঙ্গালী জাতির চরিত্রে যে সকল কলঙ্ক আরোপ করিছেন, শূরোচিত কোন কার্য্যে সম্পূর্ণ অক্ষমতাই তন্মধ্যে প্রধান। কি রূপ শৌর্য্যবীর্য্যের কথা ষ্টীভেন্স সাহেবের লক্ষ্য, তাহা বুঝিয়া উঠা অসম্ভব। কিন্তু এ স্থলে তাহার সহিত শ্লীমান সাহেবের মত একবার তুলনা করিয়া দেখা যাউক। আমি সময়াভাবে সেই পুস্তক হইতে অবিকল উদ্ধৃত করিতে পারিলাম না, কিন্তু শ্লীমান বোধ হয় এই মর্ম্মে বলিয়াছেন যে, বীরত্ব শব্দে যদি স্ত্রীজাতির প্রতি সমুচিত সম্মান প্রদর্শন এবং তাহাদিগের রক্ষার জন্য কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার, এমন কি প্রাণপর্য্যন্ত বিসর্জ্জন বুঝায়, তাহা হইলে ভারতবাসিগণের য়ুরোপীয়দিগের নিকট বড় কিছুই শিখিবার নাই। শ্লীমান সাহেব বঙ্গদেশে যতকাল ছিলেন, ষ্টীভেন্স সাহেব তাহার তুলনায় অত্যল্প কাল মাত্র অবস্থিতি করেন। কর্ণেল শ্লীমান মধ্যভারতে অবস্থানকালে এই বিষয় লিখিয়াছিলেন। বঙ্গবাসী বা মধ্যভারতবাসী সম্বন্ধে তিনি যাহা যাহা লিখিয়াছিলেন, উভয়ই জ্বলন্ত সত্য। সকল দেশের অধিবাসীদিগকেই সহজেই শঠ বা অবিশ্বাসী বলিয়া অভিযোগ আনা যাইতে পারে। বাঙ্গালীর ভীরুতা ও কাপুরুষতায় অপবাদ, আমার বোধ হয়, মেকলের অলীক উপন্যাসের উপষ স্থাপিত। যখন বিভিন্ন সময়ে সঙ্কটময় সকল স্থানেই বঙ্গবাসীর সাহসিকতায় আমাদের অনেকের জীবনরক্ষা হইয়াছে, তখন আর সেই অসত্য অভিযোগ শোভা পায় না।

 ডিকেন্স সাহেব বর্ণিত কতিপয় নাগরিক কেরাণী জীবনের ইতিহাস সমগ্র ইংরাজ জাতির মনুষ্যত্বের ইতিহাস বলিলে যে রূপ শুনায় এবং তাহা যেরূপ বিশ্বাসযোগ্য, মেকলে সাহেব বর্ণিত বাঙ্গালী চরিত্রও তদ্রূপ। মেকলে সাহেব তাঁহার লেখার উপকরণ, কতকগুলি কেরাণী ও নিষ্কর্ম্মা বাঙ্গালীর নিকট হইতে সংগ্রহ করিয়াছিলেন। বাঙ্গালীর সামরিক বিভাগে প্রবেশ অনিচ্ছাই বোধ হয়, তাঁহার এই ধারণার মূল। বাঙ্গালীর শীর্ণ অবয়ব যে, তাহার সাহসের অন্তরায়, তাহায় কোন আভাস আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আনিতে পারি না। বাঙ্গালীর শীর্ণকায় বরং ম্যালেরিয়ার দুর্দ্ধর্ষ প্রকোপেরই পরিচায়ক—সাহস অভাবের কারণ নহে। বাঙ্গালীর ইউনিফরম পরিবার ও সামরিক শৃঙ্খলার ভিতর বাঁধা থাকিবার অনিচ্ছাই মেকলের মতের মূল। সর্ব্ব বিষয়ে প্রবণতা ও সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র, বাঙ্গালী জীবনের বিশেষত্ব। যদি সামরিক বিভাগে বাঙ্গালীকে কোন স্বাধীন কার্য্যের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হইত, তাহা হইলে সহস্র সহস্র বাঙ্গালী এই ভীরু বাঙ্গালীর মধ্য হইতেও ছুটিয়া আসিত, লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী মৃত্যুর ভীষণ মূর্ত্তির সম্মুখীন হইত। মরণের ভয়ে তাহারা পলাইয়া আসিত না। এখনও যতদুর দেখিতে পাওয়া যায়, সামরিক বিভাগে কোন স্বাধীন কার্য্যে নিযুক্ত না হইয়াও তাহারা ডাক্তার বা কমিসরিয়েট কোন কর্ম্মচারী হইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে যাইতে পশ্চাৎপদ হয় না।

 মেকলের যেখানেই জ্বলন্ত জীবন্ত বিমোহন চিত্র সেইখানেই প্রায় অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা। বাঙ্গালীর চরিত্র বর্ণনা কালে ঐতিহাসিক হইয়াও তিনি ভুলিয়াছিলেন, যে সকল সেনা লইয়া বিখ্যাত ইংরাজবীধ ক্লাইব পলাশীব বঙ্গবিজয়ী সমরাঙ্গনে হতভাগ্য সিরাজকে পরাজয় করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে অধিকাংশই এই শীর্ণকায় ভীরু স্বভাব বাঙ্গালী। দুর্ভাগ্যের বিষয়, হাবড়ার সেতু পার হইবার সময় ষ্টীভেন্স সাহেব ইতিহাসের সত্য বিস্মৃত হইয়া ঘৃণার দৃষ্টিতে এবং আপনার বিষময়ী কল্পনাবলে সেই বাঙ্গালী জাতি সম্বন্ধে এক নূতন উপন্যাসের সৃষ্টি করিলেন। প্রকৃত প্রস্তাবে তাহাতে নূতনত্ব নাই মেকলের পুনরুক্তিমাত্র। আমার স্মরণ হয়, তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত বয়ন যুদ্ধের পরিণাম অনুসারে আইরিস সৈনিকদিগের কাপুরুষতা সম্বন্ধেও প্রবন্ধ বিস্তার করিয়াছেন। কিন্তু সেই স্থলেও তিনি বিস্মৃত হইয়াছেন, আইরিস অশ্বারোহীদল সেই সমরক্ষেত্রে কি রূপ অসামান্য রণপাণ্ডিত্যে পরিচালিত হইয়াছিল। ঐতিহাসিকের নিকট অধিক দিনের কথা নহে, তিনি আরও বিস্মৃত হইয়াছিলেন, লেসলিযুদ্ধের শিক্ষিত কৃতকর্ম্মা সৈন্যদল এবং প্রসিদ্ধ ত্রিংশবর্ষব্যাপী মহাসমরের সময় পারদর্শী স্বজাতীয় বীরপুঙ্গবগণ ডন্‌বারের প্রসিদ্ধ সমরাঙ্গনে ক্রমওয়েলের ক্ষুধাক্লিষ্ট সৈন্য সম্প্রদায়ের নিকট অপমানিত হইরা কি রূপ ভাবে পলায়ন করিয়াছিল।

 অপক্ষপাতী ইংরাজবর্ণিত এইরূপ পরিচয়ের পুরেও বাঙ্গালীর সাহসিকতা সম্বন্ধে পক্ষ সমর্থনের জন্য প্রবন্ধ বিস্তারের আবশ্যকতা নাই। এ স্থলে আমরা এই মাত্র উল্লেখ করিয়া প্রবন্ধের উপসংহার করিব যে, বাহুবলে বাঙ্গালী শ্রেষ্ঠ না হইলেও আদর্শ মনুষ্যোচিত গুণগ্রামে তাহারা হীন নহে। “শারীরিক বলেই অদ্যাপি পৃথিবী শাসিত হইতেছে বটে কিন্তু শারীরিক বল পশুর গুণ। মনুষ্য অদ্যাপি অনেকাংশে পশু প্রকৃতি সম্পন্ন, সেই জন্য আজিও শারীরিক বলের এতটা প্রাদুর্ভাব। তবে বাহুবল উন্নতির পক্ষে এই জন্য আবশ্যক যে, যে সকল কারণে উন্নতির হানি হয়, সে সকল উপদ্রব হইতে আত্মরক্ষা করা চাই।”