লেফ্‌টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/আনুসঙ্গিক কথা

লেফ্‌টেন্যাণ্ট

সুরেশ বিশ্বাস।

প্রথম পরিচ্ছেদ।

আনুসঙ্গিক কথা।

 কোন জাতির সভ্যতার পরিমাণ করিতে হইলে, স্বতই মনে উদয় হয়, সভ্যতার পরিমাণদণ্ড কোথায়? জনগৌরবে, ধনাধিক্যে না বীরবিক্রমে অথবা এইগুলির সমবায়ে? শারীরিক বলে না মানসিক গুণে? বিশাল জগতে যতগুলি জটিল সমস্যা আছে, ইহাও তন্মধ্যে একটি। তবে অনেকেই হয়ত অস্বীকার করিবেন না, শারীরিক বল মানবের একটি শ্রেষ্ঠ সম্পত্তি হইলেও সভ্যতার সহিত উহার তত ঘনিষ্ট সম্পর্ক নাই, উহা সভ্যতাবৃদ্ধির কোন উপায় বা উপকরণ হইতে পারে কিন্তু সভ্যতা নহে। সিংহ ব্যাঘ্রাদি পশু ও মহাবল দুর্দ্দান্ত বর্ব্বর বন্যজাতিকে সভ্য বলা যায় না।

 তবে কি মানসিক গুণে অথবা উভয়ের সমবায়ে? যদি মানসিক গুণকেই সভ্যতা বলে, তবে সে গুলি কি এবং কি রূপেই বা তাহার প্রকাশ? উত্তরে বলা যাইতে পারে, মানবের মানসিক গুণ অসংখ্য;—শিল্পবিজ্ঞানে, কৃষিবাণিজ্যে, সাহিত্যদর্শনে এবং সর্ব্বোপরি সাংসারিক ও ধর্ম্মজীবনে তাহার বিকাশ। কোন জাতি সভ্যতা সোপানে কতদূর অগ্রসর বুঝিতে হইলে, তাহাদের শিল্প-বিজ্ঞানদিই আলোচ্য হইয়া থাকে। এক্ষণে আর একটি জিজ্ঞাস্য, শারীরিক বল এই সভ্যতাবৃদ্ধি বা সভ্যতা লাভের কত দূর উপযোগী, কেনই বা আবশ্যক?

 প্রত্যেক কার্য্যই শক্তিসাধ্য। বিদ্যানুশীলন করিতে হইবে, তাহাতেও শক্তির প্রয়োজন। বিপদ্‌পাত হইতে আত্মরক্ষা করিতে হইবে, তাহাতেও শক্তির প্রয়োজন, অপরকে রক্ষা বা সংহার করিতে হইবে, তাহাতেও শক্তির প্রয়োজন। কিন্তু শারীরিক বলের সহিত মানসিক বলের কতটা সম্পর্ক? মহাবল হইলেই মনস্বী হইতে হইবে অথবা শরীর বলে শ্রেষ্ঠ না হইলে যে, মনস্বী হইতে পারে না, তাহা ত বোধ হয় না। ইংরাজ জাতি আজি নবীন সভ্যতার অগ্রণী। বীরবর নেলশন সেই বীরজাতির ক্ষণজন্মা বীরপুরুষ। বাল্যে ও কৈশোরে তিনি দুর্ব্বল ছিলেন; বীরবিক্রমে যখন তিনি শীর্ষস্থানীয়, তখনও শারীরবলে বলীয়ান নহেন। যে ক্লাইব ভারতে ব্রিটিশ রাজ্যের ভিত্তি সংস্থাপিত করেন, বিখ্যাত ঐতিহাসিক ম্যালিসন যাঁহাকে নেপোলিয়নের সহিত তুলনা করিয়াছেন, শারীরবলে তিনিও অসাধারণ ছিলেন না। যে বিখ্যাত ভ্রমণকারী আফ্রিকার নিবিড় অরণ্যানী ও মরুপ্রান্ত এবং আমেরিকার বিশাল তুষারময় ক্ষেত্র ভেদ করিয়া জ্ঞানানুরাগ ও অব্যবসায়ের পরাকাষ্ঠা দেখাইয়াছেন, তিনিও যে একজন সবল বঙ্গবাসীর তুল্য বলশালী ছিলেন, তাহা নহে। এইরূপ ইতিহাসের অনন্ত ভাণ্ডার হইতে অসংখ্য উদাহরণ সংগ্রহ করিয়া দেখান বাইতে পারে, কত ক্লাইব মহাবল না হইয়াও স্বদেশীয় সাম্রাজ্য বিস্তৃত করিয়াছেন,—কত ম্যাট্‌সিনি স্বদেশানুরাগে উদ্দীপিত হইয়া জননীয় বন্ধনশৃঙ্খল ছিন্ন করিয়াছেন,—কত বেলযোনি দুর্গম দেশ-দেশান্ত মৃত্যু তুচ্ছ করিয়া সহস্র সহস্র বর্ষ পূর্ব্বের ভগ্নাবশেব নগরী হইতে প্রাচীন দ্রব্যজাত সংগ্রহ করিতেছেন। কত _ল ব্যক্তির মনস্বিতায় লৌহবর্ত্ম ও সমুদ্র আজি ইংরাজ জাতির বাহন, তাড়িততার তাঁহাদের দূত।

 এইরূপ শত শত উদাহরণে দেখা যাইতেছে, মানস বিকাশের জন্য সিংহবিক্রমের আবশ্যকতা নাই। সিংহবিক্রমের আবশ্যকতা তখন, যখন কোন দুর্ব্বল প্রাণীর সংহার করিতে হইবে। আত্ম রক্ষার্থ বা আত্মকর্ত্তব্য অক্ষুণ্ন রাখিবার জন্যও সময়ে সময়ে উহার বিশেব প্রয়োজন। প্রবল যখন দুর্বলের প্রতি অত্যাচার করিতেছে, সেই অত্যাচার নিবারণের জন্য ইহা মানসিক গুণ, এবং অত্যাচার-নিবারণ শক্তিসাপেক্ষ। যখনই কোন মানসিক গুণের নিষ্পত্তির জন্য কার্যপ্রবৃত্তি—তখনই অল্পাধিক শক্তি সামর্থ্যের প্রয়োজন। সেই শক্তি বা শারীর বল তখনই সভ্যতার সাধন স্বরূপ। শিল্প বাণিজ্য বা দর্শনবিজ্ঞান সর্ব্বত্রই এইরূপ। কিন্তু শারীর বলে বলী হইয়া শিল্প বিজ্ঞানাদির উন্নত সোপানে অধিরূঢ় হইয়াও নির্জ্জিত বা বিজিত জাতির মৃত ও জীবিতাবশেষদিগের প্রতি দুর্ব্যবহার বর্ব্বরতারই পরিচায়ক, বীরত্বের নহে। বীরত্বও সভ্যতার অঙ্গ। সুতরাং বলা যাইতে পারে, শরীর বল যে স্থলে মানসিক গুণের সহকারী নহে—তথায় উহা সভ্যতার অঙ্গ বা অবলম্বন বলিয়া গণ্য হইতে পায়ে না। মানস বিকাশেই সভ্যতা-বিকাশ;—শারীর বল উহায় পরে ততক্ষণই প্রয়োজন, কার্য্যানুষ্ঠানের জন্য যতক্ষণ তাহা সহকার থাকে। রক্তধারায় পৃথিবী ভাসাইলে সভ্যতার যে অধিক অঙ্কুরোদগম হয়, সে বিশ্বাস আমাদের নাই।

 মানস গুণই যখন সভ্যতা, তখন দেখা যাউক, সভ্যতালোকিত জগতের ইতিহাসে বঙ্গের স্থান কোথায়? বঙ্গবাসীর এমন কি মানবিক গুণ আছে, যাহাতে তাহারা জগতের কোন শীর্ষস্থান অধিকার করিতে পারে?

 আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, কোন জাতির সভ্যতার পরিমাণ করিতে হইলে সাধারণতঃ সেই দেশের কৃষি, বাণিজ্য, শিল্পবিজ্ঞান, এবং সর্ব্বোপরি সাংসারিক ও ধর্ম্ম জীবন আলোচ্য হইয়া পড়ে। কৃষিকার্য্যে বঙ্গের প্রকৃতি এমনই অনুকুল যে, অল্পায়াসেই প্রচুর শস্য জন্মে, এবং কিরূপ প্রণালীতে তাহা উৎপাদিত হইতে পারে, বঙ্গের কৃষক সম্প্রদায় নিরক্ষর হইলেও কার্য্যক্ষেত্রে তাহাদের বিলক্ষণ অভিজ্ঞতা আছে।

 শিল্প বা বাণিজ্য আদর্শ সভ্যতা যা মানবজনোচিত উচ্চ গুণাবলীর মধ্যে গণনীয় নহে। তবে শিল্প সম্বন্ধে এইমাত্র বলা যাইতে পারে, ঢাকার মসলিন, কৃষ্ণনগরের মৃত্তিকা নির্ম্মিত প্রকৃতির অনুকৃতি, মেদিনীপুর অঞ্চলের তসর ও গরদ, বীরভূম অঞ্চলের লৌহের গঠন, দিনাজপুর অঞ্চলের প্রাচীন গৃহাদির ভগ্নাবশেষ উচ্চ শিল্পের পরিচায়ক। তবে শিল্প ও বাণিজ্য পৱম্পর এক সূত্রে গাথা, যেন এক বৃন্তে দুইটী ফুল। স্বাধীনতার বিমল বিভা ব্যতীত তাহা কোনক্রমেই স্ফূর্তি পাইতে বা বিকশিত হইতে পারে না। এক্ষণে একটি প্রশ্ন উঠিতে পারে, এখনই যেন স্বাধীনতা বিলুপ্ত হইয়াছে, হিন্দু স্বাধীনতার সময়েই ইহার শিল্প বাণিজ্য কিরূপ উন্নতি লাভ করিয়াছিল? তদুত্তরে আমরা এই মাত্র বলিব, সত্যতা প্লাবিত বর্ত্তমান যুগের শিল্প বাণিজ্য বিজ্ঞানোন্নতি আধুনিক সভ্য জাতিদিগের চিরন্তন সম্পত্তি নহে। অন্যান্য দেশে কালে যাহা ঘটিয়াছে বঙ্গের ভাগ্যেও যে, তাহা কোনক্রমেই ঘটিত না, কোন যুক্তিবলে তাহা স্বীকার করিব? প্রাচীন কবির বর্ণনার পুরাতন নগরীব ভগ্নাবশেষে, এবং প্রস্তর লিপিতে বঙ্গ সভ্যতার জ্বলন্ত প্রমাণ রহিয়াছে, সেই প্রাচীন কালেও তাহারা বৃক্ষের বল্কশ পরিত না, অপক্ক ও অস্পৃশ্য আহারে রসনা পরিতৃপ্ত করিত না, যথেচ্ছবিহারী পশুর ন্যায় স্বজাতি বা হীনজাতির নিধন সাধন করিয়া আপনার পশু প্রকৃতির পরিচয় প্রদান করে নাই। শিল্প বাণিজ্য যে লক্ষ্মীলাভের প্রধান উপার, তাহা বঙ্গবাসীরা সেই প্রাচীন কালেও বুঝিত। কিন্তু ইহাও তাহাদের প্রাণে গাঁথা ছিল, শিল্প বাণিজ্য সম্পদ্ বৃদ্ধির প্রধান সাধন, কিন্তু সম্পদ্ সভ্যতা নহে। আর বিজ্ঞানে! চারিদিকেই ধূয়া—বিজ্ঞানে বঙ্গ রা ভারতবাসী চিরকালই হীন। বিজ্ঞান বলিতে তাঁহারা কি বুঝেন, বলিতে পারি না। সমুদ্রবক্ষে সচ্ছন্দে বিহারোপযোগী রাষ্পীর পোত, দ্রুতগামী বাষ্পীয় যান, ও তাড়িত বার্ত্তাদি দেখিয়া যদিও তাঁহাৱা বঙ্গবাসীকে বিজ্ঞানান্ধ বলেন, তাহা হইলে আমরা বলিব, তাঁহাদের প্রাচীন রোম বিজ্ঞানান্ধ ছিল। সুধু প্রাচীন রোম বা গ্রীস কেন, দুই তিন শতাব্দী পূর্ব্বে জগতের সকল জাতিই বিজ্ঞানান্ধ ছিল, কিন্তু কোন্ মোহন মন্ত্রবলে সেই সকল অন্ধ জাতির সন্তানদিগের দিব্য চক্ষু ফুটিল? বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতিতে অথবা কালবশে? অথবা এই সকল তত্ত্ব কতকগুলি জাতির হৃদয়ে প্রতিফলিত হইবার আবশ্যক হইয়াছিল বলিয়া। প্রকৃতিদেবীর যে দুর্ভেদ্য রহস্য জালের মধ্যে ব্যাঘ্রাদি হিংস্র জন্তুর তীক্ষ্ণ নখর ও দংষ্ট্রা থাকে, বাবুই পক্ষীর কুলায় নির্ম্মাণের জ্ঞান স্বতঃসিদ্ধ বীবরে অপূর্ব্ব কৌশল সেতুবন্ধন সামর্থ্য জন্মে, দূর দেশান্তে গমনাগমন ও অবস্থানের জন্য বিশেষ আবশ্যক স্থলে সেই রূপ ঐ সকল তত্ত্ব উদ্ভাবিত হইয়াছে। তদ্ভিন্ন অমিবা আবার বলিব, এই সকল বিজ্ঞানোন্নতি বর্ত্তমান সভ্যজাতিদিগের চিরন্তন সম্পত্তি নহে। বঙ্গের ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকিলে এ দেশেও উহা অপরিজ্ঞাত থাকিত না?

 যে বিজ্ঞান বলে প্রতীচ্য জাতি আজি প্রাচ্য জাতিদিগের উপর আপনাদের দুব্বার প্রভাব বিস্তার করিয়াছে, যে বিজ্ঞান বলে বৃহৎ বৃহৎ কার্য্যালয় সকলই দেবালয় শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতি ধর্ম্মশাস্ত্র, অপরিজ্ঞাত ভূখণ্ডেও উন্নতির পতাকা উড়িতেছে, যে বিজ্ঞানবলে, তাড়িতে বারুদে— সর্ব্বসংহারিণী শক্তির অবতারণা, বঙ্গ বিজ্ঞানদেবীর সেই মোহিনী ও সংহারিণী মুক্তি বিকসিত হয় নাই। বিজ্ঞান এখানে ভিন্ন পথে চলিয়াছে। এখানে দেবীর তারিণী শান্তিময়ী মূর্ত্তি। বঙ্গের বিজ্ঞান—অর্থতত্ব নহে—শিল্প সম্পদ্ নহে—সমুদ্রে বক্ষে সচ্ছন্দে বিহারের উপায় নহে—লোক ক্ষয়কর প্রস্তাব প্রকাশ নহে। বঙ্গের বিজ্ঞান-পরমার্থ বিজ্ঞান—বঙ্গের বিজ্ঞান সংসার ধর্ম্ম বিজ্ঞান—বঙ্গের বিজ্ঞান সুখশান্তি বিজ্ঞান। সংসারে, সমাজে—জীবনে কিরূপ মানব বৃত্তির উৎকর্ষ ও পরম শান্তিলাভ ঘটে, তাহাই চরম লক্ষ্য। ধর্ম্ম ইহার পত্তন ভূমি—ঐহিক সুখভোগ ইহার পার্শ্ব স্তম্ভ। জাতীয় সাহিত্যে সেই মর্ম্মকাহিনী পরিব্যক্ত। মেঘমেদুর অম্বরে, কোকিলকূজিত কুঞ্জকুটীরে সেই প্রেমগীতি; গৃহে গৃহে দেবালয়ে তাহার নিত্যলীলা। বঙ্গবাসীর জীবন, প্রবাসে প্রিয়জনের স্মৃতি। কর্ত্তব্যের মধ্যেও সেই স্মৃতি সর্ব্বদা জাগরুক। সুখ সম্মিলনের জন্য বাসর প্রতীক্ষা অপেক্ষাও বুঝি তাহা সুমধুর! বিরহ ব্যতীত মিলনের সুখ কোথায়। তাই বুঝি অসংখ্য অতুল্য গীতিকাব্য-গীতিকাব্যে বিরহ সঙ্গীতের পূর্ণ বিকাশ।

 বঙ্গের বিশেষ সম্পত্তি পারিবারিক ব্যবহার-হৃদয়ের পূর্ণ প্রকাশ। দয়া, মায়া, স্নেহ, বাৎসল্য, প্রণয়ে হৃদয়ের প্রেমনির্ঝরিণী শত ধারায় উৎসারিত। আচার ব্যবহার রীতি নীতি—সকলই প্রেমময়, পবিত্রতাময়। অসংখ্য আত্মীয় কুটুম্ব লইয়া তাহাদের সংসার-সংসারে সুখশান্তিই তাহাদের জীবনের চরম লক্ষ্য। সেই সুখ, বিলাসবাসনা চরিতার্থতার নহে। সেই সুখ দয়ার বিকাশে, মমতা প্রকাশেও সেই সুখ, প্রাণ ভরিয়া ভাল বাসিতে—জগৎ ভুলিয়া প্রেমের সাধনার। মলিন মর্ত্তের নীচতা হীনতা আপনার অসীম প্রভাবেও সে স্থলে কঠোর আধিপত্য প্রকাশ করিতে পারে না। বলিরাজের যজ্ঞে বামনদেব ত্রিপাদ ভূমি গ্রহণচ্ছলে যেরূপ স্বর্গ মর্ত্য পাতাল অধিকার করিয়া। বসিয়াছিলেন, বঙ্গের ভক্তি এবং প্রীতিবাৎসল্য প্রণয়ও সেইরূপ আপনার ক্ষুদ্রকারার বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অধিকার করিয়া বসে।

 বঙ্গের আত্মীয় কুটুম্ব অসংখ্য। মমতায় এত বৈচিত্র পৃথিবীর আর কুত্রাপি নাই। তাই তাহাদের একান্নবর্তী পরিবার। সেই জন্যই বুঝি অতিথি দেবতা। সেই জন্যই বুঝি বিশ্ব প্রেম বিরল মানবের ক্ষুদ্র প্রেমের ভাণ্ডার বিশ্ব বিস্তারিত করিতে যাইলে বিলুপ্ত হইবারই অধিক সম্ভাবনা। অথবা দরিদ্রের সম্বল বলিয়া সমধিক আদরের সামগ্রী।

 বিশ্ব প্রেম বিরল হইলেও বুঝি বঙ্গেই তাহার পূর্ণ বিকাশ। মানব কেন, পশু পক্ষীতে সে প্রেম বিস্তারিত। যে দেশে চৈতন্য দেব জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, যে দেশে বৈষ্ণব ধর্ম্মের বিজয় নিশান, বিশ্বপ্রেম সে স্থলে না থাকিলে আর কোথায় থাকিবে? বিদেশী বিধর্ম্মীকে প্রাণ খুলিয়া আলিঙ্গন করিতে জগতে কয় জন পারিয়াছে। খৃষ্টীয় মিশনরিদিগকে মধ্যে মধ্যে এইরূপ প্রেমের অভিনয় করিতে দেখা যায় বটে, কি অবিলম্বেই তাহাদের প্রচ্ছন্নমূর্ত্তি প্রকাশ হইয়া পড়ে।

 আর ধর্ম্ম-জীবন। ধর্ম্মাচরণ জীবনের একটা পৃথক্‌ কার্য্য নহে। ধর্ম্ম লইয়াই জীবন—ধর্ম্মের জন্যই জীবন। জন্মগ্রহণ হইতে শ্মশান সৎকারের যবনিকাপাত পর্য্যন্ত—আদ্যোপান্ত ধর্ম্মানুষ্ঠানের অঙ্ক গর্ভাঙ্ক। তাই বলিতেছি, তাহাদের জীবনটাই ধর্ম্ম লইয়া। সংসারের ঘাত প্রতিঘাতে মধ্যে মধ্যে তাহাতে করুণ বা কঠোর ছায়াপাত হয়, কিন্তু বীভৎস দৃশ্য প্রায়ই দেখিতে হয় না। প্রাণের গান একই সুরে বলিতেছে, হৃদয় ভরিয়া ভাল বাস, মন খুলিয়া বিমল হাস, আর জীবন ভরিয়া কর্ত্তব্য কর। বঙ্গ প্রেমময়, কোমলতাময়, মানব জনোচিত সহৃদয়জনপূর্ণ আনন্দময় শান্তিনিকেতন। পৃথিবীর আজিও এতদূর সভ্যতা হয় নাই যে, আপনার পশু প্রকৃতির দুরন্ত পরিচয় না দিয়া এই সুখশান্তি বিকাশ দেখিয়া মোহিত হইবে।