লেফ্‌টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/নবদ্বীপ ও নবদ্বীপবাসী

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

নবদ্বীপ ও নবদ্বীপবাসী।

 বঙ্গের যে সকল বিভাগ বীরকীর্ত্তির বিমল গৌরবে বরণীয়, তন্মধ্যে নবদ্বীপের নামোল্লেখ করা যাইতে পারে। নবদ্বীপের নামোল্লেখের সঙ্গে সঙ্গেই কত তেজোগর্ব্বের কথা, কত সাধনাসিদ্ধির সুমহতী কাহিনী, কত পূণ্যপবিত্রতা-পাণ্ডিত্যের প্রকাশ, স্মরণে আইসে। আর মনে পড়ে, নদীয়ার সেই পূর্ণ শশধর গোরাচাঁদের কাঙাল বেশের অতুল মহিমা। বঙ্গের যাহা সার সম্পত্তি নবদ্বীপেই তাহার পূর্ণ প্রকাশ। আমরা একে একে সংক্ষেপে সেই আলোচনাই করিব।

 এখন আর সে নবদ্বীপ নাই। অতীত গৌরব হ্রাসের সহিত ভাগিরথীর পুণ্যগর্ভে তাহার অধিকাংশই অন্তর্হিত হইয়াছে। এখন ভাগিরথীর পশ্চিম দিকে নূতন নবদ্বীপ।

 রাজধানীর নামানুসারে যেমন কোন কোন স্থলে সেই প্রদেশের নামকরণ হইয়া থাকে, নবদ্বীপ সম্বন্ধেও সেইরূপ। প্রসিদ্ধ বৈষ্ণব নরহরি দাস বলেন,

‘‘নয়দ্বীপে নবদ্বীপ নাম।
পৃথক্‌ পৃথক্‌ কিন্তু হয় একগ্রাম।
যথা কোন রাজধানী স্থান।
যদ্যপি অনেক তথা হয় এক নাম॥

 কেহ কেহ বলেন, খৃষ্টীয় ৭।৮ম শতাব্দীতে নবদ্বীপ সমুদ্র তীর হইতে মানববাসভূমিরূপে পরিণত হয়। পরে সেনবংশীয়দিগের রাজত্ব সময়ে কি বীরত্বগৌরবে, কি শিক্ষা সভ্যতার বিশেষ প্রসিদ্ধ স্থান ছিল। তদবধি বীরত্ব গৌরবে না হউক, পূণ্যপাণ্ডিত্যে নবদ্বীপ আজিও গৌরবভ্রষ্ট হয় নাই, সেনবংশীয় বা পালবংশীয় রাজাদিগের সময়ে নবদ্বীপের কিরূপ শোভা সম্পত্তি ছিল, আমরা এস্থলে সে কথার উল্লেখ করিয়া পূর্ব্ব স্মৃতির তীব্র তাড়না সহ্য করিতে চাহি না। মুসলমানদিগের প্রবল অত্যাচারের সময়েও নবদ্বীপের কিরূপ অবস্থা ছিল, তাহারই একটু আভাস দিতেছি। কবি জয়ানন্দ বলেন,

“নানাচিত্রে ধাতু বিচিত্র নগরী, নানা জাতি বৈসে তথা।
চুর্ণে বিলেপিত, দেউল, দেহারা, নানাবর্ণ বৃক্ষলতা॥
জয় জয় ধন্য, নদীয়া নগরী, অলকনন্দার কূলে।
কমলাভাষিণী ক্রীড়া করে তথি, রাজিত বকুলমালে॥
প্রতি গৃহোপরি বিচিত্র কলস, চঞ্চল পতাকা উড়ে।
পূর্ব্বে যেন ছিল, অযোধ্যানগরী, বিজুরী ছটকি পড়ে॥
নাট পাঠশাল দীঘী সরোবর কূপ তড়াগ শোভন।
মাঠ মণ্ডপ সুচিত্রিত চত্বর কুন্দতুলসী আয়োপণ॥
প্রতি দ্বারে শোভে অতি বিচিত্র কপাট।
প্রতি গলি নৃত্য-গীত আনন্দিত, প্রতি ঘরে বেদ পাঠ॥
দ্বিজরূপ ধরি দেবতা গন্ধর্ব্ব জন্ম লভিলা নবদ্বীপে।
হইয়া দ্বিজনারী, ইন্দ্র বিদ্যাধরী, সঙ্গীত গঙ্গা সমীপে॥
স্বর্গ ছাড়ি যত গন্ধর্ব্বমণ্ডলী জন্মিল বৈদ্য বনিতা।
দেব ঋষি মুনি দ্বিজ রূপ ধরি অধ্যয়ন শ্রুতি

গোধূলি সময়ে মৃদঙ্গ করতাল শঙ্খধ্বনি প্রতি ঘরে।
শ্বেতচামর ময়ূরপাখা হাতে, চন্দ্রাতপ শোভা করে॥
ইষ্টক রচিত প্রাচীর প্রাঙ্গণ চিত্রিত গৃহ দ্বারে।
হিজুল হরিতাল কাঁচা চাল চৌখণ্ডী চৌকাট সালে॥
শাল রসাল বিশাল শুম্ভরাজিত চন্দ্রার্কতিলকে।
ময়ূর শুক সারস পারাবত সিংহ হংস শাবকে॥
ঘাটপাট সিংহাসন আসন চৌখড়ি ময়ূর পাখা।
বিচিত্র চামর চন্দ্রাতপ প্রতি ঘরে সুন্দর শাখা॥
ডাবর বাটা গুবাক সংপুট দর্পণ রসবাটিকা।
তাম্রহাণ্ডি রসপিত্তল কলস বারাণসী ত্রিপদিকা॥
শঙ্খ বাটাবাটি সর্ব্বাঙ্গ থাল রসময় রসখুরি।
তিরোহত গাড়ু, তাম্রমুখী মণ্ডল শীতল পিত্তল ঝারি॥
ট্যার গাটাকড়ি হিরণ্যমাদুলী কেয়ুর কঙ্কণ নূপুরে।
হেমকিয়াপাতা বিদ্রুম মুকুতা কাশ্মীর দেশের খুরে॥
তবকসুর পানবাটা কাঞ্চিদেশের বিচিত্র বেলি।
পাটনেত তোট সকলাতকম্বল শ্রীরামথানিজমকা।
তোভোট্টদেশের ইন্দ্র নীলমণি লক্ষ্মীবিলাস তারকা।
লিখিতে না পারি যত দাস দাসী প্রেমের মন্দিরে খাটে।
যে যে দ্রব্য সব ভুবনদুর্লভ বিকায় নদীয়ার হাটে॥

 নবদ্বীপের সেই সুখশান্তির সময়ে মুসলমান অত্যাচারে এখানকার পণ্ডিতমণ্ডলী, ও সাধারণের ধনমান নিতান্ত বিপন্ন হইয়া উঠিয়াছিল। কবি বলেন,

‘‘আচম্বিতে নবদ্বীপে হৈল রাজভয়।
ব্রাহ্মণ ধরিয়া রাজা জাতি প্রাণ লয়॥

নবদ্বীপে শখধ্বনি শুনে যার ঘরে।
ধন প্রাণ লয়ে তার জাতি নাশ করে॥
কপালে তিলক দেখে যজ্ঞসূত্র কান্ধে।
ঘরদ্বার লোটে তার লৌহপাশে বান্ধে॥
দেউল দেহরা ভাঙ্গে উপাড়ে তুলসী।
প্রাণভয়ে স্থির নহে নবদ্বীপবাসী॥
গঙ্গাস্নান বিরোধিল হাট ঘাট যত।
অশ্বথ পনস বৃক্ষ কাটে শত শত॥
পিরল্যা গ্রামেতে বৈসে যতেক সবন।
উচ্ছন্ন করিল নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ॥
ব্রাহ্মণে যবনে বাদ যুগে যুগে আছে।
বিষম পিয়ল্যা গ্রাম নবদ্বীপের কাছে॥
গৌড়েশ্বর বিদ্যমানে দিয়া মিথ্যাবাদ।
নবদ্বীপ বিপ্র তোমার করিব প্রমাদ॥
গৌড়ে ব্রাহ্মণ রাজা হবে হেন আছে।
নিশ্চিন্ত না থাকিহ প্রমাদ হবে পাছে॥
নবদ্বীপে ব্রাহ্মণ অবশ্য হবে রাজা!
গন্ধর্ব্বে লিখন আছে বর্ণময় প্রজা॥
এই মিথ্যাকথা রাজার মনেতে লাগিল।
নদীয়া উচ্ছন্ন কর রাজা আজ্ঞা দিল॥
বিশারদ সুত সার্ব্বভৌম ভট্টাচার্য্য।
সবংশে উৎকল গেল ছাড়ি গৌড়রাজ্য॥”

 মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সময় নবদ্বীপের সীমা কতদূর বিস্তৃত ছিল, ভারতচন্দ্রের কালিকামঙ্গলে তাহার আভাস পাওয়া যায়।

“রাজ্যের উত্তরসীমা মুর্শিদাবাদ।
পশ্চিমের সীমা গঙ্গা ভাগিরথী খাদ॥
দক্ষিণের সীমা গঙ্গাসাগরের ধার।
পূর্ব্বসীমা ধূলাপুর বড়গঙ্গা পার॥”

 নবদ্বীপ বঙ্গের বিদ্যচর্চ্চার প্রধান স্থান। সুধু বিদ্যাচর্চ্চা বা শাস্ত্রালোচনা নহে—বিদ্যাদানের বিখ্যাত স্থান। পৃথিবীর আর কোন দেশে এরূপ বিদ্যাদান প্রথা ছিল বলিয়া ত বোধ হয় না। বিদ্যার্থী আসিলে তাহাকে নিরাশ হইয়া ফিরিতে হইত না। অধ্যাপক মণ্ডলী ধনাঢ্য ছিলেন না, কিন্তু আপনাদের আহার্য‍্যের অংশ হইতেও শিক্ষার্থীকে আহার করাইয়া শিক্ষাদান করিতেন এবং শিক্ষার্থীও পিতৃনির্বিশেষে অধ্যাপককে প্রীতিভক্তি করিতেন।

 নবদ্বীপের বিভব বিস্তারের কথা আলোচনা করিতে হইলেই এখানকার পাণ্ডিত্য প্রভাবের কথা আমাদের সর্ব্বাগ্রে মনে পড়ে। এই কামকলুষময় পৃথিবীর মধ্যে ভোগবিলাসিতা হইতে সম্পূর্ণ দূরে থাকিয়া জ্ঞানচর্চ্চা ও ঈশ্বরচিন্তায় চিত্ত সমর্পণ করিয়া নবদ্বীপের পণ্ডিত সমাজ অক্ষয়কীর্ত্তি রাখিয়া গিয়াছেন। পণ্ডিত রঘুনাথ বিদ্যাদানের জন্য ব্যাকুল হইয়া যখন বৃক্ষাদিকেই শাস্ত্র ব্যাখ্যা করিয়া শুনাইলেন, তখন তিনি মনে করেন নাই, সেই ব্যাকুলতার ফলে বঙ্গদেশ ন্যায়চর্চার প্রাধান্যের অমৃত ফল উপভোগ করিবে? আর মথুরানাথ, সেই পার্থিব সুখভোগস্পৃহাহীন শিক্ষাগুরুর আদর্শ কোথায়? বিদ্যাদান ও ছাত্রপালনই তাঁহার জীবনের এক মাত্র ব্রত। গৃহে অন্ন ব্যতীত আহারের উপকরণ নাই; রামনাথ বলিলেন, উপকরণের অভাব কি। সরল প্রাণের অকপট উচ্ছ্বাসে বলিলেন, সম্মুখের তিন্তিড়ি বৃক্ষ থাকিতে আমাদের অভাব কি? ভোগবিলাস বর্জ্জিত, সদা সন্তুষ্ট সে সকল পরম পণ্ডিত ধর্ম্মজীবন মহাত্মাগণ আজ কোথায়?

 কিন্তু নবদ্বীপের প্রধান গৌরব, নদীয়ার পূর্ণ শশধর চৈতন্যদেব। একদিকে মুসলমানের দারুণ অত্যাচার, অন্য দিকে অনাচার, ব্যভিচার এবং ধর্ম্মহীন শুষ্ক তর্ক বা বেদান্তবাদের বিকৃতি বিভীষিকা। ধর্ম্মবিপ্লবের সন্ধিস্থলে, ধর্ম্মাচরণের সেই ঘোর প্রতিকূলতার মধ্যেও শ্রীচৈতন্যদেব করুণ প্রেমের প্রবাহ প্রবাহিত করিলেন। প্রথম প্রথম তাহাতেও যে নানা রূপ অত্যাচার উৎপীড়ন ঘটে নাই তাহা নহে; কিন্তু সেই সঙ্কীর্ত্তনের তরঙ্গে দেশের কঠোরকলুষতা কতক্ষণ তিষ্ঠিতে পারে! সেই নির্ম্মল, মনোমোহন, উন্মাদন প্রেমপ্রবাহে মূসলমানদিগের কঠোরতা পর্য্যন্ত ভাসিয়া গিয়াছিল। নবদ্বীপ আবার নূতন শোভার নবীন মাধুরীতে ভরিয়া উঠিল।

 শ্রীচৈতন্য স্বয়ং ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণের পূর্ণ অবতার বা পূর্ণব্রহ্ম এ স্থলে আমরা সে কথার সমালোচনা করিব না। চৈতন্যদেব সম্বন্ধে এই মাত্র বলিতেছি, তিনি অসাধারণ প্রেমিক ও ভাবুক রূপে অবতীর্ণ হইয়া, সর্ব্ব জীবে দয়া, সর্ব্ব দেবে পূজা, সর্ব্বভূতে প্রীতি ও প্রেমভক্তি বা যে বিশ্বপ্রেম দেখাইয়া গিয়াছেন, তাহা অপূর্ব্ব, অসাধারণ, অননুকরণসাধ্য। তাঁহার অপূর্ব্ব মাধুরীময় প্রেমধর্ম্মে ব্রাহ্মণ শূদ্র ভেদ ছিল না, হিন্দু মুসলমানের দ্বেষাদ্বেষ ছিল না, পণ্ডিত মূর্খের পার্থক্য ছিল না, পাপী তাপী ধনী নির্ধন সকলেই সেই প্রেমময়ের প্রেমসুধাপানে তুল্য অধিকারী। এখন শাক্ত বৈষ্ণবের দ্বন্দ্ব একটা বীভৎস ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে, কিন্তু চৈতন্যদেব স্বয়ং সেই ভেদজ্ঞান বিদূরণের জন্য কি রূপ ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, আমরা শ্রীচৈতন্যভাগবত হইতে তাহার একটু আভাস দিব। শ্রীচৈতন্যদেব এক দিন বলিলেন,

 “প্রকৃতি স্বরূপে নৃত্য হইবে আমার।” চৈতন্যদেব প্রকৃতিবেশে নৃত্য করিতে লাগিলেন।

 চৈতন্যদেব যখন প্রকৃতিবেশে নৃত্য আরম্ভ করিলেন, তখন তাঁহার ভক্তগণও তাঁহাকে চিনিতে পারিল না।

 তখন—

কেহ নারে চিনিতে ঠাকুর বিশ্বম্ভর।
হেন অতি অলক্ষিত বেশ মনোহর॥
নিত্যানন্দ মহাপ্রভু প্রভুর বডাহ।
তাঁর পাছে প্রভু আর কোন চিহ্ন নাই॥
অতএব সবে চিনিলেন প্রভু এই।
বেশে কেহ লখিতে না পারে প্রভু সেই॥
সিন্ধু হইতে প্রত্যক্ষ কি হইল কমলা।
রঘুসিংহ গৃহিণী কি জানকী আইলা॥
কিবা মহালক্ষ্মী কিবা আইলা পার্ব্বতী।
কিবা বৃন্দাবনের সম্পত্তি মূর্ত্তি সতী॥
কিবা ভাগীরথী কিবা রূপবতী দয়া।
কিবা সেই মহেশমোহিনী মহামায়া॥
এই মত অন্যোহন্যে সর্ব্ব জনে জনে।
চিনিয়া প্রভুরে আপনা সেই মানে॥

আজন্ম ধরিয়া প্রভু দেখিল যাহারা।
তথাপি দেখিতে নারে তিলার্দ্ধেক তারা॥

 চৈতন্য তখন নাচিতে নাচিতে ভক্ত সকলকে আপনার স্তব পড়িতে বলিলেন। আর নিজে—

ভাবাবেশে কখন বা অট্ট অট্ট হাসে।
মহচণ্ডী যেন সবে বুঝেন প্রকাশে॥
ঢুলিয়া ঢুলিয়া প্রভু নাচয়ে যখনে।
সাক্ষাতে রেবতী যেন কাদম্বরী পানে॥
সর্ব্বশক্তি স্বরূপা নাচেন বিশ্বম্ভর।
কেহ নাহি দেখে হেন নৃত্য মনোহর॥
মোর স্তব পড় বলে গৌরাঙ্গ শ্রীহরি।
জননী আবেশ বুঝিলেন সর্ব্বজনে।
সেইরূপে সবে স্তুতি পড়ে প্রভু শুনে॥
কেহ পড়ে লক্ষ্মীস্তব কেহ চণ্ডী স্তুতি।
সবে স্তুতি পড়েন যাহার যেন মতি॥
‘‘জয় জয় জগত-জননী মহামায়া।
দুঃখিত জীবেরে দেহ চরণের ছায়া॥
জয় জয় অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড কোটীশ্ববি।
তুমি যুগে যুগে ধর্ম্ম রাখ অবতরি॥
ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরে তোমার মহিমা।
বলিতে না পারে, অন্যে কে দিবেক সীমা॥
জগত-স্বরূপা তুমি, তুমি সর্ব্বশক্তি।
তুমি শ্রদ্ধা, দয়া, লজ্জা, তুমি বিষ্ণুভক্তি॥
বড় বিদ্যা—সকল তোমার মূর্ত্তিভেদ।

‘সর্ব্ব প্রকৃতির শক্তি তুমি’ কহে বেদ॥
নিখিল ব্রহ্মাণ্ডে পরিপূর্ণ তুমি মাতা।
কে তোমার স্বরূপ কহিতে পারে কথা॥
তুমি ত্রিজগত-হেতু গুণত্রয়ময়ী।
ব্রহ্মাদি তোমারে নাহি জানে, জানে কোই॥
সর্ব্বাশ্রয়া তুমি সর্ব্ব জীবের বসতি।
তুমি আদ্যা অধিকায়া পরমা প্রকৃতি॥
জগত আধার তুমি দ্বিতীয়-রহিতা।
মহী রূপে তুমি সর্ব্ব-জীব-পালয়িতা॥
জলরূপে তুমি সর্ব্ব জীবের জীবন।
তোমা’ স্মরিলে খণ্ডে অশেষ-বন্ধন॥
সাধুজন গৃহে তুমি লক্ষ্মী মূর্ত্তিমতী।
অসাধুর ঘরে তুমি কালরূপাকৃতি॥
তুমি সে করাহ ত্রিজগতে সৃষ্টি-স্থিতি।
তোমা না ভজিলে পায় ত্রিবিধ দুর্গতি॥
তুমি শ্রদ্ধা বৈষ্ণবের সর্ব্বত্র উদরা।
রাখহ জননি, চরণের দিয়া ছায়া॥
তোমার মায়ায় মগ্ন সকল সংসার।
তুমি না রাখিলে মাতা! কে রাখিবে আর॥
সভার উদ্ধার লাগি তোমার প্রকাশ।
দুঃখিত জীবেরে মাতা! কর নিজ দাস।
ব্রহ্মাদির বন্দ্য তুমি সর্ব্ব-ভূতবুদ্ধি।
তোমা’ স্মরিলে সর্ব্ব মন্ত্রাদির শুদ্ধি॥’’

 শ্রীগৌরাঙ্গ স্বয়ং বলিতেছেন, বিষ্ণু ও শক্তিতে প্রভেদ নাই। একই শক্তি বিবিধরূপে প্রকাশ।

 মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নবদ্বীপের আর এক জন উজ্জ্বলরত্ন। ইহাঁরা ভবানীর বরপুত্র ভবানন্দ মজুমদারের বংশধর। বঙ্গভাষার তাজমহল নির্ম্মাতা ভারতচন্দ্র এই সভার শোভা বৃদ্ধি করিতেন। এই সকল সুখসম্পদের কথার মধ্যে নদীয়ায় বিশ্বাসবংশের মহত্ত্ব ও আত্মসমর্পণের কথা উল্লেখ না করিয়া থাকা যায় না। কুক্ষণে নদীয়ায় নীলের আবাদ হইয়াছিল, বাঙ্গালীর রক্তে নীলেব ভূমির উর্ব্বরতা সাধিত না হইলেও অজস্র রক্তপাতে ভারতের ইতিহাস রঞ্জিত রহিয়াছে। নীলকরগণ নদীয়ায় নীলের আবাদ উপলক্ষে নিদারুণ অত্যাচার অনাচার করিত, রাজকর্ম্মচারিগণ সকলেই তাহাদের সুহৃদ্‌ সহায় কিন্তু নদীয়ার বিশ্বাসবংশ ধনবলে বলী না হইলেও প্রবল পরাক্রম নিষ্ঠুরপ্রকৃতি, নীলকরদিগের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হয়। নীলকরগণ নদীয়ায় যেরূপ অত্যাচার করিয়াছিল, জগতের ইতিহাসে সেরূপ নৃশংসতা নিতান্ত বিরল। ইংরাজের রাজ্যে সুসভ্য ইংরাজ জাতীয় হইয়া তাহারা যেরূপ বর্ব্বরতার পরিচয় দিয়াছে, সাধু প্রকৃতি ইংরাজগণ সেই কথা স্মরণ করিয়া তাহাদিগকে আপনাদের স্বজাতীয় বলিতে কুণ্ঠিত হন। সে যাহা হউক, বিশ্বাস বংশ সেই দারুণ নিষ্ঠুরতার প্রতিকুলতাচরণ করিতে গিয়া অনেকে গৃহ দ্বার শূন্য হইয়াছেন, সর্ব্বস্বান্ত হইয়াছেন, জীবন পর্য্যন্ত বিসর্জ্জন দিয়াছেন, তথাপি সেই দানবোচিত দুর্বৃত্ততার প্রতিকুলতাচরণে পবান্মুখ হন নাই। বিনাপরাধে গৃহ লুণ্ঠন, গৃহ দাহ, প্রাণ সংহার এমন কি অসহায়া গর্ব্ভিণী রমণীকে পদাঘাতে নিপাতিত বা সতীত্বনাশ করিতে দেখিয়া কোন্‌ মানব সন্তান নীরব নিস্পন্দ থাকিতে পারেন? বিশ্বাসবংশের ঐকান্তিক চেষ্টায় এবং ধন প্রাণদানে অবশেষে ইহার প্রতি বিধানের তুমুল আন্দোলন উঠে। এবং সদাশয় ইডেন এবং সুপ্রসিদ্ধ লং সাহেব প্রভৃতির সহায়তায় সেই অমানুষিক নৃশংস আচরণের তিরোধান ঘটে।

 এখন নানাকারণে নবদ্বীপ শ্রীভ্রষ্ট, অধিবাসিগুলি ম্যালেরিয়ায় প্রপীড়িত; তথাপি শান্তিপুর কৃষ্ণনগর প্রভৃতি স্থানের গোপগণ এখনও লাঠির খেলায় অনেক বীরের বিস্ময় উৎপাদন করিতে পারে। বোদে ও বিশে ডাকাতের অপূর্ব্ব বীর কাহিনী এখন উপন্যাস রূপে দাঁড়াইয়াছে। কিন্তু এখনও মতিয়ারির রামদাস বাবুর বল বিক্রম, বাহুবলের একটী সামান্য উদাহরণরূপে উল্লেখ করা যাইতে পারে।