লেফ্টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/নাথপুরের বিশ্বাস
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
নাথপুরের বিশ্বাস।
নদীয়ার রাজধানী কৃষ্ণনগরের ৭ ক্রোশ পশ্চিমে ইচ্ছামতী নদীতীরে নাথপুর নামে একটী পল্লীগ্রাম আছে। তথাকার বিশ্বাসবংশ ধন গৌরবে না হউক, বহুকাল হইতে নদীয়া অঞ্চলে বিশেষ মান্যগণ্য। এই প্রাচীন সম্ভ্রান্তবংশ অতুল ধনাধি পতি নহে, বড়লোক বলিয়া একটী অসামান্য অহঙ্কারে গর্ব্বিত নহে, কিন্তু সমগ্র নদীয়া অঞ্চলে জনসাধারণের নিকট তাঁহারা সুপরিচিত। তাঁহাদের খ্যাতি, ভদ্রোচিত আচার ব্যবহার ও দয়া দাক্ষিণ্যাদি সদ্গুণের সমাবেশে সুতরাং সহজে বিলুপ্ত হইবার নহে। তাহা দুদিনের অস্থায়ী খ্যাতি নহে যে, নিমেষে ফুরাইবে।
১৮৬১ খৃঃ অব্দে সুরেশচন্দ্র এই সম্ভ্রান্তবংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতা গিরিশচন্দ্র বিশ্বাস। গিরিশ বাবু বিশেষ ধনাঢ্য ছিলেন না। তিনি গবর্ণমেণ্ট আপিসে সামান্য বেতনে কার্য্য করিতেন। যখন গোরাচাঁদের প্রেমের তরঙ্গে ‘‘শান্তিপুর ডুবু ডুবু নদে ভেসে যায়’’ সেই সময় হইতেই বিশ্বাসবংশ এই শ্রীগৌরাঙ্গের উপাসক। গিরিশ বাবু কোম্পানীর কর্ম্ম করিতেন; সুখশান্তিময় স্বগ্রামে অবস্থান তাঁহার ভাগ্যে অধিক দিন ঘটিয়া উঠিত না। পরিবারগণ স্বদেশেই থাকিত। স্ত্রীপুত্রাদি পরিজন লইয়া কর্মস্থলে প্রবাস তখনকায় রীতি ছিল না। সুতরাং সেকালের পল্লীগ্রামগুলিও শ্রীভ্রষ্ট হয় নাই। অর্থোপার্জ্জনের জন্য যিনি যেখানেই কর্ম্ম করুন না কেন, সেখানে কেবল উপার্জ্জনের জন্যই অবস্থান করিতেন কিন্তু সর্ব্বদাই মনে জাগিত,সেই প্রিয় জন্মভূমি, যে স্থানে তিনি জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, যে স্থানে তাঁহার প্রিয় পরিজনবর্গ ও পূর্ব্বপুরুষগণের চরণরেণু বা কীর্ত্তিকাহিনী বর্ত্তমান, যেখানে কপট আত্মীয়তায় অপরকে ভুলাইয়া আত্মীয়বৎ করিবার আবশ্যক হয় না। আর সেই প্রবাসের পর প্রিয় পরিজনের মিলন বড়ই সুমধুর ছিল। তখন স্নেহ মমতা মূর্ত্তিমতী হইয়া প্রবাসের দীর্ঘদিন যামিনীর সুখ দুঃখময়ী স্মৃতি দূরীভূত করিত। নগরের বিলাস বিভ্রম তখন জনসমাজের হৃদয় এতদূর কলুষিত করে নাই। সে কাল গিয়াছে!
গিরিশচন্দ্রের দুই পুত্র ও তিন কন্যা; সুরেশচন্দ্রই তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র; সুরেশচন্দ্রের বয়স এই ৩৮ বৎসর মাত্র কিন্তু তিনি যেরূপ প্রতিকূল অবস্থায় পড়িয়াছিলেন, যেরূপ বিপদ অতিক্রম করিয়াছেন এবং এক্ষণে যেরূপ গৌরবে গৌরবান্বিত, তাহা অসামান্য, অসাধারণ এবং প্রকৃত বীরোচিত।
সকল দেশের সর্ব্ব সময়েই মনস্বীব্যক্তিগণ বলিয়া থাকেন, বালক ভবিষ্যতে কিরূপ ব্যক্তি হইবে, প্রথম হইতেই তাহার আভাস পাওয়া যায়। সুরেশচন্দ্রের জীবনেও তা সুস্পষ্ট প্রতিভাত। বাল্যকাল হইতেই সুরেশচন্দ্র ভয় কাহাকে বলে জানিত না। প্রসিদ্ধ ইংরাজবীর নেল্সন সাহেব বাল্যকালে পাখীরবাসা ভাঙ্গিতে বাহির হইলে স্নেহময়ী জননী ভয় দেখাইলে যেমন বলিয়াছিলেন, “ভয় কি মা।’’ সুরেশচন্দ্রও তদ্রুপ বাল্যকালে সঙ্কটময় ঘটনাতেও আভাস দিয়াছেন, ভয় কাহাকে বলে! নির্ব্বুদ্ধিতাবশে নহে, প্রকৃতিবশে। তিনি জানিতেন, অগ্নিতে হস্তক্ষেপ করিলে হস্ত পুড়িয়া যায় কিন্তু জানিয়া শুনিয়াও আবশ্যক বোধ হইলে তাহাতে বিমুখ হইতেন না।
সুরেশচন্দ্র বাল্যে বড়ই চঞ্চল ছিলেন, যখন যেদিকে যে কার্য্য করিতে ইচ্ছা হইত, সহজে তাহা হইতে বিরত হইতেন না। প্রবল ব্যক্তির বাধায় অগত্যা নিবৃত্ত হইতে হইলেও বিষম ক্রোধে ও অভিমানে তখন বালক সুরেশের চক্ষু দিয়া যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইত। কিন্তু সদ্ব্যবহারে বালক আবার তেমনই বশীভূত। শাসনে যাহা দুঃসাধ্য, একটু সহাস্য মুখে একটী মিষ্ট কথায় বালক সুরেশচন্দ্র একেবারে শিষ্ট শান্ত, নিতান্ত আজ্ঞাবহ।
সুরেশচন্দ্রের সমবয়স্কদিগের পক্ষে যাহা দুঃসাধ্য বা অসম্ভব সুরেশচন্দ্রের নিকট তাহা নহে। এইরূপে প্রায় প্রতিদিনই বালক সর্ব্বাঙ্গে অল্পাধিক আঘাত পাইত। আজ উচ্চস্থান হইতে পড়িয়া গিয়াছে, আজ কাটিয়াছে, এইরূপ ক্ষত বিক্ষত হওয়া তাঁহার বাল্য জীবনের প্রাত্যহিক ঘটনা। কিন্তু তজ্জন্য বালকসুলভ ক্রন্দন শুনা যায় নাই। লাগিয়াছে লাগুক, কাটিয়াছে কাটুক; অত্যুচ্চ হইতে লম্ফ প্রদান, অতিরিক্ত দৌড় ও বৃক্ষারোহণ এ সকল হইতে নিবৃত্ত হওয়া যায় না।
কতকগুলি ব্যক্তিকে লক্ষ্য করিলেই বুঝা যায়, তাহারা প্রভুত্ব করিতেই যেন জন্মগ্রহণ করিয়াছে; তাহারা আজ্ঞাবাহক নহে। সুরেশচন্দ্রের বাল্যকাল আলোচনা করিয়াও সেই রূপ বোধ হয়, তিনি প্রভুত্ব করিতেই জন্মিয়াছেন, অধীনতা করিতে নহে। বাল্যকালে তিনি কোন সঙ্গী সহচরকে খুঁজিয়া বেড়াইতেন না, কিন্তু দলে দলে সমবয়স্ক বালক আসিয়া সুরেশচন্দ্রের সহিত সম্মিলিত হইত, এবং তাঁহাকে আপনাদের ‘‘পাণ্ডা’’ মনে করিত।