লেফ্‌টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/বাল্য ঘটনা

চতুর্থ পরিচ্ছেদ


বাল্য ঘটনা

 বালকের অস্ফুট জীবনে ভবিষ্যৎ জীবনের অনেকটা আভাষ পাওয়া যায়। বালকের হাসি কান্না ও খেলা ধূলার মধ্যে যে বিশেষত্বটুকু থাকে, তাহা সকল সময়ে সকলে বুঝিয়া উঠিতে পারেন না বটে কিন্তু বিশেষ প্রতিকূলতা না ঘটিলে কালে তাহা পরিস্ফুট হইয়া উঠে। ছায়া দেখিয়া কায়া নির্ণয় সহজ ব্যাপার নহে।

 সুরেশচন্দ্রের সেই সুকুমার শৈশবে যে বিশেষত্বের আভাস পাওয়া যায়, এক্ষণে তাহা পরিস্ফুট বা পরিব্যক্ত কিন্তু বালকের সেই অস্থিরতা, অসাধারণ দুঃসাহস ও সহ্যগুণ তখন কয়জনের হৃদয়ে অঙ্কিত করিয়াছিল যে, সেই বালসুলভ প্রকৃতির গুঢ় বিকাশেই বর্ত্তমান পরিণত।—বীজের অভ্যন্তরে যেরূপ গুপ্ত অগোচর অন্তর্শক্তি নিহিত থাকে, মনুষ্য প্রকৃতি পর্য্যালোচনা করিলেও তাহার সুস্পষ্ট আভাস পরিলক্ষিত হয়।

 বাল্যকাল হইতেই সুরেশচন্দ্রের জীবনে লক্ষিত হইবে, তিনি অকুতোভয় এবং অপূর্ব্ব সহনশীল; প্রত্যেক ঘটনায় তাহা অল্পাধিক পরিব্যক্ত। বালকের অগ্নিশিখা দর্শনে আনন্দোচ্ছ্বাস বিচিত্র ঘটনা না হইলেও সুরেশচন্দ্রের তাহাতে একটু অসাধারণত্ব ছিল। এবং বালক সাধারণের লোহিতোজ্জ্বল অগ্নি বা দীপশিখা দর্শনে যে আনন্দ তাহা বালসুলভ হইলেও সম্ভবতঃ উহার একটা বিশেষ কারণ আছে। অনেকে অনুমান করেন, এই আনন্দের মূলে সৌন্দর্য্য-প্রিয়তা বর্ত্তমান। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য বালক সেই আকর্ষণে মোহিত বা বিদগ্ধ হইতে পশ্চাৎপদ নহে; কিন্তু জ্ঞানবৃদ্ধগণও কি সৌন্দর্য্যেয় প্রদীপ্ত শিখায় বহ্নিমুখে পতঙ্গ পতনের ন্যায় স্বেচ্ছায় দগ্ধাবশেষ না হইয়া বিরত হইতে পারেন?

 যাহা হউক, সুরেশচন্দ্র ও অগ্নির সহিত ক্রীড়ায় একান্ত আগ্রহ পরিত্যাগ করিতে পারিতেন না। স্নেহময়ী জননী সদাই শঙ্কিতা, অবাধ্য অবোধ সন্তান আগুন লইয়া কখন কি করিয়া বসে! কিরূপে অগ্নি বা দীপশিখার উপর সন্তানের ভয় জন্মাইয়া দিতে পারেন, তাহার উপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন, অবশেষে স্থির করিলেন, আগুনের তাপ লাগিলে বালক হয়ত আর আগুনের নিকট যাইবে না; এইরূপে তিনি আগুনের উপর সন্তানের ভয় জন্মাইয়া দিবার সঙ্কল্প করিলেন। একদিন সন্ধ্যাকালে তাঁহাকে অত্যাবশ্যক গৃহকর্ম্ম করিতে হইবে, সুশীল সুরেশ সঙ্গে থাকিলে তাহা কোনমতেই হইবার নহে, অথচ গৃহে এমন কেহ নাই, যাহার নিকট রাখিয়া মার প্রাণ স্থির থাকতে পারে। অন্ধকার গৃহে বালককে একাকীই বা কিরূপে রাখা যায়; আবার প্রজ্জলিত দীপালোকেই বা কোন প্রাণে রাখিয়া যাইতে পারেন। তখন কেরোসিন ল্যাম্পের এত প্রাদুর্ভাব হয় নাই এবং এরূপ সম্পত্তিশালীর গৃহও

নহে যে, গৃহে ঝাড় লণ্ঠন জ্বলিবে। তখন ঘটনাক্রমে সুরেশচন্দ্রের মাতা স্থির করিলেন, আগুনের উপর ভয় জন্মাইয়া তিনি গৃহকার্য্যে যাইবেন। গৃহের এক কোণে সেই ‘‘সনাতন’’ দীপ জ্বলিতেছিল। সন্তানকে কোলে লইয়া সুরেশ চন্দ্রের মাতা সেই দীপের দিকে অগ্রসর হইলেন, সুকুমার শিশুর সেই কোমল করপল্লবগুলি নাচাইতে নাচাইতে সেই দীপশিখার নিকট ধরিলেন। মার কোলে নির্ভর বালক হস্ত আরও বাড়াইয়া দিল। হস্তে বিলক্ষণ লাগিল, কিন্তু বালকের রোদন বা চক্ষুকোণে অশ্রু বিন্দুমাত্র নাই। মা মনে করিয়াছিলেন, সামান্য উত্তাপ লাগিলেই বালক কাঁদিয়া উঠিবে বা হস্ত সরাইয়া লইবে, কিন্তু তাঁহার সে বালক নহে। বালক অগ্নিতে হস্ত বাড়াইয়া রাখিয়া হাসে নাই বটে, কিন্তু তাহার মুখে যন্ত্রণার কোনরূপ চিহ্ন লক্ষিত হয় নাই। কাতরতার পরিবর্ত্তে কেবল মাত্র অপূর্ব্ব নীরবতা, কিন্তু মার প্রাণ তখন কত কাঁদিয়াছিল, কে বলিবে? সন্তানের অদ্ভুত সহ্যগুণ দেখিয়া তিনি বিস্মিত হইয়া সেই অবধি তাঁহার শাসন সঙ্কল্প পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। ভীষণ অগ্নিময় সমরক্ষেত্রে সুরেশচন্দ্র যে নির্ভয়ে অগ্নিক্রীড়া করিবেন, এই সামান্য ঘটনাতেই যেন তাহার সূচনা।

 সুরেশচন্দ্রের বয়স যখন দুই বৎসর মাত্র তখন হইতেই তাঁহার নির্ভীকতা ও দুঃসাহসের অদ্ভুত পরিচয় পাওয়া যায়। দুই বৎসরের শিশু একাকী খেলা করিতেছে, অকস্মাৎ নিকটবর্ত্তী প্রাচীর গাত্রে একটী “মৈ”এরদিকে বালকের দৃষ্টি পড়িল, বালক উহার নিকটবর্ত্তী হইল, একে একে উহার সর্ব্বোচ্চ স্থানে উঠিল; উহা ভূমিতল হইতে ২০ ফুট উচ্চ। বালক উচ্চে উঠিয়া একবার নিম্নে যেন নিক্ষেপ করে, আর অতুল আনন্দে সেই কচি কচি হাত দুখানি নাচাইয়া অপূর্ব্ব ভঙ্গিতে করতালি দিতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে অর্থহীন আনন্দ সঙ্গীত। বালকের চীৎকারে সুরেশচন্দ্রের মাতা ও আত্মীয় স্বজন সেইস্থানে আসিয়া পড়িল। বালকের কাণ্ড দেখিয়া সকলেই আতঙ্কে শিহরিয়া উঠিল। একটু অসাবধান, ভারবৈষম্য বা দুর্ম্মতি ঘটিলেই ভগবান যে কি দুর্ঘটনাই ঘটাইবেন, সকলে সেই আশা করিতেছেন। ২০ ফুট উচ্চ হইতে সেই দুই বৎসরের শিশু ভূমিতলে পড়িলে আর কি তাহাকে পাওয়া যাইবে! এদিকে আত্মীয় স্বজনকে দেখিয়া বালকের আনন্দ বাড়িয়া উঠিল; হর্ষোৎফুল্ল বালক সুকুমার গ্রীবা বাঁকাইয়া অপূর্ব্ব ভঙ্গীতে করতালি দিতে লাগিল। সকলেই ভীত—বিপদের আর বিলম্ব নাই। এইবার হয়ত পড়িল কেহ যে সেই “মৈ’’এ উঠিয়া বালককে নামাইয়া আনিবে, তাহাও একরূপ অসম্ভব। কেন না হয়ত উঠিতে গেলেই সিড়ি সামান্য নড়িবে। সেই সামান্য কম্পনে সুরেশের পদস্খলন হইতে পারে; অথবা কাহাকেও উঠিতে দেখিলে উন্মত্ত সুরেশ তাহাকে দেখিয়া লাফাইয়া ঝাঁপাইয়া পড়িবে কি না, কে বলিতে পারে! সুরেশচন্দ্রের জননী সন্তানকে যতই স্থির হইয়া বসিতে বলিতেছেন সুবোধ শিশুর সঙ্গীতভঙ্গী ও চীৎকার ততই বাড়িতেছে। ভয় দেখাইয়া বা ভর্ৎসনা করিয়া সুরেশকে কোনরূপ প্রতিনিবৃত্ত করিবার চেষ্টা বৃথা বুঝিয়া তখন তিনি স্নেহকাতরবাক্যে সুরেশকে ক্ষণেকের জন্য শান্ত হইতে অনুনয় করিলেন। ক্লান্তিবশেই হউক, অথবা মাতার কাতরতাতেই হউক, সুরেশচন্দ্র স্থির হইয়া বসিল। তখন কয়েক ব্যক্তি সেই “মৈ’’খানি দৃঢ়রূপে ধরিয়া রহিল, যেন কম্পিত বা বিচলিত না হয়। এবং একজন ধীরে ধীরে উহাতে উঠিয়া সুরেশচন্দ্রকে নামাইয়া আনিল। তখন সুরেশচন্দ্রের মাতা যেন হারানিধি পাইয়া বালককে কোলে লইলেন। এবং ব্যাকুল আগ্রহ ও আবেশভরে কতই চুম্বন করিলেন। মার প্রাণের ব্যাকুলতা কে বর্ণনা করিবে! বিশেষতঃ সুরেশচন্দ্রের ন্যায় শান্তশিষ্ট শিশুর জননীর সদাই ভাবনা, খেলার ছলে বালক কখন কি সর্ব্বনাশ করিয়া বসে!