লেফ্টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/বিড়াল বিরোধ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
বিড়াল বিরোধ।
দুই বৎসর বয়সে সুরেশচন্দ্র আর একবার যে বিভ্রাট বাধাইয়া বসিয়া ছিলেন, আমরা এস্থলে তাহার উল্লেখ করি। এই বিভ্রাট বিড়ালের সহিত বিরোধে ঘটিয়াছিল। পল্লীগ্রামের বিড়ালগুলি নাগরিক বিড়ালের ন্যায় নিতান্ত শান্তশিষ্ট নহে। স্থল বিশেষে তাহাদের বন্যপ্রকৃতির অনেকটা আভাস পাওয়া যায়। তদ্ব্যতীত সহরের বিড়ালগুলির একমাত্র শিকার ইন্দুর; আবার সহরের ইন্দুর এত বড় থাকে যে সময়ে সময়ে সেই শিকারের আশাও ছাড়িতে হয়। সুতরাং সহরের বিড়ালগুলি শিকারের অভাবে ক্রমশঃ আপনাদের হিংস্র স্বভাব কতকটা ভুলিয়া যায়। কিন্তু পল্লীগ্রামের মুক্ত পথে বিবিধ পক্ষী, শশক, কাঠ বিড়াল প্রভৃতি অগণ্য শিকারে থাকাতে তাহাদের শিকার বৃত্তির রীতিমত পরিচালনা হইয়া থাকে। কেন যে, বিড়ালদিগকে “বাঘের মাসী” বলে, ইহাদিগের স্বীকার প্রণালী দেখিলে অনেক সময়ে তাহা বুঝিতে পারা যায়।
একবার আমরা পল্লীগ্রামে একটী কুকুর ও বিড়ালের “দ্বৈরথ যুদ্ধ’’ দেখিয়া আশ্চর্য্য হইয়াছিলাম। ক্ষুদ্রকায় বিড়ালের সেই তর্জ্জন গর্জ্জন ও অপূর্ব্ব প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রকৃতই সুকৌশলসম্পন্ন কুকুরটী প্রথমে যেন কৌতুকচ্ছলে একটী বিড়ালকে আক্রমণ করিল। কিন্তু যখন চীৎকার ও গর্জ্জন করিতে করিতে পূর্ণ বিক্রমে সেই ক্ষুদ্রকায় তীক্ষ্ন-নখর-দশন বিড়ালের উপর আপতিত হইল, তখন তাহার প্রতিদ্বন্দ্বিতার লেজ গুটাইয়া হটিতে হইল। কিয়ৎপরে আবার পূর্ণবলে যেমন আক্রমণ, অমনি বিড়ালের নখরাঘাতে পশ্চাদ্বর্ত্তন। আমরা কৌতুহলী হইয়া সেই বিষম বিরোধ দেখিতে ছিলাম; কেহ কেহ বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য উভয়কেই নিবৃত্ত করিবার উদ্যোগ করিতেছিলেন; কিন্তু আমরা কৌতুহলী হইয়া তাঁহাদিগকে নিবৃত্ত করিয়া বলিলাম, এই উদ্যোগ হইতে বিরত হউন, যুদ্ধকাণ্ডটাই দেখা যাক্। প্রায় অর্দ্ধঘণ্টাকাল সেই সমবেত দর্শকমণ্ডলীর সম্মুখে সেই তর্জ্জন গর্জ্জন লম্ফন কুণ্ডলন চলিতে লাগিল। অবশেষে কুকুরের মুখ ও গ্রীবাদেশ ক্ষত বিক্ষত হইলে সে রণে ভঙ্গ দিয়া পলায়ন করিল। বিড়ালটী তখন পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বীর পশ্চাদনুসরণ করিল না বটে, কিন্তু বিজয় লাভে লাঙ্গুল ফুলাইয়া বিজয়নাদ করিতে করিতে অপূর্ব্ব গৌরবভরে আপন বিজয়ানন্দ প্রকাশ করিতে লাগিল।
যাহা হউক, একদিন একটি প্রকাণ্ড বিড়াল একটী বিল্ববৃক্ষে উঠিয়া একটি কাঠবিড়াল শিকার করিয়া ভূমিতলে আনয়ন করে। কাঠবিড়ালীর ক্ষীণপ্রাণ তখনও শেষ হয় নাই বটে, কিন্তু তখন গ্রীবাদেশে রক্তধারা,জীবনমাত্র অবশিষ্ট আছে। বিড়ালটী লাঙ্গুল কুণ্ডলিত করিয়া উহার বক্ষে বসিয়া আছে এবং উহার সামান্য শরীর সঞ্চালনাদি দেখিলেই তীক্ষ্ন নখরাঘাতে তাহার পরিশেষ করিতেছে। বিড়ালটা যখন এইরূপে আপনার মধ্যাহ্ন-আহার সংগ্রহ করিয়া ক্ষীণপ্রাণ দুর্ব্বল কাঠবিড়ালের উপর বসিয়া আপনার দারুণ হিংস্র ও বন্য প্রকৃতির পূর্ণ পরিচয় দিতেছিল, দুই বৎসরের অবোধ শিশু সুরেশচন্দ্রের তখন ঘটনাক্রমে সেই দিকে দৃষ্টি পড়িল। অশান্ত বালক কাঠবিড়ালী লইবার জন্য অগ্রসর হইল। বালক জানে না, বিজয়ী বীর আপনার বিজয়াধিকার বিনা বাধায় পরিত্যাগ করিবে না। বালক যেমন সেই রক্তাক্ত কলেবর কাঠবিড়াল লইতে হস্ত প্রসারণ করিল, বিড়ালটী অমনই তাহাকেই আক্রমণ করিল। এই বিড়ালটীর সহিত সুরেশের বিলক্ষণ সদ্ভাব ছিল। সুরেশচন্দ্র আপনার আহারের কিয়দংশ প্রত্যহই বিড়ালটীকে উপহার দিত।
কিন্তু বিড়ালের আবার কৃতজ্ঞতা। সে তর্জ্জন গর্জ্জন করিয়া সুরেশকে আক্রমণ করিল। সুকুমার শিশু, দুঃ—দুঃ বলিয়া বিড়ালটাকে তাড়াইতে চেষ্টা করিল, কিন্তু বালকের কথার বিড়াল কর্ণপাত করিল না। বালকের চিরাভ্যস্ত দুঃ—দুঃ উপেক্ষা করিয়া সেই কোমল করপল্লব দুইখানি ক্ষত বিক্ষত করিল, বালকও সেই রক্তাক্ত হস্তেই সাধ্যমত বাধা দিতে ছিল। কিন্তু সাধারণ বালকের ন্যায় চীৎকার বা ক্রন্দন না করিয়া সুরেশচন্দ্র আপনার সঙ্কল্প ও কর্ত্তব্য সাধনে বিরত হয় নাই। সেই দারুণ নখর প্রহার অন্য বালকে সহ্য করিতে পারিত না। সুরেশচন্দ্রের জীবন যেরূপ সঙ্কটাপন্ন হইয়াছিল, তাহাতে আরও কিয়ৎক্ষণ সেইরূপ আঘাত প্রতিঘাত চলিলে যে কি ঘটিত, স্মরণ করিলেও আমাদের শরীর শিহরিয়া উঠে। যাহা হউক, সৌভাগ্যক্রমে একজন সেই সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়া বালকের জীবন রক্ষা করে। যে সুরেশচন্দ্রের শৌর্য্যবীর্য্যে আজ ভীরু কাপুরুষ বঙ্গবাসীর নাম স্বদেশে বিদেশে সম্মানিত, ভীষণ ধূমাচ্ছন্ন বজ্রনাদী কামানের ক্রীড়াস্থলে যিনি বিপুল বিক্রমে বিহার করিতেছেন, ঘটনাবশে একটী সামান্য বিড়ালের নখরাঘাতে তাঁহার জীবন অকালে ফুরাইতে গিয়াছিল। সুরেশচন্দ্র সেই দারুণ প্রহারে কয়েক মাস শয্যাগত ছিলেন। সময়ে সময়ে তাঁহার জীবনাশাও ছিল না, কিন্তু জননী ও জন্মভূমির সৌভাগ্যক্রমে বহুকষ্টে তিনি সুস্থ হইয়া ছিলেন।