লেফ্‌টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/বালকের প্রকৃতি

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।


বালকের প্রকৃতি।

 বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সুরেশচন্দ্রের শৈশবকৃতি পরিপুষ্ট ও পরিস্ফুট হইতে লাগিল। নিতান্ত শিশুকালের সেই অস্থিরতা ও নির্ভীকতা এখন সমধিক বিকশিত হইয়াছে। ইতিহাস পাঠকদিগের অবিদিত নাই, সুপ্রসিদ্ধ মহারাষ্ট্রীয় প্রভুত্ব স্থাপয়িতা শিবাজী, দাদাজীর মুখের দিকে সতৃষ্ণনয়নে অতুল আগ্রহভরে কি রূপে ভারতকথা শুনিতেন, এবং সেই অতুল বীরকাহিনী কি রূপে বালকের ভবিষ্য জীবন গঠিত করিয়াছিল। আমাদের সুরেশচন্দ্রও সেইরূপ বিবিধ বীরবিক্রম, দুর্গাধিকার, দেশবিজয় বা রণরঙ্গকাহিনী শুনিতে বড়ই ভাল বাসিতেন। বালক পুস্তক স্পর্শ করিবে না, শ্লেট ধরিবে না, কিন্তু মহাভারত বা রামায়ণের বীরত্ব ইতিহাস পরমাগ্রহে শ্রবণ করিবে। সুধু শ্রবণ নহে, অর্জ্জুনের অপূর্ব্ব বীরকীর্ত্তি, ভীষ্মের ভীষণ প্রতিজ্ঞা, রামচন্দ্রের দুর্জ্জয়শত্রু রাবণসংহার প্রভৃতি বালকের মর্ম্মে মর্ম্মে গাঁথা থাকিত। শত্রু সাগরের মধ্যে বিবিধ প্রতিকূল ঘটনায় যখন তাঁহাদের বীরত্ব কাহিনী শ্রবণ বা স্মরণ করিত, বালকের হৃদয় আনন্দে উথলিয়া উঠিত; চক্ষুতে অপূর্ব্ব জ্যোতি প্রকাশিত হইত। কেবল পৌরাণিকী বীরকাহিনী যে, সুরেশচন্দ্রের প্রীতিবিধান করিত তাহা নহে, কি স্বদেশের, কি বিদেশের প্রাচীন বা বর্ত্তমানকালের যে কোন বীরকীর্ত্তি শুনিতে তাঁহার অসীম আগ্রহ, অপার তৃপ্তি। আলেকজাণ্ডারের দিগ্বিজয়, লিওনিডাসের স্বদেশ রক্ষা, সিজার ও হানিবলের বীরবিক্রম, আলফ্রেড ও হেরাল্‌ড, ব্রুস ও ওয়ালেস, নেপোলিয়ন অথবা ওয়াসিংটনের শৌর্য্যবীর্য্য শ্রবণে বালকের হৃদয় নাচিয়া উঠিত।

 ইংরাজী শিক্ষা তখন ভারতে এতদূর প্রসারিত হয় নাই। এখন যেমন জেলায় জেলায় বহুসংখ্যক কলেজ স্কুল স্থাপিত হইয়াছে, তখন তাহা ছিল না। সমগ্র বঙ্গে তিনটী মাত্র উচ্চশিক্ষার স্থান ছিল; হুগলী কলেজ, হিন্দুকলেজ ও কৃষ্ণনগর কলেজ। সুতরাং এই সকল কলেজে নানা স্থান হইতে ছাত্রবৃন্দ আসিয়া বিদ্যাশিক্ষা করিত। বালক সুরেশচন্দ্র এই সকল কলেজের ছাত্রদিগের সহবাস বড় ভালবাসিতেন। তাহারা কলেজে কি শিক্ষা পাইল, সুরেশচন্দ্রের তাহা শুনিতে বা শিখিতে অভিলাষ নহে। সুরেশচন্দ্র তাহাদের অবসরমত অসীম আগ্রহতায় শুনিতে চায়, বীরকাহিনী। কি রূপে কোন্‌ দেশে কোন্‌ বীরপুরুষ অপূর্ব্ব বীরত্বে আপনার নাম চিরস্মরণীয় করিয়া রাখি য়াছেন।

 শিবাজীর ন্যায় সুরেশচন্দ্রেরও বালকের দল ছিল। তবে ইহাদের কার্য্য বাগানের ফলমূল লুণ্ঠন, পক্ষীশাবক সংগ্রহ এবং ইছামতী তীরে ‘বাঙালীর মৃগয়া’ ‘মাছধরা’। সহচর অনুচরদিগের মধ্যে সুরেশচন্দ্রের অসীম প্রভাব; তাঁহার তর্জ্জনী তাড়নে সকলে তটস্থ। এইরূপে বাল্যকালেও তিনি আপন সম্প্রদায়ের নেতা বা অধিনায়ক ছিলেন।

 বালকসুলভ ছুটাছুটি বা বিবিধ উপদ্রবে ক্লান্ত হইয়া পড়িলে সুরেশচন্দ্র বিজ্ঞের ন্যায় সতরঞ্চ লইয়া বসিতেন। হয়ত খেলিবার দ্বিতীয় ব্যক্তি নাই; কিন্তু আপনিই উভয় পক্ষের সতরঞ্চ বাহিনী সাজাইয়া স্বেচ্ছামত একটী জয় পরাজয়ের ব্যবস্থা করিয়া লইতেন। এইরূপে বাল্যের প্রতি সামান্য ঘটনাতেও তাঁহার ভবিষ্য জীবনের অনুকূল ছায়াপাত দেখিতে পাওয়া যায়।

 ছয় সাত বৎসরের বালক সতরঞ্চ খেলার যে বিশেষ কিছু বুঝিত তাহা নহে, তথাপি ঐতিহাসিক বা জীবনচরিত লেখকগণ এই সকল সামান্য ঘটনার মূলে যাহাই দেখুন না কেন, জনসাধারণ বুঝিত, সুরেশচন্দ্রের ন্যায় অশান্ত, অশিষ্ট, দুর্ব্বিনীত, দুষ্ট বালক বুঝি আর নাই। কিন্তু সুরেশচন্দ্রের মাতা এক দিনের জন্যও মনে করেন নাই, আমার সুরেশ প্রকৃত দুষ্ট বা অশিষ্ট। পুত্রের বিপদাশঙ্কায় তিনি সর্ব্বদাই সশঙ্ক ছিলেন বটে, কিন্তু একবারের জন্যও সুরেশকে নিতান্ত দুষ্ট স্বভাবের বলিয়া মনে করেন নাই। তিনি যে অন্তর্যামিনী।

 সতরঞ্চ খেলা সম্বন্ধে আমাদিগের দেশে একটী কৌতুহলজনক কিম্বদন্তী আছে। লঙ্কাধিপতি রাবণ দোর্দ্দণ্ডপ্রতাপ, দেবলোক তাঁহার দুর্ব্বার বিক্রমে সন্ত্রস্ত। স্বয়ং চণ্ডীদেবী রক্ষপুরীররক্ষয়িত্রী। এইরূপে দৈববলে বলী ও প্রচণ্ড পরাক্রম বিনা যুদ্ধে তাঁহার চিত্তের অবসাদ ঘটে; হৃদয়ে স্ফূর্ত্তি পাইতেন না। পতিব্রতা বুদ্ধিমতী মন্দোদরী স্বামীর অন্তরের গতি বুঝিয়া স্থির করিলেন, এমন একটী উপায় করিতে হইবে, যাজাতে স্বামীর সমরপিপাসা কথঞ্চিৎ নিবৃত্তি হয়। সেই চেষ্টার ফলেই সতরঞ্চ ক্রীড়া। এই চতুরঙ্গসেনাসমন্বিত সতরঞ্চ ক্রীড়ায় চিত্তবিনোদন আছে, কিন্তু অগণ্য পতি পুত্র হীনা রমণীর হৃদয়ভেদী রোদন রোল নাই। রক্ষরমণীর এই পরম হিতকর অনুষ্ঠান এক্ষণে কর্ম্মহীন বঙ্গবাসীর কর্ম্মসাধনা দাঁড়াইয়াছে।

 সে যাই হউক অল্প দিবসে গিরিশ বাবু কলিকাতায় একখানি বাড়ী ক্রয় করিয়া সপরিবারে কলিকাতায় আসেন। সুরেশচন্দ্রকে কলিকাতায় বিদ্যালয়ে ভর্ত্তি করিয়া দেন। কিন্তু মস্তিষ্ক পরিচালনা অপেক্ষা শরীর পরিচালনার দিকেই সুরেশ চন্দ্রের আন্তরিক অনুরাগ; কলিকাতায় অবস্থানকালে নানা লোকের নিকট বিবিধ বীরকাহিনী শুনিবারও বিলক্ষণ সুযোগ ঘটিয়াছিল। অন্তরের অন্তরতম কক্ষে সেই সকল বীরবিক্রম অঙ্কিত হইতে লাগিল। তখন ক্রীড়াস্থলে আপন সঙ্গী সেনা লইয়া সুরেশচন্দ্র মধ্যে মধ্যে সমরাভিনয় করিতে লাগিলেন। বালকেরা দল বাঁধিয়া বাহির হইয়া দুইদলে বিভক্ত হইত। বৃক্ষ বা কোন মৃত্তিকাস্তূপ তাহাদের দুর্গ হইত এবং সেই দুর্গাধিকার উপলক্ষে উভয় দলে সমরাভিনয় হইত। যেরূপ নেপোলিয়ন গোলার পরিবর্তে বরফখণ্ড লইয়া বাল্যখেলা খেলিতেন, আমাদের সুরেশচন্দ্রও তদ্রুপ এখানকার অনায়াস লব্ধ মৃত্তিকায় গোলায় সেই উদ্দেশ্য সাধন করিতেন।