লেফ্টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/সর্প ও সুরেশ
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
সর্প ও সুরেশ।
এইবার আমরা যে ঘটনার উল্লেখ করিতেছি, সহস্রের মধ্যে একজনও এরূপে আত্মরক্ষা করিতে পারে কি না সন্দেহ! বিশেষতঃ সেই একাদশ বৎসর মাত্র বয়সে তাহার সাহস ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের উদাহরণ নিতান্ত বিরল।
সুরেশ কলিকাতা হইতে স্বদেশে ফিরিয়াছেন। স্বদেশের মুক্ত বায়ুতে বিমুক্ত হৃদয়ে অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা মিটাইতেছেন। নগরের নির্জ্জীবতা বা বিলাসিতা বালকের হৃদয়ে প্রবেশ করে নাই। তিনি সেই বাল্যের সদা চঞ্চল, অসমসাহসী অকুতোভয় নাথপুরের সুরেশচন্দ্রই আছেন। একদিন পক্ষীয় অনুসন্ধানে বাহির হইয়া একটী আম্রবৃক্ষের উপর কতকগুলি পক্ষীর বাসায় সুরেশচন্দ্রের দৃষ্টি পড়িল। আর বিলম্ব কেন? সুরেশচন্দ্র বৃক্ষে উঠিলেন। বৃক্ষে উঠিবেন, তাহাতে আবার সাবধানতা বা ভয় কি? একমাত্রপতনের আশঙ্কা,—সুরেশচন্দ্রের হৃদয়ে তাহার স্থান নাই। এখন ত ১১ বৎসর বয়স হইয়াছে।
সুরেশচন্দ্র পক্ষী নীড়ের নিকট হস্ত প্রসারণ করিবেন, এমন সময়ে অদূরে কিঞ্চিৎ নিম্নে একটী বিকট শব্দ শুনিতে পাইলেন। শব্দানুসারে যাহা দেখিলেন, তাহাতে বালক কেন, যুবকের হৃদয়ও কল্পিত ও ভীত হইয়া পড়ে। সুরেশচন্দ্র দেখিলেন, একটী প্রকাণ্ড সর্প বৃক্ষ কোটর হইতে বাহির হইয়া গর্জ্জন করিতে করিতে তাঁহার দিকে অগ্রসর হইতেছে। সর্প একবার ফুলিতেছে, আর স্থির দৃষ্টিতে তাঁহার দিকে লক্ষ্য রাখিয়াছে। তাহার চক্ষু দুইটী যেন জ্বলিতেছে। সুরেশচন্দ্র দেখিলেন, নামিবার উপায় নাই, নামিতে হইলে তাহার মুখ অতিক্রম না করিয়া অবতরণ করিবার উপায় নাই। অন্য কেহ হইলে সেই অভাবনীয় বিষম বিপদ্পাতে বিহ্বল বা মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িত। সুরেশচন্দ্র সে উপকরণে গঠিত নহেন। ক্ষণেকের মধ্যে তিনি কর্ত্তব্য স্থির করিয়া লইলেন। সে স্থান হইতে লম্ফ প্রদান করিলে জীবন সমধিক বিপন্ন হইবার সম্ভাবনা, তাহাও বুঝিতে বাকি রহিল না। সুরেশচন্দ্র অবিলম্বে শাখান্তরে সর্প হইতে একটু দূরে সরিয়া গেলেন। কিন্তু নামিবার উপায় নাই। এদিকে সর্পটী দেখিল, শিকার সরিয়া যায়। গর্জ্জন করিতে করিতে তীরবেগে সুরেশচন্দ্রের উপর আক্রমণ করিল। সৌভাগ্যক্রমে সেই লক্ষ্য ব্যর্থ হইল; নিকটবর্ত্তী একটি প্রশাখায় তাহার প্রতিরোধ ঘটিল। নিমেষের মধ্যে সুরেশচন্দ্র বুঝিলেন, জীবন রক্ষার অন্য উপায় নাই; ভয়বিহ্বল হইয়া প্রাণ হারাইলে কি হইবে! নিমেষের মধ্যে কর্ত্তব্য স্থির করিয়া প্রথম লক্ষ্য হইতে ফণা তুলিবার পূর্ব্বেই, একাদশ বৎসরের বালক বামহস্তে দৃঢ় মুষ্টিতে উহার ফণা ধরিল। বিপদ বুঝিয়া বল বুদ্ধিও যেন পরিবর্দ্ধিত হইল। সর্প তখন ফুলিতে ফুলিতে বজ্রপাশে বালকের হস্ত বেষ্টন করিতে লাগিল। সুরেশচন্দ্র তাহাতে ভীত রা কাতর নহেন। বিশেষ সৌভাগ্যক্রমে সঙ্গে একখানি তীক্ষ্ণধার চুরি ছিল। নিমেষ মধ্যে দক্ষিণ হতে ছুরিকা ধরিয়া দন্ত দ্বারা উহা খুলিয়া ফেলিলেন। নিমেষ মধ্যে সেই ছুরিকা আপনার দৃঢ়বদ্ধ মুষ্টি নিয়ে সর্পের গ্রীবাদেশে বসাইয়া দিলেন। নিমেষ মধ্যে উহা দ্বিখণ্ডিত করিয়া ভূমিতে নিক্ষেপ করিলেন। এইরূপে অসীম সাহসে তুল্য কার্যতৎপরতায় একাদশ বৎসরের বালক আসন্ন মৃত্যুমুখ হইতে অব্যাহতি লাভ করিল।
শত্রু নিপাত হইল। সুরেশচন্দ্র এইবার আপনার অতীত সাধনে অগ্রসর। এইরূপে আত্মরক্ষা করা হয়ে অসাধ্য এবং এ কেহ হইলে আর কালবিলম্ব না করিয়া গৃহাভিমূখে ফিরিত, কিন্তু সুরেশচন্দ্রের তখন ভয়ের কারণ গিয়াছে, সুতরাং সঙ্কল্প সাধন কেনই বা অবশিষ্ট থাকে; তখন তিনি পক্ষীশারয়িতে প্রবৃত্ত হইলেন। দুইটা সুন্দর পক্ষীশাবক সংগ্রহ করিয়া বৃক্ষ হইতে অবতরণ করলেন এবং সেই আপনার অপূর্ব বিজয় নিশান, মনে কর্তিত মুখ সেই সর্পটীকেও সঙ্গে লইয়া গৃহে প্রত্যাবৃত্ত হইলেন। সুরেশচন্দ্রের পিতা মাতা ও আত্মীয় মণ্ডলী সেই বিজয় অপূর্ব ধন সম্পত্তি দেখিয়া এনে শিহরিয়া উঠিলেন, গয়ে আদ্যোপান্ত সমূহ অনিয়া বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইলেন। পিতা মাতার প্রানে তখন যেরূপ হর্ষ বিষাদ ও বিস্ময়ের ভর উঠিয়াছিল, তাহার বর্ণনা নির্জীব লেখনী মুখের সাধ্যাতীত।