লেফ্‌টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/আর এক বিপদ



অষ্টম পরিচ্ছেদ।

আর এক বিপদ

 বঙ্গে অস্ত্র আইনের কল্যাণে ভারতবাসী যা ভারতগবর্ণমেণ্টের যতদূর উপকার হউক আর নাই হউক, ইংরাজ রাজ্যে শৃগাল কুক্কুরাদির কিছু প্রতাপ প্রাদুর্ভাব ঘটিয়াছে। এক একটী ক্ষিপ্ত শৃগাল বা কুকুর অন্ততঃ ১০।১২টী প্রাণী সংহার না করিয়া মারা পড়ে না। এবং তাহার বিক্রমে কিয়ৎকাল গ্রামের লোক সদাই সশঙ্ক থাকে। এইরূপ বিপদ্‌পাতে গবর্ণমেণ্টের সাহায্য প্রার্থনাও লজ্জার বিষয় এবং সাহায্য প্রার্থনায় হয়ত অনেকে সাহসী হয় না এবং সাহায্য প্রার্থনা করিলেও স্থান বিশেষে প্রার্থনা পূরণের পূর্ব্বেই কতকগুলি প্রাণীকে অকালে শৃগাল কুকুরের মুখে জীবন হারাইতে হয়।

 সুরেশচন্দ্র নাথপুরের বাটী গিয়াছেন। গ্রামে ক্ষিপ্ত কুকুর ভয়ে লোকে সদাই শঙ্কিত, কখন কাহার ভাগ্যে কি দুর্ঘটনা ঘটে। তখন পাস্তূর প্রণালী প্রচলিত হয় নাই এবং দরিদ্র নাথপুরবাসিগণের এরূপ অবস্থা ছিল না যে, বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার জন্য প্যারিস পর্যন্ত যাইয়া পাস্তূরের প্রস্তুত ঔষধাদি সেবন করে। সুতরাং ভগবানের নাম করিয়া সামান্য দেশীয় প্রলেপাদর উপরই নির্ভর করিতে হইত। সে যাহা হউক, শৃগাল কুকুরের ভয়ে বাটি আসিয়া গৃহকোণে বসিয়া থাকা সুরেশ চন্দ্রের পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু বিষমভয়ে সঙ্গীসহচরগণও সর্ব্বদা সঙ্গে থাকিত না। সুরেশচন্দ্রকে একাকী সন্ধ্যা সমীরণ সেবন করিতে যাইতে হইত। গ্রামের প্রান্তভাগের একটী পথ ধরিয়া চলিতেছেন, এমন সময়ে একটী ক্ষিপ্ত কুকুর তাঁহার দিকে দৌড়াইয়া আসিতেছে দেখিলেন। তিনি একাকী, হস্তে ধষ্টি পর্য্যন্ত নাই, নিকটে লোকালয় নাই। এমন কি বৃক্ষ পর্য্যন্ত নাই। সুরেশচন্দ্র অগত্যা সেই পথ ধরিয়া ধূলি উড়াইয়া দৌড়িতে আরম্ভ করিলেন। কুকুরও দ্রুতবেগে তাঁহার অনুসরণ করিল। মধ্যে মধ্যে পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখেন, কুকুরটী জিহ্বা বাহির করিয়া লক্‌ লক্‌ করিতে করিতে তাঁহাকেই লক্ষ্য করিতেছে। তিনিও ছুটেন, কুকুরও ক্রমশঃ তাহার অনুসরণে নিকটবর্ত্তী হইয়া আসিল। ছুটিতে ছুটিতে বালক ক্লান্ত হইয়া পড়িল; আর দৌড়াইতে পারে না। এইবার কুকুরের মুখে পড়িতে হইল; আর অব্যাহতি নাই। কিন্তু প্রত্যুৎপন্নমতি সুরেশচন্দ্র সেই দারুণ বিপদ্‌কালেও ভয়বিহ্বল না হইয়া মুহূর্ত্ত মধ্যে আপনার কর্ত্তব্য স্থির করিয়া লইলেন। সুরেশচন্দ্র আর দৌড়াইতে পারিলেন না, কুকুরটী আসিয়া পড়িল, আর দুই চারিপদ মাত্র অগ্রসরহইয়া আসিলেই তীক্ষ্ন দশন নখরে বালকের সুকুমার শরীর ক্ষত বিক্ষত করে। সুরেশচন্দ্র কলিকাতা অবস্থান কালে “জোড়া পায়ে লাথি’’ অভ্যাস করিয়াছিলেন। সেই সময়ে কিছুদিন কলিকাতায় উহার বড়ই প্রচলন হয়। সুরেশচন্দ্র সহসা দাঁড়াইলেন এবং কাল বিলম্ব না করিয়া পূর্ণ শক্তিতে কুকুরটীকে জুতাশুদ্ধ ‘‘জোড়া পায়ের লাথি’’ মারিলেন। বিষম বেগে আসিতে আসিতে আকস্মিক প্রহারে কুকুরটী পথিপার্শ্বস্থ নালায় গড়াইয়া পড়িল। সুরেশচন্দ্র ইত্যবসরে একখানি ইষ্টক সংগ্রহ করিয়া কুকুরটী উঠিতে না উঠিতে উহার মস্তকে প্রহার করিলেন। সেই অব্যর্থ সন্ধানেই কুকুটীকে আর মাথা তুলিতে হইল না, পথি পার্শ্বস্থ সেই নালায় গড়াইতে গড়াইতে সে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল। এইরূপে একাদশবর্ষীয় বালকের দ্বারা নাথপুর গ্রামের সাময়িক শঙ্কা বিদূরিত হইল। সেই সঙ্কটকালে একাদশবর্ষ মাত্র বয়সে যিনি নাথপুরের একটী বিষম আশঙ্কা বিদূয়িত করেন, পরিণত বয়সে তাহার দ্বারা যে নাথপুরের গৌরব সমধিক বর্দ্ধিত হইবে তাহাতে আর সন্দেহ নাই।