লেফ্টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/শিকার ও সুরেশ
নবম পরিচ্ছেদ।
শিকার ও সুরেশ।
শিকারের ন্যায় প্রিয় বিষয় ইংরাজের নিকট আর কিছুই নাই। শিকারে ইংরাজ জাতি সময় সময় প্রভূত অর্থ ব্যয় করিয়া থাকেন। ইংরাজদের দেশে যেরূপ শিকার প্রচলিত, ভারতবর্ষে তাহা নাই, কারণ ভারতের সহিত ইংলণ্ডের অনেক পার্থক্য। ইংলণ্ডে যখনই শিকারের আয়োজন হয় তখনই বহতর কুকুরকে সেই দলের একটী প্রধান অঙ্গরূপে দেখিতে পাওয়া যায়। শিকারীগণও সকলে তেজস্বী অশ্বে আরোহণ করিয়া বিস্তৃত প্রাঙ্গণে প্রবিষ্ট হয়েন। কেবল পক্ষী শিকারের সময় তাঁহারা অশ্ব বা কুকুর ব্যবহার না করিয়া সকলে কেবলমাত্র এক একটী বন্ধুক সঙ্গে করিয়া শিকারে রওনা হয়েন। ভারত বর্ষে ইংরাজগণ শিকারে বহির্গত হইলে সাধারণতঃ হস্তিপৃষ্ঠে গভীর জঙ্গলে প্রবিষ্ট হইয়া থাকেন। সঙ্গে অসংখ্য লোক যায়, ইহারা জঙ্গলের একদিকে থাকিয়া বন্যজন্তুদিগকে তাড়াইতে থাকে, সাহেবেরা হস্তিপৃষ্ঠে এক একস্থানে দণ্ডায়মান রহেন। বন্যজন্তুগণ তাড়া পাইয়া সেইদিকে ছুটিয়া আসিলে গুলি করিতে থাকেন। ইংলণ্ডে হিংস্রজন্তু এক্ষণে একেবারে নাই; ভারতবর্ষের জঙ্গল সকল বরাহ, বন্যমহিষ, নেকড়েবাঘ, ভল্লুক, ব্যাঘ্র, হস্তিতে পূর্ণ। এ দেশে যেখানে বন্যপশু একেবারে নাই, কেবল সেইখানেই ইংরাজগণ পদব্রজে শিকারে যাইয়া থাকেন। তবে দেশীয় শিকারীগণ হস্তী প্রভৃতি কোথায় পাইবে, তাহারা তীর ধনুক বা বন্দুক লইয়া অবাধে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করিয়া থাকে; তাহাদের প্রাণে বন্যজন্তুর ভয় একবারেই নাই। জঙ্গলই তাহাদের ঘর বাড়ী, জঙ্গলের পশুই তাহাদের জীবিকা। জলে স্থলে, রাত দিনে, সর্ব্বদা তাহারা নানা প্রকার বিপদে বেষ্টিত, কিন্তু তাহারা এ সকলের প্রতি বিন্দুমাত্রও দৃষ্টিপাত করে না। বন্যপশুচর্ম্ম, বনজাত নানা দ্রব্য, তাহারা গভীর বনে সংগ্রহ করিয়া নিকটস্থ সহরে আনিয়া বিক্রয় করিয়া জীবিকা নির্ব্বাহ করিয়া থাকে, সময় সময় কেহ কেহ বাঙ্গালিজাতিকে যে কাপুরুষ আখ্যা দিয়া থাকেন, সত্যই এই সকল লোককে কখনই সে আখ্যায় আখ্যায়িত করা যাইতে পারে না।
আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, সে সময়ে নদীয়া জেলার স্থানে স্থানে নীলকুঠি থাকায় অনেক ইংরেজ এই জেলায় বাস করিতেন। ইহাঁরা প্রায়ই অশ্বপৃষ্ঠে বিস্তৃত ময়দানে ও কৃষকদিগের শস্যশূন্য ক্ষেত্রে বরাহ, শৃগাল প্রভৃতি শিকার করিবার জন্য স্বদেশের ন্যায় বহু সংখ্যক কুক্কুর সমভিব্যাহারে শিকারে আসিতেন। ইহাঁদের সকলের হস্তেই এক একটী বড় বড় বর্ষা রহিত, বরাহ বা শৃগাল ইহাদের কুক্কুর কর্ত্তৃক তাড়িত হইয়া দীর্ঘ ঘাস বা ক্ষুদ্র ঝোপ হইতে নির্গত হইলে ইহাঁরা বর্ষা হস্তে অশ্বপৃষ্ঠে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিতে থাকিতেন। সুবিধা পাইলেই কেহ না কেহ বর্ষাদ্বারা হতভাগ্য বরাহকে বিদ্ধ করিয়া ফেলিতেন। এরূপ শিকার এখনও ইংরাজগণ সময় সময় করিয়া থাকেন। এদেশ হইতে বহু দূরে বিদেশে ভিন্ন জাতিদিগের মধ্যে নির্ব্বাষিতরূপে বাস করিয়া ইহারা সময় সময় এইরূপ শিকারে কালযাপন করিয়া কতকটা নির্ব্বাষণের ক্লেশ অপনোদন করিয়া থাকেন।
যখন সুরেশ নাগপুরে বাস করিতেছিলেন, সেই সময়ে এক দিন তিন জন সাহেব গ্রামের নিকট শিকারার্থে অশ্বারোহণে আসিলেন। সঙ্গে অসংখ্য কুক্কুর, উহারা একটা অতি হিংস্র বৃহৎ বন্য বরাহের পশ্চাৎ ধাবিত হইয়াছে। বরাহ প্রাণভয়ে ইতস্ততঃ পলাইতেছে; শিকারীগণ কোনমতেই তাহাকে বর্ষা বিদ্ধ করিতে পারিতেছেন না। প্রায় সন্ধ্যা হয়, শিকারীগণ হতাশ হইয়া অদ্যকার জন্য শিকার পরিত্যাগ করিয়া গৃহে প্রত্যাগমনের অভিপ্রায় করিতেছেন, এমন সময়ে তাঁহাদের দৃষ্টি নিকটস্থ বাঁশঝোপের মধ্যে বরাহের প্রতি পতিত হইল। অমনি বন্দুকের আওয়াজে চারিদিক প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল, কুকুরগণ ডাকিয়া উঠিল, চারিদিকে যেন এক ঘোর আলোড়ন উপস্থিত হইল। কিন্তু বরাহ আহত হইল না, তবে বন্দুকের শব্দে সে ভীত হইয়া বাঁশঝোপ পরিত্যাগ করিয়া ছুটিল। সম্মুখে বিস্তৃত মাঠ, ভীত ও বিপন্ন বরাহ এক্ষণে সেই মাঠ দিয়া প্রাণপণে ছুটিয়া চলিল; শিকারীগণও সঙ্গে সঙ্গে অশ্বপৃষ্ঠে ছুটিলেন, বরাহের পশ্চাতে কুকুরগণ মহা চীৎকার করিতে করিতে ধাবিত হইল।
যেদিকে বরাহ ছুটিয়াছে, সেইদিক হইতে এমত সময়ে তিনটী বালক গ্রামের দিকে আসিতেছিল, ইহাদের একটী সুরেশ। বালকগণ মাছ ধরিতে গ্রাম হইতে দূরবর্ত্তী স্থানে
গিয়াছিল, এক্ষণে ছিপ স্কন্ধে গৃহে ফিরিতেছিল। হটাৎ নিকটে বন্দুকের শব্দ শুনিয়া বালকগণ বালসুলভ কৌতুহলের বশবর্ত্তী হইয়া সেইদিকে ছুটিয়া আসিল। সাহেবেরা তাহাদিগকে দেখিলেন, ক্রোধান্ধ বরাহ যে এখনই তাহাদের খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিবে তাহা তাঁহারা বুঝিলেন। তাঁহারা হস্ত নাড়িয়া, চীৎকার করিয়া তাহাদিগকে পলাইতে বলিতে লাগিলেন, কিন্তু বালকগণ তাঁঁহারা কি বলিতেছেন বুঝিতে পারিল না। প্রথমে বরাহের প্রতি সুরেশেরই দৃষ্টি পড়িল। তিনি তখন তাঁহাদের বিপদ বুঝিলেন, কিন্তু ভয় কখনও সুরেশের হৃদয়ে স্থান পাইত না। এক্ষণে উন্মত্ত বরাহ দেখিয়া ভয় পাওয়া দূরে থাকুক, সুরেশের হৃদয় আনন্দে আপ্লুত হইল। তিনি যে বরাহ শিকার দেখিতে পাইবেন ইহা ভাবিয়া আনন্দে বিভোর হইলেন, তিনি পলাইবেন না, তাঁহার হৃদয়ে ভয় নাই, তবে তিনি সঙ্গীদ্বয়কে পলাইতে বলিয়া নিজে ছিপছস্তে বরাহের দিকে অগ্রসর হইলেন। দেখিতে দেখিতে মুখে গ্যাঁজলা তুলিতে তুলিতে ভীষণশব্দ করিতে করিতে বরাহ সুরেশের নিকটস্থ হইল। বরাহের পশ্চাতেই কুকুরগণ, তৎপশ্চাতেই সাহেবগণ বন্দুকহস্তে প্রস্তুত। তাঁহারা তখনও সুরেশকে পলাইতে চীৎকার করিয়া অনুরোধ করিতেছেন; পাছে গুলি সুরেশের গায় লাগে এই ভয়ে তাঁহারা বন্দুক ছুড়িতে পারিতেছেন না। অথচ বালককে রক্ষা করিবারও আর উপায় নাই, বরাহ আসিয়া সুরেশের উপর পড়িল। তাহার মুখ হইতে নির্গত গ্যাঁজলায় সুরেশের সর্ব্বাঙ্গ আপ্লুত হইল; তাহার চক্ষু হইতে বালকের প্রতি যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতে লাগিল; সে তাহার প্রথম দন্তে বালকের দেহ খণ্ড খণ্ড করিবার জন্য মস্তক অবনত করিল; আর এক মুহুর্ত্ত। সেই এক মূহুর্ত্তে কেবল একজনের নহে, শত সহস্র লোকের অদৃষ্ট-লিখনি স্থির হইয়া গেল। এই বালকের মৃত্যু বা জীবনের সহিত সহস্র লোকের জীবন সংমিশ্রিত ছিল। সুরেশও সেই সময়ে বুঝিলেন যে আর এক মূহুর্ত্তের মধ্যে তাঁহার জীবন নাট্টের শেষ মীমাংসা হইয়া যাইবে, কিন্তু তাহাতে তাঁহার প্রাণ টলিল না, তিনি ভীত হইলেন না, বরং হৃদয়ে একরূপ অনির্ব্বচনীয় আনন্দ উপলব্ধি করিতে লাগিলেন।
পর মুহুর্ত্তে সুরেশ হস্তস্থ বংশ নির্ম্মিত ছিপ দ্বারা বরাহের মস্তকে সবলে আঘাত করিলেন, বরাহ সেই গুরুতর আঘাতে স্তম্ভিত হইয়া উল্টাইয়া পড়িল। সে পুনরায় উঠিবায় পূর্ব্বেই কুকুরগণ আসিয়া তাহাকে চারিদিক হইতে বেষ্টন করিয়া দংশনে দংশনে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিল। একদিকে কুকুরকে আক্রমণ করিতে গেলে, আর তিনদিক হইতে কুকুরগণ তাহাকে দংশন করিতে থাকে। এদিকে সুরেশও ছিপদ্বারা বৃষ্টিধারার ন্যায় ক্রমাগত বরাহকে প্রহার করিতেছেন,—বরাহ প্রকৃতই নিতান্ত বিপন্ন হইয়া পড়িয়াছে। পলাইতে প্রাণপণে চেষ্টা করিয়াও সে কোনমতে পলাইতে পারিতেছে না। এদিকে সাহেবেরাও আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এক্ষণে গুলি চালাইবার আর উপায় নাই,—বন্দুক ছুড়িলে কুকুরের গায় লাগে। বরাহের অঙ্গের এমন স্থান নাই যেখানে একটা না একটা কুকুর কামড়াইয়া আছে, কাজেই সাহেবগণ বন্দুকের অপর পৃষ্ঠ দিয়া বরাহকে ক্রমাগত প্রহার করিতে লাগিলেন; এইরূপ প্রহারে অনতিবিলম্বে বরাহ পঞ্চত্ব লাভ করিল।
বরাহ বধ হইলে সাহেবেরা এই বীর বালকের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন। তাঁহারা বাঙ্গালীর মধ্যে এরূপ বালক এপর্য্যন্ত দেখেন নাই;—তাঁহারা বালকের সাহসে ও প্রত্যুৎপন্নমতিতে বিশেষ প্রীত হইয়াছিলেন,—তাঁহারা সুরেশকে বেষ্টন করিয়া দাঁড়াইলেন এবং ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাঙ্গালায় তাঁহার নাম ধাম জিজ্ঞাসা করিলেন। রাত্রি হইয়া গিয়াছে, সুরেশের সঙ্গীগণ পলাইয়াছে, তাহাদের সঙ্গীর কি হইল তাহা তাহারা দেখে নাই,—সুরেশ যেমন তাহাদিগকে পলাইতে বলিয়াছিলেন, তাহারা তেমনই পলাইয়াছিল, এক মুহুর্ত্তও অপেক্ষা করে নাই। রাত্রি হইয়াছে, চারিদিক অন্ধকারে ঘেরিয়াছে, পাড়াগাঁয়ের মাঠ,—রাস্তা নাই,—এরূপ অবস্থায় গ্রাম পর্য্যন্ত পৌঁছান সহজ নহে। সাহেবেরা সুরেশকে তাঁহাদের সঙ্গে কুঠিতে যাইতে অনুরোধ করিতে লাগিলেন।
সুরেশ নাম ধাম বলিলে, একজন সাহেব তাহা নিজ নোটবুকে লিখিয়া লইলেন। নিজেরা সাহসী,—ইংরাজজাতির ন্যায় সাহসের আদর করিতে আর কেহ পারে না। যাহাতে বীরত্ব, যাহাতে তেজ, যাহাতে সৎসাহস,—ইংরাজগণ তাহাকেই প্রাণের সহিত ভালবাসেন, মান্যভক্তি করেন,—স্বভাবতই তাঁহাদের প্রাণ তাহার প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাঁহারা নীচতা, হীনতা, দুর্ব্বলতা, তোষামোদকারিতা প্রভৃতিকে হৃদয়ের সহিত ঘৃণা করেন; ভারতবাসীকে যে তাঁহারা ঘৃণা করেন, তাহার কারণ ভারতবাসী হীন, নীচ, দুর্ব্বল তোষামোদকারী।
যেখানে এই ব্যাপার ঘটিয়াছিল, সেখান হইতে নাথপুর প্রায় একক্রোশ। অন্ধকার হইয়াছে, সুরেশ শিকারীগণকে পরিত্যাগ করিয়া যতশীঘ্র হয় গ্রামাভিমুখে গমনের চেষ্টা করিলেন,—কিন্তু সাহেবেরা কিছুতেই ছাড়েন না। একজন বলিলেন, “তুমি আমাদের সঙ্গে কুঠিতে চল। আজ রাত্রে সেখানে থাকিয়া কাল সকালে বাড়ী আসিও।”
সুরেশ উত্তর করিলেন, “আমার মা ও খুড়ো মশায় কি ভাবিবেন? আমি রাত্রে বাড়ী না ফিরিলে তাঁহারা পাগল হইবেন।’’
সাহেব। সে জন্য কোন চিন্তা নাই। তাঁহারা যাহাতে খবর পান, তাহা আমরা করিব। তোমার আত্মীয়েরা যাহাতে ভাবিত না হন সে বিষয়ে আমরা দৃষ্টি রাখিব।
সুরেশ। আমার ক্ষুধা পাইয়াছে। আপনাদের বাড়ী খেলে আমার জাত যাবে।
সাহেবেরা হাসিয়া উঠিলেন,—বলিলেন, “বালক, তোমার জাতের এত ভাবনা? জাতের বিষয় তুমি কি জান?’’
সুরেশ উত্তর করিলেন, “বোধ হয় জাতের বিষয় বেশী কিছু আমি বুঝি না, তবে সাহেবের বাড়ী খেলে যে জাত যায়, তাহা আমি জানি।”
সাহেব। তুমি এই নাথপুরেই সব সময় বাস কর?
সুরেশ। না, আমি সচরাচর কলিকাতায় বাস করি, আমি ভবানীপুরের লণ্ডন মিশন কলেজে পড়ি।
সাহেব। ওঃ তবেত তুমি অর্দ্ধেক খ্রীষ্টান। খ্রীষ্টানদের সঙ্গে যাহারা মিশে, তাহারা খ্রীষ্টান না হলেও পিরিলি হয়।
আমি তা স্বীকার করি না। আমি খ্রীষ্টানের ছোঁয়া জল খাই না, এমন কি পানও খাই না।
সাহেব। তুমি তাহাদের সঙ্গে এক সঙ্গে উঠাবসা কর, তুমি তাদের ছুঁয়ে থাক, তার পর না স্নান করেই জল খাও। স্কুলে তুমি কখন ত স্নান কর্ত্তে পার না।’’
এ কথার জবাব সুরেশ করিতে পারিলেন না,— তিনি সাহেবদের সঙ্গে যাইতে স্বীকার করিলেন। ঠিক এমন সময়ে সেই দিকে অনেক আলো আসিতেছে দেখা গেল। সুরেশের সঙ্গীদিগের নিকট তাঁহার বিপদের কথা শুনিয়া তাঁহার আত্মীয় স্বজনগণ আলো লইয়া সুরেশকে খুঁজিতে সেই দিকে আসিতেছিলেন। অপরদিক হইতে সাহেবদিগের চাকর ও লোকজনেরাও আলো লইয়া সাহেবদিগকে খুঁজিতে আসিতেছিল, কাজেই সুরেশের কুঠিতে যাওয়া হইল না, তবে তিনি পরদিনই যাইবেন স্বীকার করায় সাহেবেরা তাঁহাকে ছাড়িয়া কুঠি চলিয়া গেলেন।