লেফ্টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/মেমসাহেব ও পদ্ম
দশম পরিচ্ছেদ
মেমসাহেব ও পদ্ম।
বরাহ শিকার ঘটনা সুরেশের জীবনের একটা শুভ ব্যাপার। কারণ সেই দিন হইতে সুরেশ নাথপুরের নিকটস্থ ইংরাজসমাজে প্রবিষ্ট হইতে সক্ষম হইলেন। সে সময়ের ইংরেগণ যে দেশীয়দিগের সহিত মেশামিশি করিতে ইচ্ছা করিতেন না, এ রূপ নহে, বরং দেশীয়গণই ইংরাজদিগের সহিত মেশামিশি করিতে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক হইতেন। তখন হিন্দুয়ানীর প্রতাপ এখন হইতে অনেক গুণ অধিক ছিল, সুতরাং ম্লেচ্ছ সাহেব দিগের প্রতি লোকের কেমন একটা হৃদরের বিতৃষ্ণা ছিল। তখনকার নীলকুঠিয়াল সাহেবগণ তাঁহাদের নিজের কাজ ও ব্যবসার জন্য দেশীয়দিগের সহিত মিশিয়া দেশীয়দিগের সামাজিক আচার ব্যবহার সকল সর্ব্বদাই বিশিষ্টরূপে বিদিত হইতে পারিতেন, কিন্তু তাহাতেও তাঁহারা কখনও দেশীয়গণের সহিত মেশামিশি করিতে পারিতেন না। উভয়ের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য বিরাজ করিত।
বরাহ শিকার দিবস হইতে সুরেশ প্রয় মধ্যে মধ্যে নাথপুরের নিকটস্থ নীলকুঠিতে গমনাগমন করিতেন। সাহেব মেমগণ সকলেই তাঁহাকে বড় ভাল বাসিতেন; কুঠির দেশীয় কর্ম্মচারিগণেরও তিনি বড় প্রিয় হইলেন। সকলেই তাঁহাকে বিশেষ যত্ন আদর অভ্যর্থনা করিতে লাগিলেন। তাঁহার সরলভাব, তাঁহার নির্ভরতা, নীচ ও হীন বিষয়মাত্রেই তাঁহার ঘৃণা,পরোপকারে সর্ব্বদাই তাঁহার তৎপরতা, এই সকল গুণে সুরেশ দেখিতে দেখিতে নীলকুঠির সকলেরই একান্ত প্রিয় হইয়া উঠিলেন। তিনি এক দিন কুটিতে না আসিলে সাহেব মেমগণ সকলেই কেবল যে দুঃখিত হইতেন এমন নহে, সকলেই তাঁহার জন্য উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত হইতেন।
যে সময়ের কথা আমরা বলিতেছি, সে সময়ে নীলকুঠির সাহেবেরা প্রায়ই মেম লইয়া বাস করিতেন না। মেমরা দূর ইংলণ্ডে স্বামী বিহনে বিরহে দুঃখে কালাতিপাত করিতেন; সাহেবগণ সহস্র সহস্র ক্রোশ দূরে ম্যালেরিয়া প্রপীড়িত বঙ্গ দেশের গ্রামে দেশীয় কৃষক বেষ্টিত হইয়া নীলের চাষ করিতেন; সে সময়ে বিলাত হইতে মেম অনিবার সুবিধা ছিল না। আনিলেও রাখিবার সুবিধা হইত না। এই জন্য আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, সে সময়ে এ দেশে নীলকুঠিতে মেম প্রায় দেখিতে পাওয়া যাইত না।
তবে নাথপুর কুঠির সাহেবের মেম এ দেশে ছিলেন, তিনি বালক সুরেশকে দেখিয়া পর্য্যন্ত তাঁহাকে বড়ই ভালবাসিতে লাগিলেন। কয়েক দিনের মধ্যে সুরেশকে তিনি পুত্রনির্ব্বিশেষে ভালবাসিলেন; কারণ তাঁহার নিজের পুত্রও ঠিক সুরেশের এক বয়সী ছিলেন। তাঁহার সে পুত্রকে তিনি নিকটে রাখিতে পারেন নাই; সে বালক দূর বিলাতে লেখাপড়া করিতেছিলেন। সুরেশের ইংরাজ-প্রকৃতি-সুলত অনেক গুণ দেখিয়া মেমসাহেব তাঁহাকে নিজ পুত্রের ন্যায় ভালবাসিতেন। সুরেশও বড় আনন্দে ও সুখে নাথপুরে কালকাটাইতে লাগিলেন। সাহেব ও মেমসাহেবের নিকট সদা সর্ব্বদা থাকিয়া সুরেশ বেশ ইংরাজী বলিতে শিখিলেন; যদিও তাঁহার এখনও ইংরাজীভাষায় বিশেষ দখল জন্মে নাই, তবুও বোধ হয় সুরেশ যে রূপ সে সময়ে ইংরাজী বলিতেন, সুরেশের সমবয়সী বাঙ্গালীর ছেলে কেহ তেমন ইংরাজী বলিতে পারিতেন না।
এক দিন বৈকালে সুরেশ মেমসাহেবের সহিত একখানা টম্টম্ গাড়ী চড়িয়া বেড়াইতে বহির্গত হইলেন। মেমসাহেব প্রায়ই সুরেশকে সঙ্গে লইয়া এইরূপ বেড়াইতে যাইতেন। বিস্তৃত নীল’খেতের মধ্য দিয়া বাঁধা রাস্তা, মেমসাহেব এই রাস্তায় উপর দিয়া গাড়ী করিয়া বেড়াইতেন, সুরেশ প্রায়ই সঙ্গে থাকিতেন। মেমসাহেব তাঁহাকে নানা জ্ঞানোপদেশ দিতে থাকিতেন; সুরেশও মেমসাহেবকে এ দেশের নানা গাছ, লতা, পাখীয় নাম ও তাহাদের সম্বন্ধীয় নানা কথা বলিতেন। এই রূপ নানা কথা কহিতে কহিতে তাঁহারা এক এক দিন এক এক দিকে বেড়াইতে যাইতেন। আর মেমসাহেবের গাড়ী একটা অতি প্রাচীন পুষ্করিণীর তীরে আসিয়া দাঁড়াইল। বহু শতাব্দী পূর্ব্বে বোধ হয় কোন সদাশয় ধনাঢ্য ব্যক্তি গ্রামের লোকের জলকষ্ট নিবারণের জন্য এই সুন্দর পুষ্করিণী খনন করিছিলেন। এক্ষণে অযত্নে ইহার আর পূর্ব শোভা নাই, জলও আর বড় পরিষ্কার নাই, পুষ্করিণী প্রায় সেওলা ও জঙ্গলে পুর্ণ হইয়াছে, তবে ইহা বক্ষ অতি সুন্দর ও অতি বৃহৎ পদ্মরাজিতে পূর্ণ। বোধ হয় এমন মনমুগ্ধকর পদ্ম আর কোন পুষ্করিণীতে কখনও ফুটিত না।
প্রায় সন্ধ্যা হয়। অস্তমিত সূর্য্যের সুবর্ণ কিরণ মেমসাহেবের বদনে পতিত হইয়া এক অপরূপ সৌন্দর্য্যের আবির্ভাব করিয়াছে। সেই সূর্যের কিরণ বৃক্ষপত্রে পতিত হইয়া চারিদিক সুবর্ণে রঞ্জিত করিয়াছে। পাখীগুলি ডালে ডালে বসিয়া সন্ধ্যা সমাগমে প্রাণমন খুলিয়া গান ধরিয়াছে, দূরে কৃষকগণ স্ব স্ব গোপাল লইয়া গাইতে গাইতে গৃহাভিমুখে ফিরিতেছে। সন্ধ্যায় প্রকৃতির সৌন্দর্য্যে মেম সাহেব বিমুগ্ধ ও উৎফুল্লিত হইয়া গাড়ী হইতে সেই পুষ্করিণীর তীরে নীল নবদুর্ব্বাদল উপরে ধীরে ধীরে পদচারণ করিতে লাগিলেন, —সুরেশ ও তাঁহার পাশে পাশে চলিলেন। সুন্দর অপূর্ব্ব স্থান,—পুষ্করিণীর চারি পার্শ্বে রসাল অমৃত বৃক্ষ সকল সারি সারি দাঁড়াইয়া আছে, সেই সকল আম্র বৃক্ষের ঘন পাতায় অস্তমিত সূর্য্যের কিরণ পতিত হইয়া বৃক্ষগুলিকে এক অপূর্ব্ব সৌন্দর্য্যে ভুষিত করিয়াছে। সম্মুখে বিস্তৃত সরোবর পদ্মে পরিপূর্ণ, ছোট বড় নানা রঙ্গের নানা পদ্ম সমস্ত পুষ্করিণীটীর হৃদয় পূর্ণ করিয়া ফুটিয়া আছে। চিরকালই ইংরাজ মহিলা ফুলের বড়ই প্রয়াশিনী, ফুল দেখিলে, ফুল পাইলে মেমগণ হৃদয়ে যত অনন্দ উপলব্ধি করেন, হীরা মুক্তা জহরত পাইলে তত হন না। মেমসাহেব কতকগুলি পদ্ম সংগ্রহ করিবার জন্য মনে মনে বড়ই ব্যগ্র হইলেন, কিন্তু কে এ সময়ে পুষ্করিণীতে নামিয়া পদ্ম আনিবে? সঙ্গে সহিশ পর্যন্ত নাই, নিকটে কোন লোককেই দেখিতে পাওয়া যায় না। তিনি পদ্মলাভে হতাশ হইলেন, মনে মনে মনের বাসনা সমীত করিলেন, সুরেশেকে কিছু বললেন না; সুরেশ বালক, সে তাঁহার অভিপ্রায় জানিলেও সে কি করিতে পারে?
কিন্তু বালক মেম সাহেবের হৃদয়ের ইচ্ছা বুঝিল। সে বুঝিল মেম সাহেব কয়েকটী পদ্ম পাইলে বড়ই প্রীত হইবেন। যিনি তাঁহার জন্য এত করিয়া থাকেন, যিনি তাঁহাকে পুত্র নির্ব্বিশেষে ভালবাসেন, তাঁহার ইচ্ছা পূর্ণ হইবে না, ইহা কখনই হইতে পারে না বাল্যকাল হইতেই সুরেশ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, একবার তাঁহার মনে কোন ইচ্ছা আসিলে তিনি তাহা কার্য্যে সম্পন্ন করিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করিতেন না। সুরেশ তৎক্ষণাৎ নিজ জামা ও জুতা খুলিলেন। মেমসাহেব তাঁহার অভিপ্রায় বুঝিলেন। এ সময়ে এরূপ পুষ্করিণীতে নামিলে বিপদাশঙ্কা আছে ভাবিরা মেম সাহেব সুরেশকে এরূপ কার্য্য হইতে বিরত করিতে প্রয়াস পাইলেন, কিন্তু সুরেশ কোন কাজ করিতে একবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইলে কেহই তাঁহাকে তাহা হইতে বিরত করিতে পারিত না। সহস্র বিপদের আশঙ্কা থাকিলেও সুরেশ তাহা হইতে বিরত হইতেন না। সুরেশ মেমসাহেবকে ভীত বা চিন্তিত হইতে নিষেধ করিয়া ছুটিয়া গিষা পুষ্করিণীর জলে ঝম্প প্রদান করিলেন। তৎপরে তিনি জল ঠেলিয়া যেখানে পদ্ম ফুটিয়া ছিল, সেই দিকে চলিলেন। পুষ্করিণীতে অধিক জল ছিল না, কাজেই সুরেশ সাঁতার দিয়া যাইতে পারিলেন না, হাঁটিয়া চলিলেন।
কিন্তু সুরেশ পদ্ম আনয়ন করা যত সহজ মনে করিয়াছিলেন, তত সহজ কার্য্য বলিরা বোধ হইল না। সুরেশ কিছু দূর গিয়াই আর সহজে অগ্রসর হইতে পারিলেন না—বোধ হইল যেন তিনি ক্রমে ডুবিবার উপক্রম করিতেছেন, কি যেন তাঁহার পা জড়াইয়া ধরিতেছে। মেমসাহেব ভীত হইয়া তাঁহাকে ফিরিয়া আসিবার জন্য পুনঃ পুনঃ অনুরোধ, অনুনয়, অবশেষে আজ্ঞা করিতে লাগিলেন, কিন্তু সুরেশ ফিরিলেন না,—কষ্টে—বহু কষ্টে,তিনি পদ্মের নিকট পৌঁছিলেন ও কতকগুলি পদ্ম সংগ্রহ করিলেন, কিন্তু তৎপরেই তিনি ফিরিবার জন্য বিষম চেষ্টা করিয়াও ফিরিতে পারিলেন না, ক্রমে ডুবিয়া যাইবার উপক্রম হইল। তখন মেমসাহেব ভীত হইযা চীৎকার করিয়া উঠিলেন। তাঁহার চীৎকারে একজন কৃষক ছুটিয়া আসিল, সে আসিয়াই সুরেশের বিপদ বুঝিল। সে তৎক্ষণাৎ চীৎকার করিয়া আরও জনাকয়েককে ডাকিল। তখন তাহারা অনতিবিলম্বে একটা দড়ি সংগ্রহ কবিয়া সুরেশের দিকে ফেলিয়া দিল; সুরেশও তৎক্ষাৎ সেই দড়ি ধরিলেন ও কোমরে বাঁধিয়া দিলেন। তখন কৃষকগণ সকলে তাঁহাকে টানিয়া তীরে উঠাইল। দেখা গেল সুরেশের সর্ব্বঙ্গ কর্দ্দম আবরিত হইয়া গিয়াছে। বহুবৎসর ধরিয়া এই পুষ্করিণীতে কর্দ্দম জমিতে ছিল। এত জমিয়াছিল যে কেহ আর সাহস করিয়া ইহাতে নমিত না। নমিলে দেখিতে দেখিতে সে কর্দ্দমে বসিয়া যাইত, আর উঠিবার তাহার সাধ্য থাকিত না। কৃষকগণ না আসিলে সুরেশেরও আজ ঠিক এই অবস্থা হইত। তাঁহার প্রাণরক্ষার কোন রূপ সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু মৃত্যুমুখে পড়িয়াও সুরেশ পদ্ম ছাড়েন নাই, তিনি যখন পদ্ম সহ তীরে উঠিলেন তখন তাঁহার কথা কহিবার ক্ষমতা ছিল না।
মেম সাহেব অনতিবিলম্বে সুরেশকে গাড়িতে তুলিয়া কুঠিতে আনিলেন। সেখানে তাঁহার সর্ব্বঙ্গ হইতে কর্দ্দম ধৌত করিয়া দেওয়া হইল, এবং তাঁহাকে ঔষধি প্রদান করা হইল। শীঘ্রই সুরেশ সুস্থ হইয়া উঠিল। তাঁহার বিপদের কথা সকলে শুনিল, সাহেবের অতিশয় প্রীত হইলেন। যত দিন পদ্মটী শুকাইয়া ঝরিয়া না পড়িয়া গিয়াছিল, ততদিন মেম সাহেব সেটীকে বক্ষে ধারণ করিয়া রাখিয়া ছিলেন।
যে কয়মাস সুরেশ নাথপুরে ছিলেন, সে কয়মাস তাঁহার বড়ই সুখে কাটিয়া গিয়াছিল। এখানে পিতার ধমকানি ছিল না, পড়াশোনার বড় হাঙ্গামা ছিল না, বিশেষতঃ সাহেব মেমেরা বড়ই আদর যত্ন করিতেন। দিন রাত তিনি তাঁহাদের সঙ্গে থাকিতেন, তাঁহাদের সহিত খেলা করিতেন, শিকারে যাইতেন। সাহেবদের সঙ্গে একত্রে আহার না করিলেও, তিনি অনেক দিন কুঠিতে আহারাদি করিয়াছিলেন, পূর্ব্বভাব তাঁহার ক্রমে দুর হইতেছিল।
অবশেষে সুরেশ নাগপুর ত্যাগ করিয়া কলিকাতায় বালিগঞ্জে আসিলেন। মেম সাহেব এবং অন্যান্য সকলে অতিশয় বিষাদের সহিত তাঁহাকে বিদায় দিলেন। মেম সাহেব শীঘ্রই বিলাত যাইবেন, তিনি সুরেশকে সঙ্গে লইবার জন্য বিশেষ পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন, কিন্তু সুরেশ কিছুতেই যাইতে প্রস্তুত হইলেন না। যদি তিনি সে সময়ে তাঁহাদের সহিত যাইতেন, তাহা হইলে ভবিষ্যতে তিনি ইয়োরোপে গিয়া যে ক্লেশ সহ্য করিয়াছিলেন ও বিপদে পড়িয়াছিলেন তাহা তাঁহাকে ভুগিতে হইত না। তাহা হইলে তিনি অন্যভাবে শিক্ষিত হইয়া অন্যরূপ হইতেন। কোন সময়ে মানুষের অদৃষ্টচক্র কোনদিকে ঘূরে তা কে বলিতে পারে? মেম সাহেব যে দিন সুরেশকে বিদায় দেন, সে দিন তিনিও ভাবেন নাই যে তাহারা ভিন্নভাবে তিন অবস্থায় তাহাদের সুরেশকে আবার এক দিন দেখিতে পাইবেন। সাহেব ও মেম সাহেব উভয়ই যাহাতে সুরশের উপকার যা সাহায্য হয় এরূপ কিছু করিতে চাহিলেন,-কিন্তু সুরেশ পরের উপকায় প্রাণী নহেন, তিনি সাহেষ ও মেমের নিকট বিদায় লইয়া বালিগঞ্জে অগিমন করিলেন।