লেফ্‌টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/গঙ্গাবক্ষে

একাদশ পরিচ্ছেদ।

গঙ্গাবক্ষে।

 এই সময়ে সুরেশ নৌকারোহণ ও দাঁড়টানিতে বড় ভালবাসিতেন। নাথপুর ইচ্ছামতীর তীরে অবস্থিত—ইচ্ছামতী বাঙ্গলাদেশের একটা সুন্দর নদী,—যেখানে নদী আছে, সেখানে জেলে আছে, এবং যেখানে জেলে আছে, সেখানে জেলেডিঙ্গি ও আছে। সুরেশ তাঁহার সঙ্গীদিগের সহিত প্রায়ই মধ্যে মধ্যে এই সকল জেলেডিঙ্গি চড়িয়া ইচ্ছাসতীর স্বচ্ছবক্ষে দাঁড় ফেলিতে ফেলিতে বহু দুরে চলিয়া যাইতেন। এরূপ নৌকাবিহারে সর্ব্বদাই বিপদের আশঙ্কা আছে,—বিশেষতঃ বালকগণের পক্ষে এরূপ নৌকারোহণে জলমগ্ন হওয়ার কোনই বিচিত্র নাই, কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় নাথপুরে থাকিরা সুরেশ বা তদনুসঙ্গীগণের কোনই বিপদ ঘটে নাই।

 বালিগঞ্জে আসিয়া আর নৌকা চড়িতে না পারিয়া সুরেশের হৃদয় বড়ই বিষণ্ণ হইল। যেখানে সুরেশ বাস করিতেন সেখান হইতে গঙ্গা বহু দূরে; সেখান হইতে গঙ্গায় গিয়া নৌকা চড়া বা দাঁড়টানা সহজ কার্য্য নহে, তবে সুরেশ কোন কার্য্যেই পশ্চাৎপদ হইবার লোক ছিলেন না, —কিন্তু তাঁহার পিতা এরূপ ধনী নহেন যে তাহকে একখানা নৌকা কিনিয়া দেন; সহরের দাঁড়ী মাজীগণ এরূপ নহে যে কেবল কথায় তাঁহাকে নৌকা চড়িতে দিবে। যাহা হউক তিনি অতি আয়াসে অবশেষে একটা “রোয়িং ক্লব” স্থাপনা করিলেন। কোন গতিকে একখানা নৌকাও সংগ্রহ হইল। তিনি তাঁহার সমবয়স্ক পল্লিস্থ অন্যান্য বালকগণকে লইয়া প্রত্যহ বৈকালে গঙ্গায় নৌকারোহণ করিতে আরম্ভ করিলেন।

 এপ্রেল মাসের এক দিন আর চারিটা সমবয়স্ক বালক সমভিব্যাহারে সুরেশ নৌকা খুলিয়া গঙ্গাবক্ষে দাঁড় টানিয়া চলিলেন। গার্ডেনরিচের নিকট নৌকা পৌঁছিলে আকাশে একটু কাল মেঘ দেখা দিল, কিন্তু আকাশ তখনও বেশ পরিষ্কার, ঝড় বৃষ্টি হইবার কোন সম্ভাবনা নাই;—রৌদ্র তখনও খুব প্রখর, তবে বাতাস একবারে নাই,—গরমও অসহ্য হইয়াছে। কিন্তু ক্রমে সেই ক্ষুদ্র কাল মেঘ দেখিতে দেখিতে বড় হইল,—সুর্য্য ঢাকিয়া ফেলিল, আকাশ কাল মেঘে পূর্ণ হইয়া গেল, দেখিতে দেখিতে বাতাস প্রবল হইল। অর্দ্ধ ঘণ্টা যাইতে না যাইতে গঙ্গাবক্ষে ঘোর রোলে প্রবল ঝটিকা উঠিল। বোধ হইল যেন সহসা ইন্দ্র বরুণ বায়ু প্রভৃতির মধ্যে সহসা গৃহবিবাদ ঘটিয়া সকলে সকলের প্রতি ক্রোধান্ধ হইয়া অস্ত্রশস্ত্র লইয়া ধাবিত হইলেন। সুরেশের ক্ষুদ্র নৌকা এই প্রলয়ে পড়িয়া যায় যায় হইল।

 সুরেশ ও তাঁহার সঙ্গীগণের কেহই আকাশের ভাবগতিক কখন কি রূপ থাকে তাহা জানিতেন না। এপ্রেল ও মে মাসে বাঙ্গলাদেশে কি রূপ সহসা ঝড় উঠে —কিরূপে সামান্য মেঘ আকাশের কোণে উঠিয়া দেখিতে দেখিতে ভয়াবহ ঝটিকায় পরিণত হয়, সুরেশ বা তাঁহার সঙ্গীগণ এ বিষয় একবারও চিন্তা করেন নাই। এক্ষণে সহসা গঙ্গাবক্ষে এই ঝড় উঠায় তাঁহারা মহা বিপন্ন হইলেন। অতি কষ্টে নৌকাকে জলমগ্ন হইতে প্রতিবন্ধকতা প্রদানে প্রয়াস পাইতে লাগিলেন, কিন্তু তাঁহাদের সাধ্য কি যে এই ভয়াবহ ঝটিকায় নৌকা রক্ষা করেন; দেখিতে দেখিতে হাল ভাঙ্গিয়া গেল, তখন নৌকা লাটিমের ন্যায় তীর বেগে গঙ্গাবক্ষে ঘুষিতে আরম্ভ করিল, বালকগণ প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াও কোনমতে নৌকাকে স্থির রাখিতে পারিল না। নৌকা ঘুরিতে ঘুরিতে একটা বয়ায় লাগিল এবং তৎক্ষণাৎ জলময় হইল। সুরেশ ও তাহার সঙ্গীগণ সকলেই সঙ্গে সঙ্গে জলমগ্ন হইলেন।

 সৌভাগ্যের বিষয় সকলেই সন্তরণে সুদক্ষ ছিলেন। তারা ভাসিয়া উঠিয়া প্রাণপণে সন্তরণ দিয়া তীরাভিমুখে যাইবার চেষ্টা পাইতে লাগিলেন; কিন্তু একে প্রবল স্রোত, তাহার উপর ঝড়বৃষ্টি, তরঙ্গের উপর তরঙ্গ—বালকগণের রক্ষা পাইবার কোন আশাই নাই। এই সময়ে সেই ঝটিকায় একখানি ষ্টিমার সেইখান দিয়া যাইতেছিল,—ষ্টিমারের লোকেরা বলকদিগের অবস্থা দেখিয়া তৎক্ষণাৎ ষ্টিমার থামাইয়া অতি কষ্টে সুরেশের সঙ্গীদিগের তিন জনকে ষ্টিমারে তুলিয়া লইলেন —সুরেশ ও তাঁহার অপর সঙ্গী শ্রোতবেগে এত দূরে গিয়া পড়িয়াছিলেন যে ষ্টিমারের লোকেরা তাঁহাদের দেখিতে পাইলেন না। সুরেশ ও তাঁহার সঙ্গী ভাসিয়া চলিলেন।

 সঙ্গীকে ক্লান্ত দেখিয়া সুরেশ আপনার বিপদ ভুলিয়া তাঁহাকে যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়া কোন গতিকে প্রাণ বাঁচাইয়া ভাসিয়া চলিলেন; —কিন্তু সেই ঝটিকা মধ্যে তাঁহারা উভয়ে বহুক্ষণ একত্রে থাকিতে পারিলেন না; —সুরেশ ও তাঁহার সঙ্গী ঝটিকাবেগে দুই জন দুই দিকে গিয়া পড়িলেন। তিনি দেখিলেন তাহার সঙ্গী ক্লান্ত হইয়া তাঁহার সম্মুখে জলমগ্ন হইলেন। তিনিও ক্রমে ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন, —কিন্তু অতি কষ্টে তিনি নিজেকে কেবল জলের উপর ভাসাইয়া রাখিয়া প্রাণ রক্ষা করিলেন।

 তিনি একখানি জারমান জাহাজের পাশ দিয়া ভাসিয়া যাইতেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে সেই জাহাজস্থ একজন নাবিক তাহাকে দেখিতে পাইলেন। তাঁহার বিপদ বুঝিয়া তিনি তৎক্ষণাৎ একগাছা দড়ি তাঁহার দিকে ফেলিয়া দিল;—সুরেশ দড়িটী দেখিতে পাইলেন ও তৎক্ষণাৎ অনেক কষ্টে দড়িটী ধরিলেন। কিন্তু তিনি নিতান্তই ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন;—দড়ি বহিয়া জাহাজে উঠিতে গিয়া আবার জলে পতিত হইলেন। জাহাজের কাপ্তেন তাঁহাকে এইরূপে বিপন্ন দেখিয়া অনতিবিলম্বে জাহাজের জালিবোট নামাইয়া দিলেন; —ততক্ষণে সুরেশ আরও বহু দূরে ভাবিয়া গিয়াছিলেন,—বহু কষ্টে নৌকাস্থ নাবিকগণ তাঁহাকে অর্দ্ধ মৃত অবস্থায় টানিয়া তুলিল। তিনি যখন জাহাজে নীত হইলেন, তখন তাঁহার একবারেই সংজ্ঞা ছিল না। জাহাজের ডাক্তারের বিশেষ যত্নে নানা রূপ চিকিৎসায় পর দিবস সুরেশের সংজ্ঞা হইল, —তখন জাহাজস্থ কাপ্তেন একখানি গাড়ী নিয়া লোক সঙ্গে দিয়া তাঁহাকে বাড়ী পাঠাইয়া দিলেন। বলা বাহুল্য তাঁহার অনুপস্থিতিতে তাঁহার জনক জননী বিশেষ উদ্বিগ ও চিন্তিত হইয়াছিলেন। কি রূপ আসন্ন মৃত্যু হইতে তাহায় জীবন রক্ষা হইয়াছে শুনিয়া তাহারা হর্ষ বিষাদে লন করিতে লাগিলেন। বাল্যকাল হইতে সুরেশ পদে পদে মৃত্যু মুখ হইতে রক্ষা পাইয়া আসিতেছিলেন যেন পদে পদে ভগবান তাঁহাকে রক্ষা করিতেছিলেন। দূর ব্লেজিলে বাঙ্গালীর মুথোজ্জল করিবার জন্যই যেন তিনি প্রতি পদে পদে তাহাকে রক্ষা করিয়া আসিতেছিলেন।