লেফ্‌টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/রাষ্ট্রবিপ্লব

ষটত্রিংশ পরিচ্ছেদ।
রাষ্ট্রবিপ্লব।

 সুরেশ ক্রমে করপোরালের পদ হইতে উন্নীত হইয়া পদাতিদলের প্রথম সারজেণ্টের পদলাভ করিলেন। ১৮৯৩খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত তিনি এই পদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি নিজেই লিখিয়াছেন যে, যদিও সেনানীমণ্ডলীর মধ্যে তাঁহার সমপদস্থ সৈনিকপুরুষদিগকে যে রূপ কার্য্য দেওয়া হয়, তাহাপেক্ষা তাঁহাকে সমধিক গুরুতর ও উচ্চপদস্থ সৈনিক পুরুষের কাজ দেওয়া হইত, তথাপি তিনি কৃষ্ণকায় ভারতবাসী বলিয়া তাঁহার পদোন্নতির নানা প্রকার ব্যাঘাত ও অনেক বিলম্ব ঘটিয়াছিল। যদিও তিনি অনেক বীরোচিত কার্য্য করিয়াছিলেন, রাজ্যের অশেষ উপকার সাধন করিয়াছিলেন, সর্ব্বকর্মে বিশেষ যশলাভ করিয়াছিলেন ও রাজকর্ম্মচারিগণ কর্তৃক প্রসংসিত হইয়াছিলেন,—তথাপি চারি বৎসৱ পর্য্যন্ত তাঁহার কোন পদোন্নতি হয় নাই। তিনি যে সারজেণ্ট সেই সারজেণ্টই ছিলেন। সে সময়ে দেশব্যাপী বিপ্লব চলিতেছিল, তখন প্রায়ই তাঁহাকে এই সকল যুদ্ধে লিপ্ত থাকিতে হইত; তিনি সেই সকল যুদ্ধে বিশেষ দক্ষতা ও সাহসের পরিচয় দেন এবং তাঁহার উচ্চপদস্থ সৈনিক পুরুষগণ তাঁহার বিশেষ প্রশংসা করিয়া ঊর্দ্ধতন কর্ম্মচারীদিগকে জানাইয়াছিলেন। কিন্তু তথাপি তাঁহার কোনরূপ পদোন্নতি ঘটিল না। তিনি যে পদে ছিলেন, তাহাতে তিনি কেবল অল্পসংখ্যক সৈনিদল পরিচালনা করিতে পারিতেন, কিন্তু প্রত্যেক যুদ্ধে তাঁহার অসীম সাহস ও বীরত্ব সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করিত,—অন্যান্য সৈনিকগণ তৎপ্রতি ঈর্ষান্বিত হইত, তবে সকলেই তাঁহাকে ভয় করিত, সাহস করিয়া কেহ কিছু বলিতে পারিত না। সুদূর হিন্দুস্থানস্থ গঙ্গতীরবাসী কৃষ্ণকায় বাঙ্গালী যুবককে সকলেই ভয় করিত।

 ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দে তিনি প্রথম লেফ্‌টানেণ্টের পদ পাইলেন। এই পদ পাইয়া প্রকৃতপক্ষে তিনি একটী সেনাদলের অধিনায়ক হইলেন; কিন্তু সহজে তিনি এ পদ পান নাই। দেশে এই সময়ে ঘোর রাষ্ট্রবিপ্লব উপস্থিত হল। ব্রেজিলের নৌসেনানীমণ্ডলী বিদ্রোহ পতাকা তুলিয়া রাজধানী রায়োডি জেনিরো অবরোধ করিল। মহা ভয়াবহ যুদ্ধ বাধিল। এই সময়ে সুরেশ তাঁহার পদোন্নতি সম্বন্ধে তাঁহার খুল্লতাতকে যাহা লিখিয়াছিলেন—আমরা এখানে তাহাই উদ্বৃত করিব।

 ‘‘খুড়া মহাশয়! আমি এক্ষণে যে পদ লাভ করিয়াছি, ভাবিবেন না, আমি ইহা সহজে পাইছি। আমি যে এদেশে সেনানীমধ্যে একজন সেনাপতি হইব, ইহা আমি কখনও ভাবি নাই। অনেক সময়েই আমার পদোন্নতির কথা উঠিয়াছে এবং প্রত্যেকবারেই আমার নাম চাপা পড়িয়াছে,—আমি বিদেশী বলিয়া আমার পদোন্নতিতে প্রত্যেক বারেই ব্যাঘাত ঘটিয়াছে। সম্প্রতি দেশে বিপ্লব উপস্থিত হইয়াছে,—আমি ও আমার সমপদস্থগণ একজন সেনাপতির অধীনস্থ হইয়াছি। ইনি আমাকে চিনিতেন না, কিন্তু ইনি ন্যায়বান্‌ ব্যক্তি,—লোকের গুণ গ্রহণে সঙ্কুচিত নহেন। আমি কোন্ দেশবাসী, আমি কে, ইনি তাহা একবারও দেখেন নাই। যুদ্ধক্ষেত্রে ইনি আমার সাহস ও দক্ষতা দেখিয়া প্রীত হইয়া আমার পদোন্নতির জন্য রাজপুরুষদিগকে লিখিয়াছিলেন,—তাহাতেই আমার এই পদোন্নতি ঘটিয়াছে। তিনি আমার সম্বন্ধে এ দেশের মার্শাল ভাইস-প্রেসিডেণ্টকে বিশেষরূপে লিখিয়াছিলেন, তাহাতেই আমি লেফ্‌টানেণ্টের পদলাভ করিয়াছি। আপনি বোধ হয় শুনিয়াছেন যে, আমি লেফ্‌টানেণ্ট হইয়া নাথেয়র নামক স্থানে যে ঘোর যুদ্ধ হইয়াছিল। তাহাতে বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করিয়াছিলাম। বলা বাহুল্য আমাদেরই জয় হইয়াছে।”

 সুরেশ লিখিয়াছেন,—‘‘আমি এই পত্রের সহিত নাথেরয়ের যুদ্ধের এক চিত্র পাঠাইতেছি। নাথেরয়ে আমায় নিম্নস্থ সৈনিকগণ সকলেই আমাকে বিশেষ ভয় করিত;—কেন করিত বলা যায় না,—আমি তাহাদের কাহারও প্রতি কখনও নির্দ্দয় ব্যবহার করি নাই। আপনারা সকলেই লেখেন যে, যুদ্ধের বিশেষ বর্ণনা আমাদিগকে লিখিয়া পাঠাইবে,—কিন্তু কাকা! কি লিখিব? যুদ্ধের ভয়াবহ বর্ণনা আমি আপনাকে কি লিখিব! যে জীবন জগতে সকল অপেক্ষা প্রিয়, যুদ্ধে সেই জীবন ক্রীড়াদ্রব্যরূপে লোকে অনায়াসে নষ্ট করে। সাহস আর কাহাকে বলে। যুদ্ধক্ষেত্রে স্থিরচিত্তে প্রাণদান করার নাম, বা প্রাণদান করিবার জন্য প্রস্তুত হওয়ার নামই সাহস।

 যখন শত্রুগণ দূরে অবস্থান করে, তখন তোমার বুদ্ধি, প্রত্যুৎপন্নমতি, তোমার দক্ষতা, সাবধানতা, তোমার কার্য্যকরী হইতে পারে, কিন্তু যখন শত্রুগণ নিকটে আগত, পরস্পরের সংঘর্ষ উপস্থিত, তখন কেবল সাহস ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞার প্রয়োজন, অন্য কিছুই লাগে না। যে পক্ষ বিপুল সাহসে নির্ভর করিয়া শত্রু আক্রমণ করিতে পারে,—সেই পক্ষেরই জয় হয়। শত্রুগণ সেই পক্ষের অত্যধিক উদ্যমে ও সাহসে ভীত ও বিচলিত হইয়া পলায়ন করিয়া থাকে।’’

 এ সকল কথা প্রকৃতই বীরোচিত। প্রকৃত বীর হৃদয় না হইলে কেহ অপরকে কুকুরের ন্যায় নিজ পদানুসরণ করাইতে পারে না। অন্যকে মৃত্যুমুখে লইয়া যাওয়া সহজ কার্য্য নহে,—প্রাণের প্রকৃত উন্মাদিনী শক্তি না থাকিলে কেহ কখনই পরকে প্রাণ হারাইতে উত্তেজিত করিতে পারে না। সুরেশের এই শক্তি না থাকিলে বিদেশীয় শ্বেতকায় সৈনিকগণ ঘোর যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁহার পদানুসরণ করিয়া আসন্ন মৃত্যুমুখে অগ্রসর হইত না। যখন সুরেশ সেণ্টক্রুস নগরে বাস করিতেছিলেন, সেই সময় ব্রেজিলদেশীয় একজন অধিবাসী তাঁহাকে এতই ভালবাসিত যে, সে কেবল সুরেশের নিকট থাকিতে পারিবে বলিয়াই উক্ত সৈন্যদলে নাম লেখাইয়াছিল।

 নাথেরয়ের যুদ্ধবর্ণনা লিপিবদ্ধ করিবার পূর্ব্বে আমরা এখানে সুরেশের গৃহস্থলী সম্বন্ধে দুই একটী কথা বলিব। পাঠকগণ অবগত আছেন যে সুরেশ রায়োডি-জেনিরো নগরে আসিয়া তথাকার একটী রমণীকে ভালবাসিতেন। তাঁহারা উভয়ে উভয়কে প্রাণের সহিত ভালবাসিতেন। ইনি এই দেশের একজন চিকিৎসকের কন্যা ছিলেন,—ইহাকেই সন্তুষ্ট করিতে গিয়া সুরেশ সৈন্যদলে সামান্য সৈনিকরূপে নাম লিখাইয়াছিলেন। রমণীও তাঁহাকে ভুলেন নাই। যদিও তিনি তদবধি সুরেশকে বহুকাল আর দেখেন নাই, যদিও দেশের নানা সম্ভ্রান্ত যুবক তাঁহার পাণিগ্রহণার্থে বিশেষ ব্যগ্র হইয়াছিলেন,তবুও রমণী তাঁহাকে এক দিনের জন্যও ভুলেন নাই। তিনি সুদূর ভারতবাসী অপরিচিত হিন্দু যুবকের মূর্ত্তি সর্ব্বদাই হৃদয়ে রাখিয়া পূজা করিতেন। যাঁহার দেশ কোথায় তাহা জানেন না;—যাঁহার আত্মীয় স্বজন কিরূপ তাহা অবগত নহেন,—তিনি তাঁহাকেই চিরজীবনের জন্য হৃদয়-আসনে বসাইয়াছিলেন। বহুকাল পরে সুরেশ যখন যশ মান লাভ করিয়া লেফ্‌টানেণ্টরূপে রায়োডিজেনেরো নগরে উপস্থিত হইলেন, তখন আবার বহুকাল ধরিয়া একত্র মিলিত হইবার জন্য ব্যাকুল,—সেই হৃদয় দুইটী অবশেষে একত্র হইল। এত দিনে উভয়ের মিলন হইল। এত দিনে উভয়ে শুভ পরিণয় বন্ধনে আবদ্ধ হইলেন। মহা সমারোহে এই বিবাহকার্য্য সুসম্পন্ন হইল। নগরের সমগ্র সন্ত্রান্ত ব্যক্তিগণ এই বিবাহোৎসবে যোগদান করিয়াছিলেন। যদিও এক্ষণে সুরেশ স্বদেশ ও আত্মীয় স্বজন হইতে সহস্র সহস্র ক্রোশ দূরে অবস্থিত তথাপি তাঁহার বান্ধুবান্ধবের অভাব ছিল না। তিনি সর্ব্বদাই সম্ভ্রান্ত সমাজে মহাসমাদরে অভ্যর্থিত হইতেন। রায়োডি-জেনেরো নগরে লামোস নামক একজন মহাসম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন,—ইনি তত্রত্য একজন প্রধান জমিদার ও ধনী। ইঁহার সহিত সুরেশের বিশেষ আত্মীয়তা জন্মে। প্রকৃতপক্ষেই লামোস সাহেবই ব্রেজিলদেশে তাঁহার প্রধান বন্ধু ছিলেন। এই সকল বন্ধুদিগের মধ্যে বসবাস করিয়া সুরেশের দেশের অভাব, আত্মীয় স্বজনের অভাব,—কোনও কষ্টই উপভোগ করিতে হয় নাই। সকলেই সর্ব্বদা তাঁহাকে বাধিত করিতে ব্যাগ্র হইতেন। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, সে সময়ে সুরেশ ব্রেজিল প্রদেশে বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিলেন।

 সুরেশ সস্ত্রীক ব্রেজিলদেশে বড়ই সুখে কালাতিপাত করিতেছিলেন। তাঁহাদের যেরূপ দাম্পত্যপ্রণয় ছিল, তদ্রূপ সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায় না। এক বৎসর পরে তাঁহাদের গৃহ শিশুর আনন্দময় হাস্যরোলে প্রতিধ্বনিত হইল। ১৮৯২ খৃষ্টাব্দের শেষাংশে সুরেশের একটী পুত্রসন্তান জন্মিল। এক্ষণে এই পুত্রের বয়স প্রায় আট বৎসর।