লেফ্‌টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/লণ্ডনে

দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

লণ্ডনে।

 জাহাজ টেমসনদীর তীরস্থ লণ্ডন মহানগরী পার্শ্বে আসিয়া লাগিল। আরোহীগণ নিজ নিজ মালামাল লইয়া ব্যস্ত হইলেন। নাবিকগণ জাহাজ নঙ্গর করিবার জন্য ছুটাছুটি করিতে লাগিল। কসটম অফিসের কর্মচারীগণ আসিয়া সকলের বাক্স পেটায়। পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। যে সকল দ্রব্য মাশুল ব্যতীত বিলাতে লইয়া যাওয়া যায় না, নাবিকগণ বা আরোহীগণ কেহ লুকাইয়া তাহা আনিয়াছে কি না, ইহারা তাহাই দেখিতে লাগিলেন। জাহাজের উপর হুলুস্থুল পড়িয়া গিয়াছে, চারিদিকেই লোক ছুটাছুটি করিতেছে।

 আরোহীগণকে অভ্যর্থনা করিবার তাহাদের আত্মীয় স্বজনেরা জাহাজের উপর আসিয়াছেন,—চারিদিকেই হস্ত আলোড়ন, সকলেরই হাসি মুখ। বহু দিন পরে হয়ত স্বামী স্ত্রীকে দেখিতেছেন, জননী পুত্র কন্যার মুখ চুম্বন করিতেছেন, পিতা পুত্রকে ক্রোড়ে লইতেছেন,—এই দৃশ্য সুরেশ জাহাজের এক পার্শ্বে দাঁড়াইয়া দেখিতেছিলেন। তাহার কড়েয়ায় ও নাথপুরের বাড়ীর কথা মনে হইতেছিল, স্নেহময়ী জননীয় মুখ মনে পড়িতেছিল; -—আর কি কখন মায়ের সহিত দেখা হইবে, আর কি কখনও দেশে ফিরিতে পারিবেন না!

 সম্মুখে সুরেশ যে দৃশ্য দেখিয়েছিলেন, তেমন তিনি স্বপ্নেও কখনও উপলব্ধি করেন নাই। যে সাহেবদের ভারতবাসী দেবলোকবাসী দেবতা মনে করিয়া থাকে এখানে সেই সাহেব দিগের ছড়াছড়ি। মুটে সাহেব, গাড়োয়ান সাহেব,চাকর নকর সকলই সাহেব,যত দূর দৃষ্টি চলে তত দূর সাদা মুখ কাল লোক একটাও নজরে আইসে না। লণ্ডন সহরই বা কি ভয়ানক ব্যাপার,—বর্ণনা হয় না। হাজার হাজার সাহেব রাজপথে ছুটিতেছেন,—পদ্হালকে লজ্জা দিয়া মেমেরা নানা সাজে যাইতেছেন,—কত গাড়ী, কত ঘোড়া,কত জাহাজ, কত নৌকা; —সুরেশ ভারতের প্রধান সহর কলিকাতাবাসী — কিন্তু লণ্ডন দেখিয়া তাহার কলিকাতাকে নগণ্য সামান্য গ্রাম বলিয়া প্রতীতি জন্মিল।—তিন কোন দিকে কি দেখি কিছুই স্থির করিতে পাবিলেন না, তাঁহার মাথা ঘুরিয়া গেল;— তিনি হতভম্বের ন্যায় এক স্থানে দাঁড়াইয়া এক দিকে চাহিয়া রহিলেন।

 কেহ তাহাকে দেখিতেছিল না,—কেহ তাহার সম্বাদ লই তেছিল না;—আরোহীগণ ব্যগ্রভাবে মালামাল লইয়া আত্মীয় স্বজন বেষ্টিত হইয়া গৃহাভিমুখে চলিয়া যাইতেছিলেন। নাবিক গণ জাহাজকে সুদৃঢ়রূপে নঙ্গরবন্ধ করিবার এই ব্যস্ত ছিল; সুরেশের সম্বাদ লইবার তাহাদের অবসর ছিল না। জাহাজ বন্দরে আসিয়াছে, হিসাবপত্র সই জাহাজ- স্বামীকে দিতে হইবে, সেই সকল কাগজপত্র লইয়া কাপ্তেন সাহেব ব্যস্ত;— তাঁহারও সুরেশের সম্বাদ লইবার অবসর নাই। এই জনাকীর্ণ জাহাজের উপর সুরেশ মনে করিতেছিলেন, তাহাপেক্ষা একাকী বোধ হয় জগতে আর কেহ নাই; তাহায় বোধ হইল সংসারে তাহাপেক্ষা দুঃখীও বোধ হয় আর কেহ নাই। তাহার অজ্ঞাতসারে তাহার দুই চক্ষু জলে পূর্ণ হইয়া আসিল।

 এই সময়ে কে তাহার পৃষ্ঠে হস্তস্থাপন করিল। তিনি চম কিত হইয়া ফিরিলেন, দেখিলেন আরোহীদিগের মধ্যস্থ একটা মেম। ইনি প্রৌঢ় বয়স্থা;—স্বামী সন্ধানে ভারতে গিয়া ভারতের সহরে সহরে ফিরিয়াও সফল মনোরথ হইতে পারেন নাই, যৌবন প্রায় অতীত, অর্থও তত নাই, এরূপ অবস্থায় স্বামী লাভ বড় সহজ নহে; এক্ষণে তিনি গৃহে ফিরিতেছেন। জাহাজে তিনি আত্মীয় স্বজন বর্জিত, বালক সুরেশকে স্নেহের দৃষ্টিতে দেখিয়াছিলেন, এক্ষণে জাহাজ হইতে যাইবার সময় সুরেশকে দুই একটা মিষ্টকথা না বলিয়া যাইতে পারিলেন না।

 যখন জাহাজ হইতে আরোহীগণ সমস্ত চলিয়া গেলেনগোলমাল কতক দূর হইল—তখন কাপ্তেন সাহেব সুরেশকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। সুরেশ নিকটে আসিয়া অভিবাদন করিতে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন তুমি কি করিতে চাও? আবার যে চাকুরীতে আসিয়াছ সেই চাকুরীতে জাহাতে যাইতে চাও;— না লণ্ডনে থাকিতে চাও?”

 সুরেশ বলিলেন, আমি এখনও কিছুই স্থির করিতে পারি নাই। কি করিব এখনও ভাবিবার সময় পাই নাই।

 কাপ্তেন। ‘বেশ, ভেবে চিন্তে যা ভাল বিবেচনা কর, ঠিক কর। তবে আমার দ্বারা যেটুকু হয়, আমি সর্বদাই তোমার জন্য করিতে প্রস্তুত আছি। যত দিন জাহাজ এখানে আছে, তত দিন তুমি জাহাজে থাকিতে পার;—জাহাজ প্রায় তিন সপ্তাহ এখানে থাকিবে। এই সময়ের মধ্যে তুমি লণ্ডনের সকলই দেখিয়া লইতে পার।”

 সুরেশ। “মহাশয়! আপনাকে কি রূপে ধন্যবাদ প্রদান করিব জানি না। আমার পিতা যাহা কখন আমার জন্য করেন নাই। আপনি আমার জন্য তাহা করিয়াছেন। যত দিন দেহে জীবন থাকিবে তত দিন আমি আপনার নিকট কেনা হইয়া রহিলাম।

 কাপ্তেন সাহেব উচ্চ হাস্য করি সস্নেহে সুরেশের পৃষ্ঠ করাঘাত করিতে করিতে বলিলেন, “তোমার ধন্যবাদ আমি চাই না। তোমার ভাল হইলেই আমি বিশেষ সন্তুষ্ট হইব। ভবিষ্যতে তোমার ভাল হইয়াছে শুনিলে আমি প্রকৃতই সুখী হই। যদি আমায় পরামর্শ শোন, তবে এখন তুমি তোমার মাহিনার টাকা লইও না। এখন তুমি জাহাজে থাকিবে, সুতরাং তোমার এক পরসাও খরচ লাগিবে না। যখন আমরা এখান থেকে চলিয়া যাইব, যখন তুমি একাকী লণ্ডনে পড়িবে, যখন তোমাকে লণ্ডনে বাস করতে হবে, তখন তোমার অনেক টাকার দরকার হইবে। যাহা কিছু সংগ্রহ করিয়া নিজের নিকট রাখিতে পার, তাহই ভাল কারণ এ সহরে এক গাছি ঘাস পর্যন্ত বিনা মূল্যে পাইবে না।”

 কাপ্তেন সাহেবের সস্নেহ উপদেশে সুরেশের হৃদয় কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ হইয়া গেল —তিনি কোন কথা কহিতে পারিলেন না;— তাঁহার দুই চক্ষু হইতে দয়বিগলিতধারে নয়নাশ্রু বহিতে লাগিল। কাপ্তেন সাহেব বৃদ্ধ হইয়াছিলেন, আজীবন জলে জলে নাবিকবৃত্তি অবলম্বন করিয়া ঘুরিতেছিলেন;— কিন্তু তাঁহার প্রাণ ছিল, সংসার-সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের কঠোর আঘাতেও তাহার হৃদয় কঠিন হয় নাই। সুরেশের চক্ষে জল দেখিয়া বৃদ্ধ কাপ্তেনের চক্ষুদ্বয়ও জলে পূর্ণ হইয়া আসিল।

 কাপ্তেন সাহেব সুরেশকে বিদায় দিয়া জাহাজ-স্বামীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে প্রস্থান করিলেন। সুরেশকে তখন জাহাজের বোসেন সাহেব সঙ্গে লইয়া লণ্ডন সহর দেখাইতে বহির্গত হইলেন। লণ্ডন নগরীতে পদ স্থাপন করিয়া সুরেশ সকল মানসিক কষ্ট ভুলিয়া গেলেন। এত দিন পরে তাহার জীবনের সাধ পূর্ণ হইল। বাল্যকাল হইতে শয়নে স্বপনে তিনি যে আশাকে হৃদয়ে হৃদয়ে পোষণ করিতেছিলেন, এত দিনে সে আশা পূর্ণ হইল!