লেফ্‌টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/সারকাসে প্রবেশ

সপ্তবিংশতি পরিচ্ছেদ।


সারকাসে প্রবেশ।

 এইরূপ ঘুরিতে ঘুরিতে সুরেশ একদিন কেণ্ট প্রদেশের একটী ক্ষুদ্র সহরে উপস্থিত হইলেন। সেই সময়ে সেই সহরে একদল সারকাসওয়ালা ক্রীড়া প্রদর্শন করিতেছিলেন,—এ সারকাস খুব ভাল বা বড় সারকাস নহে,—ইহারা পল্লিগ্রামে খেলা দেখাইয়া দুই পয়সা রোজকার করিতেন। এইরূপে ঘুরিতে ঘুরিতে ইহারা এ সহরে আসিয়াছিলেন। সন্ধ্যার পর সারকাস দলের ক্রীড়কগণ সকলেই সুরেশ যে হোটেলে বাস করিতেছিলেন, সেইখানে আমোদ প্রমোদ ও কথাবার্ত্তা কহিতে আসিলেন। ক্রমে সুরেশের সহিত ইহাদের আলাপ পরিচয় হইল, উভয় পক্ষেই নানা কথাবার্ত্তা হইতে লাগিল। তাঁহাদের প্রশ্নের উত্তরে সুরেশ ভারতবর্ষের অনেক কথা তাঁহাদিগকে বলিলেন, এবং তাঁহারাও সুরেশের প্রশ্নে সুরেশকে সারকাসের অনেক কথা কহিলেন। সারকাসে যে কত আমোদ, কত উৎসাহ, কত প্রশংসা, কত যশ, কত খ্যাতি তাহা মহোৎসাহে তাঁহারা সুরেশকে বলিতে লাগিলেন, শুনিয়া সুরেশের মন তাঁহাদের কথায় বিশেষরূপে আকৃষ্ট হইল। তিনি সে রাত্রি নিদ্রা যাইতে পারিলেন না, নানা চিন্তার হৃদয় উদ্বেলিত হইতে লাগিল, সারকাসের দলে মিশিতে তাঁহার প্রাণ ব্যাকুল হইয়া পড়িল। তিনি ফিরিওয়ালা বৃত্তি পরিত্যাগ করিতে স্থির সঙ্কল্প করিলেন, ভাবিলেন যদি এই সারকাস দলে মিশেতে পারি, তাহা হইলে ভবিষ্যতে খ্যাতিলাভত হইবেই, সঙ্গে সঙ্গে বিপুল অর্থও উপার্জ্জন হইবে,—আর আমোদ প্রমোদে ও সুখ সচ্ছন্দের কথাইত নাই। এই রূপ নানা চিন্তায় তাঁহার নিদ্রা হইল না। ভোর হইতে না হইতে তিনি সেই সারকাস দলের ম্যানেজার সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে চলিলেন। সাক্ষাৎ হইলে তিনি বলিলেন “যদি আপনি আমাকে সারকাসদলে গ্রহণ করেন, তাহা হইলে আমি কুস্তি, জিম‌্নাষ্টিক প্রভৃতির খেলা দেখাইতে পারি।” সুরেশকে দেখিলে বলবান বলিয়া বোধ হইত না, তিনি আকারে খর্ব্বাকৃতি, দেহেও সেরূপ পুষ্ট ছিলেন না, তবে তাঁহার মাংসপেশী সকল বোধ হয় লৌহ অপেক্ষাও কঠিন ছিল। বাল্যকাল হইতেই তিনি ব্যায়ামপটু, কলিকাতায় অনেক জিম্‌নাষ্টিক ও কুস্তি করিয়াছেন,—বিলাতে আসিয়াও তিনি এ অভ্যাস পরিত্যাগ করেন নাই। সময় ও সুবিধা পাইলেই ব্যায়ামচর্য্যা করিতেন। তাঁহার শরীরে এইরূপে অসীম বল হইয়াছিল, কিন্তু ম্যানেজার সাহেব তাঁহার আকৃতি দেখিয়া তাঁহাকে বলবান বলিয়া ভাবিলেন না। তিনি যুবক সুরেশের কথায় মৃদুহাস্য করিলেন। সুরেশ তাঁহার মনের ভাব বুঝিয়া বলিলেন, ‘‘আমাকে পরীক্ষা করুন।’’ বোধ হয় একটু মজা করিবার জন্যই ম্যানেজার সাহেব তাঁহার দলের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বলবান ক্রীড়ককে আহ্বান করিলেন। আকৃতিতে সে দীর্ঘাকার ও বলে অসুর বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। সে উপস্থিত হইলে ম্যানেজার সাহেব বলিলেন, “তুমি ইহার সহিত লড়িতে পার?” সুরেশ বিনা দ্বিধায় বলিলেন, “কুস্তি হয় ত পারি।”

 তখন উভয়ে কুস্তির আয়োজন হইল, তৎপরে উভয়ে কুস্তি আরম্ভ হইল। শীঘ্রই দর্শকমাত্রেই বুঝিল যে সাহেবক্রীড়কের শরীরে কিছু বল অধিক থাকিলেও দক্ষতায় তিনি কোন অংশেই ভারতবাসীর সমকক্ষ নহেন। ১০ মিনিট যাইতে না যাইতেই তিনি পরাজিত হইলেন। সুখে তখন হোরাইজাণ্টাল ও প্যারেলাল বারেও ক্রীড়া দেখাইতে চাহিলেন, কিন্তু ম্যানেজার সাহেব তাঁহার ক্ষমতা বুঝিয়াছিলেন, বলিলেন, “না; আমি সন্তুষ্ট হইয়াছি, তুমি আমাদের দলে যোগ দিতে পার।”

 সেই দিন হইতে সুরেশ সেই সারকাস দলে অন্তর্ভুক্ত হইলেন। মাহিয়ানারও একটা বন্দ্যোবস্ত হইয়া গেল। সারকাস দল হইতে তিনি সমস্ত আহারাদির ব্যয় পাইবেন, অধিকন্তু সপ্তাহে ১৫ সিলিং করিয়া পারিশ্রমিক লাভ করিবেন। যদিও সারকাস ক্রীড়কদিগের ইহাপেক্ষা অনেক বেশী মাহিয়ানা ছিল, তবুও সুরেশ এই মাহিনাতেই স্বীকৃত হইলেন। তিনি নূতন, ক্রমে কাজ শিখিলে অবশ্যই তাঁহার বেতনের হার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পাইবে। এ দলে না হয়, অন্য দলে মিলিবে। এক দিকে সপ্তাহে ১৫ সিলিং পাইয়া সুরেশ যেরূপ উৎফুল্ল হইলেন, অন্যদিকে ম্যানেজার সাহেবও একজন প্রকৃত কালো ভারতবাসী এত সস্তায় পাইয়া মনে মনে বিশেষ প্রীত হইলেন। এখন বিজ্ঞাপন দিবার খুব সুবিধা হইবে,—প্রকৃত ভারতবাসীর খেলা জানিলে সারকাস দেখিবার জন্য হাজার হাজার লোক আসিয়া পড়িবে!

 তাহাই হইল। সাসেকস্ প্রদেশের ক্ষুদ্র একটী সহরে আসিয়া ম্যানেজার বিজ্ঞাপন দিলেন, “অদ্য রাত্রে এক ভারতবর্ষীয় যুবক অদ্ভূত ক্রীড়া দেখাইবেন।” সহরে যত লোক ছিল, সে রাত্রে সকলে আসিয়া সারকাসের তাবু পূর্ণ করিল, সুরেশ সারকাসওয়ালা হইয়া, সারকাসের রং বেরংয়ের পোষাকে সজ্জিত হইয়া, দর্শকদিগের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। প্রথম দর্শকমণ্ডলীর সম্মুখে উপস্থিত হইলে অভেনেতা ও অভিনেত্রীগণের মনে যে কি অবস্থা হয়, এ অবস্থায় না পড়িলে তাহা উপলব্ধি করিয়া উঠিতে পারা যায় না। মুহূর্ত্তের জন্যে সুরেশের সর্ব্বাঙ্গ কাঁপিয়া উঠিল, প্রাণ হৃদয়ে যেন বসিয়া গেল, তিনি চারিদিক অন্ধকার দেখিলেন, কিন্তু পর মুহূর্ত্তেই দর্শকদিগের ঘোর করতালিতে তাঁহার সংজ্ঞা হইল, এবং আপনাকে প্রকৃতিস্থ করিয়া খেলা আরম্ভ করিলেন।

 প্রতিপদেই করতালি, প্রতিপদেই প্রশংসা। সুরেশ সে দিন যেরূপ অদ্ভুত কৌশল ও ক্ষিপ্রকারিতার সহিত ক্রীড়া করিয়াছিলেন, তাহাতে তিনি নিজেই বিমোহিত হইয়াছিলেন। প্রশংসার উপর প্রশংসার সহিত খেলা শেষ করিয়া সুরেশ দর্শকদিগের নিকট হইতে বিদায় লইয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন। তাঁহার প্রস্থানের পরও করতালি ধ্বনিতে রঙ্গস্থল কয়েক দণ্ড পর্য্যন্ত মাতিয়া উঠিল। আহ্লাদে উৎফুল্ল হইয়া ম্যানেজার

সাহেব তাঁহার পাণিপীড়ন করিলেন। অন্যান্য অভিনেতা ও অভিনেত্রীগণও তাঁহার গৌরব ও প্রশংসায় বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করিতে লাগিলেন।