লোকরহস্য (১৯৩৯)/গ্রাম্য কথা
গ্রাম্য কথা
প্রথম সংখ্যা—পাঠশালার পণ্ডিত মহাশয়
টিপ্ টিপ্ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে; আমি ছাতি মাথায়, গ্রাম্য পথ দিয়া হাঁটিতেছি। বৃষ্টিটা একটু চাপিয়া আসিল। তখন পথের ধারে একখানা আটচালা দেখিয়া, তাহার পরচালার নীচে আশ্রয় লইলাম। দেখিলাম, ভিতরে কতকগুলি ছেলে বই হাতে বসিয়া পড়িতেছে। এক জন পণ্ডিত মহাশয় বাঙ্গালা পড়াইতেছেন। কাণ পাতিয়া একটু পড়ানটা শুনিলাম। দেখিলাম, পণ্ডিত মহাশয়ের ব্যাকরণের উপর বড় অনুরাগ। একটু উদাহরণ দিতেছি। পণ্ডিত এক জন ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বল দেখি, ভূ ধাতুর উত্তর ক্ত প্রত্যয় করিলে কি হয়?”
ছাত্রটি কিছু মোটা-বুদ্ধি, নাম শুনিলাম, “ভোঁদা।” ভোঁদা ভাবিয়া চিন্তিয়া বলিল, “আজ্ঞা, ভূ ধাতুর উত্তর ক্ত করিলে ভুক্ত হয়।”
পণ্ডিত মহাশয়, ছাত্রের মূর্খতা দেখিয়া চটিয়া উঠিলেন এবং তাহাকে “মূর্খ” “গর্দ্দভ!” প্রভৃতি নানাবিধ সংস্কৃত বাক্যে অসংস্কৃত করিলেন। ছাত্রও কিছু গরম হইয়া উঠিল, বলিল, “কেন পণ্ডিত মহাশয়! ভুক্ত শব্দ কি নাই?”
পণ্ডিত। থাকিবে না কেন? ভুক্ত কিসে হয়, তা কি জানিস্ না?
ছাত্র। তা জানিব না কেন? ভাল করিয়া চিবিয়া গিলিয়া ফেলিলেই ভুক্ত হয়।
পণ্ডিত। বেল্লিক! বানর! তাই কি জিজ্ঞাসা কর্ছি?
তখন ভোঁদার প্রতি বড়ই অসন্তুষ্ট হইয়া তিনি তাহার পার্শ্ববর্ত্তী ছাত্র রামকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভাল, রাম, তুমিই বল দেখি, ভুক্ত শব্দ কি প্রকারে হয়?”
রাম বলিল, “আজ্ঞা, ভুজ ধাতুর উত্তর ক্ত করিয়া ভুক্ত হয়।”
পণ্ডিত মহাশয় ভোঁদাকে বলিলেন, “শুন্লি রে ভোঁদা? তোর কিছু হবে না।”
ভোঁদা রাগিয়া বলিল, “না হয় না হোক্—আপনার যেমন পক্ষপাত!”
পণ্ডিত। পক্ষপাত আবার কি রে, হনুমান্।
ভোঁদা। ওর কপালে “ভুজো”, আমার কপালে ভূ?
ছাত্র যে সুচর্ব্বণীয় “ভুজো” এবং অদৃষ্টের তারতম্য স্মরণ করিয়া অভিমান করিয়াছে, পণ্ডিত মহাশয় তাহা বুঝিলেন না। রাগ করিয়া ভোঁদাকে এক ঘা প্রহার করিলেন, এবং আদেশ করিলেন, “এখন বল্, ভূ ধাতুর উত্তর ক্ত করিলে কি হয়?”
ভোঁদা। (চোখে জল) আজ্ঞে, তা জানি না।
পণ্ডিত। জানিস্ নে? ভুত কিসে হয়, জানিস্ নে?
ভোঁদা। আজ্ঞে তা জানি। মলেই ভূত হয়।
পণ্ডিত। শূওর। গাধা। ভূ ধাতুর উত্তর ক্ত ক’রে ভূত হয়।
ভোঁদা এতক্ষণে বুঝিল। মনে মনে স্থির করিল, মরিলেও যা হয়, ভূ ধাতুর উত্তর ক্ত করিলেও তা হয়। তখন সে বিনীতভাবে পণ্ডিত মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিল, “আজ্ঞে, ভূ ধাতুর উত্তর ক্ত করিলে কি শ্রাদ্ধ করিতে হয়?”
পণ্ডিত মহাশয় আর সহ্য করিতে পারিলেন না। বিরাশী সিক্কা ওজনে ছাত্রের গালে এক চপেটাঘাত করিলেন। ছাত্র পুস্তকাদি ফেলিয়া দিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বাড়ী চলিয়া গেল। তখন বৃষ্টি ধরিয়া আসিয়াছিল, রঙ্গ দেখিবার জন্য আমিও সঙ্গে সঙ্গে গেলাম। ভোঁদার মাতার গৃহ বিদ্যালয় হইতে বড় বেশী দূর নয়। ভোঁদা গৃহপ্রবেশকালে কান্নার স্বর দ্বিগুণ বাড়াইল, এবং আছাড়িয়া পড়িল। দেখিয়া ভোঁদার মা তার কাছে এসে সান্ত্বনায় প্রবৃত্ত হইল। জিজ্ঞাসা করিল, “কেন, কি হয়েছে, বাবা?”
ছেলে মাকে ভেঙ্গাইয়া বলিল, “এখন কি হয়েছে, বাবা! এমন ইস্কুলে আমায় পাঠাইয়েছিলি কেন পোড়ারমুখী?
মা। কেন, কি হয়েছে, বাবা?
ছেলে। পোড়ারমুখী এখন বলেন, কি হয়েছে, বাবা। শিগ্গির তোর ভূ ধাতুর পর ক্ত হৌক। শিগ্গির হৌক। আমি তোর শ্রাদ্ধ করি।
মা। সে আবার কি বাপ! কাকে বলে?
ছেলে। শিগ্গির তোর ভূ ধাতুর পর ক্ত হৌক। শিগ্গির হৌক।
মা। সে কি মরাকে বলে বাপ?
ছেলে। তা না ত কি? আমি তাই বল্তে পারি নাই ব’লে পণ্ডিত মশাই আমায় মেরেছে।
মা। অধঃপেতে মিন্সে! আক্কেল নেই। আমার এই এক রত্তি ছেলের আর কত বিদ্যা হবে। যে কথা কেউ জানে না, তাই বলতে পারে নি ব’লে ছেলেকে মারে! আজ মিন্সেকে আমি একবার দেখবো।
এই বলিয়া গাছকোমর বাঁধিয়া ভোঁদার মাতা পণ্ডিত মহাশয়ের দর্শনাকাঙ্ক্ষায় চলিলেন। আমিও পিছু পিছু চলিলাম। সেই সুপুত্রবতীকে অধিক দূর যাইতে হইল না। তখন পাঠশালা বন্ধ হইয়াছিল। পণ্ডিত মহাশয় গৃহে প্রত্যাবর্ত্তন করিতেছিলেন, পথিমধ্যেই উভয়ে সাক্ষাৎ হইল। তখন ভোঁদার মা বলিল, “হ্যাঁ গা পণ্ডিত মহাশয়, যা কেউ জানে না, আমার ছেলে তাই বলতে পারে নি ব’লে কি এমনি মার মারতে হয়?”
পণ্ডিত। ও গো, এমন কিছু শক্ত কথা জিজ্ঞাসা করি নাই। কেবল জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, ভূত কেমন ক’রে হয়।
ভোঁদার মা। ভূত হয় গঙ্গা না পেলেই। তা ও সব কথা ও ছেলেমানুষ কেমন ক’রে জানবে গা? ওসব কথা আমাদের জিজ্ঞাসা কর।
পণ্ডিত। ও গো, সে ভূত নয় গো।
ভোঁদার মা। তবে কি গোভূত?
পণ্ডিত। সেসব কিছু নয় গো, তুমি মেয়েমানুষ কি বুঝ্বে? বলি, একটা ভূত শব্দ আছে।
ভোঁদার মা। ভূতের শব্দ আমি অমন কত শুনেছি। তা ও ছেলেমানুষ, ওকে কি ও সব কথা ব’লে ভয় দেখাতে আছে?
আমি দেখিলাম যে, এ পণ্ডিতে পণ্ডিতে সমস্যা, শীঘ্র মিটিবে না। আমি এ রঙ্গের অংশ পাইবার আকাঙ্ক্ষায় অগ্রসর হইয়া পণ্ডিত মহাশয়কে বলিলাম, “মহাশয়, ও স্ত্রীলোক, ওর সঙ্গে বিচার ছেড়ে দিন। আমার সঙ্গে বরং এ বিষয়ের কিছু বিচার করুন।”
পণ্ডিত মহাশয় আমাকে ব্রাহ্মণ দেখিয়া, একটু সম্ভ্রমের সহিত বলিলেন, “আপনি প্রশ্ন করুন।”
আমি বলিলাম, “আচ্ছা, ভূত ভূত করিতেছেন, বলুন দেখি ভূত কয়টি?”
পণ্ডিত সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “ভাল, ভাল। পণ্ডিতে পণ্ডিতের মতই কথা কয়। শুন্লি মাগী?” তার পর আমার দিকে ফিরিয়া, এমনই মুখখানা করিলেন, যেন বিদ্যার বোঝা নামাইতেছেন। বলিলেন, “ভূত পাঁচটি।”
তখন ভোঁদার মা গর্জ্জিয়া উঠিয়া বলিল, “তবে রে মিন্সে? তুই এই বিদ্যায় আমার ছেলে মারিস্। ভূত পাঁচটা! পাঁচ ভূত, না বারো ভূত?”
পণ্ডিত। সে কি, বাছা! ও ঠাকুরটিকে জিজ্ঞাসা কর, ভূত পঞ্চ। ক্ষিত্যপ,—
ভোঁদার মা। বারো ভূত নয় ত আমার এতটা বিষয় খেলে কে? আমি কি এমনই দুঃখী ছিলাম?
ভোঁদার মা তখন কাঁদিতে আরম্ভ করিল। আমি তখন তাহার পক্ষাবলম্বন পূর্ব্বক বলিলাম, “উনি যা বলিলেন, তা হতে পারে। অনেক সময়েই শুনা যায়, অনেকের বিষয় লইয়া ভূতগণ আপনাদিগের পিতৃকৃত্য সম্পন্ন করে। কখন শোনেন নাই, অমুকের টাকাটায় ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ হইতেছে?”
কথাটা শুনিয়া, পণ্ডিত মহাশয় ঠিক বুঝিতে পারিলেন না, আমি ব্যঙ্গ করিতেছি, কি সত্য বলিতেছি। কেন না, বুদ্ধিটা কিছু স্থূল। তাঁকে একটু ভেবলাপানা দেখিয়া আমি বলিলাম, “মহাশয়, এ বিষয়ের প্রমাণ প্রয়োগ ত সকলই অবগত আছেন। মনু বলিয়াছেন,—
“কৃপণানাং ধনঞ্চৈব পোষ্যকুষ্মাণ্ডপালিনাম্।
ভূতানাং পিতৃশ্রাদ্ধেষু ভবেন্নষ্টং ন সংশয়ঃ॥”[১]
পণ্ডিত মহাশয়ের সংস্কৃতজ্ঞান ঐ ভূ ধাতুর উত্তর ক্ত পর্য্যন্ত। কিন্তু এ দিকে বড় ভয়, পাছে সেই শিষ্যমণ্ডলীর সম্মুখে, বিশেষতঃ ভোঁদার মার সম্মুখে আমার কাছে পরাস্ত হয়েন—অতএব যেমন শুনিলেন, “ভূতানাং পিতৃশ্রাদ্ধেষু ভবেন্নষ্টং ন সংশয়ঃ।” অমনই উত্তর করিলেন, “মহাশয়, যথার্থই আজ্ঞা করিয়াছেন। বেদেই ত আছে,—
“অস্তি গোদাবরীতীরে বিশালঃ শাল্মলীতরুঃ”
শুনিয়া ভোঁদার মা বড় তৃপ্ত হইল। এবং পণ্ডিত মহাশয়ের ভূয়সী প্রশংসা করিয়া বলিল, “তা, বাবা! তোমার এত বিদ্যা, তবু আমার ছেলে মার কেন?”
পণ্ডিত। আরে বেটি, তোর ছেলেকে এমনই বিদ্বান্ করিব বলিয়াই ত মারি। না মারিলে কি বিদ্যা হয়?
ভোঁদার মা। বাবা। মারিলে যদি বিদ্যা হয়, তবে আমাদের বাড়ীর কর্ত্তাটির কিছু হলো না কেন? ঝাঁটায় বল, কোঁস্তায় বল, আমি ত কিছুতেই কসুর করি না।
পণ্ডিত। বাছা! ওসব কি তোমাদের হাতে হয়? ও আমাদের হাতে।
ভোঁদার মা। বাবা। আমদের হাতে কিছুই জোরের কসুর নাই। দেখিবে?
এই বলিয়া ভোঁদার মা একগাছা বাঁকারি কুড়াইয়া লইল। পণ্ডিত মহাশয়, এইরূপ হঠাৎ অধিক বিদ্যালাভের সম্ভাবনা দেখিয়া সেখান হইতে ঊর্দ্ধশ্বাসে প্রস্থান করিলেন। শুনিয়াছি, সেই অবধি পণ্ডিত মহাশয়, আর ভোঁদাকে কিছু বলেন নাই। ভূ ধাতু লইয়া পাঠশালায় আর গোলযোগ হয় নাই। ভোঁদা বলে, “মা, এক বাঁকারিতে পণ্ডিত মহাশয়কে ভূতছাড়া করিয়াছে।”
দ্বিতীয় সংখ্যা-ধর্ম্ম-শিক্ষা
I. THEORY
“পড় বাবা, মাতৃবৎ পরদারেষু।”
ছেলে। সে কাকে বলে, বাবা?
বাপ। এই যত স্ত্রীলোক, পরের স্ত্রী, সবাইকে আপনার মা মনে করিতে হয়।
ছেলে। তারা সবাই আমার মা?
বাপ। হাঁ বাবা, তা বৈ কি।
ছেলে। বাবা, তবে তোমার বড় জ্বালা হলো। আমার মা হ’লে তারা তোমার কে হলো, বাবা?
বাপ। ছি! ছি! ছি! অমন কথা কি বলতে আছে। পড়,
“মাতৃবৎ পরদারেষু পরদ্রব্যেষু লোষ্ট্রবৎ।”
ছেলে। অর্থ কি হলো, বাবা?
বাপ। পরের সামগ্রীকে লোষ্ট্রের মত দেখ্বে।
ছেলে। লোষ্ট্র কি?
বাপ। মাটির ঢেলা।
ছেলে। বাবা, তবে ময়রা বেটাকে আর সন্দেশের দাম না দিলেও হয়—মাটির ঢেলার আর দাম কি?
বাপ। তা নয়। পরের সামগ্রী মাটির মত দেখ্বে—নিতে যেন ইচ্ছা না হয়।
ছেলে। বাবা, কুমারের ব্যবসা শিখ্লে হয় না?
বাপ। ছি বাবা। তোমার কিছু হবে না দেখ্ছি। এখন পড়,
“মাতৃবৎ পরদারেষু পরদ্রব্যেষু লোষ্ট্রবৎ।
আত্মবৎ সর্ব্বভূতেষু যঃ পশ্যতি স পণ্ডিতঃ॥”
ছেলে। আত্মবৎ সর্ব্বভূতেষু কি, বাবা?
বাপ। এই আপনার মত সকলকেই দেখ্বে।
ছেলে। তা হলেই ত হলো। যদি পরকে আপনার মত ভাবি, তা হলে পরের সামগ্রীকে আপনারই সামগ্রী ভাব্তে হবে, আর পরের স্ত্রীকেও আপনার স্ত্রী ভাব্তে হবে।
বাপ। দূর হ। পাজি বেটা, ছুঁচো বেটা। (ইতি চপেটাঘাত)
II. PRACTICE
(১)
কাদম্বিনী নামে কোন প্রৌঢ়া কলসীকক্ষে জল আনিতে যাইতেছে। তখন অধীতশাস্ত্র সেই বালক, তাহার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত।
ছেলে। বলি, মা!
কাদম্বিনী। কেন, বাছা! আহা, ছেলেটির কি মিষ্ট কথা গো! শুনে কান জুড়ায়।
ছেলে। মা, সন্দেশ খেতে একটি পয়সা দে না মা।
কাদম্বিনী। বাবা, আমি দুঃখী মানুষ, পয়সা কোথা পাব, বাবা?
ছেলে। দিবিনে বেটি? মুখপুড়ি! হতভাগি। আঁটকুড়ি!
কাদ। আ মলো। কাদের এমন পোড়ারমুখো ছেলে।
ছেলে। দিবিনে বেটি। (ইতি প্রহার এবং কলসী-ধ্বংস)
(পরে ছেলের বাপ সেই রঙ্গভূমে উপস্থিত)
বাপ। এ কি, রে বাঁদর?
ছেলে। কেন, বাবা! এ যে আমার মা। মার সঙ্গে যেমন করি, ওর সঙ্গেও তেমনি করেছি—“মাতৃবৎ পরদারেষু।” কই মাগি, বাবাকে দেখে তুই ঘোমটা দিলে নে?
(২)
ময়রা আসিয়া ছেলের বাপের কাছে নালিশ করিল যে, ছেলের জ্বালায় আর দোকান করা ভার, ছেলে দোকান লুঠ করিয়া সকল মিঠাই মণ্ডা লইয়া আসে। গোয়ালা আসিয়া ক্ষীর ছানা সম্বন্ধে সেইরূপ নালিশ করিল।
বাপ তখন ছেলেকে ধরিয়া আনিয়া প্রহার আরম্ভ করিলেন। ছেলে বলিল, “মার কেন বাবা।”
বাপ। মার্ব না? তুই পরের দ্রব্য সামগ্রী লুটে পুটে আনিস্।
ছেলে। বাবা, চোরের ভয় হয়েছে, তাই ঢিল কুড়িয়ে জমা করেছি—পরের সামগ্রী ত ঢিল।
(৩)
সরস্বতীপূজা উপস্থিত। বাপ প্রাতঃকালে ছেলেকে বলিলেন, “যা, একটা ডুব দিয়ে এসে অঞ্জলি দে—নহিলে খেতে পাবিনে।”
ছেলে। খেয়ে দেয়ে বিকেলে অঞ্জলি দিলে হয় না?
বাপ। তাও কি হয়? খেয়ে কি অঞ্জলি দেওয়া হয়, রে পাগল?
ছেলে। তবে এ বছরের অঞ্জলি আর বছর একেবারে দিলে হয় না? এবার বড় শীত।
বাপ। তা হয় না—সরস্বতীকে অঞ্জলি না দিলে কি বিদ্যা হয়?
ছেলে। একটা বছর কি ধারে বিদ্যা হয় না?
বাপ। দূর, মূর্খ। যা, ডুব দিয়ে আস্গে যা। অঞ্জলি দেওয়া হ’লে দুটো ভাল সন্দেশ দেব এখন।
“আচ্ছা” বলিয়া ছেলে নাচিতে নাচিতে ডুব দিতে গেল। বড় শীত—তেমনি বাতাস—জল কন্কনে। তখন ছেলে ভাবিয়া চিন্তিয়া, ঘাটে একটা পাঁচ বছরের বাগ্দীর ছেলে রহিয়াছে দেখিয়া তাহাকে ধরিয়া, গোটা দুই চুবানি দিল। তার পর তাকে জল হইতে তুলিয়া টানিয়া বাপের কাছে ধরিয়া আনিল। বলিল, “বাবা! নেয়ে এসেছি।”
বাপ। কই বাপু,—কই নেয়েছ?
ছেলে। এই যে বাগ্দী ছোঁড়াটাকে চুবিয়ে এনেছি।
বাপ। বড় কাজই করেছ—তুই নেয়ে এসেছিস্ কই?
ছেলে। বাবা, “আত্মবৎ সর্ব্বভূতেষু” ওতে আমাতে কি তফাৎ আছে? ওর নাওয়াতেই আমার নাওয়া হয়েছে। এখন সন্দেশ দাও।
পিতা বেত্রহস্তে পুত্রের পিছু পিছু ছুটিলেন। পুত্র পলাইতে পলাইতে বলিতে লাগিল, “বাবা শাস্ত্র জানে না।”
কিছু পরে সেই সুশিক্ষিত বালকের পিতা শুনিলেন যে, সে ও পাড়ায় শিরোমণি ঠাকুরের টোলে গিয়া শিরোমণি ঠাকুরকে বিলক্ষণ প্রহার করিয়াছে। ছেলে ঘরে এলে পিতা জিজ্ঞাসা করিলেন, “আবার এ কি করেছিস?”
ছেলে। কি করি বাবা। তুমি ত ছাড়বে না—বেত মারিবেই মারিবে। তাই আপনা আপনি সেই বেত খেয়েছি।
পিতা। সে কি রে বেটা?—আপনা আপনি কি? শিরোমণি ঠাকুরকে মেরেছিস্ যে?
ছেলে। বাবা—আত্মবৎ সর্ব্বভূতেষু— শিরোমণি ঠাকুরে আর আমাতে কি আমি তফাৎ দেখি?
পিতা প্রতিজ্ঞা করিলেন, ছেলেকে আর লেখা পড়া শিখাইবেন না।
- ↑ অস্যার্থ। কৃপণদিগের ধন আর যাহারা পোষ্যপুত্ররূপ কুষ্মাণ্ডগুলি প্রতিপালন করেন, তাঁহাদিগের ধন ভূতের বাপের শ্রাদ্ধে নষ্ট হইবে সন্দেহ নাই।