লোকরহস্য (১৯৩৯)/সুবর্ণগোলক

সুবর্ণগোলক

 কৈলাসশিখরে, নবমুকুলশোভিত দেবদারুতলায় শার্দ্দুলচর্ম্মাসনে বসিয়া হরপার্ব্বতী পাশা খেলিতেছিলেন। বাজি একটি স্বর্ণগোলক। মহাদেবের খেলায় দোষ এই— আড়ি মারিতে পারেন না—তাহা পারিলে সমুদ্রমন্থনের সময়ে বিষের ভাগটা তাঁহার ঘাড়ে পড়িত না। গৌরী আড়ি মারিতে পটু—প্রমাণ, পৃথিবীতে তাঁহার তিন দিন পূজা। আর খেলায় যত হউক না হউক, কান্নাইয়ে অদ্বিতীয়া, কেন না, তিনিই আদ্যাশক্তি। মহাদেবের ভাল দান পড়িলে কাঁদিয়া হাট বাঁধান— আপনার যদি পড়ে পাঁচ দুই সাত, তবে হাঁকেন পোয়া বারো। হাঁকিয়া তিন চক্ষে মহাদেবের প্রতি কটাক্ষ করেন—যে কটাক্ষে সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয় হয়, তাহার গুণে মহাদেব দান দেখিয়াও দেখিতে পায়েন না। বলা বাহুল্য যে, দেবাদিদেবের হার হইল। ইহাই রীতি।

 তখন মহাদেব পার্ব্বতীকে স্বীকৃত কাঞ্চনগোলক প্রদান করিলেন। উমা তাহা গ্রহণ করিয়া পৃথিবীতে নিক্ষেপ করিলেন। দেখিয়া পঞ্চানন ভ্রূকুটী করিয়া কহিলেন, “আমার প্রদত্ত গোলক ত্যাগ করিলে কেন?”

 উমা কহিলেন, “প্রভো, আপনার প্রদত্ত গোলক অবশ্য কোন অপূর্ব্ব শক্তিবিশিষ্ট এবং মঙ্গলপ্রদ হইবে। মনুষ্যের হিতার্থে তাহা প্রেরণ করিয়াছি।”

 গিরিশ বলিলেন, “ভদ্রে। প্রজাপতি, বিষ্ণু, এবং আমি, এই তিন জনে যে সকল নিয়ম নিবদ্ধ করিয়া সৃষ্টিস্থিতিলয় করিতেছি, তাহার ব্যতিক্রমে কখন মঙ্গল হয় না। যে মঙ্গল হইবার, তাহা সেই সকল নিয়মাবলির বলেই ঘটিবে। কাঞ্চনগোলকের কোন প্রয়োজন নাই। যদি ইহার কোন মঙ্গলপ্রদ গুণ হয়, তবে নিয়মভঙ্গ দোষে লোকের অনিষ্ট হইবে। তবে তোমার অনুরোধে উহাকে একটি বিশেষ গুণযুক্ত করিলাম। বসিয়া উহার কার্য্য দর্শন কর।”


 কালীকান্ত বসু বড় বাবু। বয়স বৎসর পঁয়ত্রিশ, দেখিতে সুন্দর পুরুষ, কয় বৎসর হইল, পুনর্ব্বার দার পরিগ্রহ করিয়াছেন। তাঁহার স্ত্রী কামসুন্দরীর বয়ঃক্রম আঠার বৎসর। তাঁহার পত্নী তাহার পিতৃভবনে ছিল। কালীকান্তবাবু স্ত্রীর সম্ভাষণে শ্বশুরবাড়ী যাইতেছিলেন। শ্বশুর বিশেষ সম্পন্ন ব্যক্তি—গঙ্গাতীরবর্ত্তী গ্রামে বাস। কালীকান্ত ঘাটে নৌকা লাগাইয়া পদব্রজে যাইতেছিলেন, সঙ্গে রামা চাকর একটা পোর্টমাণ্টো বহিয়া যাইতেছিল। পথিমধ্যে কালীকান্তবাবু দেখিলেন, একটি স্বর্ণগোলক পড়িয়া আছে। বিস্মিত হইয়া তাহা উঠাইয়া লইলেন। দেখিলেন, সুবর্ণ বটে। প্রীত হইয়া তাহা ভৃত্য রামাকে রাখিতে দিলেন; বলিলেন, “এটা সোণার দেখিতেছি। কেহ হারাইয়া থাকিবে। যদি কেহ খোঁজ করে, বাহির করিয়া দিব। নহিলে বাড়ী লইয়া যাইব। এখন রাখ।”

 রামা বস্ত্রমধ্যে গোলকটি লুকাইয়া রাখিবার অভিপ্রায়ে, পথে পোর্টমাণ্টো নামাইল। পরে কালীকান্তবাবুর হস্ত হইতে গোলকটি গ্রহণ করিয়া বস্ত্রমধ্যে লুকাইল।

 কিন্তু রামা আর পোর্টমাণ্টো মাথায় তুলিল না। কালীকান্তবাবু স্বয়ং তাহা উঠাইয়া মাথায় করিলেন। রামা অগ্রসর হইয়া চলিল, বাবু মোট মাথায় পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। তখন রামা বলিল, “ওরে রামা”

 বাবু বলিলেন, “আজ্ঞা?”

 রামা বলিল, “তুই বড় বেআদব, দেখিস্ যেন আমার শ্বশুরবাড়ী গিয়া বেআদবি করিস্ না। তাহারা ভদ্রলোক।”

 বাবু বলিলেন, “আজ্ঞে তা কি পারি? আপনি হচ্ছেন মুনিব—আপনার কাছে কি বেআদবি করিতে পারি?”


 কৈলাসে গৌরী বলিলেন, “প্রভো, আমি ত কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। আপনার স্বর্ণগোলকের কি গুণ এ?”

 মহাদেব বলিলেন, “গোলকের গুণ চিত্তবিনিময়। আমি যদি নন্দীর হাতে এই গোলক দিই, তবে নন্দী ভাবিবে, আমি মহাদেব, আমাকে ভাবিবে নন্দী; আমি ভাবিব, আমি নন্দী, নন্দীকে ভাবিব মহাদেব। রামু ভাবিতেছে, আমি কালীকান্ত বসু, কালীকান্তকে ভাবিতেছে, এ রামা চাকর। কালীকান্ত ভাবিতেছে, আমি রামা খানসামা, রামাকে ভাবিতেছে, কালীকান্তবাবু।”


 কালীকান্তবাবু যখন শ্বশুরবাড়ী পৌছিলেন, তখন তাঁহার শ্বশুর অন্তঃপুরে। কিন্তু বাহিরে একটা গণ্ডগোল উঠিল। দ্বারবান্ রামদীন পাঁড়ে বলিতেছে, “আরে ও খানসামাজি, তোম হুঁয়া মৎ বইঠিও—তোম হামারা পাশ আও।” শুনিয়া রামা গরম হইয়া, চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া বলিতেছে, “যা বেটা মেড়ুয়াবাদী যা—তোর আপনার কাজ করগে।”

 দ্বারবান্ পোর্টমাণ্টো নামাইয়া নিল। কালীকান্ত বলিল, “দরওয়ানজি, বাবুকে অমন করিয়া অপমান করিও না। উনি রাগ করিয়া চলিয়া যাইবেন।”

 দ্বারবান্ জামাইবাবুকে চিনিত, খানসামাকে চিনিত না। কালীকান্তের মুখে এইরূপ কথা শুনিয়া মনে করিল, যেখানে জামাইবাবুই ইহাকে বাবু বলিতেছেন, সেখানে ইনি কোন ছদ্মবেশী বড় লোক হইবেন। দ্বারবান্ তখন ভক্তিভাবে রামাকে যুক্তকরে আশীর্ব্বাদ করিয়া কহিল, “গোলামকি কসুর মাপ কিজিয়ে!” রামা কহিল, “আচ্ছা, তামাকু ভেজ দেও!”

 শ্বশুরবাড়ীর খানসামা উদ্ধব, অতি প্রাচীন পুরাতন ভৃত্য। সেই বাঁধা হুঁকায় তামাকু সাজিয়া আনিল। রামা, তাকিয়ায় হেলান দিয়া, তামাকু খাইতে লাগিল। কালীকান্ত চাকরদের ঘরে গিয়া, কলিকায় তামাকু খাইতে লাগিল। উদ্ধব বিস্মিত হইয়া কহিল, “দাদা ঠাকুর, এ কি এ?” কালীকান্ত কহিল, “ওঁর সাক্ষাতে কি তামাকু খাইতে পারি?”

 উদ্ধব গিয়া অন্তঃপুরে কর্ত্তাকে সংবাদ দিল, “জামাইবাবু আসিয়াছেন, তাঁহার সঙ্গে একজন কে ছদ্মবেশী মহাশয় এসেছেন— জামাইবাবু তাঁকে বড় মানেন, তাঁর সাক্ষাতে তামাকু পর্য্যন্ত খান না।”

 কর্ত্তা নীলরতনবাবু শীঘ্র বহির্ব্বাটীতে আসিলেন। কালীকান্ত তাঁহাকে দেখিয়া দূর হইতে একটি সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিয়া সরিয়া গেল। রামা আসিয়া নীলরতনের পায়ের ধূলা লইয়া কোলাকুলি করিল। নীলরতন ভাবিল, “সঙ্গের লোকটা সভ্যভব্য বটে— তবে জামাই বাবাজিকে কেমন কেমন দেখিতেছি।”

 নীলরতনবাবু রামাকে স্বাগত জিজ্ঞাসা করিতে বসিলেন, কিন্তু কথাবার্তা শুনিয়া কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। এদিকে অন্তঃপুর হইতে জলযোগের স্থান হইয়াছে বলিয়া পরিচারিকা কালীকান্তকে ডাকিতে আসিল। কালীকান্ত বলিল, “বাপ রে, আমি কি বাবুর আগে জল খেতে পারি! আগে বাবুকে জল খাওয়াও। তার পর আমার হবে এখন। আমি, মাঠাকুরুণ, আপনাদের খাচ্চিই ত।”

 “মাঠাকুরুণ” শুনিয়া পরিচারিকা মনে করিল, “জামাইবাবু আমাকে একজন শাশুড়ী টাশুড়ী মনে করিয়াছেন—না করবেন কেন; আমাকে ভাল মানুষের মেয়ে বই ত আর ছোট লোকের মেয়ের মত দেখায় না। এঁরা দশটা দেখেছেন—মানুষ চিনতে পারেন—কেবল এই বাড়ীর পোড়া লোকেই মানুষ চেনে না।” অতএব বিন্দী চাকরাণী জামাইবাবুর উপর বড় খুসি হইয়া অন্তঃপুরে গিয়া বলিল, “জামাইবাবুর বিবেচনা ভাল—সঙ্গের মানুষটি না খেলে কি তিনি খেতে পারেন— তা আগে তাঁকে জল খাওয়াও, তবে জামাই খাবেন।”

 বাড়ীর গৃহিণী মনে ভাবিলেন, “সে উপরি লোক, তাহাকে বাড়ীর ভিতরে আনিয়া জল খাওয়ান হইতে পারে না। জামাইকেও বাহিরে খাওয়ান হইতে পারে না। তা, তার যায়গা হউক বাহিরে, আর জামাইয়ের যায়গা হউক ভিতরে।” গৃহিণী সেইরূপ বন্দোবস্ত করিলেন। রামা বাহিরে জলযোগের উদ্যোগ দেখিয়া বড় ক্রুদ্ধ হইল, ভাবিল, “এ কি অলৌকিকতা?” এদিকে দাসী কালীকান্তকে অন্তঃপুরে ডাকিয়া আনিল। ঘরের ভিতর স্থান হইয়াছে, কিন্তু কালীকান্ত উঠানে দাঁড়াইয়া বলিল, “আমাকে ঘরের ভিতর কেন? আমাকে এইখানে হাতে দুটো ছোলা গুড় দাও, খেয়ে একটু জল খাই।” শুনিয়া শালীরা বলিল, “বোসজা মশাই যে, এবার অনেক রকম রসিকতা শিখে এয়েছ দেখতে পাই।” কালীকান্ত কাতর হইয়া বলিল, “আজ্ঞে আমাকে ঠাট্টা করেন কেন, আমি কি আপনাদের তামাসার যোগ্য?” একজন প্রাচীনা ঠাকুরাণীদিদি বলিল, “আমাদের তামাসার যোগ্য কেন? —যার তামাসার যোগ্য, তার কাছে চল।” এই বলিয়া কালীকান্তের হাত ধরিয়া হড়হড় করিয়া টানিয়া ঘরের ভিতর লইয়া আসিল।

 সেখানে কালীকান্তের ভার্য্যা কামসুন্দরী দাঁড়াইয়া ছিল। কালীকান্ত তাহাকে দেখিয়া প্রভুপত্নী মনে করিয়া সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিল।

 কামসুন্দরী দেখিয়া, চন্দ্রবদনে মধুর হাসি হাসিয়া বলিল, “ওকি ও রঙ্গ—এ আবার কোন্ ঠাট শিখিয়া আসিয়াছ?” শুনিয়া কালীকান্ত কাতর হইয়া কহিল, “আজ্ঞে, আমার সঙ্গে অমন সব কথা কেন—আমি আপনার চাকর-আপনি মুনিব।”

 রসিকা কামসুন্দরী বলিল, “তুমি চাকর, আমি মুনিব, সে আজ না কাল? যত দিন আমার বয়স আছে, তত দিন এই সম্পর্কই থাকিবে। এখন জল খাও।”

 কালীকান্ত মনে করিল, “বাবা, এঁর কথার ভাব যে কেমন কেমন। আমাদের বাবু যে একটা গেছো মেয়ের হাতে পড়েছেন দেখতে পাই। তা আমার সরাই ভাল।” এই ভাবিয়া কালীকান্ত পুনর্ব্বার ভক্তিভাবে প্রণাম করিয়া পলাইবার উদ্যোগ করিতেছিলেন, দেখিয়া কামসুন্দরী আসিয়া তাঁহার গাত্রবস্ত্র ধরিল; বলিল, “ওরে আমার সোণার চাঁদ! আমার সাত রাজার ধন এক মাণিক। আমার কাছ থেকে আর পলাতে হয় না।” এই বলিয়া কামসুন্দরী স্বামীকে আসনের দিকে টানিতে লাগিল।

 কালীকান্ত আন্তরিক কাতরতার সহিত হাত যোড় করিয়া বলিতে লাগিল, “দোহাই বৌঠাকুরাণি, আপনার সাত দোহাই— আমাকে ছাড়িয়া দিন— আপনি আমার স্বভাব জানেন না—আমি সে চরিত্রের লোক নই।” কামসুন্দরী হাসিয়া বলিল, “তুমি যে চরিত্রের লোক, আমি বেশ জানি—এখন জল খাও।”

 কালীকান্ত বলিল, “যদি আপনার কাছে কেহ আমার এমন নিন্দা করিয়া থাকে, তবে সে ঠক—ঠকাম করিয়াছে। আপনার কাছে হাতযোড় করিতেছি, আপনি আমার গুরুজন—আমায় ছাড়িয়া দিন।”

 কামসুন্দরী রসিকতাপ্রিয়; মনে করিল যে, এ একতর নূতন রসিকতা রটে। বলিল, “প্রাণাধিক, তুমি কত রসিকতা শিখিয়া আসিয়াছ, তাহা বুঝা যাইবে।” এই বলিয়া স্বামীর দুই হস্ত ধারণ করিয়া আসনে বসাইবার জন্য টানিতে লাগিল।

 হস্তধারণ মাত্র কালীকান্ত সর্ব্বনাশ হইল মনে করিয়া “বাবা রে, গেলাম রে, এগো রে, আমায় মেরে ফেল্লে রে” বলিয়া চীৎকার আরম্ভ করিল। চীৎকার শুনিয়া গৃহস্থ সকলে ভীত হইয়া দৌড়িয়া আসিল। মা, ভগিনী, পিসী প্রভৃতিকে দেখিয়া কামসুন্দরী স্বামীর হস্ত ছাড়িয়া দিল। কালীকান্ত অবসর পাইয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল।

 গৃহিণী কামসুন্দরীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি লা কামি— জামাই অমন করে উঠলো কেন? তুই কি মেরেছিস্?”

 বিস্মিতা কামসুন্দরী মর্ম্মপীড়িতা হইয়া কহিল, “মারিব কেন? আমি মারিব কেন—আমার যেমন পোড়া কপাল।” ক্রমে ক্রমে সুর কাঁদনিতে চড়িতে লাগিল—“আমার যেমন পোড়া কপাল—কোন্ আবাগী আমার সর্ব্বনাশ করেছে—কে ওষুধ করেছে—” বলিতে বলিতে কামসুন্দরী কাঁদিয়া হাট লাগাইল।

 সকলেই বলিল, “হুঁ। তুই মেরেছিস্; নহিলে অমন করে কাতরাবে কেন?” এই বলিয়া সকলে, কামকে “পাপিষ্ঠা” “ডাইনী” “রাক্ষসী” ইত্যাদি কথায় ভর্ৎসনা করিতে লাগিল। কামসুন্দরী বিনাপরাধে নিন্দিতা ও ভর্ৎসিতা হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ঘরে গিয়া দ্বার দিয়া শুইয়া পড়িল।

 এদিকে কালীকান্ত বাহিরে আসিয়া দেখিল যে, বড় একটা গোলযোগ বাধিয়া উঠিয়াছে। নীলরতনবাবু স্বয়ং এবং দ্বারবান্ ও উদ্ধব, সকলে পড়িয়া যে যেখানে পাইতেছে, সে সেইখানে রামাকে প্রহার করিতেছে; কিল, লাতি, চড়, চাপড়ের বৃষ্টির মধ্যে রামা চাকর কেবল বলিতেছে, “ছেড়ে দে রে, বাবা রে, জামাই মারে, এমন কখন শুনি নাই, আমার কি—তোদেরই মেয়েকে একাদশী করতে হবে।” নিকটে দাঁড়াইয়া তরঙ্গ চাকুরাণী হাসিতেছে, সে সর্ব্বদা কালীকান্তবাবুর বাড়ীতে যাতায়াত করিত, সে রামা চাকরকে চিনিত, সেই বলিয়া দিয়াছে। কালীকান্তবাবু মারপিট দেখিয়া ক্ষিপ্তের ন্যায় উঠানময় বেড়াইতে লাগিল, বলিতে লাগিল, “কি সর্ব্বনাশ হইল। বাবুকে মারিয়া ফেলিল।” ইহা দেখিয়া নীলরতনবাবু আরও কোপাবিষ্ট হইয়া রামাকে বলিতে লাগিলেন, “তুই বেটাই জামাইকে কি খাওয়াইয়া পাগল করিয়া দিয়াছিস্ —মার বেটাকে জুতো।” এই কথা বলায়, যেমন শ্রাবণ মাসে বৃষ্টির উপর বৃষ্টি চাপিয়া আইসে, তেমনি নির্দ্দোষী রামার উপর প্রহারবৃষ্টি চাপিয়া আসিল। মারপিটের চোটে বস্ত্রমধ্য হইতে লুকান স্বর্ণগোলকটি পড়িয়া গেল। দেখিয়া তরঙ্গ চাকুরাণী তাহা কুড়াইয়া লইয়া নীলরতনবাবুর হস্তে দিল। বলিল, “ও মিন্সে চোর! দেখুন, ও একটা সোণার তাল চুরি করিয়া রাখিয়াছে।” “দেখি” বলিয়া নীলরতনবাবু স্বর্ণগোলক হস্তে লইলেন,—অমনি তিনি রামাকে ছাড়িয়া দিয়া, সরিয়া দাঁড়াইয়া কোঁচার কাপড় খুলিয়া মাথায় দিলেন; তরঙ্গও মাথার কাপড় খুলিয়া, কোঁচা করিয়া পরিয়া, পাদুকা হস্তে রামাকে মারিতে প্রবৃত্ত হইল।

 উদ্ধব তরঙ্গকে বলিল, “তুই মাগি আবার এর ভিতর এলি কেন?”

 তরঙ্গ বলিল, “কাকে মাগি বলিতেছিস্?”

 উদ্ধব বলিল, “তোকে।”

 “আমাকে ঠাট্টা?” এই বলিয়া তরঙ্গ মহাক্রোধে হস্তের পাদুকার দ্বারা উদ্ধবকে প্রহার করিল। উদ্ধবও ক্রুদ্ধ হইয়া, স্ত্রীলোককে মারিতে না পারিয়া, নীলরতনবাবুর দিকে চাহিয়া বলিল, “দেখুন দেখি কর্ত্তা মহাশয়, মাগির কত বড় স্পর্দ্ধা, আমাকে জুতা মারে!” কর্ত্তা তখন একটুখানি ঘোমটা টানিয়া, একটু রসের হাসি হাসিয়া, মৃদুস্বরে কহিলেন, “তা মেরেছেন মেরেছেন, তুমি রাগ করিও না। মুনিব —মারতে পারেন।”

 শুনিয়া উদ্ধব আরও ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল, “ও আবার কিসের মুনিব—ওও চাকর, আমিও চাকর। আপনি এমনি আজ্ঞা করেন! আমি আপনারই চাকর, ওর চাকর কেন হব? আমি এমন চাকরি করি না।”

 শুনিয়া কর্ত্তা আবার একটু মধুর হাসি হাসিয়া বলিলেন, “মরণ আর কি! বুড়ো বয়সে মিন্সের রস দেখ? আমার চাকর আবার তুমি কিসে হতে গেলে?”

 উদ্ধর অবাক্ হইল, মনে করিল, “আজ কি পাগলের পাড়া পড়িয়াছে নাকি?” উদ্ধব বিস্মিত হইয়া রামাকে ছাড়িয়া দাঁড়াইল।

 এমত সময়ে বাড়ীর গোরক্ষক গোবর্দ্ধন ঘোষ সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। সে তরঙ্গের স্বামী। সে তরঙ্গের অবস্থা ও কার্য্য দেখিয়া বিস্মিত হইল— তরঙ্গ তাহাকে গ্রাহ্যও করিল না। এদিগে কর্ত্তামহাশয় গোবর্দ্ধনকে দেখিয়া ঘোমটা টানিয়া এক পাশে দাঁড়াইলেন। গোবর্দ্ধনকে আড়ে আড়ে দেখিয়া চুপি চুপি বলিলেন, “তুমি উহার ভিতর যাইও না।” গোবর্দ্ধন তরঙ্গের আচরণ দেখিয়া অত্যন্ত রুষ্ট হইয়াছিল—সে কথা তাহার কাণে গেল না; সে তরঙ্গের চুল ধরিতে গেল। “নচ্ছার মাগি, তোর হায়া নেই” এই বলিয়া গোবর্দ্ধন অগ্রসর হইতেছিল, দেখিয়া তরঙ্গ বলিল, “গোবরা, তুইও কি পাগল হয়েছিস না কি? যা, গোরুর যাব দিগে যা।” শুনিয়া গোবর্দ্ধন, তরঙ্গের কেশাকর্ষণ করিয়া উত্তম মধ্যম আরম্ভ করিল। দেখিয়া নীলরতনবাবু বলিলেন, “যা! পোড়াকপালে মিন্সে কর্ত্তাকে ঠেঙ্গিয়া খুন করলে।” এদিগে তরঙ্গও ক্রুদ্ধ হইয়া “আমার গায়ে হাত তুলিস” বলিয়া গোবর্দ্ধনকে মারিতে আরম্ভ করিল। তখন একটা বড় গোলযোগ হইয়া উঠিল। শুনিয়া পাড়ার প্রতিবাসী রাম মুখোপাধ্যায়, গোবিন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি আসিয়া উপস্থিত হইল। রাম মুখোপাধ্যায় একটা সুবর্ণগোলক পড়িয়া আছে দেখিয়া গোবিন্দ চট্টোপাধ্যায়ের হস্তে দিয়া বলিলেন, “দেখুন দেখি মহাশয়, এটা কি?”


 কৈলাসে পার্ব্বতী বলিলেন, “প্রভো! আপনার গোলক সম্বরণ করুন—ঐ দেখুন, গোবিন্দ চট্টোপাধ্যায় বৃদ্ধ রাম মুখোপাধ্যায়ের অন্তঃপুরমধ্যে প্রবেশ করিয়া রামের বৃদ্ধা ভার্য্যাকে পত্নী সম্বোধনে কৌতুক করিতেছে। আর রাম মুখোপাধ্যায়ের পরিচারিকা তাহার আচরণ দেখিয়া তাহাকে সম্মার্জনী প্রহার করিতেছে। এদিগে বৃদ্ধ রাম মুখোপাধ্যায়, আপনাকে যুবা গোবিন্দ চট্টোপাধ্যায় মনে করিয়া, তাঁহার অন্তঃপুরে গিয়া তাঁহার ভার্য্যাকে টপ্পা শুনাইতেছে। এ গোলক আর মুহূর্ত্তকাল পৃথিবীতে থাকিলে গৃহে গৃহে বিশৃঙ্খলা হইবে। অতএব আপনি ইহা সম্বরণ করুন।”

 মহাদেব কহিলেন, “হে শৈলসুতে। আমার গোলকের অপরাধ কি? এ কাণ্ড কি আজ নূতন পৃথিবীতে হইল? তুমি কি নিত্য দেখিতেছ না যে, বৃদ্ধ যুবা সাজিতেছে, যুবা বৃদ্ধ সাজিতেছে, প্রভু ভৃত্যের তুল্য আচরণ করিতেছে, ভৃত্য প্রভু হইয়া বসিতেছে। কবে না দেখিতেছ যে, পুরুষ স্ত্রীলোকের ন্যায় আচরণ করিতেছে, স্ত্রীলোক পুরুষের মত ব্যবহার করিতেছে? এ সকল পৃথিবীতে নিত্য ঘটে, কিন্তু তাহা যে কি প্রকার হাস্যজনক, তাহা কেহ দেখিয়াও দেখে না। আমি তাহা একবার সকলের প্রত্যক্ষীভূত করাইলাম। এক্ষণে গোলক সম্বৃত করিলাম। আমার ইচ্ছায় সকলেই পুনর্ব্বার স্ব স্ব প্রকৃতিস্থ হইবে, এবং যাহা যাহা ঘটিয়া গিয়াছে, তাহা কাহারও স্মরণ থাকিবে না। তবে, লোকহিতার্থে আমার বরে বঙ্গদর্শন এই কথা পৃথিবীমধ্যে প্রচারিত করিবে।”