শকুন্তলা (আদি ব্রাহ্মসমাজ সংস্করণ)/তপোবনে

তপোবনে।

 রাজা রাজ্যে চলে গেলেন, আর শকুন্তলা সেই বনে দিন গুন্‌তে লাগল।

 যাবার সময় রাজা নিজের মোহর আংটী শকুন্তলাকে দিয়ে গেলেন, বলে গেলেন—সুন্দরি, তুমি প্রতিদিন আমার নামের একটি করে অক্ষর পড়বে, নামও শেষ হবে আর বনপথে সোণার রথ তোমাকে নিতে আসবে।”

 কিন্তু হায়, সোণার রথ কই এল?

 কত দিন গেল, কত রাত গেল; দুষ্মন্ত নাম কতবার পড়া হয়ে গেল, তবু সোণার রথ কই এল! হায় হায়, সোণার সাঁঝে সোণার রথ সেই যে গেল আর ফিরল না!

 পৃথিবীর রাজা সোণার সিংহাসনে, আর বনের রাণী কুটীর দুয়ারে,—দুই জনে দুই খানে।

 রাজার শোকে শকুন্তলার মন ভেঙ্গে পড়ল। কোথা রইল অতিথিসেবা, কোথা রইল পোষা হরিণ, কোথা রইল সাধের নিকুঞ্জবনে প্রাণের দুই প্রিয়সখী! শকুন্তলার মুখে হাসি নেই, চোখে ঘুম নেই! রাজার ভাবনা নিয়ে কুটীর দুয়ারে পাষাণ-প্রতিমা বসে রইল।

 রাজার রথ কেন এল না? কেন রাজা ভুলে রইলেন?

 রাজা রাজ্যে গেলে একদিন শকুন্তলা কুটীর দুয়ারে গালে হাত দিয়ে বসে বসে রাজার কথা ভাবছে—ভাবছে আর কাঁদছে, এমন সময় মহর্ষি দুর্ব্বাসা দুয়ারে অতিথি এলেন, শকুন্তলা জানতেও পারলে না, ফিরেও দেখলে না। একে দুর্ব্বাসা মহা অভিমানী, একটুতেই মহা রাগ হয়, কথায় কথায় যা’কে তা’কে ভস্ম করে ফেলেন, তা’র উপর শকুন্তলার এই অনাদর—তাঁ’কে প্রণাম করলে না, বসতে আসন দিলে না, পা ধোবার জল দিলে না।

 দুর্ব্বাসার সর্বাঙ্গে যেন আগুণ ছুটল, রাগে কাঁপ্‌তে কাঁপ্‌তে বললেন—“কি অতিথির অপমান? পাপীয়সি, এই অভিশম্পাত করছি—যা’র জন্যে আমার অপমান করলি সে যেন তোকে কিছুতে না চিনতে পারে।”

 হায়, শকুন্তলার কি তখন জ্ঞান ছিল—যে দেখবে কে এল কে গেল! দুর্ব্বাসার একটি কথাও তা’র কাণে গেল না। মহামানী মহর্ষি দুর্ব্বাসা ঘোর অভিশম্পাত করে চলে গেলেন—সে কিছুই জানতে পারলে না, কুটীর দুয়ারে আনমনে যেমন ছিল তেমনি রইল। অনসূয়া প্রিয়ম্বদা দুই সখী উপবনে ফুল তুলছিল, ছুটে এসে দুর্ব্বাসার পায়ে লুঠিয়ে পড়ল। কত সাধ্য সাধনা করে, কত কাকুতি মিনতি করে, কত হাতে পায়ে ধরে দুর্ব্বাসাকে শান্ত করলে। শেষ এই শাপান্ত হ’ল—“রাজা যাবার সময় শকুন্তলাকে যে আংটী দিয়ে গেছেন সেই আংটী যদি রাজাকে দেখাতে পারে তবেই রাজা শকুন্তলাকে চিনবেন; যত দিন সেই আংটী রাজার হাতে না পরবে ততদিন রাজা সব ভূলে থাকবেন।” দুর্ব্বাসার অভিশাপে তাই পৃথিবীর রাজা সব ভুলে রইলেন। বনপথে সোণার রথ আর ফিরে এল না।

 এদিকে দুর্ব্বাসাও চলে গেলেন আর তাতঃ কণ্ব তপোবনে ফিরে এলেন। সারা পৃথিবী খুঁজে শকুন্তলার মেলেনি। তিনি ফিরে এসে শুনলেন সারা পৃথিবীর রাজা বনে এসে তা’র গলায় মালা দিয়েছেন। তাতঃ কণ্বের আনন্দের সীমা রইল না, তখনি শকুন্তলাকে রাজার কাছে পাঠাবার উদ্‌যোগ করতে লাগলেন। দুঃখে অভিমানে শকুন্তলা মাটীতে মিশে ছিল, তা’কে কত আদর করলেন, কত আশীর্ব্বাদ করলেন!

 উপবনে দুই সখী যখন শুনলে শকুন্তলা শ্বশুরবাড়ি চল্লো, তখন তা’দের আর আহ্লাদের সীমা রইল না! প্রিয়ম্বদা কেশর ফুলের হার নিলে, অনসূয়া গন্ধফুলের তেল নিলে। দুই সখীতে শকুন্তলাকে সাজাতে বসল।

 তা’র মাথায় তেল দিলে, খোঁপায় ফুল দিলে কপালে সিদুঁর দিলে, পায়ে আল্‌তা দিলে, নতুন বাকল দিলে;—তবু ত মন উঠল না? সখীর এ কি বেশ করে দিলে?

 প্রিয়সখী শকুন্তলা পৃথিবীর রাণী, তা’র কি এই সাজ? হাতে মৃণালের বালা, গলায় কেশরের মালা, খোঁপায় মল্লিকার ফুল, পরনে বাকল?—হায়, হায়, মতির মালা কোথায়? হীরের বালা কোথায়? সোণার মল কোথায়? পরণে সাড়ী কোথায়?

 বনের দেবতারা সখীদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করলেন।

 বনের গাছ থেকে সোণার সাড়ী উড়ে পড়ল, হাতের বালা খসে পড়ল, মতির মালা ঝরে পড়ল, পায়ের মল বেজে পড়ল। বনদেবতারা পলকে বনবাসিনী শকুন্তলাকে রাজ্যেশ্বরী মহারাণীর সাজে সাজিয়ে দিলেন।

 তারপর যাবার সময় হ’ল। হায়, যেতে কি পা সরে, মন কি চায়?

 শকুন্তলা কোন দিকে যাবে,—সোণার পুরীতে রাণীর মত রাজার কাছে চলে যাবে—না—তিন সখীতে বনপথে আজন্ম—কালের তপোবনে ফিরে যাবে?

 এদিকে শুভলগ্ন বহে যায়, ওদিকে বিদায় আর শেষ হয় না। কুঞ্জবনে মল্লিকা মাধবী কচি কচি পাতা নেড়ে ফিরে ডাকছে, মা-হারা হরিণ-শিশু সোণার আঁচল ধরে বনের দিকে টানছে, প্রাণের দুই প্রিয়সখী গলা ধরে কাঁদছে। এক দণ্ডে এত মায়া এত ভালবাসা কাটান কি সহজ?

 মা-হারা হরিণ-শিশুকে তাতঃ কণ্বের হাতে, প্রিয় তরুলতাদের প্রিয়সখীদের হাতে সঁপে দিতে কত বেলাই হ’য়ে গেল।

 তপোবনের শেষে বটগাছ, সেইখান থেকে তাতঃ কণ্ব ফিরলেন। দুই সখী কেঁদে ফিরে এল। আসবার সময় শকুন্তলার আঁচলে রাজার সেই আংটী বেঁধে দিলে, বলে দিলে—“দেখিস্‌, ভাই, যত্ন করে রাখিস।”

 তারপর বনের দেবতাদের প্রণাম করে, তাতঃ কণ্বকে প্রণাম করে, শকুন্তলা রাজপুরীর দিকে চলে গেল।

 পরের মেয়ে পর হ’য়ে পরের দেশে চলে গেল, বনখানা আঁধার করে গেল!

 ঋষির অভিশাপ কখন মিথ্যা হয় না। রাজপুরে যাবার পথে শকুন্তলা একদিন শচীতীর্থের জলে গা ধুতে গেল। সাঁতার জলে গা ভাসিয়ে, নদীর জলে ঢেউ নাচিয়ে শকুন্তলা গা ধুলে। রঙ্গভরে অঙ্গের সাড়ি জলের উপর বিছিয়ে দিলে; জলের মত চিকণ আঁচল জলের সঙ্গে মিশে গেল, ঢেউয়ের সঙ্গে গড়িয়ে গেল। সেই সময়ে দুর্ব্বাসার শাপে রাজার সেই আংটী শকুন্তলার চিকণ আঁচলের এক কোণ থেকে অগাধ জলে পড়ে গেল, শকুন্তলা জানতেও পারলে না।

 তারপর ভিজে কাপড়ে তীরে উঠে, কালো চুল এলো করে, হাসিমুখে শকুন্তলা বনের ভিতর দিয়ে রাজার কথা ভাবতে ভাবতে শূন্য আঁচল নিয়ে রাজপুরে চলে গেল। আংটীর কথা মনেই পড়ল না।