শকুন্তলা (আদি ব্রাহ্মসমাজ সংস্করণ)/রাজপুরে

রাজপুরে।

 দুর্ব্বাসার শাপে রাজা শকুন্তলাকে একেবারে ভুলে বেশ সুখে আছেন। সাত ক্রোশ জুড়ে রাজার সাত মহল বাড়ি; তা’র এক এক মহলে এক এক রকম কাজ চলছে। প্রথম মহলে রাজসভা;—সেখানে সোণার থামে সোণার ছাত, তা’র তলায় সোণার সিংহাসন; সেখানে দোষী নির্দ্দোষের বিচার চলছে। তারপর দেবমন্দির;—সেখানে সোণার দেওয়ালে মানিকের পাখী, মুক্তোর ফল, পান্নার পাতা; মাঝখানে প্রকাণ্ড হোমকুণ্ড,—সেখানে দিবাবাত্রি হোম হচ্ছে। তারপর অতিথি-শালা;—সেখানে সোণার থালায় দুসন্ধ্যা লক্ষ লক্ষ অতিথি খাচ্ছে। তারপর নৃত্যশালা;—সেখানে নাচ চলছে, সানের উপর সোনার নুপুর রুণুঝুনু বাজছে, ম্ফটিকের দেয়ালে অঙ্গের ছায়া তালে তালে নাচছে। সঙ্গীতশালায় গান চলছে, অন্তঃপুরে সংসারের কাজ চলছে, উপবনে উৎসব চলছে। সোণার পালঙ্কে পৃথিবীর রাজা দুষ্মন্ত বসে আছেন, দক্ষিণ-দুয়ারি ঘরে দক্ষিণের বাতাস আসছে;—শকুন্তলার কথা তাঁ’র মনেই নাই। হায়, দুর্ব্বাসার শাপে সুখের অন্তঃপুরে সোণার পালঙ্কে রাজা সব ভুলে রইলেন।

 আর শকুন্তলা কত ঝড় বৃষ্টিতে—কত পথ চলে—রাজার কাছে এল, রাজা চিনতেও পারলেন না; বললেন—“কন্যে, তুমি কেন এসেছ? কি চাও? টাকা কড়ি চাও,—না—ঘর বাড়ি চাও, কী চাও?’

 শকুন্তলা বল্‌লে—“মহারাজ, আমি টাকাও চাই না, কড়িও চাই না, ঘর বাড়ি কিছুই চাই না, আমি চাই তোমায়। তুমি আমার রাজা, আমার গলায় মালা দিয়েছ, আমি তোমায় চাই।”

 রাজা বললেন—“ছি ছি, কন্যে, একি কথা! তুমি হলে বনবাসিনী তপস্বিনী, আমি হলেম রাজ্যেশ্বর মহারাজা, আমি তোমায় কেন মালা দেব? টাকা চাও টাকা নাও, ঘর বাড়ি চাও তাই নাও, গায়ের গহনা চাও তাও নাও। রাজ্যেশ্বরী হ’তে চাও—এ কেমন কথা?’

 রাজার কথায় শকুন্তলার প্রাণ কেঁপে উঠল, কাঁদতে কাঁদতে বল্‌লে—“মহারাজ, সে কি কথা? আমি যে সেই শকুন্তলা—আমায় ভুলে গেলে? মনে নেই, মহারাজ, সেই মাধবীর বনে একদিন আমরা তিন সখীতে গুন্‌ গুন্‌ গল্প করছিলুম এমন সময় তুমি অতিথি এলে; সখীরা তোমায় পা-ধোবার জল দিলে, আমি আঁচলে ফল এনে দিলেম, তুমি হাসি মুখে তাই খেলে। তারপর একটা পদ্মপাতায় জল নিয়ে আমার হরিণ শিশুকে খাওয়াতে গেলে, সে ছুটে পালাল, তুমি কত ডাকলে, কত মিষ্টি কথা বল্‌লে, কিছুতে এল না। তারপর আমি ডাকতেই আমার কাছে এল, আমার হাতে জল খেল,তুমি আদর করে বল্‌লে—‘দুজনেই বনের প্রাণী কিনা তাই এত ভাব’—শুনে সখীরা হেসে উঠল, আমি লজ্জায় মরে গেলাম। তার পর, মহারাজ, তুমি কতদিন তপস্বীর মতো সে বনে রইলে; বনের ফল খেয়ে, নদীর জল খেয়ে, কতদিন কাটালে। তারপর একদিন পূর্ণিমা রাতে মালিনীর তীরে নিকুঞ্জ বনে আমার কাছে এলে, আমার গলায় মালা দিলে;—মহারাজ, সে কথা কি ভুলে গেলে? যাবার সময় তুমি, মহারাজ, আমার হাতে তোমার আংটী, পরিয়ে দিলে; প্রতিদিন তোমার নামের একটি করে অক্ষর পড়তে বলে দিলে, বলে গেলে—নামও শেষ হবে আর আমায় নিতে সোণার রথ পাঠাবে। কিন্তু মহারাজ, সোণার রথ কই পাঠালে, সব ভুলে রইলে? মহারাজ, এমনি করে কি কথা রাখলে?”

 বনবাসিনী শকুন্তলা রাজার কাছে কত অভিমান করলে, রাজাকে কত অনুযোগ করলে, সেই কুঞ্জবনের কথা, সেই দুই সখীর কথা, সেই হরিণ-শিশুর কথা,—কত কথাই মনে করে দিলে, তবু রাজার মনে পড়ল না। শেষে রাজা বল্‌লেন—“কই, কন্যে, দেখি তোমার সেই আংটী? তুমি যে বল্‌লে আমি তোমায় আংটী দিয়েছি, কই দেখাও দেখি কেমন আংটী?” শকুন্তলা তাড়াতাড়ি আঁচল খুলে আংটী দেখাতে গেল, কিন্তু হায়, আঁচল শূন্য,— রাজার সেই সাতরাজার ধন এক-মানিকের বরণ-আংটী কোথায় গেল! এতদিনে দুর্ব্বাসার শাপ ফল্‌লো। হায়, রাজাও তা’র পর হলেন, পৃথিবীতে আপনার লোক কেউ রইল না!

 ‘মা-গো’—বলে শকুন্তলা রাজসভায় সানের উপর ঘুরে পড়ল; তা’র কপাল ফুটে রক্ত ছুটল। রাজার সভায় হাহাকার পড়ে গেল।

 সেই সময় শকুন্তলার সেই পাষাণী মা মেনকা স্বর্গপুরে ইন্দ্রসভায় বীণা বাজিয়ে গান গাচ্ছিল। হঠাৎ তা’র বীণার তার ছিঁড়ে গেল, গানের সুর হারিয়ে গেল, শকুন্তলার জন্যে প্রাণ কেঁদে উঠল; অমনি সে বিদ্যুতের মত মেঘের রথে এসে রাজার সভা থেকে শকুন্তলাকে কোলে তুলে একবারে হেমকূট পর্ব্বতে নিয়ে গেল।

 সেই হেমকূট পর্ব্বতে কশ্যপের আশ্রমে স্বর্গের অপ্সরাদের মাঝে কতদিনে শকুন্তলার একটি রাজচক্রবর্ত্তী রাজকুমার হ’ল।

 সেই কোল-ভরা ছেলে পেয়ে শকুন্তলার বুক জুড়ল।

 শকুন্তলা তো চলে গেল। এদিকে রাজবাড়ির জেলেরা একদিন শচীতীর্থের জলে জাল ফেলতে আরম্ভ করলে। রূপলী রঙ্গের সরলপুটী, চাঁদের মত পায়রা-চাঁদা, সাপের মত বাণমাছ, দাঁড়াওয়ালা চিংড়ি, কাঁটাভরা বাটা, কত কি জালে পড়ল। সোণালি রূপলী মাছে নদীর পাড় মাছের ঝুড়ি যেন সোণায় রূপায় ভরে গেল। সারাদিন জেলেদের জালে কত রকমের কত যে মাছ পড়ল তা’র ঠিকানা নেই। শেষে ক্রমে বেলা পড়ে এল; নীল আকাশ, নদীর জল, নগরের পথ আঁধার হয়ে এল, জেলেরা জাল গুড়িয়ে ঘরে চল্‌লো।

 এমন সময় এক জেলে জাল ঘাড়ে নদীতীরে দেখা দিল। প্রকাণ্ড জালখানা মাথার উপর ঘুরিয়ে নদীর উপর উড়িয়ে দিলে; মেঘের মতো কাল জাল আকাশে ঘুরে, নদীর এ-পার ও-পার দু-পার জুড়ে জলে পরল। সেই সময় মাছের সর্দ্দার, নদীর রাজা, বুড়ো মাছ রুই অন্ধকারে সন্ধ্যার সময় সেই নদী ঘেরা কাল জালে ধরা পড়ল। জেলে পাড়ায় রব উঠল—জাল কাটবার গুরু, মাছের সর্দ্দার, বুড়ো রুই এতদিনে জালে পড়েছে। যে যেখানে ছিল নদীতীরে ছুটে এল। তারপর অনেক কষ্টে মাছ ডাঙ্গায় উঠল। এত বড় মাছ কেউ কখন দেখেনি। আবার যখন সেই মাছের পেট চিরতে সাত রাজার ধন এক-মানিকের আংটী জ্বলন্ত আগুণের মত ঠিক্‌রে পড়ল তখন সবাই অবাক্‌ হয়ে রইল। যা’র মাছ তা’র আনন্দের সীমা রইল না।

 গরীব জেলে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলে। মাছের ঝুড়ি, ছেঁড়া জাল জলে ফেলে মানিকের আংটী সেকরার দোকানে বেচতে চল্‌লো।

 রাজা শকুন্তলাকে যে আংটী দিয়েছিলেন—এ সেই আংটী, শচীতীর্থে গা-ধোবার সময় তা’র আঁচল থেকে যখন জলে পড়ে যায় তখন রুইমাছটা খাবার ভেবে গিলে ফেলেছিল।

 জেলের হাতে রাজার মোহর আংটী দেখে সেকরা কোটালকে খবর দিলে। কোটাল জেলেকে মারতে মারতে রাজসভায় হাজির করলে। বেচারা জেলে রাজদরবারে দাঁড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে কেমন করে মাছের পেটে আংটী পেয়েছে নিবেদন করলে। রাজমন্ত্রী দেখলেন সত্যই আংটীতে মাছের গন্ধ, জেলে ছাড়া পেয়ে মোহরের তোড়া বখশিশ নিয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি গেল।

 এদিকে আংটী হাতে পড়্‌তেই রাজার তপোবনের কথা সব মনে পড়ে গেল। শকুন্তলার শোকে রাজা যেন পাগল হয়ে উঠলেন। বিনা দোষে তা’কে দূর করে দিয়ে প্রাণ যেন তুঁষের আগুণে পুড়তে লাগল। মুখে অন্য কথা নেই কেবল—‘হা শকুন্তলা—হা শকুন্তলা’।

 আহারে, বিহারে, শয়নে, স্বপনে, কিছুতে সুখ নাই; রাজ-কার্য্যে সুখ নাই, অন্তঃপুরে সুখ নাই, উপবনে সুখ নাই, কোথাও সুখ নাই। সঙ্গীতশালায় গান বন্ধ হ’ল, নৃত্যশালায় নাচ বন্ধ হ’ল, উপবনে উৎসব বন্ধ হ’ল। রাজার দুঃখের সীমা রইল না। একদিকে বনবাসিনী শকুন্তলা কোলভরা ছেলে নিয়ে হেমকূটের সোণার শিখরে বসে রইল, আর একদিকে জগতের রাজা রাজা দুষ্মন্ত জগৎজোড়া শোক নিয়ে ধূলায় ধূসর পড়ে রইলেন।

 কত দিন পরে দেবতার কৃপা হল। স্বর্গ থেকে ইন্দ্রদেবের রথ এসে রাজাকে দৈত্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করবার জন্যে স্বর্গপুরে নিয়ে গেল। সেখানে নন্দনবনে কত দিন কাটিয়ে, দৈত্যদের সঙ্গে কত যুদ্ধ করে, মন্দারের মালা গলায় পরে, রাজা রাজ্যে ফিরছেন—এমন সময় দেখলেন, পথে হেমকূট পর্ব্বত, মহর্ষি কশ্যপের আশ্রম। রাজা মহর্ষিকে প্রণাম করবার জন্য সেই আশ্রমে চল্‌লেন।

 এই আশ্রমে অনেক তাপস অনেক তপস্বিনী থাকতেন,অনেক অপ্সর অনেক অপ্সরা থাকত। আর থাকত—শকুন্তলা আর তা’র পুত্র রাজপুত্র সর্ব্বদমন।

 রাজা দুষ্মন্ত যেমন দেশের রাজা ছিলেন তাঁ’র সেই রাজপুত্র তেমনি বনের রাজা ছিল। বনের যত জীব জন্ত তাঁ’কে বড়ই ভালোবাসত। সেই বনে সাতক্রোশ জুড়ে একটা প্রকাণ্ড বটগাছ ছিল, তা’র তলায় একটা প্রকাণ্ড অজগর দিনরাত্রি পড়ে থাকত; এই গাছতলায় সর্ব্বদমনের রাজসভা বসত। হাতিরা তা’কে মাথায় করে নদীতে নিয়ে যেত, শুঁড়ে করে জল ছিটিয়ে গা ধুইয়ে দিত, তারপর তা’কে সেই সাপের পিঠে বসিয়ে দিত—এই তা’র রাজসিংহসন। দুদিকে দুই হাতি পদ্মফুলের চামর ঢোলাত, অজগর ফণা মেলে মাথায় ছাতা ধরত; ভালুক ছিল মন্ত্রী, সিংহ ছিল সেনাপতি, বাঘ ছিল চৌকিদার, শেয়াল ছিল কোটাল আর ছিল—শুক পাখী তা’র প্রিয়সখা, কত মজার মজার কথা বলত, দেশ বিদেশের গল্প করত। সে পাখীর বাসায় পাখীর ছানা নিয়ে খেলা করত, বাঘের বাসায় বাঘের কাছে বসে থাকত,—কেউ তাকে কিছু বলত না। সবাই তাকে ভয়ও করত, ভালও বাস্‌ত।

 রাজা যখন সেই বনে এলেন তখন রাজপুত্র একটা সিংহ-শিশুকে নিয়ে খেলা করছিল, তা’র মুখে হাত পুরে দাঁত গুনছিল, তা’কে কোলে পিঠে করছিল, তা’র জটা ধরে টানছিল। বনের তপস্বিনীরা কত ছেড়ে দিতে বলছিলেন, কত মাটীর ময়ূরের লোভ দেখাচ্ছিলেন, শিশু কিছুতে শুনছিল না। এমন সময় রাজা সেখানে এলেন, সিংহ-শিশুকে ছাড়িয়ে সেই রাজ-শিশুকে কোলে নিলেন; দুষ্ট শিশু রাজার কোলে শান্ত হ’ল। সেই রাজশিশুকে কোলে করে রাজার বুক যেন জুড়িয়ে গেল। রাজা তো জানেন না যে এ শিশু তাঁ’রই পুত্র; ভাবছেন—পরের ছেলেকে কোলে করে মন কেন এমন হল, এর উপর কেন এত মায়া হল? এমন সময় শকুন্তলা অঞ্চলের নিধি কোলের বাছাকে খুঁজতে খুঁজতে সেইখানে এলেন। রাজা রাণীতে দেখা হ’ল, রাজা আবার শকুন্তলাকে আদর করলেন, তাঁ’র কাছে ক্ষমা চাইলেন। দেবতার কৃপায় এতদিনে আবার মিলন হ’ল, দুর্ব্বাসার শাপান্ত হ’ল। কশ্যপ অদিতিকে প্রণাম করে রাজা রাণী রাজপুত্র কোলে রাজ্যে ফিরলেন।

 তারপর কত দিন সুখে রাজত্ব করে, রাজপুত্রকে রাজ্য দিয়ে রাজা রাণী সেই তপোবনে তাতঃ কণ্বের কাছে, সেই দুই সখীর কাছে, সেই হরিণ-শিশুদের কাছে, সেই সহকার এবং মাধবীলতার কাছে ফিরে গেলেন এবং তাপস তাপসীদের সঙ্গে সুখে জীবন কাটিয়ে দিলেন।

সমাপ্ত।