শকুন্তলা (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ১৮৭৫)/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
রাজা, মৃগয়ায় আগমনকালে, স্বীয় প্রিয়বয়স্য মাধব্যনামক ব্রাহ্মণকে সমভিব্যাহারে আনিয়াছিলেন। রাজসহচরেরা, নিয়ত রাজভোগে কালযাপন করিয়া, স্বভাবতঃ সাতিশয় বিলাসী ও সুখাভিলাষী হইয়া উঠে। অশন, বসন, শয়ন, উপবেশন, কোনও বিষয়ে কিঞ্চিন্মাত্র ক্লেশ হইলে তাহাদের একান্ত অসহ্য হয়। মাধব্য রাজধানীতে অশেষ সুখসম্ভোগে কালহরণ করিতেন। অরণ্যে সে সকল সুখভোগের সম্পর্ক ছিল না; প্রত্যুত, সকল বিষয়ে সবিশেষ ক্লেশ ঘটিয়া উঠিয়াছিল।
এক দিবস, প্রভাতে গাত্রোত্থান করিয়া, যৎপরোনাস্তি বিরক্ত হইয়া, মাধব্য মনে মনে কহিতে লাগিলেন, এই মৃগয়াশীল রাজার সহচর হইয়া প্রাণ গেল। প্রতিদিন প্রাতঃকালে মৃগয়ায় যাইতে হয়, এবং এই মৃগ, ঐ বরাহ, এই শার্দ্দুল, এই করিয়া মধ্যাহ্নকাল পর্যন্ত বনে বনে ভ্রমণ করিতে হয়। গ্রীষ্মকালে পল্বল ও বননদী সকল শুস্কপ্রায় হইয়া আইসে; যে অল্পপ্রমাণ জল থাকে তাহাও, বৃক্ষের গলিত পত্র সকল অনবরত পতিত হওয়াতে, অত্যন্ত কটু ও কষায় হইয়া উঠে। পিপাসা পাইলে, সেই বিরস বারি পান করিতে হয়। আহারের সময় নিয়মিত নাই; প্রায় প্রতিদিন অনিয়ত সময়েই আহার করিতে হয়। আহারসামগ্রীর মধ্যে শূল্য মাংসই অধিকাংশ; তাহাও প্রত্যহ প্রকৃতরূপ পাক করা হয় না। আর, প্রাতঃকাল অবধি মধ্যাহ্ন পর্য্যন্ত অশ্বপৃষ্ঠে পরিভ্রমণ করিয়া, সর্ব্ব শরীর বেদনায় এরূপ অভিভূত হইয়া থাকে যে, রাত্রিতেও সুখে নিদ্রা যাইতে পারি না। রাত্রিশেষে নিদ্রার আবেশ হয়; কিন্তু ব্যাধগণের বনগমনকোলাহলে অতি প্রত্যুষেই নিদ্রা ভঙ্গ হইয়া যায়। ত্বরায় যে এই সকল ক্লেশের অবসান হইবেক, তাহার ও সম্ভাবনা দেখিতেছি না। সে দিবস, আমরা পশ্চাৎ পড়িলে, রাজা, একাকী এক মৃগের অনুসরণক্রমে তপোবনে প্রবিষ্ট হইয়া, আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে শকুন্তলানাম্নী এক তাপসকন্যা নিরীক্ষণ করিয়াছেন। তাহাকে দেখিয়া অবধি, নগরগমনের কথা আর মুখে আনেন না। এই ভাবিতে ভাবিতেই, রাত্রি প্রভাত হইয়া গেল, এক বারও চক্ষু মুদি নাই।
মাধব্য এই সমস্ত চিন্তা করিতেছেন, এমন সময়ে দেখিতে পাইলেন, রাজা মৃগয়ার বেশধারণপূর্ব্বক, তৎকালোচিত সহচরগণে পরিবেষ্টিত হইয়া, সেই দিকে আসিতেছেন। তখন তিনি মনে মনে এই বিবেচনা করিলেন, বিকলঙ্গের ন্যায় হইয়া থাকি, তাহা হইলেও যদি আজি বিশ্রাম করিতে পাই। এই বলিয়া, মাধব্য, ভগ্নকলেবরের ন্যায়, একান্ত বিকল হইয়া রহিলেন; পরে, রাজা সন্নিহিত হইবামাত্র, সাতিশয় কাতরতাপ্রদর্শনপূর্ব্বক কহিলেন, বয়স্য! আমার সর্ব্ব শরীর অবশ হইয়া আছে, হস্ত প্রসারণ করি, এমন ক্ষমতা নাই; অতএব কেবল বাক্য দ্বারাই আশীর্ব্বাদ করি।
রাজা মাধব্যকে, তদবস্থ অবস্থিত দেখিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, বয়স্য! তোমার শরীর এরূপ বিকল হইল কেন? মাধব্য কহিলেন, কেন হইল কি আবার; স্বয়ং অস্থি ভাঙ্গিয়া দিয়া, অশ্রুপাতের কারণ জিজ্ঞাসা করিতেছ? রাজা কহিলেন, বয়স্য! বুঝিতে পারিলাম না, স্পষ্ট করিয়া বল। নদীতীরবর্ত্তী বেতস যে কুজভাব অবলম্বন করে, সে কি স্বেচ্ছাবশতঃ সেইরূপ করে; অথবা নদীবেগপ্রভাবে? রাজা কহিলেন, নদীবেগ তাহার কারণ। মাধব্য কহিলেন, তুমিও আমার অঙ্গবৈকল্যের। রাজা কহিলেন, সে কেমন? মাধব্য কহিলেন, আমি কি বলবি, ইহা কি উচিত হয় যে, রাজকার্য্য পরিত্যাগ করিয়া, বনচরের ব্যবসায় অবলম্বনপূর্ব্বক, নিয়ত বনে বনে ভ্রমণ করিবে। আমি ব্রাহ্মণের সন্তান; সর্ব্বদা তোমার সঙ্গে সঙ্গে মৃগের অন্বেষণে কাননে কাননে ভ্রমণ করিয়া, সন্ধিবন্ধ সকল শিথিল হইয়া গিয়াছে, এবং সর্ব্ব শরীর অবশ হইয়া রহিয়াছে। অতএব, বিনয়বাক্যে প্রার্থনা করিতেছি, অন্ততঃ এক দিনের মত আমায় বিশ্রাম করিতে দাও।
রাজা, মাধব্যের প্রার্থনা শুনিয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন, এ ত এইরূপ কহিতেছে; আমারও শকুন্তলাদর্শন অবধি মৃগয়াবিষয়ে মন নিতান্ত নিরুৎসাহ হইয়াছে। শরাসনে শরসন্ধান করি, কিন্তু মৃগের উপর নিক্ষেপ করিতে পারি না; তাহাদের মুগ্ধ নয়ন অবলোকন করিলে, শকুন্তলার অলৌকিকবিভ্রমবিলাসশালী নয়নযুগল মনে পড়ে। মাধব্য রাজার মুখে দৃষ্টিপাত করিয়া ভাবিতে লাগিলেন, আমি অরণ্যে রোদন করিলাম। রাজা ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, না হে না, আমি অন্য কিছু ভাবিতেছি না। সুহৃদ্বাক্য লঙ্ঘন করা কর্তব্য নহে, এই বিবেচনায় আজি মৃগয়ায় ক্ষান্ত হইলাম। মাধব্য, শ্রবণমাত্র যার পর নাই আনন্দিত হইয়া, চিরজীবী হও বলিয়া, চলিয়া যাইবার উপক্রম করিলেন। রাজা কহিলেন, বয়স্য! যাইও না, আমার কিছু কথা আছে। মাধব্য, কি কথা বল বলিয়া, শ্রবণোন্মুখ ইইরা, দণ্ডায়মান রহিলেন। রাজা কহিলেন, বয়স্য! কোনও অনায়াসসাধ্য কর্ম্মে আমার সহায়তা করিতে হইবেক। মাধব্য কহিলেন, বুঝিয়াছি, আর বলিতে হইবে না, মিষ্টান্নভক্ষণে; সে বিষয়ে আমি বিলক্ষণ নিপুণ বটি, অনায়াসেই সহায়তা করিতে পারিব। রাজা কহিলেন, না হে না, আমি যা বলিব। এই বলিয়া, দৌবারিককে আহ্বান করিয়া, রাজা সেনাপতিকে আনয়ন করিতে আদেশ দিলেন।
দৌবারিকমুখে রাজার আহ্বানবার্তা শ্রবণ করিয়া সেনাপতি অনতিবিলম্বে নৃপতিগোচরে উপস্থিত হইলেন, এবং মহারাজের জয় হউক বলিয়া, কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিলেন, মহারাজ! সমুদয় উদ্যোগ হইয়াছে; আর অনর্থ কালহরণ করিতেছেন কেন, মৃগয়ায় চলুন। রাজা কহিলেন, আজি মাধব্য, মৃগয়ার দোষর্কীর্ত্তন করিয়া, আমায় নিরুৎসাহ করিয়াছে। সেনাপতি, রাজার অগোচরে, ইঙ্গিত দ্বারা মাধব্যকে কহিলেন, সখে! তুমি স্থিরপ্রতিজ্ঞ হইয়া থাক; আমি কিয়ৎ ক্ষণ প্রভুর চিত্তবৃত্তির অনুবর্ত্তন করি। অনন্তর, রাজাকে কহিলেন, মহারাজ! ও পাগলের কথা শুনেন কেন? ও কখন কি না বলে। মৃগয়া অপকারী কি উপকারী, মহারাজই বিবেচনা করুন না কেন। দেখুন, প্রথমতঃ, স্থূলতা ও জড়তা অপগত হইয়া, শরীর বিলক্ষণ পটু ও কর্ম্মণ্য হয়; ভয় জন্মিলে অথবা ক্রোধের উদয় হইলে, জন্তুগণের মনের গতি কিরূপ হয়, তাহা বারংবার প্রত্যক্ষ হইতে থাকে; আর চল লক্ষ্যে শরক্ষেপ করা অভ্যাস হইয়া আইসে; মহারাজ! যদি চল লক্ষ্যে শরক্ষেপ অব্যর্থ হয়, ধনুর্ধরের পক্ষে অধিক শ্লাঘার বিষয় আর কি হইতে পারে? যাহারা মৃগয়াকে ব্যসনমধ্যে গণ্য করে, তাহারা নিতান্ত অর্বাচীন; বিবেচনা করুন, এরূপ আমোদ, এরূপ উপকার আর কিসে আছে? মাধব্য শুনিয়া, কৃত্রিম কোপ প্রদর্শন করিয়া, কহিলেন, আরে নরাধম! ক্ষান্ত ই, আর তোর প্রবৃত্তি জন্মাইতে হইবেক না; আজি উনি আপন প্রকৃতি প্রাপ্ত হইয়াছেন। আমি দিব্য চক্ষে দেখিতেছি, তুই বনে বনে ভ্রমণ করিয়া, এক দিন, নরনাসিকালোলুপ ভল্লুকের মুখে পড়িবি।
উভয়ের এইরূপ বিবাদারম্ভ দেখিয়া, রাজা সেনাপতিকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, দেখ! আমরা আশ্রমসমীপে আছি, এজন্য তোমার মতে সম্মত হইতে পারিলাম না। অদ্য মহিষেরা, নিপানে অবগাহন করিয়া, নিরুদ্বেগে জলক্রীড়া করুক; হরিণগণ, তরুচ্ছায়ায় দলবদ্ধ হইয়া, রোমন্থ অভ্যাস করুক; বরাহেরা অশঙ্কিত চিত্তে পল্বলে মুস্তা ভক্ষণ করুক; আর আমার শরাসনও বিশ্রাম লাভ করুক। সেনাপতি কহিলেন, মহারাজের যেমন অভিরুচি। রাজা কহিলেন, তবে যে সমস্ত মৃগয়াসহচর পূর্ব্বে বনপ্রস্থান করিয়াছে, তাহাদিগকে ফিরাইয়া আন; আর সেনাসংক্রান্ত লোকদিগকে বিলক্ষণ, সতর্ক করিয়া দাও, যেন তাহারা কোনও ক্রমে তপোবনের উৎপীড়ন না জন্মায়।
সেনাপতি যে আজ্ঞা মহারাজ বলিয়া নিষ্ক্রান্ত হইলে, রাজা সন্নিহিত মৃগয়াসহচরদিগকে মৃগয়াবেশ পরিত্যাগ করিতে আদেশ দিলেন। তদনুসারে তাহারা তথা হইতে প্রস্থান করিলে, রাজা ও মাধব্য, সন্নিহিত লতামণ্ডপে প্রবিষ্ট হইয়া, শীতল শিলাতলে উপবেশন করিলেন।
এই রূপে উভয়ে নির্জনে উপবিষ্ট হইলে, রাজা মাধব্যকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, বয়স্য! তুমি চক্ষুর ফল পাও নাই, কারণ, দর্শনীয় বস্তুই দেখ নাই। মাধব্য কহিলেন, কেন তুমি ত আমার সম্মুখে রহিয়াছ। রাজা কহিলেন, তা নয় হে, আমি আশ্রমললামভূতা কণ্বদুহিতা শকুন্তলাকে উল্লেখ করিয়া কহিতেছি। মাধব্য, কৌতুক করিবার নিমিত্ত, কহিলেন, একি বয়স্য! তপস্বিকন্যায় অভিলাষ! রাজা কহিলেন, বয়স্য! পুরুবংশীয়েরা এরূপ দুরাচার নহে যে পরিহার্য্য বস্তুর উপভোগে অভিলাষ করে। তুমি জান না, শকুন্তলা মেনকাগর্ভসম্ভূতা, রাজর্ষি বিশ্বামিত্রের কন্যা; তপস্বীর আশ্রমে প্রতিপালিত হইয়াছে এই মাত্র, বস্তুতঃ তপস্বিকন্যা নহে।
মাধব্য, শকুন্তলার প্রতি রাজার প্রগাঢ় অনুরাগ দেখিয়া, হাস্যমুখে কহিলেন, যেমন পিণ্ডখর্জ্জুর ভক্ষণ করিয়া রসনা মিষ্ট রসে অভিভূত হইলে, তিন্তিলীভক্ষণে স্পৃহা হয়, সেইরূপ স্ত্রীরত্বভোগে পরিতৃপ্ত হইয়া, তুমি এই অভিলাষ, করিতেছ। রাজা কহিলেন, না বয়স্য! তুমি তাকে দেখ নাই, এই নিমিত্ত এরূপ কহিতেছ। মাধব্য কহিলেন, তার সন্দেহ কি; যাহা তোমারও বিস্ময় জন্মাইয়াছে, সে বস্তু অবশ্য রমণীয়। কহিলেন, বয়স্য! অধিক আর কি বলিব, তার শরীর মনে করিলে মনে এই উদয় হয়, বুঝি বিধাতা প্রথমতঃ চিত্রপটে চিত্রিত করিয়া পরে জীবনদান করিয়াছেন; অথবা, মনে মনে মনোমত উপকরণসামগ্রী সকল সঙ্কলন করিয়া, মনে মনে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলি যথাস্থানে বিন্যাসপুর্ব্বক, মনে মনেই তাহার শরীর নির্মাণ করিয়াছেন; হস্ত দ্বারা নির্মিত হইলে, শরীরের সেরূপ মার্দ্দব ও রূপলাবণ্যের সেরূপ মাধুরী সম্ভবত না। ফলতঃ, ভাই রে, সে এক অভূতপূর্ব্ব স্ত্রীরত্নসৃষ্টি। মাধব কহিলেন, বয়স্য! বুঝিলাম, শকুন্তলা যাবতীয় রূপবতীদিগের পরাভবস্থান। রাজা কহিলেন, তাহার রূপ অনাঘ্রাত প্রফুল্ল পুষ্প স্বরূপ, নখাঘাতবর্জ্জিত নব পল্লব স্বরূপ, অপরিহিত নূতন রত্ন স্বরূপ, অনাস্বাদিত অভিনব মধু স্বরূপ, জন্মান্তরীণ পুণ্যরাশির অখণ্ড ফল স্বরূপ; জানি না, কোন ভাগ্যবানের ভাগ্যে সেই নির্মল রূপের ভোগ আছে।
রাজার মুখে শকুন্তলার এইরূপ বর্ণনা শুনিয়া, চমৎকৃত হইয়া, মাধব্য কহিলেন, বয়স্য! তবে শীঘ্র তাহার পাণিগ্রহণ কর; দেখিও, যেন তোমার ভাবিতে চিন্তিতে এরূপ অসুলভরূপনিধান কন্যানিধন কোনও অসভ্য তপস্বীর হস্তে পতিত না হয়। রাজা কহিলেন, শকুন্তলা নিতান্ত পরাধীনা; বিশেষতঃ, কুলপতি কণ্ব এক্ষণে আশ্রমে নাই। মাধব্য কহিলেন, ভাল বয়স্য! তোমায় এক কথা জিজ্ঞাসা করি, বল দেখি, তোমার উপর তার অনুরাগ কেমন? রাজা কহিলেন, বয়স্য! তপস্বিকন্যারা স্বভাবতঃ অপ্রগল্ভস্বভাবা; তথাপি তাহার আকার ইঙ্গিতে আমার প্রতি অনুরাগের স্পষ্ট চিহ্ন লক্ষিত হইয়াছে— যত ক্ষণ আমার সম্মুখে ছিল, আমার সহিত কথা কয় নাই; কিন্তু আমি কথা কহিতে আরম্ভ করিলে, অনন্যচিত্তা হইয়া স্থির কর্ণে শ্রবণ করিয়াছে; নয়নে নয়নে সঙ্গতি হইলে, মুখ ফিরাইয়া লইয়ছে, কিন্তু অন্য দিকেও অধিক ক্ষণ চাহিয়া থাকে নাই। আবার প্রস্থানকালে কয়েকপদমাত্র গমন করিয়া, কুশের অঙ্কুরে পদতল ক্ষত হইল, চলিতে পারি না, এই বলিয়া দাঁড়াইয়া রহিল, আর কুরবকশখায় বল্কল লাগিয়াছে, এই বলিয়া বল্কলমোচনচ্ছলে বিলম্ব করিয়া, আমার দিকে মুখ ফিরাইয়া সতৃষ্ণ নয়নে বারংবার নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। এ সকল অনুরাগের লক্ষণ বই আর কি হতে পারে? মাধব্য কহিলেন, বয়স্য! তবে তোমার মনোরথসিদ্ধির অধিক বিলম্ব নাই। ভাগ্যক্রমে, তপোবন তোমার উপবন হইয়া উঠিল। রাজা কহিলেন, বয়স্য! কোনও কোনও তপস্বীরা আমায় চিনিতে পারিয়াছেন। বল দেখি, এখন কি ছলে কিছু দিন তপোবনে থাকি। মাধব্য কহিলেন, কেন, অন্য ছলের প্রয়োজন কি? তুমি রাজা, তপোবনে গিয়া তপস্বীদিগকে বল, আমি রাজস্ব আদায় করিতে আসিয়াছি; যাবৎ তোমরা রাজস্ব না দিবে, তারৎ আমি তপোবনে থাকিব। রাজা কহিলেন, তপস্বীরা সামান্য প্রজার ন্যায় রাজস্ব দেন না; তাঁহারা অন্যবিধ রাজস্ব দিয়া থাকেন; তাঁহারা যে রাজস্ব দেন, তাহা রত্নরাশি অপেক্ষাও প্রার্থনীয়। দেখ, সামান্য প্রজারা। রাজাদিগকে যে রাজস্ব দেয়, তাহা বিনশ্বর; কিন্তু তপস্বীরা তপস্যার ষষ্ঠাংশস্বরূপ অবিনশ্বর রাজস্ব প্রদান করিয়া থাকেন।
রাজা ও মাধব্য উভয়ের এইরূপ কথোপকথন চলিতেছে, এমন সময়ে দ্বারবান্ আসিয়া কহিল, মহারাজ! তপোবন হইতে দুই ঋষিকুমার আসিয়া দ্বারদেশে দণ্ডায়মান আছেন, কি আজ্ঞা হয়। রাজা কহিলেন, অবিলম্বে লইয়া আইস। তদনুসারে ঋষিকুমারের রাজসমীপে উপনীত হইয়া, মহারাজের জয় হউক, বলিয়া, আশীর্বাদ করিলেন। রাজা আসন হইতে গাত্রোত্থানপূর্ব্বক প্রণাম করিলেন এবং জিজ্ঞাসিলেন, তপস্বীরা কি আজ্ঞা করিয়া পাঠাইয়াছেন, বলুন। ঋষিকুমারেরা কহিলেন, মহারাজ! আপনি এখানে আছেন জানিতে পারিয়া, তপস্বীরা মহারাজকে এই অনুরোধ করিতেছেন যে মহর্যি আশ্রমে নাই, এই নিমিত্ত নিশাচরেরা যজ্ঞের বিঘ্ন জন্মাইতেছে; অতএব আপনাকে, তাঁহার প্রত্যাগমন পর্য্যন্ত এই স্থানে থাকিয়া, তপোবনের উপদ্রব নিবারণ করিতে হইবেক। রাজা কহিলেন, তপস্বীদিগের এই আদেশে অনুগৃহীত হইলাম। মাধব্য কহিলেন, বয়স্য! মন্দ কি, এ তোমার অনুকূল গলহস্ত। রাজা শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিলেন; অনন্তর, দৌবারিককে আহ্বান করিয়া, সারথিকে রথ প্রস্তুত করিতে আদেশ দিয়া, ঋষিকুমারদিগকে কহিলেন, আপনারা প্রস্থান করুন; আমি যথাকালে তপোবনে উপস্থিত হইতেছি। ঋষিকুমারেরা অতিশয় আহ্লাদিত হইয়া কহিলেন, মহারাজ! না হইবেক কেন? আপনি যে বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, আপনার এই ব্যবহার তাহার উপযুক্তই বটে। বিপদ্গ্রস্তকে অভয়দান পুরুবংশীয়দিগের কুলব্রত।
এই বলিয়া আশীর্বাদ করিয়া ঋষিকুমারের প্রস্থান করিলে পর, রাজা মধিব্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন, বয়স্য! যদি তোমার শকুন্তলাদর্শনে কৌতূহল থাকে, আমার সমভিব্যাহারে চল। মাধব্য কহিলেন, তোমার মুখে তাহার বর্ণনা শুনিয়া দেখিতে অত্যন্ত অভিলাষ হইয়াছিল; কিন্তু এক্ষণে নিশাচরের নাম শুনিয়া সে অভিলাষ এক বারে গিয়াছে। রাজা শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন; ভয় কি, আমার নিকটে থাকিবে। মাধব্য কহিলেন, তবে আর নিশাচরে আমার কি করিবেক? এইরূপ কথোপকথন হইতেছে, এমন সময়ে দ্বারপাল আসিয়া কহিল, মহারাজ! রথ, প্রস্তুত, আরোহণ করিলেই হয়। কিন্তু বৃদ্ধ মহিষীর বার্ত্তা লইয়া করভক এই মাত্র রাজধানী হইতে উপস্থিত হইল। রাজা কহিলেন, অবিলম্বে উহারে আমার নিকটে লইয়া আইস। অনন্তর, করভক রাজসমীপে আসিয়া নিবেদন করিল, মহারাজ! বৃদ্ধ দেবী আজ্ঞা করিয়াছেন, আগামী চতুর্থ দিবসে তাঁহার এক ব্রত আছে; সেই দিবস মহারাজকে তথায় উপস্থিত থাকিতে হইবেক।
এ দিকে তপস্বীদিগের কার্য্য, ও দিকে গুরুজনের আজ্ঞা, উভয়ই অনুল্গঙ্ঘনীয়, এই নিমিত্ত, কর্তব্যনিরূপণে অসমর্থ হইয়া রাজা নিতান্ত আকুলচিত্ত হইলেন, এবং মাধব্যকে কহিলেন, বয়স্য! বিষম সঙ্কটে পড়িলাম, কি করিব কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না। মাধব্য পরিহাস করিয়া কহিলেন, কেন, ত্রিশঙ্কুর মত মধ্যস্থলে থাক। রাজা কহিলেন, বয়স্য! এ পরিহাসের সময় নয়, সত্য সত্যই অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়াছি; কি করি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। পরে, তিনি কিয়ৎ ক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিলেন, সখে! মা তোমায় পুত্রবৎ পরিগৃহীত করিয়াছেন। তুমি রাজধানী ফিরিয়া যাও, এবং জননীর পুত্রকার্য্য সম্পাদন কর। তাঁহাকে কহিবে, তপস্বীদিগের কার্য্যে অত্যন্ত ব্যস্ত আছি, এজন্য যাইতে পারিলাম না। মাধব্য, ভাল, আমি চলিলাম, কিন্তু তুমি যেন আমায় নিশাচরভয়ে কাতর মনে করিও না; এই বলিয়া কহিলেন, এখন আমি রাজার অনুজ হইলাম; রাজার অনুজের মত যাইতে ইচ্ছা করি। রাজা কহিলেন, আমার সঙ্গে অধিক লোক জন রাখিলে, তপোবনের উৎপীড়ন হইতে পারে; অতএব সমুদয় অনুচরদিগকে তোমারই সঙ্গে পাঠাইতেছি। মাধব্য শুনিয়া সাতিশয় আহলাদিত হইয়া কহিলেন, আজি আমি যথার্থ যুবরাজ হইলাম।
এই রূপে মাধব্যের রাজধানী প্রতিগমন নির্দ্ধারিত হইলে, রাজা মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, এ অতি চপলস্বভাব, হয় ত শকুন্তলাবৃত্তান্ত অন্তঃপুরে প্রকাশ করিবেক; এখন কি করি; অথবা এইরূপ কহিয়া বিদায় করি; এই বলিয়া মাধব্যের হতে ধরিয়া কহিলেন, বয়স্য! ঋষিরা কয়েক দিনের জন্য তপোবনে থাকিতে অনুরোধ করিয়াছেন, এই নিমিত্ত রহিলাম, নতুবা যথার্থই আমি শকুন্তলালাভে অভিলাষী হইয়াছি এমন নয়; আমি ইতিপূর্ব্বে তোমার নিকট শকুন্তলাসংক্রান্ত যে সকল গল্প করিয়াছি, সে সমস্ত পরিহাসমাত্র, তুমি যেন যথার্থ ভাবিয়া একে আর করিও না। মাধব্য কহিলেন, তার সন্দেহ কি? আমি এক বারও তোমার ঐ সকল কথা যথার্থ ভাবি নাই।
অনন্তর, রাজা তপস্বীদিগের যজ্ঞবিঘ্ননিবারণার্থে তাপে বনে প্রবিষ্ট হইলেন; এবং মাধব্যও, যাবতীয় সৈন্য সামন্ত ও সমুদয় অনুযাত্রিক সঙ্গে লইয়া, রাজধানী প্রস্থান করিলেন।