শকুন্তলা (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ১৮৭৫)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

রাজা, মাধব্য সমভিব্যাহারে সমস্ত সৈন্য সামন্তু বিদায় করিয়া দিয়া, তপস্বিকার্য্যের অনুরোধে তপোবনে অবস্থিতি করিলেন; কিন্ত‍ু দিন যামিনী কেবল শকুন্তলাচিন্তায় একান্ত মগ্ন হইয়া দিনে দিনে কৃশ, মলিন, দুর্বল, ও সর্ব্ববিষয়ে নিতান্ত নিরুৎসাহ হইতে লাগিলেন। আহার, বিহার, শয়ন, উপবেশন কোনও বিষয়েই তাঁহার মনের সুখ ছিল না। কোন সময়ে কোন স্থানে গেলে শকুন্তলাকে দেখিতে পাইব, নিয়ত এই অনুধ্যান ও এই অনুসন্ধান। কিন্তু, পাছে তপোবনবাসীরা তাঁহার অভিসন্ধি বুঝিতে পারেন, এই আশঙ্কায় তিনি সতত সাসিশয় সঙ্কুচিত থাকেন।

 এক দিন, মধ্যাহ্ন কালে, রাজা নির্জনে উপবিষ্ট হইয়া ভাবিতে লাগিলেন, শকুন্তলার দর্শন ব্যতিরেকে আর আমার প্রাণরক্ষার উপায় নাই। কিন্তু তপস্বীদিগের প্রয়োজন সম্পন্ন হইলে, যখন তাঁহাৱা আমায় রাজধানীগমনের অনুমতি করিবেন, তখন আমার কি দশা হইবেক; কি রূপে তাপিত প্রাণ শীতল করিব। সে যাহা হউক, এখন কোথায় গেলে শকুন্তলাকে দেখিতে পাই। বোধ করি, প্রিয়া মালিনীতীরবর্ত্তী শীতল লতামণ্ডপে আতপকাল অতিবাহিত করিতেছেন; সেই খানে যাই, তাঁহারে দেখিতে পাইব। এই বলিয়া তিনি, গ্রীষ্মকালের মধ্যাহ্ন সময়ে, সেই লতামণ্ডপের উদ্দেশে প্রস্থান করিলেন।

 এ দিকে, শকুন্তলাও, রাজদর্শনদিবসাবধি, দুঃসহ বিরহযাতনায় সাতিশয় কাতর হইয়াছিলেন; ফলতঃ, তাহার ও বাজার অবস্থার কোনও অংশে কোনও প্রভেদ ছিল না। সে দিবস শকুন্তলা অত্যন্ত অসুস্থ হওয়াতে, অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা তাঁহাকে মালিনীতীরবর্ত্তী নিকুঞ্জবনে লইয়া গেলেন এবং তন্মধ্যবর্তী শীতল শিলাতলে, নব পল্লব ও জলার্দ্র পদ্মপত্র প্রভৃতি দ্বারা শয্যা, প্রস্তুত করিয়া, তাহাতে শয়ন করাইয়া, অশেষপ্রকার শুশ্রুষা করিতে লাগিলেন।

 রাজা, ক্রমে ক্রমে সেই নিকুঞ্জবনের সন্নিহিত হইয়া, চরণচিহ্নপ্রভৃতি লক্ষণ দ্বারা বুঝিতে পারিলেন, শকুন্তলা তথায় আছেন। তিনি কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইয়া, লতার অন্তরাল হইতে শকুন্তলাকে অবলোকন করিয়া, যৎপরোনান্তি প্রীত হইয়া কহিতে লাগিলেন, আঃ! আমার নয়নযুগল শীতল হইল, প্রিয়ারে দেখিলাম। ইহারা তিন সখীতে কি কথোপকথন করিতেছে, লতাবিতানে ব্যবহিত হইয়া, কিয়ৎ ক্ষণ শ্রবণ ও অবলোকন করি। এই বলিয়া, রাজা উৎসুক মনে শ্রবণ ও সভৃষ্ণ নয়নে অবলোকন করিতে লাগিলেন।

 শকুন্তলার শরীরতাপ সাতিশয় প্রবল হওয়াতে, অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা শীতল সলিলার্দ্র নলিনীদল লইয়া কিয়ৎ ক্ষণ বায়ু সঞ্চালন করিলেন, এবং জিজ্ঞাসিলেন, সখি শকুন্তলে! কেমন, মলিনীদলবায়ু তোমার সুখজনক বোধ হইতেছে? শকুন্তলা কহিলেন, সখি! তোমরা কি বাতাস করিতেছ? উভয়ে শুনিয়া সাতিশয় বিষন্ন হুইয়া, পরস্পর মুখনিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। বাস্তবিক, তৎকালে শকুন্তলা, দুষ্মম্ভচিন্তায় নিতান্ত মগ্ন হইয়া, এক বারে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হইয়াছিলেন। রাজা, শুনিয়া ও শকুন্তলার অবস্থা দেখিয়া, মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিলেন, ইহাকে অত্যন্তু অসুস্থশরীর দেখিতেছি। কিন্তু কি কারণে এ এরূপ অসুস্থ হইয়াছে? গ্রীষ্মের প্রাদুর্ভাববশতঃ ইহার ঈদৃশ অসুখ, কি যে কারণে আমার এই দশা ঘটিয়াছে, ইহারও তাহাই। অথবা, এ বিষয়ে আর সংশয় করিবার আবশ্যকতা নাই; গ্রীষ্মদোষে কামিনীগণের এরূপ অবস্থা কোনও মতেই সম্ভাবিত নহে।

 প্রিয়ংবদা শকুন্তলার অগোচরে অনসূয়াকে কহিলেন, সখি! সেই রাজর্ষির প্রথম দর্শন অবধিই শকুন্তলা কেমন একপ্রকার হইয়াছে; ঐ কারণে ত ইহার এ অবস্থা ঘটে নাই? অনসূয়া কহিলেন, সখি! আমারও ঐ আশঙ্কাই হয়; ভাল, জিজ্ঞাসা করিতেছি। এই বলিয়া, তিনি শকুন্তলাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, প্রিয়সখি! তোমার শরীরের গ্লানি উত্তরোত্তর প্রবল হইয়া উঠিতেছে; অতএব আমরা তোমায় কিছু জিজ্ঞাসা করিতে চাই। শকুন্তলা কহিলেন, সখি! কি বলিবে বল। তখন অনসূয়া কহিলেন, তোমার মনের কথা কি, আমরা তাহার বিন্দু বিসর্গও জানি না; কিন্তু ইতিহাসকথায় বিরহী জনের যেরূপ অবস্থা শুনিতে পাই, বোধ হয়, তোমারও যেন সেই অবস্থা ঘটিয়াছে। সে যা হউক, কি কারণে তোমার এত অসুখ হইয়াছে বল; প্রকৃত রূপে রোগনির্ণয় না হইলে, প্রতীকারচেষ্টা হইতে পারে না। শকুন্তলা কহিলেন, সখি! আমার অত্যন্ত ক্লেশ হইতেছে, এখন বলিতে পারিব না। প্রিয়ংবদা কহিলেন, অনসূয়া ভালই বলিতেছে; কেন আপনার মনের বেদনা গোপন করিয়া রাখ? দিন দিন কৃশ ও দুর্বল হইতেছ। দেখ, তোমার শরীরে আর কি আছে; কেবল লাবণ্যময়ী ছায়ামাত্র অবশিষ্ট রহিয়াছে।

 রাজা অন্তরাল হইতে শ্রবণ করিয়া কহিতে লাগিলেন, প্রিয়ংবদা যথার্থ কহিয়াছে; শকুন্তলার শরীর নিতান্ত কৃশ ও একান্ত বিবর্ণ হইয়াছে। কিন্তু কি চমৎকার! এ অবস্থাতে দেখিয়াও, আমার মনের ও নয়নের অনির্বচনীয় প্রীতিলতা হুইতেছে।

 অবশেষে শকুন্তলা, মনের ব্যথা আর গোপন করা অসাধ্য বিবেচনা করিয়া, দীর্ঘনিশ্বাসপরিত্যাগপূর্ব্বক কহিলেন, সখি! যদি তোমাদের কাছে না বলিব, আর কার কাছেই বলিব; কিন্তু মনের বেদনা ব্যক্ত করিয়া, তোমাদিগকে কেবল দুঃখভাগিনী করিব। অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা কহিলেন, সখি! এই নিমিত্তই ত আমরা এত আগ্রহ করিতেছি; তুমি কি জান না, আত্মীয় জনের নিকট দুঃখের কথা কহিলেও, দুঃখের অনেক লাঘব হয়।

 এই সময়ে, রাজা শঙ্কিত হইয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন, যখন সুখের সুখী ও দুঃখের দুঃখী জিজ্ঞাসা করিয়াছে, তখন অবশ্যই এ আপন মনের বেদনা ব্যক্ত করিবেক। প্রথমদর্শনদিবসে, প্রস্থানকালে সতৃষ্ণ নয়নে বারংবার নিরীক্ষণ করিয়া, অনুরাগের স্পষ্ট লক্ষণ প্রদর্শন করিয়াছিল, তথাপি এখন কি বলিবে, এই ভয়ে অভিভূত ও কাতর হইতেছি।

 শকুন্তলা কহিলেন, সখি! যে অবধি আমি সেই রাজর্ষিকে নয়নগোচর করিয়াছি—এই মাত্র কহিয়া, লজ্জায় নম্রমুখী হইয়া রইলেন, আর বলিতে পারিলেন না। তখন তাঁহারা উভয়ে কহিতে লাগিলেন, সখি! বল, বল, আমাদের নিকট লজ্জা কি? শকুন্তলা কহিলেন, সেই অবধি, তাঁহাতে অনুরাগিণী হইয়া, আমার এই অবস্থা ঘটিয়াছে। এই বলিয়া, তিনি বিষণ্ণ বদনে অপূর্ণ নয়নে লজ্জায় অধোমুখী হইয়া রহিলেন। অনসুয়া ও প্রিয়ংবদা সাতিশয় প্রীত হইয়া কহিলেন, সখি! সৌভাগ্যক্রমে তুমি অনুরূপ পাত্রেই অনুরাগিণী হইয়াছ; অথবা, মহানদী, সাগর পরিত্যাগ করিয়া, আর কোন জলাশয়ে প্রবেশ করিবেক।

 রাজা শুনিয়া আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইয়া কহিতে লাগিলেন, যা শুনিবার তা শুনিলাম; এত দিনের পর আমার তাপিত প্রাণ শীতল হইল।

 শকুন্তলা কহিলেন, সখি! আর আমি যাতনা সহ্য করিতে পারি না, এখন প্রাণবিয়োগ হইলেই পরিত্রাণ হয়। প্রিয়ংবদা, শুনিয়া, সাতিশয় শঙ্কিত হইয়া, শকুন্তলার অগোচরে অনসুয়াকে কহিলেন, সখি! আর ইহাকে সান্ত্বনা করিয়া ক্ষান্ত রাখিবার সময় নাই; আমার মতে আর কালাতিপাত করা কর্ত্তব্য নয়, ত্বরায় কোনও উপায় করা আবশ্যক। তখন অনসুয়া কহিলেন, সখি! যাহাতে অবিলম্বে অথচ গোপনে শকুন্তলার মনোরথ সম্পন্ন হয়, এমন কি উপায় হয়, বল। প্রিয়ংবদা কহিলেন, সখি! গোপনের জন্যেই ভাবনা, অবিলম্বে হওয়া কঠিন নয়। অনসূয়া কহিলেন, কি জন্যে, বল দেখি। প্রিয়ংবদা কহিলেন, কেন তুমি কি দেখ নাই, সেই রাজর্ষিও, শকুন্তলাকে দেখিয়া অবধি দিন দিন দুর্বল ও কৃশ হইতেছেন?

 রাজা শুনিয়া স্বীয় শরীরে দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, যথার্থই এরূপ হইয়াছি বটে। নিরস্তুর অন্তরতাপে তাপিত হইয়া, আমার শরীর বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে; এবং দুর্বল ও কৃশও যৎপরোনাস্তি হইয়াছি।

 প্রিয়ংবদা কহিলেন, অনসূয়ে! শকুন্তলার প্রণয়পত্রিকা করা যাউক; সেই পত্রিকা, আমি পুষ্পের মধ্যগত করিয়া, নির্ম্মাল্যচ্ছলে রাজর্ষির হস্তে দিয়া আসিব। অনসূয়া কহিলেন, সখি! এ অতি উত্তম পরামর্শ; দেখ, শকুন্তলাই বা কি বলে। শকুন্তলা কহিলেন, সখি! আমাকে আর কি জিজ্ঞাসা করিবে? তোমাদের যা ভাল বোধ হয় তাই কর। তখন প্রিয়ংবদা কহিলেন, তবে আর বিলম্বে কাজ নাই; মনোমত একখানি পত্রিকা রচনা কর। শকুন্তলা কহিলেন, সখি! রচনা করিতেছি; কিন্তু পাছে তিনি অবজ্ঞা করেন, এই ভয়ে আমার হৃদয় কম্পিত হইতেছে।

 রাজা শকুন্তলার আশঙ্কা শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিলেন, এবং তাঁহাকে উদ্দেশ করিয়া কহিতে লাগিলেন, সুন্দরি! তুমি যাহার অবজ্ঞাভয়ে ভীত হইতেছ, সে এই তোমার সমাগমের নিমিত্ত একান্ত উৎসুক হইয়া রহিয়াছে; তুমি কি জান না, রত্ন কাহারও অন্বেষণ করে না, রত্নেরই অন্বেষণ সকলে করিয়া থাকে।

 অনসূয়া ও প্রিয়ংবদাও, শকুন্তলার আশঙ্কা শুনিয়া, কহিলেন, অয়ি আত্মগুণাবমানিনি! কোন ব্যক্তি আতপত্র দ্বারা শরৎকালীন জ্যোৎস্না নিবারণ করিয়া থাকে? শকুন্তলা ঈষৎ হাস্য করিয়া পত্রিকারচনায় প্রবৃত্ত হইলেন, এবং কিঞ্চিৎ পরে কহিলেন, সখি! রচনা করিয়াছি, কিন্তু লিখনসামগ্রী কিছুই নাই, কিসে লিখি বল। প্রিয়ংবদা কহিলেন, এই পদ্মপত্রে লিখ।

 লিখন সমাপন করিয়া, শকুন্তলা সখীদিগকে কহিলেন ভাল শুন দেখি সঙ্গত হয়েছে কি না। তাঁহারা শুনিতে লাগিলেন; শকুন্তলা পড়িতে আরম্ভ করিলেন, হে নির্দয়! তোমার মন আমি জানি না, কিন্তু আমি তোমাতে একান্ত অনুরাগিণী হইয়া নিরন্তুর সন্তার্পিত হইতেছি—এই মাত্র শুনিয়া আর অন্তরালে থাকিতে না পারিয়া, রাজা সহসা সম্মুখে উপস্থিত হইলেন এবং শকুন্তলাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, সুন্দরি! তুমি সন্তাপিত হইতেছ যথার্থ বটে; কিন্ত‌ু বলিলে বিশ্বাস করিবে না, আমি এক বারে দগ্ধ হইতেছি। অনমুয়া ও প্রিয়ংবদা, সহসা রাজাকে সমাগত দেখিয়া, যৎপরোনাস্তি হর্ষিত হইলেন এবং গাত্রোত্থানপূর্ব্বক, পরম সমাদরে স্বাগত জিজ্ঞাসা করিয়া বসিবার সংবর্দ্ধনা করিলেন। শকুন্তলাও, অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া, গাত্রোথান করিতে উদ্যত হইলেন।

 তখন রাজা শকুন্তলাকে নিবারণ করিয়া কহিলেন, সুন্দরি! গাত্রোত্থান করিবার প্রয়োজন নাই; তোমার দর্শনেই আমার সম্পূর্ণ সংবর্দ্ধনা লাভ হইয়াছে। বিশেষতঃ, তোমার শরীরের যেরূপ গ্লানি, তাহাতে কোনও মতেই শয্যা পরিত্যাগ করা কর্ত্তব্য নহে। সখীরা রাজাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, মহারাজ! এই শিলাতলে উপবেশন করুন। রাজা উপবিষ্ট হইলেন। শকুন্তলা, লজ্জায় অত্যন্ত জড়ীভূতা হইয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, হৃদয়! যার জন্যে তত উতলা হইয়াছিলে, এখন তাহাকে দেখিয়া এত কাতর হইতেছ কেন? রাজা অনসূয়া ও প্রিয়ংবদাকে কহিলেন, আজি আমি তোমাদের সখীকে অতিশয় অসুস্থ দেখিতেছি। উভয়ে ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, এখন সুস্থ হইবেন। শকুন্তলা লজ্জায় অবনতমুখী হইয়া রহিলেন।

 অনসূয়া কহিলেন, মহারাজ! শুনিতে পাই, রাজাদিগের অনেক মহিষী থাকে, কিন্ত‌ু সকলেই প্রেয়সী হয় না; অতএব আমরা, যেন সখীর নিমিত্ত অবশেষে মনোদুঃখ না পাই। রাজা কহিলেন, যথার্থ বটে রাজাদিগের অনেক মহিলা থাকে; কিন্তু আমি অকপট হৃদয়ে কহিতেছি, তোমাদের সখীই আমার জীবনসর্ব্বস্ব হইবেন। তখন অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা সাতিশয় হর্ষিত হইয়া কহিলেন, মহারাজ! এক্ষণে আমরা নিশ্চিন্ত ও চরিতার্থ হইলাম। শকুন্তলা কহিলেন, সখি! আমরা মহারাজকে। লক্ষ্য করিয়া কত কথা কহিয়াছি; ক্ষমা প্রার্থনা কর। সখীরা হাস্যমুখে কহিলেন, যে কহিয়াছে সেই ক্ষমা প্রার্থনা করিবে, অন্যের কি দায়। তখন শকুন্তলা কহিলেন, মহারাজ! যদি কিছু কহিয়া থাকি, ক্ষমা করিবেন; পরোক্ষে কে কি না বলে। রাজা শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিলেন।

 এইরূপ কথোপকথন চলিতেছে, এমন সময়ে প্রিয়ংবদা লতামণ্ডপের বহির্ভাগে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া, কহিলেন, অনসূয়ে! মৃগশাবকটি উৎসুক হইয়া ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিতেছে; বোধ করি, আপন জননীর অন্বেষণ করিতেছে; আমি উহাকে উহার মার কাছে দিয়া আসি। তখন অনসুয়া কহিলেন সখি! ও অতি চঞ্চল, তুমি একাকিনী উহারে ধরিতে পারিবে না, চল আমিও যাই। এই বলিয়া উভয়ে প্রস্থানোন্মুখী হইলেন। শকুন্তলা উভয়কেই প্রস্থান করিতে দেখিয়া কহিলেন, সখি। তোমরা দুজনেই আমায় ফেলিয়া চলিলে, আমি এখানে এককিনী রহিলাম। তাঁহারা কহিলেন, সখি! একাকিনী কেন, পৃথিবীনাথকে তোমার নিকটে রাখিয়া গেলাম। এই বলিয়া, হাসিতে হাসিতে, উভয়ে লতামণ্ডপ হইতে প্রস্থান করিলেন।

 উভয়ে প্রস্থান করিলে, শকুন্তলা, সত্য সত্যই সখীরা চলি। গেল এই বলিয়া, উৎকণ্ঠিতার ন্যায় হইলেন। রাজা কহিলেন, সুন্দরি! সখীদের নিমিত্ত এত উৎকণ্ঠিত হইতেছ কেন? আমি তোমার সখীস্থানে রহিয়াছি; যখন যে আদেশ করিবে, তৎক্ষণাৎ তাহা সম্পাদন করিব। শকুন্তলা কহিলেন, মহারাজ! আপনি অতি মান্য ব্যক্তি, এ দুঃখিনীকে অকারণে অপরাধিনী করেন কেন? এই বলিয়া শয্যা হইতে উঠিয়া, শকুন্তলা গমনোন্মুখী হইলেন। রাজা কহিলেন, সুন্দরি! এ কি কর; একে তোমার অবস্থা এই, তাহাতে আবার মধ্যাহ্ন কাল অতি উত্তাপের সময়; এ অবস্থায় এ সময়ে লতামণ্ডপ হইতে বহির্গত হওয়া কোনও মতেই উচিত নহে। এই বলিয়া হস্তে ধরিয়া, রাজা নিবারণ করিতে লাগিলেন। শকুন্তলা কহিলেন, মহারাজ! ও কি কর, ছাড়িয়া দাও, সখীদের নিকটে যাই; তুমি জান না, আমি আপনার বশ নই। রাজা, লজ্জিত ও সঙ্কুচিত হইয়া, শকুন্তলার হাত ছাড়িয়া দিলেন। শকুন্তলা কহিলেন, মহারাজ! আপনি লজ্জিত হইতেছেন কেন? আমি আপনাকে কিছু বলি নাই, দৈবের তিরস্কার করিতেছি। রাজা কহিলেন, দৈবের তিরস্কার কেন কর? দৈবের অপরাধ কি? শকুন্তলা কহিলেন, দৈবের তিরস্কার শত বার করিব। সে আমায় পরের অধীন করিয়া পরের গুণে মোহিত করে কেন?

 এই বলিয়া, শকুন্তলা চলিয়া যাইবার উপক্রম করিলেন। রাজা পুনরায় শকুন্তলার হস্তে ধরিলেন। শকুন্তলা কহিলেন, মহারাজ! কি কর, ইতস্ততঃ ঋষিরা ভ্রমণ করিতেছেন। তখন রাজা কহিলেন, সুন্দরি! তুমি গুরু জনের ভয় করিতেছ কেন? ভগবান্ কণ্ব কখনই কষ্ট বা অসন্তুষ্ট হইবেন না। শত শত রাজর্ষিকন্যারা গান্ধর্ব্ববিধানে আপনাদিগকে অনুরূপ পাত্রের হস্তগত করিয়াছেন, এবং তাঁহাদের গুরুজনেরাও, পরিশেষে সবিশেষ অবগত হইয়া, সম্পূর্ণ অনুমোদন করিয়াছেন। শকুন্তলা, মহারাজ! এই সম্ভাষণমাত্রপরিচিত ব্যক্তিকে ভুলিবেন না এই বলিয়া, রাজার হাত ছাড়াইয়া চলিয়া গেলেন। রাজা কহিলেন, সুন্দরি! তুমি আমার হাত ছাড়াইয়া সম্মুখ হইতে চলিয়া গেলে, কিন্ত‌ু আমার চিত্ত হইতে যাইতে পারিবে না। শকুন্তলা শুনিয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন, ইহা শুনিয়া, আর আমার পা উঠিতেছে না। যাহা হউক, কিয়ৎ ক্ষণ অন্তরালে থাকিয়া ইঁহার অনুরাগ পরীক্ষা করিব। এই বলিয়া, লতাবিতানে আবৃতশরীরা হইয়া, শকুন্তলা কিঞ্চিৎ অন্তরে অবস্থান করিলেন।

 রাজা, একাকী লতামণ্ডপে অবস্থিত হইয়া, শকুন্তলাকে উদ্দেশ করিয়া কহিতে লাগিলেন, প্রিয়ে! আমি তোমা বই আর জানি না; কিন্তু তুমি নিতান্ত নির্দয় হইয়া আমায় এক বারেই পরিত্যাগ করিয়া গেলে; তুমি বড় কঠিন। পরে, তিনি কিয়ৎ ক্ষণ মৌন ভাবে থাকিয়া কহিলেন, আর প্রিয়াশূন্য লতামণ্ডপে থাকিয়া কি ফল? এই বলিয়া তথা হইতে চলিয়া যান, এমন সময়ে শকুন্তলার মৃণালবলয় ভূতলে পতিত দেখিয়া তৎক্ষণাৎ তাহা উঠাইয়া লইলেন, এবং পরম সমাদরে বক্ষঃস্থলে স্থাপনপূর্ব্বক, কৃতার্থম্মন্য চিত্তে শকুন্তলাকে উদ্দেশ করিয়া, কহিতে লাগিলেন, প্রিয়ে! তোমার মৃণালবলয়, অচেতন হইয়াও, এই দুঃখিত ব্যক্তিকে আশ্বাসিত করিলেক; কিন্ত‌ু তুমি তাহা করিলে না। শকুন্তলা, আর ইহা শুনিয়া বিলম্ব করিতে পারি না, কিন্তু কি বলিয়াই যাই; অথবা, এই মৃণালবলয়ের ছলেই যাই; এই বলিয়া পুনর্বার লতামণ্ডপে প্রবেশ করিলেন। রাজা দর্শনমাত্র হর্ষসাগরে মগ্ন হইয়া কহিলেন, এই যে আমার জীবিতেশ্বরী আসিয়াছেন! বুঝিলাম, দেবতারা আমার পরিতাপ শুনিয়া সদয় হইলেন, তাহাতেই পুনরায় প্রিয়ারে দেখিতে পাইলাম। চাতক পিপাসায় শুষ্ককণ্ঠ হইয়া জলপ্রার্থনা করিল, অমনি নব জলধর হইতে শীতল জলধারা তাহার মুখে পতিত হইল।

 শকুন্তলা রাজার সম্মুখবর্ত্তনী হইয়া কহিলেন, মহারাজ! অর্দ্ধ পথে স্মরণ হওয়াতে, আমি এই মৃণালবলয় লইতে আসিয়াছি, আমার মৃণালবলয় দাও। রাজা কহিলেন, যদি তুমি, আমায় যথাস্থানে নিবেশিত করিতে দাও, তোমার মৃণালবলয় তোমায় ফিরিয়া দি, নতুবা দিব না। শকুন্তলা অগত্যা সম্মতা হলেন। রাজা কহিলেন, এস এই শিলাতলে বসিয়া পরাইয়া দি। উভয়ে শিলাতলে উপবিষ্ট হইলেন; রাজা শকুন্তলার হস্ত লইয়া মৃণালবলয় পরাইবার উদেযাগ করিতে লাগিলেন। শকুন্তলা একান্ত আকুলহৃদয় হইয়া কহিলেন, আর্য্যপুত্র! সত্বর হও, সত্বর হও। রাজা, আর্যপুত্রসম্ভাষণ শ্রবণে যৎপরোনান্তি হর্ষ প্রাপ্ত হইয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, স্ত্রীলোকেরা স্বামীকেই আর্য্যপুত্রশব্দে সম্ভাষণ করিয়া থাকে; বুঝি আমার মনোরথ পূর্ণ হইল। অনন্তর, তিনি শকুন্তলাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, সুন্দরি! মৃণালবলয়ের সন্ধি সম্যক্ সংশ্লিষ্ট হইতেছে না; যদি তোমার মত হয়, অন্য প্রকারে সংযোজন করিয়া পরাই। শকুন্তলা ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, তোমার যা অভিরুচি।

 রাজা, নানা ছলে বিলম্ব করিয়া, শকুন্তলার হস্তে মৃণাল বলয় পরাইয়া দিলেন এবং কহিলেন, সুন্দরি! দেখ দেখ, কেমন সুন্দর হইয়াছে। শকুন্তলা কহিলেন, দেখিব কি, আমার নয়নে কর্ণোৎপলরেণু পতিত হইয়াছে, দেখিতে পাই না। রাজা ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, যদি তোমার মত হয়, ফুৎকার দিয়া পরিষ্কার করিয়া দি। শকুন্তলা কহিলেন, তাহা হইলে অত্যন্ত উপকৃত হই বটে, কিন্তু তোমায় অত দূর বিশ্বাস হয় না। রাজা কহিলেন, সুন্দরি! অবিশ্বাসের বিষয় কি? নূতন ভৃত্য কি কখনও প্রভুর আদেশের অতিরিক্ত করিতে পারে? শকুন্তলা কহিলেন, ঐ অতিভক্তিই অবিশ্বাসের কারণ। অনন্তর রাজা, শকুন্তলার চিবুকে ও মস্তকে হস্ত প্রদান করিয়া, তাঁহার মুখকমল উত্তোলন করিলেন। শকুন্তলা, শঙ্কিতা ও কম্পিত হইয়া, রাজাকে বারংবার নিষেধ করিতে লাগিলেন। রাজা, সুন্দরি! শঙ্কা কি, এই বলিয়া শকুন্তলার নয়নে ফুৎকার প্রদান করিতে লাগিলেন।

 কিয়ৎ ক্ষণ পরে, শকুন্তলা কহিলেন, আর পরিশ্রম করিতে হইবেক না, আমার নয়ন পূর্ব্ববৎ হইয়াছে; আর কোনও অসুখ নাই। মহারাজ! আমি অত্যন্ত লজ্জিত হইতেছি; তুমি আমার এত উপকার করিলে, আমি তোমার কোনও প্রত্যুপকার করিতে পারিলাম না। রাজা কহিলেন, সুন্দরি! আর কি প্রত্যুপকার চাই? আমি যে তোমার সুরভি মুখকমলের আঘ্রাণ লাভ করিয়াছি, তাহাই আমার পরিশ্রমের যথেষ্ট পুরস্কার হইয়াছে; মধুকর কমলের আঘ্রাণমাত্রেই সন্তুষ্ট হইয়া থাকে। শকুন্তলা ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, সন্তুষ্ট না হইয়াই বা কি করে।

 এইরূপ কৌতুক ও কথোপকথন হইতেছে, এমন সময়ে, চক্রবাকবধূ! রজনী উপস্থিত, এই সময়ে চক্রবাককে সম্ভাষণ করিয়া লও; এই শব্দ শকুন্তলার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইল। শকুন্তলা, সঙ্কেত বুঝিতে পারিয়া, সাতিশয় শঙ্কিত হইয়া কহিলেন, মহারাজ! আমার পিতৃম্বসা আর্যা গৌতমী, আমার অসুস্থতার সংবাদশুনিয়া, আমি কেমন আছি জানিতে আসিতেছেন; এই নিমিত্তই, অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা চক্রবাকচক্রবাকীচ্ছলে আমাদিগকে সাবধান করিতেছে; তুমি সত্বর লতামণ্ডপ হইতে নির্গত ও অন্তর্হিত হও। রাজা, ভাল আমি চলিলাম, যেন পুনরায় দেখা হয়, এই বলিয়া, লতবিতানে ব্যবহিত হইয়া, শকুন্তলাকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।

 কিয়ৎ ক্ষণ পরে, শান্তিজলপূর্ণ কমণ্ডলু হস্তে লইয়া, গৌতমী লতামণ্ডপে প্রবেশ করিলেন, এবং শকুন্তলার শরীরে হস্ত প্রদান করিয়া কহিলেন, বাছা! শুনিলাম, আজি তোমার বড় অসুখ হয়েছিল, এখন কেমন আছ, কিছু উপশম হয়েছে? শকুন্তলা কহিলেন, হা ঁপিসি! আজি বড় অসুখ হয়েছিল; এখন অনেক ভাল আছি। তখন গৌতমী, কমণ্ডলু হইতে শান্তিজল লইয়া, শকুন্তলার সর্ব্ব শরীরে সেচন করিয়া কহিলেন, বাছা! সুস্থ শরীরে চিরজীবিনী হয়ে থাক। অনন্তর, লতামণ্ডপে অনসূয়া অথবা প্রিয়ংবদা কাহাকেও সন্নিহিত না দেখিয়া, কহিলেন, এই অসুখ, তুমি একলা আছি বাছা, কেউ কাছে নাই। শকুন্তলা। কহিলেন, না পিসি! আমি একলা ছিলাম না, অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা বরাবর আমার নিকটে ছিল; এই মাত্র মালিনীতে জল আনিতে গেল। তখন গৌতমী কহিলেন, বাছা! আর রোদ নাই, অপরাহ্ণ হয়েছে, এস কুটীরে যাই। শকুন্তলা অগত্যা তাঁহার অনুগামিনী হইলেন। রাজাও, আর আমি প্রিয়াশূন্য লতামণ্ডপে থাকিয়া কি করি, এই বলিয়া শিবিরোদ্দেশে প্রস্থান করিলেন।

 এই ভাবে কতিপয় দিবস অতিবাহিত হইল। পরিশেষে রাজা, গান্ধর্ব্ব বিধানে শকুন্তলার পাণিগ্রহণসমাধানপূর্ব্বক, ধর্ম্মরণ্যে কিছু দিন অবস্থিতি করিয়া, নিজ রাজধানী প্রস্থান করিলেন।