শকুন্তলা (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ১৮৭৫)/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

রাজা দুষ্মন্ত প্রস্থান করিলে পর, এক দিন অনসূয়া প্রিয়ংবদাকে কহিতে লাগিলেন, সখি! শকুন্তলা গান্ধর্ব্ব বিবাহ দ্বারা আপন অনুরূপ পতি লাভ করিয়াছে বটে; কিন্ত‌ু আমার এই ভাবনা হইতেছে, পাছে রাজা নগরে গিয়া অন্তঃপুরবাসানীদিগের সমাগমে শকুন্তলাকে ভুলিয়া যান। প্রিয়ংবদা কহিলেন, সখি! সে সন্দেহ করিও না; তেমন আকৃতি কখনও গুণশূন্য হয় না। কিন্তু আমার আর ভাবনা হইতেছে, না জানি, পিতা আসিয়া, এই বৃত্তান্ত শুনিয়া, কি বলেন। অনসূয়া কহিলেন, সখি! আমার বোধ হইতেছে, তিনি শুনিয়া কষ্ট বা অসন্ত‌ুষ্ট হইবেন না; এ তাঁহার অনভিমত কর্ম্ম হয় নাই। কেন না, তিনি প্রথমাবধি এই সঙ্কল্প করিয়া রাখিয়াছিলেন, গুণবান্ পাত্রে কন্যা প্রদান করিব; যদি দৈবই তাহা সম্পন্ন করিল, তাহা হইলে তিনি বিনা আয়াসে কৃতকার্য্য হইলেন। সুতরাং ইহাতে তাঁহার রোষ বা অসন্তোষের বিষয় কি। উভয়ে, এই রূপ কথোপকথন করিতে করিতে, কুটীরের কিঞ্চিৎ দূরে পুষ্পচয়ন করিতে লাগিলেন।

 এ দিকে, শকুন্তলা; অতিথিপরিচর্য্যার ভার গ্রহণ করিয়া, একাকিনী কুটীরদ্বারে উপবিষ্টা আছেন; দৈবযোগে দুর্বাসা ঋষি আসিয়া, তাঁহাকে উদ্দেশ করিয়া, কহিলেন, আমি অতিথি। শকুন্তলা, রাজার চিন্তুায় নিতান্তু মগ্ন হইয়া, এক কালে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হইয়াছিলেন, সুতরাং দুর্ব্বাসার কথা শুনিতে পাইলেন না। দুর্ব্বাসা অবজ্ঞাদর্শনে রোষবশ হইয়া কহিলেন, আঃ পাপীয়সি! তুই অতিথির অবমাননা করিলি। তুই যার চিন্তায় মগ্ন হইয়া আমায় অবজ্ঞা করিলি—আমি অভিশাপ দিতেছি— স্মরণ করাইয়া দিলেও, সে তোরে স্মরণ করিবেক না।

 প্রিয়ংবদা, শুনিতে পাইয়া, ব্যাকুল হইয়া কহিতে লাগিলেন, হার! হায়! কি সর্ব্বনাশ ঘটিল। শূন্যহৃদয়া শকুন্তলা কোনও পূজনীয় ব্যক্তির নিকট অপরাধিনী হইল। এই বলিয়া, সেই দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া, প্রিয়ংবদা কহিতে লাগিলেন, সখি! যে সে নয়, ইনি দুর্ব্বাসা, ইঁহার কথায় কথায় কোপ; ঐ দেখ, শাপ দিয়া রোষভরে সত্বরে প্রস্থান করিতেছেন। অনসূয়া কহিলেন, প্রিয়ংবদে! বৃথা আক্ষেপ করিলে আর কি হইবে বল? শীঘ্র গিয়া পায় ধরিয়া ফিরাইয়া আন; আমিও এই অবকাশে, কুটীরে গিয়া, পাদ্য অর্ধ প্রভৃতি প্রস্তুত করিয়া রাখিতেছি। প্রিয়ংবদা দুর্ব্বাসার পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। অনসূয়া কুটীরাভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

 অনসূয়া কুটীরে পঁহুছিবার পূর্ব্বেই, প্রিয়ংবদা তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইয়া কহিলেন, সখি! জানই ত দুর্ব্বাসা স্বভাবতঃ অতিকুটিলহৃদয়, তিনি কি কাহারও অনুনয় শুনেন; তথাপি অনেক বিনয়ে কিঞ্চিৎ শান্ত করিয়াছি। যখন দেখিলাম নিতান্ত ফিরিবেন, তখন চরণে ধরিয়া কহিলাম, ভগবন্! সে তোমার কন্যা, তোমার প্রভাব ও মহিমা কি জানে? কৃপা করিয়া তাহার এই অপরাধ ক্ষমা করিতে হইবেক। তখন তিনি কহিলেন, আমি যাহা কহিয়াছি, তাহা অন্যথা হইবার নহে; তবে যদি কোনও অভিজ্ঞান দর্শাইতে পারে, তাহার শাপমোচন হইবেক; এই বলিয়া চলিয়া গেলেন। অনসূয়া কহিলেন, ভাল, এখন আশ্বাসের পথ হইয়াছে। রাজর্ষি প্রস্থানকালে শকুন্তলার অঙ্গুলিতে এক স্বনামাঙ্কিত অঙ্গুরীয় পরাইয়া দিয়া গিয়াছেন। অতএব, শকুন্তলার হস্তেই শকুন্তলার শাপমোচনের উপায় রহিয়াছে। রাজা যদিই বিস্মৃত হন, তাঁহার সেই স্বনামাঙ্কিত অঙ্গুরীয় দেখাইলেই স্মরণ হইবে। উভয়ে এইরূপ কথোপকথন করিতে করিতে,কুটীরাভিমুখে চলিলেন।

 কিয়ৎ ক্ষণে, উভয়ে কুটীরদ্বারে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, শকুন্তলা, করতলে কপোল বিন্যাস করিয়া, স্পন্দহীনা, মুদ্রিতনয়না, চিত্রার্পিতার ন্যায়, উপবিষ্টা আছেন। তখন প্রিয়ংবদা কহিলেন, অনসূয়ে! দেখ দেখ, শকুন্তলা পতিচিন্তায় মগ্ন হইয়া এক বারে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হইয়া রহিয়াছে; ও কি অতিথি অভ্যাগতের তত্ত্বাবধান করিতে পারে। অনসূয়া কহিলেন, সধি! এ বৃত্তান্ত আমাদেরই মনে মনে থাকুক, কোনও মতে কর্ণান্তর করা হইবেক না; শকুন্তলা শুনিলে প্রাণে বাঁচিবেক না। প্রিয়ংবদা কহিলেন, সখি! তুমি কি পাগল হয়েছ? এ কথাও কি শকুন্তলাকে শুনাতে হয়? কোন ব্যক্তি উষ্ণ জলে নবমলিকা সেচন করে?

 কিয়ৎ দিন পরে, মহর্ষি কণ্ব সোমতীর্থ হইতে প্রত্যাগমন করিলেন। এক দিন তিনি, অগ্নিগৃহে প্রবিষ্ট হইয়া, হোমকার্য্য সম্পাদন করিতেছেন, এমন সময়ে এই দৈববাণী হইল—মহর্ষে! রাজা দুষ্মন্ত, মৃগয়া উপলক্ষে তোমার ওপোবন আসিয়া, শকুন্তলার পাণিগ্রহণ করিয়া গিয়াছেন এবং শকুন্তলাও তৎসহযোগে গর্ভবতী হইয়াছেন। মহর্ষি, এই রূপে শকুন্তলার পরিণয়বৃত্তান্ত অবগত হইয়া, তাঁহার অগোচরে ও সম্মতি ব্যতিরেকে সম্পন্ন হইয়াছে বলিয়া, কিঞ্চিন্মাত্র ৱোষ বা অসন্তোষ প্রদর্শন করিলেন না; বরং যৎপরোনাস্তি প্রীত হইয়া কহিতে লাগিলেন, আমার পরম সৌভাগ্য যে শকুন্তলা এতাদৃশ সৎপাত্রের হস্তগত হইয়াছে। অনন্তর তিনি, প্রফুল্ল বদনে শকুন্তলার নিকটে গিয়া, সাতিশয় পরিতোষ প্রদর্শন করিয়া কহিলেন, বৎসে! তোমার পরিণয়বৃত্তান্ত অবগত হইয়া অনির্বচনীয় প্রীতি প্রাপ্ত হইয়াছি, এবং স্থির করিয়াছি, অবিলম্বে দুই শিষ্য ও গৌতমীকে সমভিব্যাহারে দিয়া, তোমায় ভর্ত্তৃসন্নিধানে পাঠাইয়া দিব। অনন্তর, তদীয় আদেশ ক্রমে শকুন্তলার প্রস্থানের উদেযাগ হইতে লাগিল।

 প্রস্থানসময় উপস্থিত হইল। গৌতমী, এবং শার্ঙ্গরব ও শারদ্বত নামে দুই শিষ্য, শকুন্তলাসমভিব্যাহারে গমনের নিমিত্ত প্রস্তুত হইলেন। অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা যথাসম্ভব বেশ ভূষা সমাধান করিয়া দিলেন। মহর্ষি শোকাকুল হইয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন, অদ্য শকুন্তলা যাইবে বলিয়া, আমার মন উৎকণ্ঠিত হইতেছে, নয়ন অনবরত বাষ্পবারিতে পরিপূর্ণ হইতেছে, কণ্ঠরোধ হইয়া বাক‍্শক্তিরহিত হইতেছি, জড়তায় নিতান্ত অভিভূত হইতেছি। কি আশ্চার্য্য! আমি বনবাসী, স্নেহবশতঃআমারও ঈদৃশ বৈপ্লব্য উপস্থিত হইতেছে, না জানি সংসারীরা এমন অবস্থায় কি দুঃসহ ক্লেশ ভোগ করিয়া থাকে। বুঝিলাম, স্নেহ অতি বিষম বস্তু। পরে শোকাবেগ সংবরণ করিয়া, শকুন্তলাকে কহিলেন বৎসে! বেলা হইতেছে, প্রস্থান কর; আর অনর্থ কালহরণ করিতেছ কেন? এই বলিয়া তপোবনতরুদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন হে সন্নিহিত তরুগণ! যিনি তোমাদের জলসেচন না করিয়া কদাচ জলপান করিতেন না, যিনি ভূষণপ্রিয়া হইয়াও স্নেহবশতঃ কদাচ তোমাদের পল্লবভঙ্গ করিতেন না, তোমাদের কুসুমপ্রসবের সময় উপস্থিত হইলে, যাঁহার আনন্দের সীমা থাকিত না, অদ্য সেই শকুন্তলা পতিগৃহে যাইতেছেন, তোমরা সকলে অনুমোদন কর।  অনন্তর, সকলে গাত্রোথান করিলেন। শকুন্তলা, গুরুজনদিগকে প্রণাম করিয়া, প্রিয়ংবদার নিকটে গিয়া অশ্রুপূর্ণ নয়নে কহিতে লাগিলেন, সখি! আর্য্যপুত্রকে দেখিবার নিমিত্ত, আমার চিত্ত অত্যন্ত ব্যগ্র হইয়াছে বটে, কিন্তু তপোবন পরিত্যাগ করিয়া যাইতে আমার পা উঠিতেছে না। প্রিয়ংবদা কহিলেন, সখি! তুমিই যে কেবল তপোবনবিরহে কাতর হইতেছ এরূপ নহে, তোমার বিরহে তপোবনের কি অবস্থা ঘটিতেছে, দেখ!— জীবমাত্রেই নিরানন্দ ও শোকাকুল; হরিণগণ, আহারবিহারে পরাঙ্মুখ হইয়া, স্থির হইয়া রহিয়াছে, মুখের গ্রাস মুখ হইতে পড়িয়া যাইতেছে; ময়ুর ময়ূরী, নৃত্য পরিত্যাগ করিয়া, উর্দ্ধমুখ হইয়া রহিয়াছে; কোকিলগণ, আম্রমুকুলের রসাস্বাদে বিমুখ হইয়া, নীরব হইয়া আছে; মধুকর মধুকরী মধুপানে বিরত হইয়াছে ও গুন্ গুন্ ধ্বনি পরিত্যাগ করিয়াছে।

 কণ্ব কহিলেন, বৎসে! আর কেন বিলম্ব কর, বেলা হয়। তখন শকুন্তলা কহিলেন, তাত! বনতোষিণীকে সম্ভাষণ না করিয়া যাইব না। এই বলিয়া, তিনি বনতোষিণীর নিকটে গিয়া কহিলেন, বনতোষিণি! শাখাবাহু দ্বারা আমায় স্নেহভরে আলিঙ্গন কর; আজি অবধি আমি দূরবর্ত্তিনী হইলাম। অনন্তর, অনসূয়া ও প্রিয়ংবদাকে কহিলেন, সখি! আমি বনতোষিণীকে তোমাদের হস্তে সমর্পণ করিলাম। তাঁহারা কহিলেন, সখি! আমাদিগকে কাহার হস্তে সমর্পণ করিলে বল? এই বলিয়া শোকাকুল হইয়া রোদন করিতে লাগিলেন। তখন কণ্ব কহিলেন, অনসূয়ে! প্রিয়ংবদে! তোমরা কি পাগল হইলে? তোমরা কোথায় শকুন্তলাকে সান্তনা করিবে, না তোমরাই রোদন করিতে আরম্ভ করিলে।

 এক পূর্ণগর্ভা হরিণী কুটীরের প্রান্তে শয়ন করিয়া ছিল। তাহার দিকে দৃষ্টিপাত হওয়াতে, শকুন্তলা কণ্বকে কহিলেন, তাত! এই হরিণী নির্বিঘ্নে প্রসব হইলে, আমায় সংবাদ দিবে, ভুলিবে না বল? কণ্ব কহিলেন, না বৎসে! আমি কখনই বিস্মৃত হইব না।

 কয়েক পদ গমন করিয়া, শকুন্তলার গতিভঙ্গ হইল। শকুন্তলা, আমার অঞ্চল ধরিয়া কে টানে, এই বলিয়া মুখ ফিরাইলেন। কন্ব কহিলেন, বংসে! যাহার মাতৃবিয়োগ হইলে, তুমি জননীর ন্যায় প্রতিপালন করিয়াছিলে; যাহার আহারের নিমিত্ত তুমি সর্ব্বদা শ্যামাক আহরণ করিতে; যাহার মুখ কুশের অগ্রভাগ দ্বারা ক্ষত হইলে, তুমি ইঙ্গুলীতৈল দিয়া ব্রণশোষণ করিয়া দিতে; সেই মাতৃহীন হরিণশিশু তোমার গমন রোধ করিতেছে। শকুন্তলা তাহার গাত্রে হস্ত প্রদান করিয়া কহিলেন, বাছা! আর আমার সঙ্গে এস কেন, ফিরিয়া যাও, আমি তোমায় পরিত্যাগ করিয়া যাইতেছি, তুমি মাতৃহীন হইলে, আমি তোমায় প্রতিপালন করিয়াছিলাম; এখন আমি চলিলাম; অতঃপর পিতা তোমার রক্ষণাবেক্ষণ করিবেন। এই বলিয়া, শকুন্তলা রোদন করিতে করিতে চলিলেন। তখন কণ্ব কহিলেন, বৎসে! শান্ত হও, অশ্রুবেগ সংবরণ কর, পথ দেখিয়া চল; উচ্চ নীচ না দেখিয়া পদক্ষেপ করাতে, বারংবার আঘাত লাগিতেছে।

 এইরূপ নানা কারণে মনের বিলম্ব দেখিয়া, শার্ঙ্গরব কণ্বকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ভগবন্! আপনকার আর অধিক দূর সঙ্গে আসিবার প্রয়োজন নাই, এই স্থলেই, যাহা বলিতে হয়, বলিয়া দিয়া প্রতিগমন করুন। কণ্ব কহিলেন, তবে আইস, এই ক্ষীরবৃক্ষের ছায়ায় দণ্ডায়মান হই। তদনুসারে, সকলে সন্নিহিত ক্ষীরপাদপের ছায়ায় অবস্থিত হইলে, কণ্ব কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া শার্ঙ্গরবকে কহিলেন, বৎস! তুমি, শকুন্তলাকে রাজার সম্মুখে রাখিয়া তাঁহারে আমার এই আবেদন জানাইবে—আমরা বনবাসী, তপস্যায় কালযাপন করি; তুমি অতি প্রধান বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছ; আর শকুন্তলা বন্ধুবর্গের অগোচরে স্বেচ্ছাক্রমে তোমাতে অনুরাগিণী হইয়াছে; এই সমস্ত বিবেচনা করিয়া, অন্যান্য সহধর্ম্মিণীর ন্যায়, শকুন্তলাতেও স্নেহদৃষ্টি রাখিবে; আমাদের এই পর্য্যন্ত প্রার্থনা; ইহার অধিক ভাগ্যে থাকে ঘটিবেক, তাই আমাদের বলিয়া দিবার নয়।

 মহর্ষি, শার্ঙ্গরবের প্রতি এই সন্দেশ মির্দেশ করিয়া, শকুন্তলাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, বৎসে! এক্ষণে তোমারেও কিছু উপদেশ দিব। আমরা বনবাসী বটে, কিন্তু লৌকিক ব্যাপারে নিতান্ত অনভিজ্ঞ নহি। তুমি পতিগৃহে গিয়া গুরুজনদিগের শুশ্রুষা করিবে, সপত্নীদিগের সহিত প্রিয়সখীব্যবহার করিবে, পরিচারিণীদিগের প্রতি সম্পূর্ণ দয়া দাক্ষিণ্য প্রদর্শন করিবে, সৌভাগ্যগর্ব্বে গর্ব্বিত হইবে না, স্বামী কার্কশ্যপ্রদর্শন করিলেও রোষবশা ও প্রতিকূলচারিণী হইবে না; মহিলারা এরূপ ব্যবহারিণী হইলেই গৃহিণীপদে প্রতিষ্ঠিত হয়; বিপরীতকারিণীরা কুলের কণ্টকস্বরূপ। ইহা কহিয়া, বলিলেন, দেখ গৌতমীই বা কি বলেন? গৌতমী কহিলেন, বধুদিগকে এই বই আর কি কহিয়া দিতে হইবেক? পরে শকুন্তলাকে কহিলেন, বাছা! উনি যেগুলি বলিলেন, সকল মনে রাখিও।

 এই রূপে উপদেশদান সমাপ্ত হইলে, কণ্ব শকুন্তলাকে কহিলেন, বৎসে! আমরা আর অধিক দূর যাইব না; আমাকে ও সখীদিগকে আলিঙ্গন কর। শকুন্তলা অশ্রুপূর্ণ নয়নে কহিলেন, অনসূয়া প্রিয়ংবদাও কি এই খান হইতে ফিরিয়া যাইবে? ইহারা সে পর্য্যন্ত আমার সঙ্গে যাউক। কণ্ব কহিলেন, না বৎসে! ইহাদের বিবাহ হয় নাই, অতএব সে পর্য্যন্ত যাওয়া ভাল দেখায় না; গৌতমী তোমার সঙ্গে যাবেন। শকুন্তলা পিতাকে আলিঙ্গন করিয়া, গদগদ স্বরে কহিলেন, তাত! তোমাকে না দেখিয়া, সেখানে কেমন করিয়া প্রাণধারণ করিব। এই বলিতে বলিতে, তাঁহার দুই চক্ষে ধারা বহিতে লাগিল। তখন কণ্ব অশ্রুপূর্ণ নয়নে কহিলেন, বৎসে! এত কাতর হইতেছ কেন? তুমি পতিগৃহে গিয়া গৃহিণীপদে প্রতিষ্ঠিত হইয়া, সাংসারিক ব্যাপারে অনুক্ষণ এরূপ ব্যস্ত থাকিবে যে, আমার বিরহজনিত শোক অনুভব করিবার অবকাশ পাইবে না। শকুন্তলা পিতার চরণে নিপতিত হইয়া কহিলেন, তাত! আবার কত দিনে এই তপোবনে আসিব? কণ্ব কহিলেন, বৎসে! সসাগরা ধরিত্রীর একাধিপতির মহিষী হইয়া, এবং অপ্রতিহতপ্রভাব স্বীয় তনয়কে সিংহাসনে সন্নিবেশিত ও তদীয় হস্তে সমস্ত সাম্রাজ্যের ভার সমর্পিত দেখিয়া, পতিসমভিব্যাহারে পুনরায় এই শান্তরসাস্পদ তপোবনে আসিবে।

 শকুন্তলাকে এইরূপ শোকাকুলা দেখিয়া গৌতমী কহিলেন, বাছা! আর কেন, ক্ষান্ত হও, যাবার বেলা বহিয়া যায়; সখীদিগকে যাহা বলিতে হয় বলিয়া লও, আর বিলম্ব করা হয় না। তখন শকুন্তলা সখীদিগের নিকটে গিয়া কহিলেন, সখি! তোমরা উভয়ে এক কালে আলিঙ্গন কর। উভয়ে আলিঙ্গন করিলেন। তিন জনেই রোদন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে, সখীরা শকুন্তলাকে কহিলেন, সখি! যদি রাজা শীঘ্র চিনিতে না পারেন, তাঁহাকে তাঁহার স্বনামাঙ্কিত অঙ্গুরীয় দেখাইও। শকুন্তলা শুনিয়া আতিশয় শঙ্কিত হইয়া কহিলেন, সখি! তোমরা এমন কথা বলিলে কেন, বল? তোমাদের কথা শুনিয়া আমার হৃৎকম্প হইতেছে। সখীরা কহিলেন, না সখি! ভীত হইও না; স্নেহের স্বভাবই এই, অকারণে অনিষ্ট আশঙ্কা করে।

 এই রূপে ক্রমে ক্রমে সকলের নিকট বিদায় লইয়া, শকুস্তলা গৌতমীপ্রভৃতি সমভিব্যাহারে দুষ্মন্তরাজধানী প্রতি প্রস্থান করিলেন। কণ্ব, অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা একদৃষ্টিতে শকুন্তলার দিকে চাহিয়া রহিলেন। ক্রমে ক্রমে শকুন্তলা দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইলে, অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা উচ্চৈঃ স্বরে রোপন করিতে লাগিলেন। মহর্ষি দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কহিলেন, অনসূয়ে! প্রিয়ংবদে! তোমাদের সহচরী প্রস্থান করিয়াছেন; এক্ষণে শোকাবেগ সংবরণ করিয়া, আমার সাহিত আশ্রমে প্রতিগমন কর। এই বলিয়া মহর্ষি আশ্রমাভিমুখে প্রস্থান করিলেন, এবং তাঁহারাও তাঁহার অনুগামিনী হইলেন। যাইতে যাইতে, মহর্ষি মনে মনে কহিতে লাগিলেন, যেমন স্থাপিত ধন ধনস্বামীকে প্রত্যর্পণ করিলে, লোক নিশ্চিন্ত ও সুস্থ হয়, তদ্রপ, অদ্য আমি শকুন্তলাকে পতিগৃহে প্রেরণ করিয়া নিশ্চিন্ত ও সুস্থ হইলাম।